চট্টগ্রামে গৃহবধূর ঝুলন্ত মরদেহ উদ্ধার স্বামী পলাতক

আগের সংবাদ

চ্যালেঞ্জ উত্তরণে সংস্কার জরুরি : বাংলাদেশের অর্থনীতিতে তিনটি প্রধান চ্যালেঞ্জ দেখছে আইএমএফ

পরের সংবাদ

গণভবনে কৃষি খামার : নগরীয় কৃষির এক অনন্য দৃষ্টান্ত

প্রকাশিত: মে ৮, ২০২৩ , ১২:০০ পূর্বাহ্ণ
আপডেট: মে ৮, ২০২৩ , ১২:০০ পূর্বাহ্ণ

করোনা মহামারির কারণে সারা বিশ্বে খাদ্য সরবরাহ শৃঙ্খল ভেঙে পড়ে। খাদ্যের দাম বেড়ে যায় অস্বাভাবিকভাবে। অনেক খাদ্য আমদানিকারক দেশে দুর্ভিক্ষ দেখা দেয়। মারা যায় হাজারো মানুষ। বাংলাদেশে সে অবস্থার সৃষ্টি হয়নি। কিন্তু রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধের কারণে দেশে খাদ্যশস্যের দাম বেড়ে যায়। যুদ্ধের আগে যে চালের দাম ছিল কেজিপ্রতি ৪০ টাকা; তা বেড়ে দাঁড়ায় ৮০-৮৫ টাকায়। ৩৪ টাকা কেজির আটার দাম বেড়ে দাঁড়ায় ৮০ টাকা। ১০০ টাকা লিটারের সয়াবিন তেলের মূল্য বেড়ে হয় ১৮০ টাকা। ৬৫ টাকা কেজির চিনির মূল্য বেড়ে দাঁড়ায় ১৩০ টাকা। শুধু খাদ্যশস্য নয়; যুদ্ধের কারণে আমদানিনির্ভর প্রতিটি পণ্যের দামই বেড়ে ভোক্তাদের নাগালের বাইরে চলে যায়। খাদ্যের দাম বাড়ার কারণে মাছ ও মুরগির দাম বেড়ে যায়। যুদ্ধের আগে যে ব্রয়লার মুরগির প্রতি কেজির দাম ছিল ১৫০ টাকা রমজান মাসে তা বেড়ে হয় ২৫০ টাকা। পাঙাশ মাছের দাম ১০০ টাকা থেকে বেড়ে দাঁড়ায় ২০০ টাকায়। ভোগ্যপণ্যের দাম বাড়ার সঙ্গে মধ্যবিত্ত ও নিম্ন-মধ্যবিত্তদের আয় উপার্জন না বাড়ায় তাদের জীবন হয়ে ওঠে দুর্বিষহ। বাংলাদেশে যাতে ভবিষ্যতে খাদ্যের কোনো অভাব না হয়, এজন্য প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা তার পিতার পদাঙ্ক অনুসরণ করে কৃষির ওপর সর্বাধিক গুরুত্বারোপ করেন। জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান বলতেন, খাদ্যের অভাব হলে মানুষের মাথা ঠিক থাকে না। আমার এ স্বাধীনতা ব্যর্থ হয়ে যাবে যদি বাংলার মানুষ তিন বেলা পেট ভরে ভাত খেতে না পায়। পৃথিবীর কোথাও টাকা দিয়েও চাল কিনতে পাওয়া যায় না। ভাত খেতে হলে আমাদের চাল পয়দা করতে হবে। দেশের প্রতি ইঞ্চি জমি কৃষিকাজে ব্যবহার করতে হবে। আধুনিক প্রযুক্তি প্রয়োগ করে ফলন বাড়াতে হবে। শেখ হাসিনা শুধু দেশবাসীকে উপদেশ প্রদান করেই ক্ষান্ত হননি। তিনি সরকারি বাসভবন; গণভবনের প্রতি ইঞ্চি জমিকে কৃষিকাজে ব্যবহার করে তার বক্তব্যের বাস্তবতাকে দেশের ১৭ কোটি মানুষের সামনে তুলে ধরেছেন। স্থাপন করেছেন নগরীয় কৃষির এক বিরল দৃষ্টান্ত। কৃষি শুধু গ্রামে নয়, নগরেও হতে পারে- এ কথা তিনি তার গণভবনের কৃষি খামারের মাধ্যমে নগরবাসীকে দেখিয়ে দিয়েছেন। আমরা তাই বলতে চাই- টেকসই খাদ্য নিরাপত্তার স্বার্থে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার বিরল দৃষ্টান্ত অনুসরণ করে পৃথিবীর অন্যান্য দেশের মতো বাংলাদেশেও গ্রামীণ কৃষির পাশাপাশি নগরীয় কৃষি ব্যবস্থা গড়ে তুলতে হবে।
নগরীয় কৃষি হলো, কোনো নগর ও তার আশপাশে খাদ্যশস্য উৎপাদন, প্রক্রিয়াজাতকরণ, বিতরণ ও বাজারজাতকরণের সব কার্যক্রম। শুধু খাদ্যশস্য উৎপাদনই নয়; শাকসবজি, ফলমূল, মাশরুম, মাছ ও জলজ প্রাণীর চাষ এবং হাঁস-মুরগি, পশুপালন ও দুগ্ধ উৎপাদনসহ সব কার্যক্রমই নগরীয় কৃষির অন্তর্ভুক্ত। নগরীয় কৃষির উদ্দেশ্য হলো- এক. নগরবাসীর জন্য প্রয়োজনীয় খাদ্যশস্য, ফলমূল, শাকসবজি, মাছ, মাংস, ডিম, দুধ উৎপাদন ও সরবরাহের ব্যবস্থা করা। দুই. নগরের জীববৈচিত্র্য সংরক্ষণ ও পরিবেশের ভারসাম্য রক্ষা করা। তিন. নগরবাসীর মধ্যে স্বল্পমূল্যে স্বাস্থ্যসম্মত নিরাপদ খাদ্য সরবরাহ নিশ্চিত করা। চার. কৃষি উৎপাদনের মাধ্যমে নগরবাসীর আয় বৃদ্ধি ও কর্মসংস্থানের ব্যবস্থা করা। পাঁচ. নগরের বর্জ্য থেকে জৈব সার ও বিদ্যুৎ উৎপাদন করা। ছয়. বায়ুদূষণ, শব্দদূষণ, মাটি ও পানিদূষণের হাত থেকে নগরবাসীকে রক্ষা করা। সাত. নগরের সব ভবনের ছাদ ও বারান্দায় এবং অন্যান্য প্রতিষ্ঠানের অব্যবহƒত জমিতে জৈব পদ্ধতিতে চাষাবাদ করা। আট. নগরের সৌন্দর্য বৃদ্ধিকল্পে রাস্তার ধার, ব্যালকনি ও ছাদ সবুজায়ন করা। এছাড়া নগরের তাপমাত্রা হ্রাস এবং জলবায়ু পরিবর্তনের প্রভাব মোকাবেলায়ও নগরীয় কৃষি উল্লেখযোগ্য অবদান রাখে।
বর্তমানে বাংলাদেশে প্রায় ৫ কোটি লোক নগরে বসবাস করে। ২০৩০ সালে সাড়ে ৮ কোটি ৩৯ লাখ এবং ২০৫০ সালে প্রায় শতভাগ লোক নগরে বসবাস করবে। নগরে বসবাসকারী এই বৃহৎ জনগোষ্ঠীকে কৃষি কর্মকাণ্ডের বাইরে রেখে দেশের খাদ্য ও পুষ্টি নিরাপত্তা, কর্মসংস্থান, দারিদ্র্য বিমোচন করা কোনো অবস্থাতেই সম্ভব হবে না। এজন্য জাতীয় কৃষি নীতিতে নগরীয় কৃষিকে অন্তর্ভুক্ত করতে হবে। সেই সঙ্গে প্রতিটি কৃষি গবেষণা ইনস্টিটিউট ও কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়ের গবেষণা কর্মকাণ্ডে নগরীয় কৃষিকে যুক্ত করতে হবে। কৃষি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের পাঠ্যসূচিতে নগরীয় কৃষিকে অন্তর্ভুক্ত করতে হবে। মনে রাখতে হবে, আগামী দিনের বাংলাদেশ হবে নগর সরকার ও নগরীয় কৃষির বাংলাদেশ। এ জন্য গ্রামীণ কৃষির পাশাপাশি নগরবাসীর চাহিদা, খাদ্যাভ্যাস, আবহাওয়া ও ঐতিহ্যের সঙ্গে সামঞ্জস্য রেখে আপদকালীন বাজার ব্যবস্থার কথা মনে রেখে বিদেশের মতো করে নয়; আমাদের মতো করেই নগরীয় কৃষিব্যবস্থা গড়ে তুলতে হবে।
বৈশ্বিক খাদ্য সংকট মোকাবেলায় জনগণকে প্রতি ইঞ্চি জমিতে আবাদ করার আহ্বান জানিয়েছেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। তিনি স্বয়ং নিজে তার সরকারি বাসভবন; গণভবনের অব্যবহৃত প্রতি ইঞ্চি জমিকে কাজে লাগিয়েছেন। পুরো গণভবনকে প্রায় একটি খামার বাড়িতে পরিণত করে সৃষ্টি করেছেন নগরীয় কৃষির এক বিরল দৃষ্টান্ত। বিশ্বে খাদ্য ও নিত্যপণ্যের সংকট দেখা দেয়ার পর থেকে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা তার প্রায় প্রতিটি বক্তব্যে খাদ্য উৎপাদন বাড়ানোর ওপর গুরুত্বারোপ করছেন। তিনি সরকারি, বেসরকারি ও দলের সব অনুষ্ঠানে প্রতি ইঞ্চি জমিকে আবাদের আওতায় আনার আহ্বান জানিয়ে আসছেন। এরই ধারাবাহিকতায় তিনি নিজে গণভবন আঙিনার পতিত প্রতি ইঞ্চি জমিকে উৎপাদনের আওতায় এনেছেন এবং জনগণের প্রতি জানানো নিজের আহ্বানকে বাস্তবে রূপদান করে নগরীয় কৃষির এক অনন্য দৃষ্টান্ত স্থাপন করেছেন। এ দেশের আলো-হাওয়ায় বেড়ে ওঠা প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা সাধারণ জীবনযাপনে অভ্যস্ত। দেশের মাটি-মানুষ, কৃষির সঙ্গে মিশে আছে তার প্রাণ। কৃষক তার আত্মার আত্মীয়। গণভবনে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার এই ফসলি উঠানে নানা ধরনের ফসলের আবাদ তারই একটা উৎকৃষ্ট দৃষ্টান্ত। প্রতি ইঞ্চি জমিতে আবাদ করার বিষয়টি জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের ১৯৭৪ সালের সবুজ বিপ্লবের ডাক থেকে অনুপ্রাণিত হয়েছেন প্রধানমন্ত্রী। গণভবন আঙিনায় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বাঁশফুল, পোলাওর চাল, লাল চালসহ বিভিন্ন জাতের ধান; ফুলকপি, পাতাকপি, লালশাক, পালংশাক, ধনেপাতা, গ্রামবাংলার জনপ্রিয় বথুয়া শাক, ব্রোকলি, টমেটো, লাউ, শিমসহ প্রায় সব ধরনের শীতকালীন শাকসবজি চাষ করছেন। এছাড়া গণভবনে তিল, সরিষা, সরিষা ক্ষেতে মৌচাক পালনের মাধ্যমে মধু আহরণ, হলুদ, মরিচ, পেঁয়াজ, তেজপাতাসহ বিভিন্ন ধরনের মসলা; আম, কাঁঠাল, কলা, লিচু, বরই, ড্রাগন, স্ট্রবেরিসহ বিভিন্ন ধরনের ফল; গোলাপ, সূর্যমুখী, গাঁদা, কৃষ্ণচূড়াসহ বিভিন্ন ধরনের ফুলেরও চাষ করছেন প্রধানমন্ত্রী। তিনি অবসর পেলেই এসব তদারকিও করেন এবং এসব ফসল ফলাতে ব্যবহার করা হয় গণভবনে গরুর খামারের গোবর থেকে উৎপাদিত জৈব সার। এছাড়া গণভবনের আঙিনায় আলাদা করে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা গরুর খামার, দেশি হাঁস-মুরগি, তিতির, চীনা হাঁস, রাজহাঁস, কবুতরের খামার করেছেন। তিনি গণভবন পুকুরে চাষ করছেন রুই-কাতল, তেলাপিয়া, চিতলসহ বিভিন্ন প্রজাতির মাছ। এমনকি গণভবন পুকুরে মুক্তার চাষও করছেন তিনি। উৎপাদিত এসব নিত্যপ্রয়োজনীয় দ্রব্য প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা নিজের জন্য সামান্য রেখে গণভবন কর্মচারী এবং দরিদ্র-অসহায় মানুষের মধ্যে বিলিয়ে দেন।
সমাজতান্ত্রিক সোভিয়েত ইউনিয়নের পতন ও মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের বাণিজ্যিক অবরোধের কারণে ক্ষুদ্র দ্বীপরাষ্ট্র কিউবার খাদ্য, জ¦ালানি, রাসায়নিক সার ও কীটনাশক আমদানির পথ প্রায় রুদ্ধ হয়ে পড়ে। ১৯৮৯ থেকে ১৯৯৩ সালের মধ্যে দেশটির অভ্যন্তরীণ কৃষি উৎপাদন অর্ধেক হ্রাস পায়। দেশে তীব্র খাদ্য সংকট দেখা দেয়। কিউবা পড়ে মহাবিপদে। এ বিপদ থেকে বাঁচার জন্য কিউবা তাদের বাগান, পার্ক, সরকারি অফিসের পরিত্যক্ত জায়গা, বাড়ি-ঘরের ছাদগুলোকে কৃষি কাজে ব্যবহার শুরু করে। তারা রাসায়নিক সার ও কীটনাশকের পরিবর্তে জৈব সার বিশেষ করে কেঁচো কম্পোস্ট ও জৈব বালাই নাশক ব্যবহারের দিকে নজর দেয়। সরকার নগরীয় কৃষিকাজে নিয়োজিত ব্যক্তিদের সহায়তায় এগিয়ে আসে। নগরীয় কৃষকদের প্রশিক্ষণ, উপকরণ সরবরাহ এবং সরকারি পরিত্যক্ত জায়গায় কৃষকদের আবাদ করার অধিকার দিয়ে নতুন আইন প্রণয়ন করে। ফলে কিউবা অল্প সময়ের মধ্যে খাদ্য সংকট সমস্যা সমাধানে সক্ষম হয়। বর্তমানে হাভানা নগরে ৮ হাজারের বেশি কৃষি খামার রয়েছে। এসব খামারের ৩৫ হাজার হেক্টর জমিতে প্রায় ৩ লাখ ২২ হাজার মানুষ নগরীয় কৃষির সঙ্গে জড়িত। তারা বিভিন্ন প্রকার শাকসবজি ও ফলমূলের পাশাপাশি উৎপাদন করছে ডিম, দুধ ও মাংস। উৎপাদিত পণ্য বিক্রি করছেন নগরবাসীর কাছে। সরবরাহ করছেন স্কুল, কলেজ, হাসপাতাল ও হোটেল রেস্তোরাঁগুলোতে। এতে নগরবাসীর কর্মসংস্থান ও দারিদ্র্য বিমোচনের সুযোগও সৃষ্টি হচ্ছে। এ নতুন কৃষিব্যবস্থার আরো সুবিধা হলো- এটি জ¦ালানি সাশ্রয়ী এবং কম কার্বন নিঃসরণকারী। এতে নগরবাসী হৃদরোগ, উচ্চ রক্তচাপ ও ডায়াবেটিস টাইপ-২-এর মতো জটিল রোগ থেকে রক্ষা পায়। কিউবার এই নগরীয় কৃষি ব্যবস্থা সারা পৃথিবীতে ব্যাপক জনপ্রিয়তা অর্জন করে এবং জাতিসংঘের খাদ্য ও কৃষি সংস্থা তাদের কর্মসূচিতে এটিকে অন্তর্ভুক্ত করে। আমাদের প্রত্যাশা জাতিসংঘের খাদ্য ও কৃষি সংস্থা প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার এই শুভ উদ্যোগকে নগরীয় কৃষির উৎকৃষ্ট দৃষ্টান্ত হিসেবে সারা বিশ্বের মানুষের কাছে তুলে ধরবে। এতে মানুষের কাছে নগরীয় কৃষির কদর বাড়বে এবং এটির কার্যক্রম পৃথিবীর প্রতিটি নগরে ছড়িয়ে পড়বে।

নিতাই চন্দ্র রায় : কৃষিবিদ ও কলাম লেখক।
[email protected]

মন্তব্য করুন

খবরের বিষয়বস্তুর সঙ্গে মিল আছে এবং আপত্তিজনক নয়- এমন মন্তব্যই প্রদর্শিত হবে। মন্তব্যগুলো পাঠকের নিজস্ব মতামত, ভোরের কাগজ লাইভ এর দায়ভার নেবে না।

জনপ্রিয়