পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় : সবাই সার্বভৌমত্বকে সম্মান দেখাবে- এই প্রত্যাশা বাংলাদেশের

আগের সংবাদ

মেয়র প্রার্থীদের প্রতিশ্রæতির ফুলঝুরি : ‘পরিকল্পিত সিলেটে’ প্রাধান্য

পরের সংবাদ

অধ্যাপক নুরুল ইসলামের ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়

প্রকাশিত: জুন ১৭, ২০২৩ , ১২:০০ পূর্বাহ্ণ
আপডেট: জুন ১৭, ২০২৩ , ১২:০০ পূর্বাহ্ণ

‘অ্যান অডেসি : দ্য জার্নি অব মাই লাইফ’ অর্থনীতিবিদ এবং বাংলাদেশের প্রথম পরিকল্পনা কমিশনের ডেপুটি চেয়ারম্যান (কার্যত কমিশন প্রধান) নুরুল ইসলামের জীবন-সফরের একটি দলিল। এই লেখাটিতে তার ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে ছাত্রজীবন ও শিক্ষকতা জীবনের কিছু কিছু খণ্ডচিত্র তুলে ধরা হবে, অনেকটাই তার লেখার সরাসরি অনুবাদ।
চট্টগ্রাম কলেজ থেকে কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ে অনুষ্ঠিত আইএ পরীক্ষায় সবার মধ্যে ষষ্ঠ স্থান দখল করে কলকাতার প্রেসিডেন্সি কলেজে বিএ অনার্স কোর্সে ভর্তি হলেন, বিষয় অর্থনীতি। প্রেসিডেন্সি ব্রিটিশ ভারতের অন্যতম শ্রেষ্ঠ কলেজ। হোসেন শহীদ সোহরাওয়ার্দী তখন বাংলার মুখ্যমন্ত্রী, বিখ্যাত পরিসংখ্যানবিদ প্রশান্ত চন্দ্র মহলানবিশ কলেজের প্রিন্সিপাল এবং সেবার প্রথম একজন মুসলমান অধ্যাপক ভাইস প্রিন্সিপাল হয়েছেন- তিনি ডক্টর কুদরত-ই-খুদা। প্রেসিডেন্সি থেকে অর্থনীতিতে অনার্স প্রথম বর্ষ শেষ করে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে দ্বিতীয় বর্ষে ভর্তি হতে এলেন, প্রায় প্রত্যাখ্যাত হওয়ার অবস্থা। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অর্থনীতি বিভাগের সুনাম এতটাই ছিল যে শিক্ষকরা মনে করলেন প্রেসিডেন্সি থেকে এলেও এই ছাত্র কুলিয়ে উঠতে পারবেন না। তদবির করে কর্তৃপক্ষকে রাজি করানো হলো ভর্তি পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হলেই ঢাকায় যোগ দিতে পারবেন। নুরুল ইসলাম ভর্তি পরীক্ষায় প্রথম হলেন এবং শেষ পর্যন্ত সতীর্থদের ডিঙ্গিয়ে গেলেন। এমএ ক্লাসের শেষ বর্ষে ক্লাসমেট হিসেবে যাদের পেলেন তারা হচ্ছেন- মোজাম্মেল হক, রফিক-উর-রহমান ভুইয়া, মোশাররফ হোসেন, মফিজুর রহমান ও রেজাউল হক খন্দকার।
১৯৪৭-এ দেশ ভাগের কারণে শ্রেষ্ঠ হিন্দু শিক্ষকরা ঢাকা ছেড়ে চলে গেলে অর্থনীতির মাদ্রাজি অধ্যাপক এস ভি আয়ার ভারতে ফিরে গেলেন না। ঢাকা তার এত প্রিয় হয়ে উঠেছিল যে মাদ্রাজ শহরে নিজের বাড়ির নির্মাণ করে নাম দিলেন ঢাকা হাউস।
নুরুল ইসলাম লিখেছেন : ১৯৪৯-এর অনার্স ফাইনাল পরীক্ষায় আমি প্রথম শ্রেণিতে প্রথম স্থান অধিকার করলাম। অনার্সে সব বিষয়ের মধ্যে সর্বোচ্চ নম্বর পেয়ে কালী নারায়ণ স্কলারশিপ পেলাম। মোজাম্মেল হক দ্বিতীয় স্থান অধিকার করলেন। কিন্তু দ্বিতীয় স্থান অধিকারী এমএর জন্য আর অপেক্ষা করলেন না। পূর্ব পাকিস্তান সরকারের একটি বিদেশ বৃত্তি জুটিয়ে ফেললেন। তিনি তখনকার পূর্ব পাকিস্তানের চিফ সেক্রেটারির ছোট ভাইয়ের বন্ধু ছিলেন আর চিফ সেক্রেটারিকে তিনি এতটা মুগ্ধ করতে পেরেছিলেন যে বৃত্তিটা তাকেই দিলেন। বৃত্তি নিয়ে মোজাম্মেল হার্ভার্ড চলে যাওয়ার পরই কেবল আমিই এই বৃত্তির সংবাদটি শুনি। এ বৃত্তি কখনো বিজ্ঞাপিত হয়নি, আবেদনের আমন্ত্রণ জানানো হয়নি। এমএতেও আমি ফার্স্ট ক্লাস ফার্স্ট হলাম, রিয়াজুল হক খন্দকার সেকেন্ড (তিনি লন্ডন স্কুল অব ইকোনমিক্স থেকে পিএইচডি করে পাকিস্তান প্ল্যানিং কমিশনের জয়েন্ট চিফ ইকোনমিস্ট এবং ১৯৭৩-এ বাংলাদেশ প্ল্যানিং কমিশনের প্রোগ্রামিং ডিভিশনের চিফ পদে অধিষ্ঠিত ছিলেন)। নুরুল ইসলাম জীবনে প্রথম স্যুট ও টাই পরে পিএইচডির রোডস স্কলারশিপের জন্য সাক্ষাৎকার দিতে গিয়েছিলেন; কিন্তু সে বৃত্তি পান ভূতত্ত্ব বিভাগের মেধাবী এবং সর্ব বিষয়ে চৌকস একজন ছাত্র। তিনি অতঃপর পাকিস্তান সরকারের বৃত্তি নিয়ে ১৯৫১-এর আগস্টে হার্ভার্ড বিশ্ববিদ্যালয় যান এবং সাফল্যের সঙ্গে ডক্টরেট ডিগ্রি নিয়ে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে শিক্ষকতার জন্য ফিরে আসেন।

বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষকের বিড়ম্বনা
১৯৫৫ থেকে ১৯৬৫ যে সময়টায় আমি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক ছিলাম দুটি বিষয় বিশেষভাবে উল্লেখ করার মতো। প্রথমত, আর্টস ফ্যাকাল্টিতে যেসব শ্রেষ্ঠ উজ্জ্বলতম শিক্ষার্থী ভর্তি হয়েছেন তাদের পছন্দ অর্থনীতিতে অনার্স কোর্স আর যারা সায়েন্স ফ্যাকাল্টিতে যোগ দিয়েছেন তারা বেছে নিয়েছেন পদার্থবিজ্ঞানে অনার্স কোর্স।
দ্বিতীয়ত, শ্রেষ্ঠ শিক্ষার্থীদের প্রায় সবাই প্রতিযোগিতামূলক সিভিল সার্ভিস অব পাকিস্তান (সিএসপি) পরীক্ষায় অংশ নিয়েছেন এবং তাদের অনেকে পরীক্ষায় সফলকাম হয়েছেন। যারা এসব পরীক্ষায় সফল হননি তাদের অনেকেই পরে বিশ্ববিদ্যালয়ে শিক্ষক হিসেবে যোগ দিয়েছেন। কিন্তু যারা সিভিল সার্ভিসের জন্য প্রতিযোগিতামূলক পরীক্ষায় বসেননি, কেবল বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকই হতে চেয়েছেন তাদের পরিস্থিতি ছিল খুব বিব্রতকর। কারণ সাধারণ জনধারণা (পাবলিক পারসেপশন) অনুযায়ী সিভিল সার্ভিস পরীক্ষায় ফেল করে শিক্ষকতায় যোগদান করা শিক্ষার্থীদের সঙ্গে তাদের ব্র্যাকেটবন্দি করা হতো।
হার্ভার্ড বিশ্ববিদ্যালয়ের পিএইচডি নিয়ে (১৯৫৫-এর আগস্টে সম্পন্ন করলেন ১৯৫৬-এর শুরুতে ডিগ্রি প্রাপ্ত হলেন) বহুসংখ্যক সম্ভাবনার দুয়ার রুদ্ধ করে ঢাকায় ফিরে এলেন, পূর্ব পাকিস্তানের বাইরে থাকার ইচ্ছা তার নেই। তার নিজের শিক্ষক এবং ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অর্থনীতি বিভাগের প্রধান মাজহারুল হকের সঙ্গে দেখা করলেন এবং বললেন তাকে যদি রিডার/সহযোগী অধ্যাপক হিসেবে নিয়োগ করা হয় তা হলে অর্থনীতি বিভাগে যোগ দিতে তিনি আগ্রহী। তিনি বিষয়টি নিয়ে ভাইস চ্যান্সেলরের সঙ্গে আলাপ করলেন এবং ভাইস চ্যান্সেলরের সঙ্গে সাক্ষাৎ করতে তাকে উৎসাহিত করলেন। ‘আমাকে নিয়োগ দানের জন্য তিনি শক্তভাবে ওকালতি করেছেন। বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকতার মতো পদসোপান নিয়ন্ত্রিত একটি পেশায় রিডার/সহযোগী অধ্যাপকের মতো জ্যেষ্ঠ পদে এত কনিষ্ঠ একজন ব্যক্তিকে নিজের সমমর্যাদায় অধিষ্ঠিত করার এমন উদ্যোগ অস্বাভাবিক ও দুর্লভ। মাজহারুল হক এতটাই উদার ছিলেন যে তার মধ্যে নিরাপত্তাহীনতার সামান্য অনুভূতিও কাজ করেনি; তার মধ্যে এই দুশ্চিন্তা কাজ করেনি যে কনিষ্ঠ একজন তরুণ সহকর্মী হয়ে ঢুকে তাকে ডিঙ্গিয়ে চলে যেতে পারে।
অর্থনীতি বিভাগে অগ্রগামী অর্থনৈতিক তত্ত্ব, মুদ্রাতত্ত্ব এবং মাস্টার্স ডিগ্রি ক্লাসে আন্তর্জাতিক বাণিজ্য পড়াবার মতো যোগ্য শিক্ষকের মারাত্মক অভাব ছিল। আমি ভাইস চ্যান্সেলর ডব্লিউ ডব্লিউ জেনকিন্সের সঙ্গে দেখা করলাম। এই ইংরেজ সাহেব যুক্তরাজ্যে পদার্থবিজ্ঞানের অধ্যাপক ছিলেন। (যেসব সুযোগ ও অফার তার ছিল তিনি ভিসির কাছে তুলে ধরে তাকে কেন রিডার/অ্যাসোসিয়েট প্রফেসর পদে নিয়োগ করা যাবে তার যৌক্তিকতা প্রদর্শন করলেন।) তিনি আমার যুক্তি গ্রহণ করতে সম্মত কিন্তু তার আশঙ্কা নিয়োগ কমিটির বুড়োরা প্রচণ্ড বাধার সৃষ্টি করবেন। তারা মনে করবেন যত যোগ্যতাই থাকুক শিক্ষকতার অভিজ্ঞতা ছাড়া কাউকে রিডার/অ্যাসোসিয়েট প্রফেসর পদে নিয়োগ দান কোনোভাবেই গ্রহণযোগ্য হতে পারে না। অবশ্য ১৯৪৭-এর স্বাধীনতা পূর্ববর্তী সময়ে ব্রিটিশ প্রশাসকরা উচ্চশিক্ষাগত যোগ্যতার তরুণ প্রার্থীকে অ্যাসোসিয়েট প্রফেসর নিয়োগ করেছে। এমনকি ১৯৪৭-এর পর ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে এমন নিয়োগের কিছু কিছু উদাহরণ আছে। পূর্ব পাকিস্তান প্রশাসনিক ও টেকনিক্যাল সার্ভিসের দুজন সদস্য কয়েক বছর সরকারি চাকরি করার পর পিএইচডি করতে গিয়েছেন এবং ডিগ্রি পেয়ে দেশে ফেরামাত্রই অ্যাসোসিয়েট প্রফেসর হিসেবে যোগ দিয়েছেন- তাদের একজন অর্থনীতি বিভাগে, অন্যজন রসায়ন বিভাগে। যদিও তাদের শিক্ষকতার অভিজ্ঞতা ছিল না, বয়সের দিক দিয়ে তো আমার চেয়ে অনেক বড় ছিলেন। আমাকে নিয়োগ দিতে ভাইস চ্যান্সেলর সিলেকশন কমিটিকে রাজি করালেন অথবা তাদের অস্বীকৃতিকে নাকচ করে দিলেন- কোনটা ঘটেছে আমার জানা নেই। নিয়োগ লাভের এক সপ্তাহের মধ্যে আমাকে নিয়ে বিশ্ববিদ্যালয়ের অসন্তুষ্ট ও অসুখী হওয়ার মর্মধ্বনী বেশ শোনা যেতে শুরু করল। ভাইস চ্যান্সেলরের বিরুদ্ধে তার স্বৈরাচারী কর্মকাণ্ডের লিখিত বিবরণী পত্রিকায় ছাপা হলো- বলা হলো, এটাই ভাইস চ্যান্সেলরের জঘন্যতম আত্মীয় তোষণের উদাহরণ। আমি নিজেও অসন্তুষ্ট, আমি স্বাগত তো নই-ই, বরং আমি বিশ্ববিদ্যালয়ের ফ্যাকাল্টি হওয়ারও যোগ্য নই। আমি কয়েকটি সংবাদপত্রের রিপোর্ট সঙ্গে নিয়ে ভাইস চ্যান্সেলরের সঙ্গে দেখা করলাম। কিন্তু এসব নিয়ে সম্পূর্ণ উদাসীন কিংবা এ ধরনের গণসমালোচনা তার কাজে দুষ্প্রবেশ্য। তিনি হাসিমুখে একটিমাত্র মন্তব্য করলেন, আমার দেশবাসী ইংরেজি ভাষাটা ঠিকভাবে জানে না, কারণ প্রতিবেদনে যে আত্মীয়তোষণ বা নিপোটিজম বলা হয়েছে সেটা তার বেলায় খাটে না। তিনি একজন ইংরেজ এবং এ দেশে একজন ভিজিটর, এ দেশে তার রক্তসম্পর্কের কোনো আত্মীয় নেই। এসব সমালোচনা উপেক্ষা করার পরামর্শ দিলেন এবং আমার ওপর অর্পিত দায়িত্ব সবচেয়ে ভালোভাবে সম্পাদন করতে বললেন। তিনি আমাকে উৎসাহিত করলেন আমি যেন শিক্ষক হিসেবে নিজেকে প্রতিষ্ঠিত করি এবং উঁচুমানের গবেষণা নিয়ে ব্যস্ত থাকি। যদি তার এই সমর্থন ও উৎসাহ না পেতাম আমি হয়তো যুক্তরাষ্ট্রে চলে যেতাম এবং সম্ভবত আইএমএফে যোগ দিতাম। একজন ইংরেজ ভাইস চ্যান্সেলর না হয়ে আমার দেশি কেউ যদি ভাইস চ্যান্সেলর হতেন, সম্ভবত তাই ঘটত। দেশি ভাইস চ্যান্সেলর পদ্ধতির বাইরে গিয়ে আমার পক্ষে এমন শক্ত সমর্থন দিতেন না কিংবা সিলেকশন কমিটির প্রস্তাব নাকচ করতেন না। অসনাতন একটি পদক্ষেপ গ্রহণ না করে তিনি ঐতিহ্যকেই মেনে নিতেন।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে তার ছাত্রদের মধ্যে ছিলেন মুহাম্মদ ইউনূস (গ্রামীণ ব্যাংকের প্রতিষ্ঠাতা এবং নোবেল পুরস্কার বিজয়ী), ফখরুদ্দীন আহমদ (বাংলাদেশের কেয়ারটেকার সরকারপ্রধান ২০০৬-২০০৭), মির্জ্জা আজিজুল ইসলাম (একই সরকারের অর্থ উপদেষ্টা ২০০৬-২০০৭), মোহাম্মদ ফরাসউদ্দীন (বাংলাদেশ ব্যাংকের গভর্নর), মাহমুদ আলী (পররাষ্ট্রমন্ত্রী ২০১৪ পরবর্তী), ওসমান ফারুক (মন্ত্রী ২০০১-২০০৬), তওফিক এলাহি এবং তওফিক ইমাম (প্রধানমন্ত্রীর উপদেষ্টা), এ আর খান (গবেষণা পরিচালক পিআইডিই, পরে যুক্তরাষ্ট্রের ইউনিভার্সিটি অব ক্যালিফোর্নিয়া রিভারসাইডের অধ্যাপক), মনজুর এলাহী (বিশিষ্ট শিল্পপতি, তত্ত্বাবধায়ক সরকারের উপদেষ্টা) এবং আনিসুর রহমান (অর্থনীতির অধ্যাপক এবং ১৯৭২ পরিকল্পনা কমিশনের সদস্য হিসেবে আমার সহকর্মী)। তার ছাত্রছাত্রীদের অনেকেই ঢাকা ও বাংলাদেশের অন্যান্য বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক, বাংলাদেশ সরকারের সচিব ও রাষ্ট্রদূত ছিলেন।
বেঙ্গল সিভিল সার্ভিসের সদস্য ডক্টর এম এন হুদা চাকরি ছেড়ে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে অর্থনীতির শিক্ষকতা শুরু করেন। নুরুল ইসলাম অর্থনীতি বিভাগে তাকে শিক্ষক হিসেবে পান, তিনি কৃষি অর্থনীতিতে কর্নেল বিশ্ববিদ্যালয় থেকে পিএইচডি করে ঢাকায় সহযোগী অধ্যাপক/রিডার পদে যোগ দেন। এম এন হুদা এবং নুরুল ইসলাম একই সঙ্গে অধ্যাপক পদে পদোন্নতি পান। ১৯৫৭ সালে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে শিক্ষকতায় যোগ দেয়া রেহমান সোবহানের তিনি ভূয়সী প্রশংসা করেন। একবার আমার একজন সহকর্মী এ এন এম মাহমুদ আমাকে বিখ্যাত আইনজীবী এবং পূর্ব পাকিস্তান সরকারের একজন সাবেক মন্ত্রী হামিদুল হক চৌধুরীর একটি অনুরোধ বার্তা আমার কাছে পৌঁছে দিলেন। তার কন্যা আমার ছাত্রী, আমি তাকে প্রাইভেট পড়াতে রাজি আছি কিনা জানতে চেয়েছেন। তিনি অবশ্যই একটি ভালো অঙ্কের সম্মানী দেবেন, কত হলে আমি রাজি হব তাও জানাতে বললেন। আমাকে আনা-নেয়ার জন্য একটি গাড়ি আমার হেফাজতেই রাখা হবে। তিনি চাচ্ছেন সে সময় ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে লভ্য শ্রেষ্ঠ শিক্ষাই যেন তার কন্যা লাভ করে। যা হোক, বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকের মর্যাদা ও সম্মান সম্পর্কে আমার ধারণা ছিল অত্যন্ত উঁচু এবং আমি ভাবলাম যদিও তখন আমার বেতন ৮০০ টাকা, যত টাকা সম্মানীই দেয়া হোক প্রাইভেট টিউটর হওয়া আমার মর্যাদাকে ক্ষুণ্ন করবে। প্রকৃতপক্ষে আমার ইগো এই ভেবে আহত হয়েছে যে ধনী ও বিখ্যাত আইনজীবী ভেবেছেন আমাকে প্রাইভেট টিউটর হিসেবে পাওয়া সম্ভব। আমি আমার সহকর্মীকে জানিয়ে দিলাম যে আমি প্রাইভেট টিউটর হতে রাজি নই। তিনি আমার আচরণ কীভাবে নিয়েছেন আমার জানা নেই, আমার সহকর্মী কখনো তা আমাকে জানাননি।
মোনেম খান তখন পূর্ব পাকিস্তানের গভর্নর, আমি অর্থনীতি বিভাগের চেয়ারম্যান। আমার একজন ছাত্র রাশেদ খান মেনন বামপন্থি রাজনৈতিক দলের সদস্য ছিলেন, দেশের স্বৈরাচারী সরকারের বিরোধিতা করেন। সরকারবিরোধী কাজের জন্য তাকে গ্রেপ্তার করে কারাগারে পাঠানো হয়। মোনেম খান মনে করলেন রাষ্ট্রবিরোধী কর্মকাণ্ডের জন্য তাকে জেলে আটক রাখাই উত্তম, জেলখানায় বসে তার এমএ ফাইনাল পরীক্ষার অনুমতি দেয়া যাবে না। আর তা করতে হলে বিভাগীয় চেয়ারম্যানকে প্রত্যয়ন করতে হবে বিষয়ভিত্তিক ক্লাসে তার প্রয়োজনীয় হাজিরা নেই এবং টিউটোরিয়াল বা ক্লাস পরীক্ষায় তার ফলাফল এত খারাপ যে তাকে পরীক্ষা দেয়ার উপযুক্ত মনে করা যায় না। মোনেম খান গভর্নর হিসেবে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের চ্যান্সেলর। তিনি ভাইস চ্যান্সেলর ওসমান গনিকে তার ইচ্ছা বাস্তবায়নের কথা বললেন। ভাইস চ্যান্সেলর তাকে প্রয়োজনীয় সহযোগিতা করেননি, এটা প্রতীয়মান হলে তিনি তার জীবন দুর্বিষহ করে তুলতে পারেন, তাকে পদ থেকে সরিয়েও দিতে পারেন। সে ক্ষেত্রে রাশেদ খান মেননের যে পরীক্ষায় বসার যোগ্যতা নেই আমার কাছ থেকে সেই সার্টিফিকেট নিতে হবে। কিন্তু আমি দেখলাম তিনি পরীক্ষায় বসার যোগ্যতা অর্জনে সব চাহিদাই পূরণ করেছেন, তাকে অযোগ্য ঘোষণার কোনো সুযোগ নেই। আমি ভাইস চ্যান্সেলরের সঙ্গে কথা বললাম। তিনি বললেন গভর্নরকে না বলার একটি যুক্তিসঙ্গত কারণ বের করতে হবে, নতুবা তিনি ‘না’ স্বাভাবিকভাবে নেবেন না।
শেষ পর্যন্ত আমরা কৌশল নির্ধারণ করলাম, চ্যান্সেলরকে বোঝানো হবে যে অধ্যাপক মিথ্যা বিবৃতিতে সই করতে রাজি নন। আর বিশ্ববিদ্যালয় বিধি অনুযায়ী কেবল অসহযোগিতার অভিযোগে বিভাগীয় চেয়ারম্যানের বিরুদ্ধে কিছু করার সুযোগ নেই। তাকে সরিয়ে দিতে হলে বড় ধরনের অসদাচরণ বা তার মানসিক অক্ষমতার প্রমাণ দিতে হবে। ভাইস চ্যান্সেলর এটাই মোনেম খানকে ব্যাখ্যা করলেন, আর একজন ছাত্রের জন্য বিভাগীয় চেয়ারম্যানকে চাকরিচ্যুত করলে তার বিরোধী শিবির সমস্যা আরো বাড়িয়ে তুলবে- এ আশঙ্কাই গভর্নর করে থাকবেন।… তাছাড়া চাইলে একজন অধ্যাপককে হেনস্তা করার অনেক পথ সরকারের জানাই আছে।

ড. এম এ মোমেন : সাবেক সরকারি চাকুরে, নন-ফিকশন ও কলাম লেখক।

মন্তব্য করুন

খবরের বিষয়বস্তুর সঙ্গে মিল আছে এবং আপত্তিজনক নয়- এমন মন্তব্যই প্রদর্শিত হবে। মন্তব্যগুলো পাঠকের নিজস্ব মতামত, ভোরের কাগজ লাইভ এর দায়ভার নেবে না।

জনপ্রিয়