জিএম কাদের : স্বাধীনতার ৫০ বছরেও দেশে সাংবাদিকতা অনিরাপদ

আগের সংবাদ

রাজশাহীতে লিটনকে টেক্কা দেয়ার মতো প্রতিদ্ব›দ্বী নেই

পরের সংবাদ

বাঙালি জাতিসত্তার বিকাশ

প্রকাশিত: জুন ১৮, ২০২৩ , ১২:০০ পূর্বাহ্ণ
আপডেট: জুন ১৮, ২০২৩ , ১২:০০ পূর্বাহ্ণ

দ্বিজাতিতত্ত্বের ভিত্তিতে পাকিস্তান রাষ্ট্র সৃষ্টি হওয়ার অল্প সময়ের মধ্যেই বাঙালি জাতি এর অসারতা বুঝতে পারল। শুধু উপলব্ধিই করল না, এর পেছনে পাকিস্তানি শাসকগোষ্ঠীর যে দুরভিসন্ধি রয়েছে তা হাড়ে হাড়ে টের পেল। ভাষা আন্দোলনের মাধ্যমে শাসক চক্রের গোপন উদ্দেশ্য পরিষ্কার হয়ে গেল। পাকিস্তানের সংখ্যাগরিষ্ঠ মানুষের ভাষা বাংলাকে উপেক্ষা করে উর্দুকে রাষ্ট্রভাষা হিসেবে চাপিয়ে দেয়ার অপকৌশলের মাধ্যমেই জাতি বুঝতে পারল জাতিসত্তার প্রতি আঘাতের সূত্রপাত; বাঙালি জাতিসত্তার ভিত্তিকে নির্মূল করার চক্রান্ত। স্পষ্ট হয়ে গেল দ্বিজাতিতত্ত্বের ভিত্তিতে দেশকে ভাগ করার অসারতা। ধর্মকে জাতীয়তার একমাত্র উপাদান হিসেবে জিকির তুলে পূর্ববঙ্গের মুসলমানদের মধ্যে পাকিস্তান সৃষ্টির যে ক্রেজ সৃষ্টি হয়েছিল ভাষা আন্দোলনের মাধ্যমে বাংলাকে রাষ্ট্রভাষা প্রতিষ্ঠিত করতে শাসক চক্রকে বাধ্য করায় বাঙালির মোহমুক্তি হলো। বাঙালি অচিরেই বুঝতে পারে ধর্মের ভিত্তিতে দেশ ভাগ পশ্চিম পাকিস্তানি শাসকদের একটি ধাপ্পা মাত্র, যা ছিল বাঙালি জাতিসত্তাকে নির্মূল করে পূর্ববঙ্গকে শোষণ করার সুদূরপ্রসারি চক্রান্তেরই অংশবিশেষ।
বাংলা রাষ্ট্রভাষা হিসেবে স্বীকৃতি পাওয়ার পর বাঙালি জাতীয়তাবাদের পথ প্রশস্ত হলো। পূর্ববঙ্গের বাঙালিদের মনে ভাষা, শিল্প সংস্কৃতি, রীতিনীতি ইত্যাদি ক্ষেত্রে স্বকীয়তাবোধ জাগ্রত হতে লাগল। বাঙালি জাতিসত্তার এ সব উপাদানই যে পশ্চিমা জনগোষ্ঠী থেকে সম্পূর্ণ আলাদা এ বাস্তবতা তারা সহসাই অনুভব করতে লাগল। শুধু ধর্মের বন্ধনে দুটি ভিন্ন ভাষা ও সংস্কৃতির মানুষকে এক জাতিসত্তার মোড়কে বাঁধা যায় না এ বাস্তবতাটুকু শাসকদের নানা কূটচালের মধ্য থেকেও এ বাংলার মানুষের বুঝতে দেরি হলো না। যা হোক, ভাষা আন্দোলনের মাধ্যমে জাতিসত্তার যে বীজ বপন হয়েছিল বাঙালি জাতীয়তাবাদ গঠনের উপলব্ধিতেই তার পূর্ণতা প্রাপ্তি ঘটেছিল। এ পথ অতিক্রমে বাঙালি মানসে ধর্মনিরপেক্ষতার বোধ জেগে উঠল। এই ধর্মনিরপেক্ষতাবোধই বাঙালির মননে অসাম্প্রদায়িক চেতনার উৎসভূমি। ধর্মভিত্তিক জাতীয় চেতনা হতে অসাম্প্রদায়িক, জাতীয়তাবাদী চেতনা উন্মেষের পথ মোটেই মসৃণ ছিল না। জাতির মানসে এ চেতনার চারা গাছের বয়োবৃদ্ধি ঘটতে এবং বাঙালি জাতিসত্তার ভিত্তিতে জাতীয়তাবাদের এক প্ল্যাটফর্মে দাঁড়াতে অনেক চড়াই-উতরাই পার হতে হয়েছিল। লক্ষ্য অর্জনে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের নেতৃত্বে জাতিকে অপরিসীম ত্যাগ-তিতিক্ষা, নির্যাতন, বলিদান তথা প্রতিটি আন্দোলন সংগ্রামে জীবনের বাজি ধরতে হয়েছিল। ১৯৫২-এর ভাষা আন্দোলন হতে শুরু করে ’৬২-র শিক্ষা আন্দোলন, স্বায়ত্তশাসনের দাবিতে ’৬৬ এর ৬ দফা আন্দোলন, ’৬৯-এর গণ-অভ্যুত্থান এবং পরিণতিতে ১৯৭১-এর রক্তাক্ত মুক্তিযুদ্ধের মাধ্যমে স্বাধীন বাংলাদেশের অভ্যুদয় হয়। স্বকীয় ভাষা সংস্কৃতি, কৃষ্টির ভিত্তিতে অসাম্প্রদায়িক বাংলাদেশ গঠনের লক্ষ্যে অখণ্ড জাতিসত্তা বিকাশ লাভ করে বাঙালি স্বাধীনতা অর্জন করে। স্বকীয় জাতিসত্তা ও অসাম্প্রদায়িক বাংলাদেশ গঠনের চেতনাই মুক্তিযুদ্ধের চেতনা, যা দেশের স্বাধীনতা অর্জনে ৩০ লাখ মুক্তিযোদ্ধাকে আত্মাহুতি দানে উদ্বুদ্ধ করেছিল।
স্বাধীনতার পর ১৯৭২ সালের সংবিধানে ধর্মনিরপেক্ষতাসহ চার মূল নীতিতে মুক্তিযুদ্ধের চেতনা প্রতিফলিত হয়। কিন্তু ১৯৭৫ সালে বঙ্গবন্ধুকে সপরিবারে হত্যার পর মুক্তিযুদ্ধের চেতনা বাস্তবায়নের পথ রুদ্ধ হয়ে যায়। ৫ম সংশোধনীর মাধ্যমে জিয়াউর রহমান সংবিধান হতে ধর্মনিরেপক্ষতা ও সমাজতন্ত্র বিলুপ্ত করেন। এর পরিবর্তে রাষ্ট্র পরিচালনায় পাকিস্তানি ভাবধারায় ধর্মের ভিত্তিতে পুনরায় জাতীয়তাবাদ প্রাধান্য পায়। সামরিক শাসক জিয়াউর রহমানের নেতৃত্বে দেশের শাসনভার স্বাধীনতাবিরোধী চক্রের হাতে ন্যস্ত হয়। এরপর জেনারেল এরশাদ ১৯৮২ সালে দেশ শাসনের ক্ষমতা হস্তগত করলে ৮ম সংশোধনীর মাধ্যমে সংবিধানে রাষ্ট্র ধর্মের বিধান প্রবর্তন করে বাঙালি জাতিসত্তার মূলে কুঠারাঘাত করেন। এতে করে দেশের অন্য ধর্মাবলম্বীদের ২য় শ্রেণির নাগরিকে পরিণত করা হয়। এর ফলে মুক্তিযুদ্ধের চেতনা বাস্তবায়নের পথ পুরোপুরি রুদ্ধ হয়ে যায়। পক্ষান্তরে দেশে পাকিস্তানি এজেন্ডা বাস্তবায়নের পথ অবারিত হয়। দ্বিজাতিতত্ত্বের নীতি পুনরুজ্জীবিত হওয়ার ফলে মুক্তিযুদ্ধের চেতনা বাস্তবায়ন তো দূরের কথা বঙ্গবন্ধুর নাম উচ্চারণ করাই প্রকারান্তরে নিষিদ্ধ হয়ে যায়।
রাজনৈতিক ক্ষেত্রে ১৯৭৫ পরবর্তী সময়ে স্বৈরাচারী সরকারের শাসনকালে বাঙালি জাতিসত্তার বিলোপ ও মুক্তিযুদ্ধের চেতনা বিনাশের প্রক্রিয়া পূর্ণোদ্যমে শুরু হয়। বাঙালি জাতীয়তাবাদের পরিবর্তে পাকিস্তানি ভাব ধারায় দ্বিজাতিতত্ত্বের ভিত্তিতে জাতীয়তাবাদকে সংজ্ঞায়িত করার সব প্রস্তুতি সম্পন্ন করা হয়। রাজনৈতিক পৃষ্ঠপোষকতায় ধর্মের ভিত্তিতে জাতিকে বিভাজন ও ধর্মের নামে জাতির পরিচয় নির্ধারণ করা হয়। বাঙালিয়ানার বিলোপ ঘটাতে আধুনিক শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে ইংরেজির প্রাধান্য, পোশাক পরিচ্ছদ, চাল-চলন, সংস্কৃতি চর্চা ইত্যাদির ওপর বাঙালিয়ানার পরিবর্তে পাকিস্তানি ভাবধারায় ধর্মীয় প্রভাব বিস্তার লাভ করে। ধীরে ধীরে জাতি হিসেবে বাঙালি পরিচয় ম্রিয়মাণ হয়ে ধর্মীয় পরিচয়ই প্রাধান্য পেতে থাকে। এর ফলে বাঙালি জাতিসত্তা নিস্তেজ হয়ে পড়ে। তবে পহেলা বৈশাখে নববর্ষে সূর্যোদয়ের সঙ্গে সঙ্গে রমনা বটমূলে ছায়ানটের বর্ষবরণ, মঙ্গল শোভাযাত্রা এবং সাংস্কৃতিক অন্যান্য কর্মকাণ্ডের মাধ্যমে প্রগতিমনাদের অন্তরে একদিনের জন্য হলেও বাঙালিয়ানার উচ্ছ¡াস সৃষ্টি হয়। বাঙালি জাতিসত্তা পূর্ণরূপে প্রতিষ্ঠা করে একটি অসাম্প্রদায়িক বাংলাদেশ গঠনের লক্ষ্যে ৩০ লাখ শহীদের আত্মত্যাগের বিনিময়ে স্বাধীনতা অর্জিত হয়েছিল। কিন্তু আজ অবস্থাদৃষ্টে মনে হয় স্বাধীনতার ৫২ বছর অতিক্রান্ত হলেও অসাম্প্রদায়িক বাংলাদেশ তথা মুক্তিযুদ্ধের চেতনা বাস্তবায়নের পথে পদে পদে বাধার সৃষ্টি করা হচ্ছে। বিরোধী চক্রের অপরাজনীতির ফলে সামাজিক, সাংস্কৃতিক, নৈতিক, মূল্যবোধ ইত্যাদি ক্ষেত্রে ইত্যাদি ক্ষেত্রে সরকারের নিরলস চেষ্টা থাকা সত্ত্বেও আমরা ইপ্সিত লক্ষ্য অর্জন করতে পারিনি। বাঙালিয়ানা আজ ধর্মভিত্তিক জাতীয়তাবাদের সঙ্গে অবিরাম সংঘর্ষে লিপ্ত। কোনো শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান, হাটবাজার, কর্মক্ষেত্রে গেলে ভাষা, পোশাক পরিচ্ছদ, চেহারা, চালচলনে, আবহে সংস্কৃতির এ সংঘাতের প্রতিফলন খুব স্পষ্টরূপে দৃশ্যমান হয়। কিন্তু ’৭৫ পূর্ববর্তী সময়ে এমনকি স্বাধীনতা আন্দোলনের সময়ও বাঙালির ভাষা, পরিধেয়, আচার আচরণ, সংস্কৃতি বা আদর্শগতভাবে এক ঝলকে এ অঞ্চলের মানুষ বাঙালি হিসেবেই দৃশ্যমান ছিল।
সংস্কৃতির এ সংঘাতময় অবস্থায়ও শেখ হাসিনার সরকার মুক্তিযুদ্ধের চেতনা বাস্তবায়ন তথা বাঙালি জাতিসত্তার পূর্ণ বিকাশে আন্তরিক প্রয়াস চালিয়ে যাচ্ছে। দেশ থেকে জঙ্গি সন্ত্রাসবাদ নির্মূল এবং বঙ্গবন্ধুর খুনিদের বিচার স্বাধীনতাবিরোধী অপশক্তির বিরুদ্ধে সরকারের জিরো টলারেন্সেরই অংশবিশেষ। বর্তমান সরকার সংবিধানে ধর্মনিরপেক্ষতাসহ ১৯৭২ সালের রাষ্ট্রীয় চার মূলনীতি পুনরুজ্জীবিত করে। শেখ হাসিনার সরকার মুক্তিযুদ্ধের চেতনা পুনরুজ্জীবনের জন্য শত প্রতিকূলতার মধ্যেও আন্তরিকভাবে চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছে। স্বৈরশাসকদের আমলে জাতির মন থেকে বিস্মৃতপ্রায় বঙ্গবন্ধু এই সরকারের সময় প্রতিটি স্তরে পুনঃপ্রতিষ্ঠিত হয়েছেন। শিশু-কিশোররা স্বাধীনতাবিরোধী শক্তির মন গড়া ইতিহাসের বেড়াজাল হতে মুক্ত হয়ে মুক্তিযুদ্ধের প্রকৃত ইতিহাস সম্পর্কে জানতে পারে। বঙ্গবন্ধুর অর্থনৈতিক মুক্তির স্বপ্ন শেখ হাসিনা সরকারের আমলে বাস্তবায়ন হচ্ছে এবং বর্তমান সরকারের অভূতপূর্ব উন্নয়নের সুফল জাতি ইতোমধ্যে পাচ্ছে। উন্নয়নশীল দেশ থেকে এখন নিম্ন মধ্যবিত্ত দেশের কাতারে দাঁড়িয়েছে। ডিজিটাল বাংলাদেশের স্বপ্ন বাস্তবায়ন হয়েছে এবং ২০৪১ সালের মধ্যে জাতি স্মার্ট বাংলাদেশের গর্বিত নাগরিক হওয়ার স্বপ্ন দেখছে। এই মন্দার সময়েও প্রবৃদ্ধির হার অনেক উন্নত দেশ থেকেও বাংলাদেশ ঊর্ধ্বমুখী ধারা বজায় রাখতে সক্ষম হয়েছে। প্রবৃদ্ধির ঊর্ধ্বমুখী হার, বৈদেশিক মুদ্রার ভাণ্ডার, অভূতপূর্ব অর্থনৈতিক উন্নয়ন, পররাষ্ট্রনীতি ইত্যাদি ক্ষেত্রে বাংলাদেশ বর্তমান সরকারের আমলে আন্তর্জাতিক ক্ষেত্রে প্রশংসা অর্জন করেছে এবং বিভিন্ন সামাজিক ও মানবিক ইনডেক্সে বাংলাদেশ অনেক দেশের কাছে রোল মডেল হিসেবে স্থান করে নিয়েছে।
জাতি এখনো আশায় বুক বেঁধে আছে এই ভেবে যে, ক্ষমতাসীন মুক্তিযুদ্ধের পক্ষের সরকার স্বাধীনতার লক্ষ্য অর্জন তথা বাঙালি জাতিসত্তার পূর্ণ বিকাশে সজাগ এবং তৎপর আছে। বঙ্গবন্ধুর দিক নির্দেশনায় অস্থায়ী সরকারের নেতৃত্বে মুক্তিযুদ্ধের চেতনায় উদ্বুদ্ধ হয়ে ৯ মাসের রক্তক্ষয়ী যুদ্ধে আমাদের অকুতোভয় মুক্তিসেনারা দেশকে হানাদার মুক্ত করে ১৬ ডিসেম্বর, ১৯৭১ বিজয় অর্জন করেছিল। মুক্তিযুদ্ধের চেতনা বাস্তবায়ন তথা বাঙালি জাতিসত্তার পূর্ণ বিকাশের মাধ্যমেই ৩০ লাখ শহীদের রক্তের ঋণ শোধ করা সম্ভব। মুক্তিযুদ্ধের পক্ষের বর্তমান হাসিনা সরকার বঙ্গবন্ধুর আদর্শ তথা বাঙালি জাতীয়তাবাদ প্রতিষ্ঠার জন্যে নিরলস কাজ করে যাচ্ছে। অভূতপূর্ব অর্থনৈতিক উন্নয়নের পাশাপাশি আপসহীনতার সঙ্গে মুক্তিযুদ্ধের চেতনা বাস্তবায়নেও সরকারের অবস্থান অনড় ও স্পষ্ট বলে সচেতন মহল মনে করে। বঙ্গবন্ধুর রাজনৈতিক আদর্শ ও অর্থনৈতিক মুক্তির লক্ষ্য অর্জনে দেশ ইতোমধ্যে কয়েক ধাপ এগিয়েছে। এমতাবস্থায় স্বাধীনতার স্বপ্ন বাস্তবায়নে নিরাশ হওয়ার কোনো কারণ নেই। তবে এ ব্যাপারে সরকারের হাতকে শক্তিশালী করতে দেশবাসীকেও সচেতন থাকতে হবে।

শুভ্রেন্দু ভট্টাচার্য : লেখক ও কবি; সাবেক পরিচালক, বাংলাদেশ মুক্তিযোদ্ধা কল্যাণ ট্রাস্ট, মুক্তিযুদ্ধ বিষয়ক মন্ত্রণালয়।

মন্তব্য করুন

খবরের বিষয়বস্তুর সঙ্গে মিল আছে এবং আপত্তিজনক নয়- এমন মন্তব্যই প্রদর্শিত হবে। মন্তব্যগুলো পাঠকের নিজস্ব মতামত, ভোরের কাগজ লাইভ এর দায়ভার নেবে না।

জনপ্রিয়