হাসপাতালে খালেদা জিয়া

আগের সংবাদ

অপরাধের স্বর্গরাজ্য রোহিঙ্গা ক্যাম্প

পরের সংবাদ

গরু নিয়ে সাতকাহন

প্রকাশিত: জুন ১৪, ২০২৩ , ১২:০০ পূর্বাহ্ণ
আপডেট: জুন ১৪, ২০২৩ , ১২:০০ পূর্বাহ্ণ

গরু গৃহপালিত প্রাণী। গরুর বাজার মূল্য এখন তীব্র থেকে তীব্রতর। গরুর উপকারিতা সম্পর্কে কারোই অজানা থাকার কথা নয়। আমাদের শিক্ষার্থীদের মধ্যে একজনও পাওয়া যাবে না যে, গরুর রচনা লেখেনি কিংবা পড়েনি। তাই গরুর উপকারিতা সম্পর্কে বলা নিরর্থক। সাহিত্যিক সত্যেন সেন পশুর প্রতি কিশোরদের মমত্ববোধ সৃষ্টি অভিপ্রায়ে রচনা করেছিলেন ‘লাল গরুটা’ নামক রচনাটি। পাঠ্যসূচিতেও সেটি অন্তর্ভুক্ত ছিল। কিন্তু হেফাজতিদের দাবির মুখে রচনাটি সরকারের আদেশে পাঠ্যসূচি থেকে প্রত্যাহার করা হয়েছে। গরুর প্রতি কিশোর মনে ভালোবাসা জাগানো সহ্য করেনি হেফাজতিরা।
উপকারী গরুর অপকারিতার একটি দৃষ্টান্তও জানা যায় না। কৃষিপ্রধান আমাদের দেশে গরুর সর্বোচ্চ ব্যবহার কৃষিতে। গাভীর দুধ আমাদের খাদ্য সংস্কৃতির অবিচ্ছেদ্য অংশ। গরুর মাংস আমাদের প্রোটিন চাহিদা পূরণে সহজলভ্য ছিল। কিন্তু এখন অতি উচ্চমূল্যের কারণে সাধারণের ক্রয়-ক্ষমতার বাইরে। আমাদের পার্শ্ববর্তী বৃহৎ ভারতের মোট জনসংখ্যার প্রায় ৬০ ভাগ মানুষ নিরামিষভোজি। তারা মাছ-মাংস এমনকি ডিম পর্যন্ত খায় না এবং এটা ধর্মীয় আচারিক মতানুসারে। বৌদ্ধ-জৈন ছাড়াও প্রচুর হিন্দু ধর্মাবলম্বী সেখানে নিরামিষভোজী। ভারতের পশ্চিম, উত্তর এবং দক্ষিণের রাজ্যগুলোতে নিরামিষভোজীর সংখ্যা অধিক। সেখানকার সর্বাধিক খাবারের হোটেল ভেজিটেরিয়ান। নন-ভেজ হোটেল পাওয়া গেলেও খুবই অল্প।
গরুর মাংসভোজী মুসলিম, খ্রিস্টান ব্যতীত সংখ্যাগরিষ্ঠ হিন্দু-জৈন ধর্মাবলম্বীরা গরুর মাংস খাওয়াকে ধর্মহানি বলে মান্য করে। বৈদিক যুগে হিন্দুরা গরুর মাংস খেলেও দুটি বিশেষ কারণে পরে তারা সেটা ত্যাগ করেছে। নিম্নবর্গের (হরিজন) হিন্দুদের মধ্যে গরুর মাংস খাওয়ার রেওয়াজ রয়েছে। তবে সংখ্যায় অতীতের তুলনায় কমেছে, ব্রাহ্মণ্যবাদীদের নিষ্ঠুর হস্তক্ষেপে। অথচ হিন্দু ধর্মের কোনো শাস্ত্রে কিন্তু গরুর মাংস খাওয়া নিষিদ্ধ নয়।
শ্রীকৃষ্ণকে মামাদের অভিসম্পাত থেকে রক্ষায় পরিবার-বিচ্ছিন্ন করা হয়েছিল। শিশু শ্রীকৃষ্ণ গাভীর দুধ পান করেই জীবন রক্ষা করেছিলেন। শিবের সহচর নন্দী আকৃতিতে-আদলে ষাঁড়। ভারতের বিভিন্ন মন্দিরে বিশালাকার পাথরের ষাঁড়ের মূর্তি দেখেছি। সেগুলো শিবের সহচর নন্দীর মূর্তি। নন্দীর মূর্তিকে প্রণাম ও পূজা করতেও দেখেছি। ধর্মীয় কৃতজ্ঞতার আচারিক নিয়ম পালনেই হিন্দুরা গরুর মাংস খায় না। তবে অবাক করার বিষয় কাশ্মিরের মুসলমানরাও কিন্তু গরুর মাংস খায় না। সিংহভাগ মুসলিম অধ্যুষিত কাশ্মিরের শ্রীনগরের মুসলিম খাবার হোটেলগুলোতে লেখা ‘নো-বিফ’। কারণ অনুসন্ধানে জেনেছি, শ্রীনগরে সুফি-সাধক নূরউদ্দিন ওয়ালির কথা, তার মাজারও সেখানে রয়েছে। এই নূরউদ্দিনের ধর্ম মা ছিলেন এক হিন্দু সন্ন্যাসিনী। তার নাম লালেশ্বরী। শৈশবে এই ধর্ম-মা নূরউদ্দিনকে নিজ স্তন পান করিয়েছিলেন। হিন্দুরা নূরউদ্দিন ওয়ালিকে নুন্দঋষি বলে। ধর্ম-মাতা লালেশ্বরীকে মুসলমানরা ডাকে লাল্লাদেদ। মৃত্যুর পূর্বে নূরউদ্দিন তার ভক্তদের উদ্দেশে তার হিন্দু-মাতার স্তন্যদানের ঋণ শোধের জন্য গরু জবাই ও গরুর মাংস খেতে বারণ করেছিলেন। সেই নির্দেশেই কাশ্মিরের সংখ্যাগরিষ্ঠ মুসলমানরা গরুর মাংস খায় না। গরু জবাই করে না।
আমাদের নিকটবর্তী কলকাতায় সবচেয়ে সস্তা খাবার ছিল গরুর মাংস। এখন সেখানে গরুর মাংসের দাম কয়েকগুণ বেড়েছে। তবে আমাদের তুলনায় এখনো অনেক কম। গরুর মাংসের মূল্যবৃদ্ধির কারণ জানতে চেয়েছিলাম বিহারি মুসলমান এক হোটেল মালিকের কাছে। তিনি বলেছিলেন, এখানকার মুসলিম-খ্রিস্টানরাই কেবল গরুর মাংস খায় না, হিন্দুদের মধ্যেও একটি অংশ গরুর মাংস খায়।
চাহিদা বৃদ্ধিতেই গরুর মাংসের মূল্যবৃদ্ধি ঘটেছে। ৩৪ বছরের বাম শাসনামলে প্রাপ্তি যে নেই, সেটা সঠিক নয়। পশ্চিম বাংলায় অসাম্প্রদায়িক-ধর্মনিরপেক্ষ দৃষ্টিভঙ্গি বিকাশে বামপন্থিদের ভূমিকা অনস্বীকার্য। হিন্দুত্ববাদী মোদির জোয়ারে সারা ভারত স্রোতে গা ভাসালেও পশ্চিম বাংলা অসাম্প্রদায়িক চেতনায় সে স্রোত মুক্ত ছিল। জাতীয় নির্বাচনে পশ্চিম বাংলায় মোদির হিন্দুত্ববাদী বিজেপির ভোট প্রাপ্তি সে কারণেই তখন ছিল অতি নগণ্য।
বিজেপির সঙ্গে তৃণমূল কংগ্রেস নির্বাচনী জোট করেও সফল হতে পারেনি। কেবল মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় কেন্দ্রীয় রেলমন্ত্রী হতে পেরেছিলেন। কিন্তু বিধানসভার নির্বাচনে জয়ী হওয়ার পর পশ্চিম বাংলায় বিজেপির অবিশ্বাস্য উত্থান ঘটেছে তৃণমূলের হাত ধরে। গত বিধানসভার নির্বাচনে তৃণমূল পেয়েছে ২ কোটি ৮৭ লাখ ভোট এবং বিজেপি পেয়েছে ২ কোটি ২৮ লাখ ভোট। এতে প্রমাণিত হয়ে যায় আগামীতে পশ্চিম বাংলার রাজ্য সরকার বিজেপি গঠন করলেও অবাক-বিস্ময়ের কারণ হবে না।
সাংবিধানিক ধর্মনিরপেক্ষ-গণতান্ত্রিক ভারত তার সব ঐতিহ্য মোদির শাসনামলে একে একে খুইয়েছে। গো-রক্ষার নামে হিন্দুত্ববাদীদের হাতে অহরহ ঘটছে নিরপরাধ মানুষ হত্যা। গো-রক্ষায় নানা কালা-কানুন আরোপ করা হয়েছে এবং হচ্ছেও।
মোদির সহচর বজরং দল, শিবসেনা, হিন্দুমহাসভা, আরএসএস প্রমুখ চরমপন্থি হিন্দুত্ববাদীদের আসল উদ্দেশ্য ভারতকে হিন্দুরাষ্ট্রে পরিণত করা। যেহেতু ভারতীয় জনগণের নিরঙ্কুশ সমর্থন পেয়েই তারা একক সংখ্যাগরিষ্ঠতায় ক্ষমতায় এসেছে। তাই তাদের আত্মবিশ্বাস ভারতকে হিন্দুরাষ্ট্রে পরিণত করার ক্ষেত্রে সংখ্যাগরিষ্ঠ জনগণের নিরঙ্কুশ সমর্থন তারা পাবে। মোদির শাসনামলেই বাংলাদেশে গরু পাঠানো বন্ধ করার ফলে দেশে গরুর মূল্য বহুগুণ বৃদ্ধি পেয়েছে। আমাদের দেশে গরু না-পাঠানোর আনুষ্ঠানিক ঘোষণা পর্যন্ত দিয়েছে। আতঙ্কের বিষয় হচ্ছে ভারতে মুসলমানদের ওপর সাম্প্রদায়িক আঘাত এলে আমাদের মৌলবাদীরা সে সুযোগ হাতাতে তৎপর হয়ে উঠবে। এতে সর্বাধিক লাভবান হবে হিন্দু জাতীয়তাবাদী বিজেপি। বাংলাদেশে হিন্দু সম্প্রদায় অনিরাপদ অভিযোগ তুলে ভারতের হিন্দুদের উত্তেজিত করে আস্থা অর্জন ও সমর্থন পাওয়া তাদের পক্ষে সহজতর হবে। তেমন মওকার সুযোগ তারা যে গ্রহণে অপেক্ষায় নেই, সেটাও বলি কীভাবে?
গরুকে কেন্দ্র করে উপমহাদেশের রাজনীতি নতুন নয়। স্বয়ং গান্ধী পর্যন্ত গো-রক্ষার আন্দোলনে মুখ্য ভূমিকা পালন করেছিলেন। সিপাই বিদ্রোহে ১৮৫৭ সালে হিন্দু-মুসলমানের ঐক্য রক্ষায় সম্রাট বাহাদুর শাহ জাফর পর্যন্ত কুরবানির ঈদে গরু জবাই নিষিদ্ধ করেছিলেন। নিজে দুম্বা কুরবানি দিয়ে সব মুসলমানকে গরু জবাই থেকে নিবৃত্ত করেছিলেন। হিন্দুত্ববাদী মোদির শাসনামলে গো-রক্ষার অজুহাতে ভারতে মানুষ হত্যা এখন সাধারণ ব্যাপার হয়ে দাঁড়িয়েছে।
ইরাকে থাকার সময়ে কুরবানি ঈদের দিনের স্মৃতি বয়ান করছি, আমি পাঁচ বছর ইরাকের বিভিন্ন প্রদেশ ও অঞ্চলে কুরবানি ঈদের দিন পশু কুরবানি দিতে দেখিনি। কুরবানির ঈদের দিন ইরাক চষে বেড়িয়েও কোথাও পশু কুরবানি দেখার সৌভাগ্য আমার হয়নি।
অর্থনৈতিক এবং রাজনৈতিক উভয় ক্ষেত্রে অধিক মূল্যবান গরুকে নিয়ে আমরা তামাশা করি। মূর্খদের গরু বলে গাল দিই। গরু শব্দটি অত্যন্ত নেতিবাচক রূপে হরহামেশা নানা ক্ষেত্রে ব্যবহার করে থাকি। কিন্তু গরু যে উগ্র হিন্দু জাতীয়তাবাদীদের কাছে মানুষের জীবনের চেয়েও মূল্যবান; তার অকাট্য বহু প্রমাণ তো আমাদের সামনে দৃশ্যমান। তারপরও গরু নিয়ে উপহাস, তুচ্ছ-তাচ্ছিল্য করতে আমরা দ্বিধা করি না। অথচ উপকারী গরুর প্রতি আমাদের আগ্রহের কমতি নেই। আমাদের প্রান্তিক মানুষের জীবন-জীবিকায় গরু অপরিহার্য অনুষঙ্গ। কুরবানির ঈদ এলে আমরা গরু কুরবানি দিই। গরু কুরবানি দেয়া সামাজিক মর্যাদা বৃদ্ধির অংশ হয়ে দাঁড়িয়েছে। কে কতটি এবং কত বড় গরু কুরবানি দিচ্ছে, এ নিয়ে বিত্তবানদের মধ্যে শীতল প্রতিযোগিতাও রয়েছে। এটাতো সত্য, দেশে গরু কুরবানি দেয়া-না দেয়ার ওপর নির্ভর করে সামাজিক মর্যাদা রক্ষা ও হারানো ভয়।

মযহারুল ইসলাম বাবলা : নির্বাহী সম্পাদক, নতুন দিগন্ত।
[email protected]

মন্তব্য করুন

খবরের বিষয়বস্তুর সঙ্গে মিল আছে এবং আপত্তিজনক নয়- এমন মন্তব্যই প্রদর্শিত হবে। মন্তব্যগুলো পাঠকের নিজস্ব মতামত, ভোরের কাগজ লাইভ এর দায়ভার নেবে না।

জনপ্রিয়