জিএম কাদের : স্বাধীনতার ৫০ বছরেও দেশে সাংবাদিকতা অনিরাপদ

আগের সংবাদ

রাজশাহীতে লিটনকে টেক্কা দেয়ার মতো প্রতিদ্ব›দ্বী নেই

পরের সংবাদ

জামায়াত কি পুনর্বাসিত হচ্ছে

প্রকাশিত: জুন ১৮, ২০২৩ , ১২:০০ পূর্বাহ্ণ
আপডেট: জুন ১৮, ২০২৩ , ১২:০০ পূর্বাহ্ণ

রাজনীতিতে কি ঘেন্না-পীত বলে কিছু নেই?
এই কথাটা উঠেছে বাংলাদেশ জামায়াত ইসলামী নামের দলটিকে উচ্চ আদালতের রায়ে সন্ত্রাসী দল হিসেবে রায় ঘোষণা এবং নির্বাচন কমিশন কর্তৃক নিষিদ্ধ করার পর গত ১০ বছর তাদের অস্তিত্ব জনগণ টের পায়নি। তবে সর্বশেষ ২৯ মে পুলিশ তাদের কয়েকজন নেতাকে আটক করে। তখন জানা যায় যে তারা সমাবেশ করার পারমিশন নেয়ার জন্য পুলিশের কাছে গিয়েছিল। তিন ঘণ্টা পর তাদের ছেড়ে দেয়া হয়। ওই ৩ ঘণ্টায় কী কী হয়েছে, তার কোনো তথ্য আমরা পাইনি বা জানি না।
আদালতের রায়ের মাধ্যমে ও নির্বাচন কমিশন জামায়াতকে রাজনৈতিক দলের নিবন্ধিত তালিকা থেকে বাদ দেয়। অনিবন্ধিত কোনো রাজনৈতিক সংগঠন তাদের কর্মসূচি পালন করতে পারে কি না, সেই আইন সম্পর্কে আমাদের জানা নেই। আবার সেই দলটি যদি দেশের স্বাধীনতায় বিশ্বাস না করে, সেই দলটি যদি ১৯৭১ সালের গণহত্যার সহযোগী হিসেবে দোষী সাব্যস্ত হয়ে থাকে, সেই দলটি যদি আগুন সন্ত্রাসের জন্য চিহ্নিত ও চিত্রিত হয়ে থাকে- তাহলে সেই দলটিকে পুলিশ মাঠের রাজনীতি বা ঘরের ভেতরে রাজনীতি করার পারমিশন দেয় কেমন করে? এই পারমিশন কি পুলিশ দিয়েছে? নাকি স্বয়ং ক্ষমতাসীন দল দিয়েছে? স্বাধীনতা যুদ্ধের সরাসরি বিরোধিতাকারী হিসেবে জামায়াত ইসলামী আর স্বাধীনতাযুদ্ধে নেতৃত্বে থাকা দল আওয়ামী লীগের মধ্যে রাজনৈতিক আকাশ-পাতাল ব্যবধান থাকার পরও গত ৫০ বছরে আমরা নানা রাজনৈতিক রং দেখেছি। সেসব দেখে এটাই মনে হয়েছে যে রাজনীতির নামে কতটা হৃদয়হীন হতে পারে রাজনীতিকরা।
১৯৭১ সালে জামায়াত রাজনীতির নামে আমাদের স্বাধীনতার বিরুদ্ধেই কেবল লড়েনি পাকিস্তানি সামরিক সরকারের সেনাদের পাশে দাঁড়িয়ে, তারা গণহত্যার সহজ পথগুলোও চিনিয়ে দিয়েছে তাদের। আবার ৭১-এর পর, স্বাধীন দেশের সরকারগুলো কেমনতর হিংস্রতার পরিচয় দিয়েছে ভিন্ন ভিন্ন রাজনৈতিক দলের বিরুদ্ধে, তার ইতিহাসও আমরা জানি, সেগুলো লেখাও আছে কালো কলমে তারও চেয়ে বেশি কালো কালিতে। স্বাধীনতাযুদ্ধের নেতৃত্বদানকারী দল ও মুক্তিযুদ্ধের বীর সেনানিসহ সামরিক বেসামরিক রাজনৈতিক দলের বগলতলায় থেকে জামায়াত আজ অনেক বড় দল হিসেবে গড়ে উঠেছে। এই দলটির রাজনৈতিক অভিলাষ হচ্ছে আল্লাহর শাসন কায়েম করা। ১৪ বছর আগের সমাজ আর চিন্তার পরিবেশ প্রতিবেশ তো আর আজকে নেই। এই পরিবর্তিত পরিস্থিতিতেও তারা আল্লাহর শাসন কায়েম করতে চায়। গণতন্ত্রের পথে এদের বিশ্বাস নেই। মানুষকে মানুষ হিসেবে বিবেচনা করার মতো রাজনৈতিক অভিজ্ঞানও তাদের নেই। অথচ তারা রাজনীতি করেন গণমানুষের ধর্মবিশ্বাস নিয়ে।
ইসলাম ধর্মের ন্যায় ও কল্যাণের নির্দেশটুকু ছাড়া আর কিছু দরকার নেই। কারণ আধুনিক পুঁজিবাদী গণতন্ত্রের রূপে আছে সেই কল্যাণ ও ন্যায় বা সাম্য স্ট্রাকচার, যা আমরা সহজেই বরণ করে নিতে পারি। কিন্তু যখন দেখি এদেশের রাজনীতিতে রগ কাটার রাজনীতি চালু করে ছাত্রশিবির, আমরা এ নিষ্ঠুর কর্মের পরিস্থিতি দেখে হতবুদ্ধি হয়ে পড়ি। দেখাদেখি ওই নিষ্ঠুরতার রোগটি ছড়িয়ে পড়ে আওয়ামী লীগের সব শাখা রাজনৈতিক দলের কর্মীদের মধ্যেও। এই রাজনৈতিক কুকীর্তির নৃশংসতা এখন দমিত থাকলেও আগুন সন্ত্রাসের যে বয়ান চালু আছে তার জন্য পরস্পরকে দায়ী করে বিএনপি ও আওয়ামী লীগ। আর জাতীয় ও স্থানীয় সরকারের বিভিন্ন নির্বাচনে ভোটচুরি, ভোট ডাকাতি এখন আর রিগিং শব্দে বর্ণনা করা কঠিন। চুরি আর পুকুর চুরির মধ্যে যে পার্থক্য তারই রাজনৈতিক কুকীর্তি হচ্ছে নির্বাচনের ভোট না দেয়ার কুকীর্তি। দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনের প্রাক্কালে সেই খেলাই শুরু হয়েছে। আর এ খেলায় কে হারবে, কে জিতবে, সেটা সময়ই ভালো বলতে পারবে।
আপাতত জামায়াতকে মাঠে ছাড়ল সেই প্রশ্নে আসি।
দীর্ঘ ১০ বছর পর জামায়াতে ইসলামীকে সমাবেশের অনুমতি দেয়ায় নতুন চাঞ্চল্য তৈরি হয়েছে রাজনীতিতে। নানা প্রশ্ন সবার মনে- তাহলে যুদ্ধাপরাধের দায়ে অভিযুক্ত জামায়াত কি আবার প্রকাশ্যে রাজনীতিতে ফিরছে? সরকার কি তার কৌশলে পরিবর্তন এনেছে? নাকি মার্কিন নতুন ভিসানীতির সুফল পেতে শুরু করেছে জামায়াতও?
এ ঘটনায় ক্ষুব্ধ প্রতিক্রিয়া জানিয়েছে একাত্তরের ঘাতক দালাল নির্মূল কমিটি। বলছে, এটি ৩০ লাখ শহীদের সঙ্গে বেইমানি। অবশ্য ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগ বলেছে, নির্বাচন সামনে রেখে আবারো আগুন সন্ত্রাসের প্রস্তুতি নিতে বিএনপিই জামায়াতকে মাঠে নামিয়েছে। অন্যদিকে জামায়াতের বিষয়ে কৌশলী অবস্থান গ্রহণ করেছে বিএনপি। দলটি বলছে, সব রাজনৈতিক দলেরই সভা-সমাবেশের অনুমতি পাওয়ার গণতান্ত্রিক অধিকার রয়েছে। (সমকাল/০৬/১১/২৩)

ক. বিএনপি কেন এ কথা বলছে যে- সব রাজনৈতিক দলেরই সভা-সমাবেশের অনুমতি পাওয়ার অধিকার রয়েছে। তাদের এই বক্তব্য আমার মনে সন্দেহ জাগল, পারমিশন কি বিএনপি দিয়েছে? তারা কি ক্ষমতায়? পুলিশ কি তাদেরই অধীন? আর জামায়াত কি রাজনৈতিক দল হিসেবে নিবন্ধিত? নিবন্ধন না থাকলে কি সেই দলকে রাজনৈতিক দল হিসেবে চিহ্নিত করা যায়? ওই দলটি তো নিষিদ্ধ। কারণ ছাত্রশিবির ও জামায়াতকে নিষিদ্ধ করেছেন উচ্চ আদালত। সেই অনিবন্ধিত ও নিষিদ্ধ দলটিকে বিএনপি দল হিসেবে বর্ণনা করছে আর কোনো আইনের বলে পুলিশ জামায়াতকে সভা-সমাবেশ করার পারমিশন দিল। তাহলে কি এটাই সত্য যে দেশের ক্ষমতার রাজনৈতিক স্বাধীনতা ভোগ করে পুলিশ? এটা কি পুলিশি রাষ্ট্র? পুলিশ কি কোনো ঘোঁট পাকাচ্ছে?
পুলিশের ওপরওয়ালারা বলছে জামায়াতকে মাঠে নামিয়েছে বিএনপি। স্বয়ং আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক ওবায়দুল কাদের এ কথা বলেছেন। তার কথা শুনে মনে হলো রাষ্ট্র চালায় আওয়ামী লীগ আর পুলিশ চালায় বিএনপি। যেসব শান্তি সমাবেশ ও মিছিল করেছে বিএনপি, তাই তাদের পুলিশ তাদেরই লাঠিপেটা করে, বেতের বাড়িতে রক্তাক্ত করে দিয়ে গুলি চালিয়ে মাত্র ১৭ জনের প্রাণ হরণ করেছে। আর ওবায়দুল কাদেরের শান্তি সমাবেশের চটাং চটাং কথার সূত্র ধরে একটা ধাওয়াও দেয়নি ছাত্রলীগের উচ্ছৃঙ্খলদের।

খ. অন্ধ রাজনীতির এই খেলায় আগামী জাতীয় নির্বাচনে কোন দল হারে আর কোনো দল জেতে সেটা দেখার জন্য তো এমন একটি সমাধানে পৌঁছাতে হবে, যে ব্যবস্থায় অবশ্যই ভোটারদের ভোট প্রয়োগের অধিকার কায়েম হবে। গত ২০১৪ সালের নির্বাচনে নির্বাচন কমিশন ১৫৩টি আসনে বিনা ভোটে আওয়ামী লীগের প্রার্থীকে বিজয়ী ঘোষণা করে দিয়েছিল। নির্বাচন হতে হবে প্রতিদ্ব›িদ্বতাপূর্ণ, সংবিধানের এই শর্তটি লঙ্ঘন করে সে সময়কার নির্বাচন কমিশন।
তারা যে সংবিধানকে বুড়ো আঙুল দেখিয়ে ক্ষমতাসীনদের লেজুড়ে যে উঠেছিলেন, সেই বিশ্লেষণ না করলেই সাধারণ মানুষ তা বুঝেছে। তবে ২০২৩/২৪ সালে অনুষ্ঠিতব্য নির্বাচনে ক্ষমতাসীন দলটি কী করবে, তা বলার সময় এসেছে বটে। দেশের রাজনৈতিক পরিস্থিতি ঘোলা ও বিষাক্ত করে তোলার লক্ষ্যেই জামায়াত মাঠে নেমেছে। হাইকোর্ট এই দলটিকে সন্ত্রাসী দল হিসেবে গণতান্ত্রিক রাজনীতিতে অযোগ্য মাঠে নিয়ে আসার পেছনে আছে গভীরতর এক পরিকল্পনার অংশ। এবং আরো ইসলামি নামের দলগুলোকেও এই শোভাযাত্রায় শামিল করবে বোঝা যাচ্ছে। যাতে বিএনপি তাদের অধীনে নির্বাচনে না এলেও এসব বাহাত্তরে দলের সম্মিলিত জোটের ব্যানার টানিয়ে একটি অনন্য সাধারণ নির্বাচন করার ইতিহাস রচনা করবে। অথবা এদের সন্ত্রাসী রাজনীতির ঘরানাকে ব্যবহার করবে কেউ কেউ। এই সবই স্পেকুলেশন। অর্থাৎ অনুমান নির্ভর ব্যাখ্যা। গোঁফ দেখে যায় চেনা বলে যে কথাটি চালু আছে বেড়ালে ইঁদুর ধরার ক্ষমতা যাচাইয়ের, আওয়ামী লীগেরও গোঁফ দেখে সেটা চেনা যাচ্ছে।
গ. আসলে ক্ষমতা এমন এক মসনদ, যেখানে অর্থবিত্তের রমরমা। তার ঘ্রাণ পাওয়া যায় সহজেই। সেই ক্ষমতার ঘ্রাণে মাতোয়ারা রাজনৈতিক ক্ষমতাবানরা। তারা কেউ মসনদ ছাড়তে চান না, ছলে-বলে-কলে-কৌশলে মসনদে থাকতে চান, আবার সেখানে যাওয়ার কসরৎ করেন। এই খেলার প্রথম ধাপটি সংবিধান সংশোধন করে নির্দলীয় তত্ত্বাবধায়ক সরকার ব্যবস্থা পাল্টে দিয়েছে আওয়ামী লীগ। এখন বলছে সংবিধানের আলোকেই নির্বাচন হবে। অন্য কোনোভাবে হবে না। আবার বিএনপি বলছে তাদের করা ব্যবস্থায় ফিরে যেতে হবে। কেননা ওই ব্যবস্থায় নিরপেক্ষ রিগিংলেস নির্বাচন হয়ে আসছিল। সেটা বাতিল করার অর্থ হচ্ছে ভোট ছাড়াই ক্ষমতার মসনদের থাকার অপচেষ্টা। এই উভয় পক্ষের সামনে বা পেছনে বা এদের মধ্যিখানে জনগণ নামক এদের মালিক ভোটাররা নেই। কী চমৎকার মৌলিক থিংকিং রাজনীতিকদের। জনগণ দ্বারা নয়, কিন্তু জনগণের জন্য নির্বাচন করে ক্ষমতায় থাকাই হচ্ছে রাজনীতিকদের মৌলিক প্রয়াস। এই চিন্তা ও চেষ্টার অন্ধ গলি থেকে বেরিয়ে আসতে হবে তাদের না হলে এদেশের ভোটার জনগণের ভোট প্রয়োগের অধিকার কায়েম হবে না।

ড. মাহবুব হাসান : সাংবাদিক ও কলাম লেখক।
[email protected]

মন্তব্য করুন

খবরের বিষয়বস্তুর সঙ্গে মিল আছে এবং আপত্তিজনক নয়- এমন মন্তব্যই প্রদর্শিত হবে। মন্তব্যগুলো পাঠকের নিজস্ব মতামত, ভোরের কাগজ লাইভ এর দায়ভার নেবে না।

জনপ্রিয়