পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় : সবাই সার্বভৌমত্বকে সম্মান দেখাবে- এই প্রত্যাশা বাংলাদেশের

আগের সংবাদ

মেয়র প্রার্থীদের প্রতিশ্রæতির ফুলঝুরি : ‘পরিকল্পিত সিলেটে’ প্রাধান্য

পরের সংবাদ

পাকিস্তানের শ্বেতহস্তী সেনাবাহিনী ও দেউলিয়া অর্থনীতি

প্রকাশিত: জুন ১৭, ২০২৩ , ১২:০০ পূর্বাহ্ণ
আপডেট: জুন ১৭, ২০২৩ , ১২:০০ পূর্বাহ্ণ

পাকিস্তানের অর্থনৈতিক দুরবস্থা থেকে শিক্ষা নেয়ার আছে অনেক কিছু। বৈশ্বিক অর্থনৈতিক মন্দার প্রভাব পৃথিবীর সব দেশের অর্থনীতিকে নেতিবাচকভাবে প্রভাবিত করছে। পাকিস্তানের অর্থনীতি ধসে যাওয়ার মূল কারণ হলো সামরিক খাতে অযাচিত ব্যয়। সাড়ে ৫ লাখ সদস্যবিশিষ্ট সেনাবাহিনী এবং সব মিলিয়ে ৭ লাখের একটি সশস্ত্র বাহিনীর বোঝা বহন করতে হচ্ছে পাকিস্তানকে। জন্মশত্রæ ভারতের সঙ্গে যুদ্ধের জন্য এত বড় সেনাবাহিনী পুষছে পাকিস্তান। প্রশ্ন হচ্ছে, দেশের অস্তিত্ব বিলীন হয়ে গেলে সেনাবাহিনীকে পুষে কী লাভ হবে। একই ভাবনা গভীরভাবে ভাবতে হবে ভারত সরকারকেও। জনসংখ্যার ২২ শতাংশ মানুষকে দারিদ্র্যসীমার নিচে রেখে, অপ্রয়োজনীয় সামরিক ব্যয় কতটুকু যুক্তিযুক্ত সে কথা ভাবার সময় হয়েছে। ভারতের কয়েকটি রাজ্যের কৃত্রিম চাকচিক্য সমগ্র ভারতের চিত্র নয়। ভারতের মোট জনসংখ্যার ২২ শতাংশ মানুষ যখন ৩ বেলা খাবারের জন্য জীবনযুদ্ধে লিপ্ত সে সময় সরকার পাকিস্তান থেকে সমর শক্তিতে শ্রেষ্ঠত্ব দেখানোর জন্য প্রতিযোগিতা করছে এটি কোনোভাবেই কাম্য হতে পারে না।
যাক ফিরে আসি পাকিস্তান প্রসঙ্গে কারণ আজকের লেখার মূল প্রতিপাদ্য পাকিস্তান। সামরিক বাহিনীর কারণে শুধু অর্থনীতি নয়, পাকিস্তানের রাজনীতিও সবসময় অস্থির থাকে। পাকিস্তান সৃষ্টির পর ১৯৫৮ সালে ওই যে কুখ্যাত সেনাশাসক আইয়ুব খান জোর করে ক্ষমতা দখল করল, এরপর থেকে পাকিস্তানে আর গণতন্ত্র ফেরেনি। আমার কথার সঙ্গে অনেকেই দ্বিমত পোষণ করতে পারেন কারণ মাঝে মাঝে সামরিক শাসকদের সঙ্গে সমঝোতা করে ছদ্ম গণতন্ত্র ফিরে আসে পাকিস্তানে: কিন্তু ১৯৫৮ সালের পর আর কখনো পাকিস্তানের রাজনীতিতে গণতন্ত্রায়ন ঘটেনি অথবা একটি মন্দ গণতান্ত্রিক সংস্কৃতিও তৈরি হতে পারেনি। পাকিস্তানের রাজনীতি ১৯৫৮ সালের পর থেকে সামরিক বাহিনীর নিয়ন্ত্রণে রয়েছে। কথাটিকে খুব উচ্চ লয়ের মনে হলেও সার্বিক বাস্তবতায় পাকিস্তানের সব ক্ষমতা যে সেনা নিয়ন্ত্রিত তা পাকিস্তানের জনগণ এবং সমগ্র বিশ্বের জনগণ খুব ভালো করে জানে এবং মেনেও থাকে। সাম্প্রতিক সময়ে সেনাবাহিনীর বিরুদ্ধে ইমরান খানের সংগ্রামের কারণে এসব কথা রাখঢাক না রেখেই বেরিয়ে আসছে।
ইউক্রেন যুদ্ধের কারণে সৃষ্ট অর্থনৈতিক মন্দা পাকিস্তানকে প্রায় দেউলিয়া রাষ্ট্রে পরিণত করতে পারত না যদি পাকিস্তান রাষ্ট্রটি জন্মের পর থেকে গণতান্ত্রিক ব্যবস্থার সামান্য রীতিনীতি অনুশীলন করত। পাকিস্তানের জন্মের পর কখনো গণতান্ত্রিক সরকার নিরবচ্ছিন্নভাবে শাসন করতে পারেনি। ভারত জুজুর ভয় দেখিয়ে সামরিক বাহিনী গণতান্ত্রিক সরকার যে পাকিস্তানে কার্যকর নয়; এ বিষয়টি জনগণের কাছে প্রমাণ করতে সব সময় ব্যস্ত থাকে। মাঝে মাঝে জনমনে যখন কিছুটা অসন্তোষ সৃষ্টি হয় তখন তারাই একটি পুতুল গণতান্ত্রিক সরকার প্রতিষ্ঠা করে। এর দুটি উদ্দেশ্য একটি হলো পুতুল সরকারের মেয়াদ শেষ হওয়ার আগেই অস্থিরতা তৈরি করে সামরিক বাহিনী প্রমাণ করার চেষ্টা করে রাজনৈতিক দল সরকার পরিচালনার জন্য অনুপযুক্ত; এতে সাপও মরে লাঠিও ভাঙে না। পাকিস্তান সৃষ্টির পর দীর্ঘমেয়াদি চিন্তা করে সব ক্ষেত্রে টেকসই উন্নয়নের প্রচেষ্টা চালানো হয়নি। যুক্ত পাকিস্তানে অর্থাৎ ১৯৭১ সাল পর্যন্ত পাকিস্তানের অর্থনীতি ছিল আমদানিনির্ভর। এখনো অর্থনীতি পরনির্ভরশীল এবং মূলত আমদানিনির্ভর। পাকিস্তানের জন্মের পর থেকে কিছুদিন পূর্ব পর্যন্ত সুঁইসুতা, বলপেন থেকে শুরু করে সব নিত্যপ্রয়োজনীয় দ্রব্য বিদেশ থেকে বিশেষ করে চীন থেকে আমদানি করতে হতো। যেহেতু সামরিক সরকার দেশ পরিচালনা করে থাকে পাকিস্তানে, তাই দীর্ঘমেয়াদি টেকসই উন্নয়ন পরিকল্পনা অনুপস্থিত ছিল। লক্ষ করবেন বাংলাদেশেও যখন সামরিক শাসন কার্যকর ছিল, তখন টেকসই উন্নয়নের পরিবর্তে চাকচিক্য পূর্ণ মন ভোলানো উন্নয়নের বহর দেখা যেত। বাংলাদেশের সামরিক শাসকরা এরকম চুঁইয়ে পড়া অর্থনীতির মডেল পেয়েছিলেন পাকিস্তানি প্রভু আইয়ুব খানের কাছ থেকে। গণতন্ত্র উন্নয়নকে টেকসই করে তুলে, গণতান্ত্রিক কাঠামো জন অংশগ্রহণের মূল্য দেয়, এ কারণে গণতন্ত্র চর্চার মাধ্যমে দেশকে টেকসই উন্নয়নের দিকে ধাবিত করা যায়। সামরিক শাসন জবাবদিহিতাকে অপছন্দ করে। সামরিক শাসকরা জনগণকে বলেন, ‘ব্লাডি সিভিলিয়ান’। সামরিক শাসন যখন জারি করা হয়, তখন প্রচার মাধ্যমে প্রথম ফরমানে বলা হয়, ‘সংবিধান স্থগিত করা হলো বা কনস্টিটিউশন সাস্পেন্ডেড’। যেখানে সংবিধানই থাকে না সেখানে কোনো আইনের শাসন থাকতে পারে না। আইনের শাসনের অনুপস্থিতিতে জনগণের মুখ খোলার সব পথ বন্ধ হয়ে যায়। গণমাধ্যমকে নিয়ন্ত্রণ করে সামরিক শাসকরা। আমাদের দেশে পঁচাত্তরের আগস্টে যে সামরিক শাসন শুরু হয়েছিল তা ১৯৯১ সালে এরশাদ শাসনের পর শেষ হয়। বাংলাদেশের সামরিক শাসক ও পাকিস্তানের সামরিক শাসক ও শাসনের সাদৃশ্য এত বেশি ছিল এ কারণে প্রসঙ্গক্রমে আমাদের সামরিক শাসনের কথা চলে এলো। মোটকথা সামরিক শাসন কোনো অবস্থাতেই, পৃথিবীর কোনো দেশেই সার্বিক উন্নয়নে ভূমিকা রাখতে পারেনি। পাকিস্তানের আজকের এই দুরবস্থার অন্তর্নিহিত কারণ হলো, সামরিক বাহিনীর উচ্চাভিলাষ এবং এর থেকে সৃষ্ট সামরিক শাসন।
দীর্ঘ সামরিক শাসনের ফলাফল কী দাঁড়াচ্ছে? পাকিস্তানের দীর্ঘদিনের বিশ্বস্ত বন্ধু চীন ও সৌদি আরব এখন আর দেশটির দুরারোগ্য নির্ভরশীলতার ভার নিতে নারাজ। চীনা অর্থে নির্মিত বিদ্যুৎকেন্দ্রগুলোর কিস্তির টাকা বহুদিন ধরে পরিশোধ না করায় ওই বিদ্যুৎকেন্দ্রগুলো থেকে বিদ্যুৎ সরবরাহ বন্ধ করে দিতে বাধ্য হচ্ছে চীন। যে কারণে গোটা পাকিস্তান ভয়াবহ লোডশেডিংসহ প্রায়ই বিদ্যুৎ বিপর্যয়ের শিকার হচ্ছে। নাটকীয়ভাবে দাম বেড়ে ১ ডলার এখন ২৭৭ রুপিতে বিক্রি হচ্ছে। মূল্যস্ফীতি সমস্যা এমন ভয়াবহ অবস্থায় পৌঁছেছে যে এখন ১ কেজি আটার দাম ১৬০ রুপি এবং ১ কেজি চিনির দাম ৩০০ রুপি ছাড়িয়ে গেছে। পাকিস্তানের আর্থিক হাল এখন এতটাই খারাপ যে বহু সরকারি অফিস সপ্তাহে মাত্র দুদিন খোলা থাকে। অধিকাংশ সরকারি কর্মচারীদের বেতন বন্ধ। ভারতের মতো দেশ থেকেও কূটনৈতিক মিশনের অর্ধেক কর্মচারীকে দেশে ফিরিয়ে নিয়ে যাওয়া হয়েছে। বিদেশমন্ত্রী বিলাওয়াল ভুট্টো ঘোষণা করেছেন, তার বিদেশ সফরের খরচের অনেকটাই আপাতত নিজের পকেট থেকে বহন করবেন।
দিল্লিতে পাক দূতাবাস কর্মচারীদের ছেলে-মেয়েদের পড়াশোনার জন্য একটি স্কুল ছিল পাকিস্তান বোর্ডের অধীনে। অর্থাভাবে সেটি বন্ধ করে দেয়া হয় গত মাসে। নিউইয়র্কে দেশের পুরনো দূতাবাস ভবন সম্প্রতি বেচে দিয়েছে পাক সরকার। ওয়াশিংটনে একটি হোটেল ছিল পাকিস্তান সরকারের। সেটি লিজ দিয়েছে সে দেশের সরকার। উদ্দেশ্য খরচ কমানো এবং আয় বৃদ্ধি। তাতেও আর্থিক হাল ফেরার লক্ষণ নেই। দেশে জিনিসপত্রের দাম আকাশছোঁয়া। একটি ডিমের দাম পাকিস্তানি মুদ্রায় পঞ্চাশ টাকা। মানুষ কেনাকাটা বন্ধ করায় বিদেশি কোম্পানি ব্যবসা গোটাচ্ছে পাকিস্তান থেকে।
১৯৪৮ সাল থেকেই পাকিস্তান সরকারের বাজেটের প্রধান খাত হয়ে দাঁড়িয়েছে প্রতিরক্ষা খাত, যেখান থেকে গত ৭৫ বছরেও ওই খাতকে সরানো যায়নি। এই অসহনীয় বোঝা যে পাকিস্তানের অর্থনীতিকে বিপর্যয়ের দিকে ধাবিত করছে, সে সত্য বিশ্বের সামনে চূড়ান্তভাবে পরিষ্কার হয়ে উঠছে এবার। বিশ্বের ষষ্ঠ বৃহত্তম জনসংখ্যা-অধ্যুষিত দেশ পাকিস্তানের জনসংখ্যা এখন সাড়ে ২২ কোটি ছাড়িয়ে গেছে। এত বড় সশস্ত্র বাহিনীর খায়েশ মেটানোর পর এত বিশাল জনগোষ্ঠীর খাদ্য, বস্ত্র, বাসস্থান, শিক্ষা ও চিকিৎসার জোগান দেয়া কোনোমতেই পাকিস্তানের কোনো শাসক দল বা জোটের পক্ষে সম্ভব হচ্ছে না।
পাকিস্তানের সাধারণ মানুষ যারা, ভয়ংকর মানবিক পর্যায়ে সম্মুখীন তারা রাজনীতি কিংবা সমরনীতির ঘোরপ্যাঁচ বোঝেন না, সমগ্র পৃথিবীর সাধারণ মানুষ যারা প্রান্তে অবস্থান করেন তারা কূটকৌশলের ধার ধারেন না। এবার পাকিস্তানের রাজনীতির মানুষদের দৃষ্টিভঙ্গি, অহংবোধের পরিবর্তন নিয়ে আসতে হবে। বঙ্গবন্ধু কখনো পাকিস্তানের সাধারণ মানুষের বিরুদ্ধে ছিলেন না। তিনি সব সময় সাধারণ মানুষ যারা শাসক কিংবা ঔপনিবেশিক শক্তির দ্বারা শোষিত, তাদের পক্ষে ছিলেন। বঙ্গবন্ধুর সেই বিখ্যাত উক্তির কথা স্মরণ করি, ‘বিশ্ব দুই শিবিরে বিভক্ত- শোষক আর শোষিত। আমি শোষিতের পক্ষে।’ বঙ্গবন্ধুর কথা এখন পাকিস্তানে নানাভাবে উচ্চারিত হচ্ছে। পাকিস্তানের শাসকদের উচিত বঙ্গবন্ধুর নাম রাজনৈতিক সুবিধা আদায়ের জন্য উচ্চারণ না করে, বঙ্গবন্ধুর আদর্শ অনুসরণ করে সামরিক শাসনের ভিত্তিকে নির্মূল করা। পাকিস্তান সামরিক এস্টাবলিশমেন্টের করতল থেকে বের হতে না পারলে, দীর্ঘমেয়াদে পাকিস্তান কোনোদিন সাধারণ মানুষের কল্যাণ রাষ্ট্রে পরিণত হতে পারবে না।

শেখর ভট্টাচার্য : কলাম লেখক ও উন্নয়ন গবেষক।

মন্তব্য করুন

খবরের বিষয়বস্তুর সঙ্গে মিল আছে এবং আপত্তিজনক নয়- এমন মন্তব্যই প্রদর্শিত হবে। মন্তব্যগুলো পাঠকের নিজস্ব মতামত, ভোরের কাগজ লাইভ এর দায়ভার নেবে না।

জনপ্রিয়