টানা দাবদাহের পর সিলেটে স্বস্তির বৃষ্টি

আগের সংবাদ

প্রথম দিনের ঈদযাত্রায় স্বস্তি : কমলাপুরে নেই হুড়োহুড়ি, সড়ক মহাসড়কে নেই যানজট, নৌপথে বেড়েছে যাত্রীর চাপ

পরের সংবাদ

সামাজিক ও অর্থনৈতিক বৈষম্য নিরসনে জাকাতের গুরুত্ব ও তাৎপর্য

প্রকাশিত: এপ্রিল ১৯, ২০২৩ , ১২:০০ পূর্বাহ্ণ
আপডেট: এপ্রিল ১৯, ২০২৩ , ১২:০০ পূর্বাহ্ণ

ইসলামে নামাজকে যেমন গুরুত্ব দেয়া হয়েছে, তেমনি গুরুত্ব দেয়া হয়েছে জাকাতকে। পবিত্র কুরআনের ৮২ জায়গায় নামাজের এবং ৩২ জায়গায় জাকাতের কথা বলা হয়েছে। আর ২৭ জায়গায় নামাজ ও জাকাতের কথা একত্রে বলা হয়েছে। সামর্থ্যবান ব্যক্তি জাকাত আদায় না করলে তার পরিণাম বা ফলাফল সম্পর্কেও পবিত্র কুরআনে হুঁশিয়ার করা হয়েছে। ইসলামে জাকাত ব্যবস্থার প্রচলন হয়েছে মূলত একটি সাম্যভিত্তিক সমাজ গঠন করার জন্য। সমাজে ধনীদের হাতেই যাতে সম্পদ কুক্ষিগত না থাকে, যাতে একটি অর্থনৈতিক বৈষম্যহীন সমাজ প্রতিষ্ঠিত হয়, কেউ পাঁচতলায় আর কেউ গাছ তলায় থাকার মনোবৃত্তি যাতে তৈরি না হয়, সে লক্ষ্যেই জাকাত প্রদানের হুকুম জারি হয়েছে। কারণ যদি সমাজের মুষ্টিমেয় লোকের হাতে সম্পদ পুঞ্জীভূত হয়ে যায়, তবে সেখানে দরিদ্র মানুষের সংখ্যা বৃদ্ধি পাবে, বৃদ্ধি পাবে সামাজিক-অর্থনৈতিক বৈষম্য ও অস্থিরতা। ফলে সমাজে সৃষ্টি হবে একটি ভারসাম্যহীন অবস্থা। সে কারণে ধনীদের ওপর জাকাত ফরজ করা হয়েছে। এটি ধনীদের কোনো দয়া বা অনুগ্রহ নয়। বরং ধনীদের থেকে গরিবদের প্রাপ্য অধিকার।
জাকাতের উদ্দেশ্য হলো, সহায়তার মনোভাব পোষণ ও অথনৈতিক সমৃদ্ধি আনায়ন। দারিদ্র্যবিমোচন ও মানুষের মধ্যে ভেদাভেদ কমিয়ে আনা। আমরা জাকাতের অন্যান্য সব দিক আলোচনায় না এনে কেবল উল্লিখিত তিন/চারটি দিক সম্পর্কে বিশ্লেষণ করলে দেখতে চাই, জাকাত সমাজের জন্য খুবই কল্যাণকর একটি ব্যবস্থা। আমাদের সমাজে এমন অনেক মানুষ রয়েছেন, যারা তাদের সন্তানদের শুধু অর্থাভাবে উচ্চ শিক্ষার ব্যবস্থা করতে পারছেন না। এমতাবস্থায় যদি ধনী মানুষগুলো ইসলামী আইন অনুযায়ী তাদের অর্থের শরিয়ত নির্ধারিত অংশ জাকাত হিসেবে সমাজের এই গরিব মানুষগুলোর হাতে যথাযথভাবে আদায় করে, তবে সে মানুষগুলো তাদের সন্তানগুলোকে শিক্ষিত করে গড়ে তুলতে পারে। ভবিষ্যতে এ শিক্ষিত মানুষগুলো সমাজের জন্য হয় আশীর্বাদ ও কল্যাণকর। কখনোই তারা সমাজের জন্য বোঝা হয় না। তারা দেশ ও সমাজের উন্নয়নের জন্য এমন কিছু অবদান রাখতে পারে, যা অশিক্ষিত থাকলে কোনোভাবেই তাদের দ্বারা সম্ভব হতো না। শুধু তাই নয়, শিক্ষিত হওয়ার ফলে তাদের মধ্যে মনুষ্যত্ববোধ জন্ম নেয়ায় সে সমাজের অনেক অনাচার, অবিচার ও অপরাধপ্রবণতা থেকে মানুষকে বিরত রাখার ফলে সমাজে শান্তির বিস্তার করতে সক্ষম হয়। এভাবে জাকাত আদায়ের মাধ্যমে সমাজ কল্যাণময় হয়ে ওঠে।
জাকাত প্রদানের খাত যেমন সুনির্দিষ্ট, তেমনি সুনির্দিষ্ট এর বণ্টন ব্যবস্থাও। জাকাতের মূল উদ্দেশ্য যেহেতু গরিব-দুঃখীদের অভাব দূরীকরণের মাধ্যমে বৈষম্যহীন সাম্যভিত্তিক সমাজ গঠন করা, তাই জাকাত যেনতেনভাবে দিলে হবে না। দিলে সেটা হবে শুধু লোক দেখানো মাত্র। জাকাত এমনভাবে দিতে হবে, যেন গ্রহীতার অভাব দূর হয়, সে স্বাবলম্বী হতে পারে। পরেরবার যাতে তাকে আবার সাহায্যের জন্য অন্যের কাছে হাত পাততে না হয়। এজন্য জাকাতের অর্থ শত শত, হাজার হাজার মানুষের মাঝে অল্প অল্প করে না দিয়ে নিজের বা পার্শ্ববর্তী এলাকার জাকাত পাওয়ার যোগ্য মুষ্টিমেয় কয়েকজনকে টার্গেট করে বিতরণ করতে হবে। তাহলে সেটা হবে ফলপ্রসূ ও কার্যকর। বর্তমান পৃথিবীর অশান্তির অন্যতম কারণ দারিদ্র্য। বিস্ময়কর বিষয় হলো, সম্পদের স্বল্পতা নয় বরং দেশের কিছু শ্রেণির মানুষের হাতে সম্পদ কুক্ষিগত থাকাই দারিদ্র্যের অন্যতম কারণ। জাকাতভিত্তিক অর্থনীতি প্রতিষ্ঠার মাধ্যমে দারিদ্র্যবিমোচন করে পৃথিবীতে শান্তি প্রতিষ্ঠা করা সম্ভব। মাহে রমজানের সঙ্গে জাকাতের রয়েছে ঐতিহ্যগত সম্পর্ক। যেহেতু জাকাত চন্দ্রবর্ষ দ্বারা হিসাব করা হয় এবং আমাদের দেশে অধিকতর কল্যাণের আশায় সাধারণত রমজান মাসেই জাকাত আদায় করা হয়। ইসলামের অন্যতম মৌলিক ভিত্তি হিসেবে কারা জাকাত আদায় করবেন, কোন কোন জিনিসের জাকাত আদায় করবেন, জাকাতের সঠিক হিসাব কীভাবে করবেন, কোন কোন খাতে কীভাবে জাকাত আদায় করবেন এবং জাকাতের হকদারগণ কীভাবে জাকাত গ্রহণ করবেন এ সম্পর্কে মৌলিক জ্ঞান অর্জন করা জাকাত দাতা ও জাকাত গৃহীতা তথা সব মুসলিম নর-নারীর জন্যই ফরজ বা একান্ত অপরিহার্য। ইদানীং পৃথিবীর বিভিন্ন দেশে ইসলামী ব্যাংকগুলো সমাজে বিদ্যমান অসহনীয় দারিদ্র্য ও বেকারত্ব নিরসনকল্পে জাকাতের অর্থ পরিকল্পিতভাবে সংগ্রহ করে তহবিল গঠন এবং সেই তহবিল থেকেই দারিদ্র্যবিমোচন ও অর্থনৈতিক উন্নয়নের জন্য কার্যপরিকল্পনা গ্রহণ করে দৃষ্টান্ত স্থাপন করেছে। অনুরূপভাবে কোনো এলাকার বিত্তবান লোকজন যদি জাকাতের তহবিল গঠন করে গরিব মানুষের পুনর্বাসনের উদ্যোগ নেয়, তাহলেও গ্রামবাংলার অর্থনৈতিক উন্নয়ন সহজতর হবে। নতুবা জাকাত সরকারি জাকাত ফান্ডে জমা দিতে হবে এবং সেখান থেকে জনকল্যাণের প্রয়োজনীয় কার্যকর ভূমিকা নিলে দরিদ্র জনগোষ্ঠীর অর্থনৈতিক উন্নয়ন সম্ভব হবে। সরকারের বাস্তবমুখী উদ্যোগ, প্রয়োজনীয় আইন প্রণয়ন এবং কার্যকর ভূমিকা ও সুদূরপ্রসারী পরিকল্পনার পাশাপাশি এ দেশে যারা সাহেবে নিসাব তারা সবাই স্বেচ্ছাপ্রণোদিত হয়ে নিয়মিত জাকাতের অর্থ পরিকল্পিতভাবে ব্যয়ের জন্য উদ্যোগী হলে দেশে গরিব জনগণের ভাগ্যের চাকা ঘুরবে। এ জন্য প্রয়োজন সদিচ্ছার ও সুষ্ঠু পরিকল্পনার। তাই রাষ্ট্রের রাজস্ব আয় বাড়ানো আর জনগণের ভাগ্য পরিবর্তনের জন্য শিক্ষাব্যবস্থার সব স্তরে জাকাতবিষয়ক ইসলামী অর্থনীতির শিক্ষা চালু করা; সর্বস্তরের মানুষের কাছে জাকাতভিত্তিক অর্থনৈতিক ব্যবস্থার গুরুত্ব তুলে ধরা; সব মুসলিম দেশে সরকারিভাবে জাকাত আদায়ের ব্যবস্থা গ্রহণ করা যেতে পারে।
জাকাতের মাধ্যমে ধনী ও দরিদ্রের মধ্যে অর্থনৈতিক ভারসাম্য বজায় রাখা হয়। ইসলামে সম্পদ বণ্টন ব্যবস্থায় ধনীরা তাদের সম্পদের কিছু অংশ জাকাত দিলে গরিবদের সম্পদ কিছুটা বেড়ে যায় এবং অর্থনৈতিক বৈষম্য দূর হয়। জাকাতভিত্তিক অর্থ ব্যবস্থা মহানবী (সা.)-এর আদর্শ মদিনা রাষ্ট্র, খোলাফায়ে রাশেদিনের শাসনামলে অর্থনৈতিক বৈষম্য ও দারিদ্র্যবিমোচন করে মুসলিম উম্মাহকে সমকালীন বিশ্বে একটি সমৃদ্ধ ও উন্নত জাতিতে পরিণত করেছিল। এভাবে জাকাত ফান্ডের অর্থ দিয়ে যদি অভাবীদের একটি তালিকা তৈরি করে অগ্রাধিকার ভিত্তিতে বিশটি পরিবারকে বাছাই করে প্রতিটি পরিবারকে ৫,০০০ টাকার মধ্যে উপার্জনযোগ্য কোনো কর্মসংস্থানের ব্যবস্থা করা হয় এবং যে পরিবারের কর্তা একজন শক্তিমান পুরুষ তাকে একটি ভ্যান বা মাঝারি নৌকা কিনে দেয়া হয়, যে পরিবারের কর্তা একজন বয়োবৃদ্ধ পুরুষ তাকে একটি ছোট পান-চায়ের দোকান করে দেয়া হয়, আর যে পরিবারের প্রধান একজন বিধবা মহিলা তাকে একটা ভালো সেলাই মেশিন কিনে দেয়া হয়, তাহলে এর সুষ্ঠু ও সঠিক ব্যবহার করে তারা দৈনন্দিন রোজগার করে সংসার চালাতে পারবে। এভাবে প্রতি বছর যদি বিশটি পরিবারকে স্বাবলম্বী করা যায়, তাহলে মদিনায় যেমন খোলাফায়ে রাশেদিনের শেষ দিকে জাকাত নেয়ার মতো লোক খুঁজে পাওয়া যায়নি, তেমনি ২০ বছর পর হয়তো ওই মহল্লায়ও জাকাত নেয়ার মতো কোনো লোক খুঁজে পাওয়া যাবে না। এজন্য প্রয়োজন হবে সম্মিলিত সামাজিক অঙ্গীকার। পরিশেষে আমরা বলতে পারি, আর্থসামাজিক উন্নয়নে জাকাত এক তাৎপর্যপূর্ণ ভূমিকা পালন করে থাকে। জাকাত ব্যবস্থায় সমাজের অথনৈতিক অবস্থা সুদৃঢ় হয়। ধনী-দরিদ্রের বৈষম্য নিরসনে এটি এক উত্তম ব্যবস্থা। সাম্য ও সমতার বিধান ছাড়া সামাজিক শান্তি ও শৃঙ্খলা সুরক্ষা হয় না। দারিদ্র্য ও বেকারত্ব দূরীকরণ হলেই সমাজ স্থিতিশীল হয়। অপরাধ কমে আসে। তাই এটা প্রতিষ্ঠিত সত্য, জাকাত সমাজে অর্থনৈতিক উন্নয়ন ও বৈষম্য নিরসনে এক অপরিসীম ভূমিকা পালন করে থাকে।

ড. ফোরকান উদ্দিন আহাম্মদ : কলাম লেখক ও গবেষক।
[email protected]

মন্তব্য করুন

খবরের বিষয়বস্তুর সঙ্গে মিল আছে এবং আপত্তিজনক নয়- এমন মন্তব্যই প্রদর্শিত হবে। মন্তব্যগুলো পাঠকের নিজস্ব মতামত, ভোরের কাগজ লাইভ এর দায়ভার নেবে না।

জনপ্রিয়