প্রকাশিত: ফেব্রুয়ারি ১৮, ২০২৩ , ১২:০০ পূর্বাহ্ণ
আপডেট: ফেব্রুয়ারি ১৮, ২০২৩ , ১২:০০ পূর্বাহ্ণ
এনজিও সেক্টরের পথিকৃৎ ঘাসফুল-প্রতিষ্ঠাতা পরাণ রহমানের আজ ৮ম মৃত্যুবার্ষিকী। প্রয়াত পরাণ রহমানের মৃত্যুর পর তার সম্পর্কে মন্তব্য করতে গিয়ে বিশিষ্ট নারীনেত্রী খুশী কবির লেখেন, ‘আমাকে কেউ যদি জিজ্ঞেস করে একজন সমাজকর্মী কাকে বলে; তাহলে আমার চোখের সামনে ভেসে ওঠে পরাণ আপা’। এমজেএফের নির্বাহী পরিচালক শাহীন আনাম বলেন, ‘পরাণ রহমান সমাজ পরিবর্তনে বিশ্বাসী ছিলেন। গরিব ঘরে কেউ জন্ম নিলে গরিব হয়ে থাকবে তা বিশ্বাস করতেন না। গভীর ভালোবাসা দিয়ে কাজটি করতেন। সত্তরের ১২ নভেম্বর স্মরণকালের ভয়াবহ ঘূর্ণিঝড়ে বাংলাদেশের উপকূলীয় অঞ্চলে নেমে আসে ভয়াবহ দুর্যোগ। অসংখ্য মানুষ ভিটে-মাটি এবং পরিবারের স্বজনদের হারিয়ে নিঃস্ব হয়ে পড়ে। জলোচ্ছ¦াসে বহু মানুষ পরিবার থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়ে। পরাণ রহমান সে সময় মেয়েদের নিয়ে ত্রাণের কাজ শুরু করেন। সুবিধাবঞ্চিত এসব নারী ও নিষ্পাপ শিশুরাই ছিল পরাণ রহমানের ‘ঘাসফুল’। তিনি তাদের কাছে টেনে নিলেন পরম মমতায়। ক্ষুধার্ত শিশু ও অসহায় মানুষের জন্য তিনি প্রতিদিন রুটি-সবজি নিয়ে হাজির হতেন। এই কাফেলায় অন্য মেয়েদের সঙ্গে বড় মেয়ে পারভীন মাহমুদও ছিলেন। সত্তরের ক্ষত শুকাতে না শুকাতেই একাত্তরে শুরু হয় মুক্তিযুদ্ধ। মুক্তিযুদ্ধের সময় যেসব সাহসী নারী গোপনে গ্রামে-গঞ্জে ঘুরে যুবকদের ভারত সীমান্তে প্রশিক্ষণে পাঠাতে কাজ করেন তাদের মধ্যে পরাণ রহমান অন্যতম একজন। পরাণ রহমান মুক্তিযোদ্ধাদের পথ দেখিয়েছিলেন, তাদের খাবার সরবরাহ করতেন, সংবাদ আদান-প্রদান করতেন, অস্ত্র লুকিয়ে রেখে মুক্তিযোদ্ধাদের সহযোগিতা করেছেন। মুক্তিযুদ্ধে অংশগ্রহণের বিষয়ে নিজের লেখাতে পরাণ রহমান লিখেছেন, ‘১৯৭১-এ শহীদ মির্জা লেইনের যুবক-তরুণরা অতর্কিতে আক্রমণ, গেরিলা যুদ্ধ বা প্রতিরোধ গড়ার মহড়া, বন্দুক চালানো শিক্ষা নিয়েছিল। সে সময় তিনিসহ কয়েক নারী ও আর নিজাম রোডে এলিট পেইন্টের মালিক সিরাজ সাহেবের খালি জমিতে একত্রিত হয়েছিলেন। সেখানে ফার্স্ট-এইড শিক্ষার সঙ্গে বন্দুক চালানো শিখেছিলেন কয়েক নারী। মুক্তিযুদ্ধে অংশগ্রহণে ইচ্ছুক নারীদের যুদ্ধে আহতদের রক্ত বন্ধ করা ও ব্যান্ডেজ করা শিখিয়েছিলেন। আত্মরক্ষা ও ফার্স্ট-এইড প্রশিক্ষণ দিয়ে সশস্ত্র যুদ্ধের প্রস্তুতিতে আত্মনিয়োগ করেন। শেষ বিজয় না আসা পর্যন্ত তিনি গ্রামে-গ্রামে রিকশা নিয়ে ঘুরে ঘুরে যুবকদের দেশত্যাগে উদ্বুদ্ধ করতেন। তিনি সত্যিকার অর্থে একজন মুক্তিযোদ্ধা সংগঠক ছিলেন। অবশেষে ৩০ লাখ শহীদ ও ৫ লাখ মা-বোনের সম্ভ্রমের বিনিময়ে আসে লাল-সবুজের পতাকা।
স্বাধীনতা ঘোষণার পর যেসব শরণার্থী ভারতে আশ্রয় নিয়েছিলেন, তারা ফিরে আসতে শুরু করে। শুরু হয় চারদিকে হাহাকার। পর্যাপ্ত খাদ্য নেই, ওষুধ নেই, রাস্তাঘাট নেই, ঘরবাড়ি পুড়ে দিয়েছে, থাকার জায়গা নেই, আত্মীয় স্বজন, মা-বাবা, যুবক সন্তানকে হত্যা করা হয়েছে, যুদ্ধকালীন যৌন নির্যাতনের শিকার মা-বোনের দাঁড়ানোর আশ্রয় নেই, সর্বত্রই যেন নেই আর নেই। এমন এক অবর্ণনীয় বেদনাদায়ক পরিস্থিতিতে পরাণ রহমান ঝাঁপিয়ে পড়লেন রিলিফ-ওয়ার্কে। তিনি পাড়া-পড়শি, আত্মীয়-স্বজনদের কাছ থেকে অর্থ সংগ্রহ শুরু করে অসহায় দুর্গত মানুষের জন্য ত্রাণ ও পুনর্বাসনকল্পে কাজ শুরু করেন। যাত্রা শুরু হয় তার প্রাতিষ্ঠানিক উন্নয়ন কর্মকাণ্ডের। জন্ম নেয় উন্নয়ন সংগঠন ‘ঘাসফুল’। সংগঠনের মাঠ পর্যায়ে কাজের ক্ষেত্র হিসেবে তিনি প্রথমেই বেছে নেন চট্টগ্রামের লালখান বাজারস্থ ‘পোড়া কলোনি’ নামক দারিদ্র্যনিপীড়িত একটি জনপদ। স্বাধীনতার পরপর দেশের বিভিন্ন প্রান্ত থেকে বহু নির্যাতিত বীরাঙ্গনারা পরিচয় গোপন করে এখানে আশ্রয় নেয়। পরাণ রহমান অন্যান্য দুস্থ পরিবারের সঙ্গে তাদেরও স্বাস্থ্যসেবার পাশাপাশি কাউন্সিলিং দিতে শুরু করেন। নতুন জীবনের স্বপ্ন দেখান। পরাণ রহমান বিভাজন থেকে বন্ধনকে আবিষ্কার করতেন বেশি এবং বন্ধুত্বের সেতুবন্ধনে আবদ্ধ করেছেন অনেক মানুষকে। তিনি বেগম রোকেয়া, সুফিয়া কামালসহ নারী উন্নয়নযাত্রার মহীয়সী নারীদের এক সার্থক প্রতিনিধি। পরাণ রহমান উন্নয়ন কর্মকাণ্ডের সূচনা করেছিলেন চট্টগ্রামে, যা আজ সারাদেশে ছড়িয়ে পড়ছে। উন্নয়নযাত্রার সহকর্মী হিসেবে তার স্মৃৃতি, উপদেশ, মমতা এখনো আমাদের হৃদয়ে অমলিন।
মন্তব্য করুন
খবরের বিষয়বস্তুর সঙ্গে মিল আছে এবং আপত্তিজনক নয়- এমন মন্তব্যই প্রদর্শিত হবে। মন্তব্যগুলো পাঠকের নিজস্ব মতামত, ভোরের কাগজ লাইভ এর দায়ভার নেবে না।