যৌতুকের জন্য স্ত্রী হত্যার মামলায় স্বামীর মৃত্যুদণ্ড

আগের সংবাদ

বিদেশিদের নজর ঢাকার দিকে : ব্যস্ত সময় পার করলেন ভারত, মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র ও কোরিয়ার শীর্ষ কূটনীতিকরা

পরের সংবাদ

সাহিত্যে সৃজন-মনন : লেখকের দায়

প্রকাশিত: ফেব্রুয়ারি ১৫, ২০২৩ , ১২:০০ পূর্বাহ্ণ
আপডেট: ফেব্রুয়ারি ১৫, ২০২৩ , ১২:০০ পূর্বাহ্ণ

সাহিত্য হলো একটা সৃষ্টি বা নির্মিতি। ভাষা হলো সাহিত্যের দেহ। ভাষার শক্তি, সৃজনশীলতা ও সৌন্দর্যের প্রকাশ ঘটে সাহিত্যে। সাহিত্যের কাজ সৌন্দর্য উৎপাদন করা, বিস্ময় তৈরি করা; যা সৃষ্টির সাথে সম্পর্কিত। সৃষ্ট ব্যাপার না থাকলে কোনো লেখাই সাহিত্য পদবাচ্য হতে পারে না। যে মানসিক প্রক্রিয়ায় কোনো বিশেষ অনুভব বা ঘটনা সৃজন প্রক্রিয়ায় যুক্ত হয়ে সাহিত্য হয়ে উঠে, তা সম্পূর্ণ অভ্যন্তরীণ। এ মানসিক প্রক্রিয়ায় অন্তরের সাথে বাহিরের সংযোগ ঘটায় পঞ্চইন্দ্রিয় রূপী পঞ্চ জানালা। মানুষের চিন্তা, চেতনা, আবেগ, অনুভব ও কৌতুহলকে যা স্পর্শ করে তার সবই সাহিত্যের অনুষঙ্গ। এসব অনুষঙ্গ যেমন সাহিত্যের উপজীব্য, তেমনি এসবকে জাগিয়ে তোলা বা এসবের বিস্তৃতিও সাহিত্যের কাজ। এক্ষেত্রে মুখ্য ভূমিকা পালন করেন লেখক। এজন্য একজন লেখককের পর্যাপ্ত স্বাধীনতা ও সময় চাই। এ প্রসঙ্গে কথাসাহিত্যিক সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়ের একটা মন্তব্য প্রণিধানযোগ্য। তিনি বলেন, ‘সাহিত্য রচনা আসলে চব্বিশ ঘণ্টার কাজ- একজন লেখক দিনের পর দিন বা মাসের পর মাস এক লাইনও না লিখলেও তিনি আসলে সর্বক্ষণই সাহিত্য নিয়েই ব্যাপৃত থাকেন। তার গতিবিধি ও ব্যবহারিক স্বাধীনতা অত্যন্ত জরুরি।’ কবি সৈয়দ শামসুল হকের মতে, ‘একজন লেখককে জ্ঞাত নিয়ম জেনে নিতে হয় বটে; কিন্তু তিনি নিজেও কিছু নতুন নিয়ম নির্মাণ করতে পারেন। আর যেহেতু তিনি নিজেই কিছু নতুন নিয়ম নির্মাণ করতে সক্ষম- তার কাজের প্রকৃতিই তাই। অতএব একজন লেখককে সেই সব অবস্থার ভেতর দিয়ে যেতে হয় বা তাকে যেতে দিতে হয়, যেখানে তিনি কখনো ভুলপথে চলেছেন, কখনো আঁধারে হাঁটছেন, কখনোবা মেঘহীন পূর্ণিমায়।’ আসলে মানুষের সবচেয়ে বড় পরিচয় হলো- সে ভাবতে পারে, করতে পারে চিন্তা। এ চিন্তা আবার হতে পারে অনুভূতিজাত বা বিষয়জাত। তবে যে চিন্তা গতানুগতিকতার বাইরে অন্য রকমের শৈলী নিয়ে স্বয়ং প্রকাশিত হয়, তাই সাহিত্য। সহিত্যের ক্ষেত্রে নির্দিষ্টরূপে বিন্যাস বা নির্মাণের প্রয়োজন রয়েছে, অভিজ্ঞতাকে সেখানে সাবলীলভাবে মিশিয়ে দিতে হয়। অভিজ্ঞতার উত্তাপটুকু না হলে লেখা নিষ্পাণ আর সংবেদন সৃষ্টিতে ব্যর্থ হয়। লেখকের ব্যক্তিগত অনুভূতিজাত সাহিত্যকে ঝঁনলবপঃরাব খরঃবৎধঃঁৎব এবং বস্তুসত্তার প্রাধান্যজাত সাহিত্যকে ঙনলবপঃরাব খরঃবৎধঃঁৎব বলা হয়। তবে নিছক বস্তুনিষ্ট সাহিত্য (জবধষরংঃরপ খরঃবৎধঃঁৎব) ছাড়া সব সাহিত্যই অনুভূতিজাত।
আত্মপ্রকাশের আকাক্সক্ষা ও সৌন্দর্য সৃষ্টির স্বপ্রণোদিত তাগাদা থেকে লেখক সাহিত্য সৃষ্টির প্রেরণা পান। সাহিত্যে লেখক নিজের কথা, পরের কথা বা বস্তু পৃথিবীর কথা শিল্পসম্মতভাবে প্রকাশ করেন। এখানে লেখক বা সাহিত্যিকের মন ও বিষয়বস্তুর প্রকাশ ভঙ্গি বেশ গুরুত্বপূর্ণ। তিনি চাইলে বস্তুপৃথিবী থেকে পরাপৃথিবী, সমকাল থেকে প্রাগৈতিহাসিক, চেতন থেকে অবচেতন- যেখানে খুশি যেভাবে খুশি পরিভ্রমণ করতে পারেন। সাহিত্যে একজন লেখক সবকিছুকে নিজের ভাবনা কেন্দ্রে নিয়ে এসে, তাকে দ্বিগুণ পরিশীলিত করে উগড়ে দেন। লেখক জীবনের লক্ষ্য হওয়া উচিত নিজের মতো হওয়া, স্বতন্ত্র হওয়া এবং মৌলিক হওয়া; যাতে লেখার ভেতর দিয়ে জীবন-জগৎ পরিভ্রমণ করা যায়। কারণ জীবন থেকেই সাহিত্যের উজ্জীবন, জীবন বিচ্ছিন্ন হলে সাহিত্যে চলে না।
সাহিত্যের সহস্রধারা। বিভিন্ন ও বিচিত্র দিকে ছড়িয়ে রয়েছে তার চৌহদ্দি। তবে সাহিত্য দু’ধরনের- জ্ঞানের সাহিত্য ও ভাবের সাহিত্য। জ্ঞানের সাহিত্য মানুষের বুদ্ধিকে জাগ্রত করে, যুগের কথা বলে। আর ভাবের সাহিত্য মানুষের আবেগ- অনুভূতির কথা বলে। জ্ঞানের সাহিত্যে জ্ঞানের বিস্তৃতির সাথে সাথে পূর্বেরটা মূল্যহীন হয়ে পড়ে। নতুন করে সংশোধনের প্রয়োজন পড়ে। কারণ এ জ্ঞান ফলিত বিজ্ঞানের অংশ। ফলিত সাহিত্য আশ্রয় গ্রহণ করে বিজ্ঞানের ওপর। বিজ্ঞান মেতে থাকে নিত্য-নতুন সৃষ্টি নিয়ে। আজ যা নতুন, কাল অন্য কোনো নতুন সৃষ্টির বৈভবে তা হয়ে যায় পুরানো। তবে ভাবের সাহিত্য চিরকালীন; সব সময়ের সাহিত্য। সাহিত্যে শুধু আঙ্গিক চর্চাই হচ্ছে না, চিন্তার চর্চাও হচ্ছে। সাহিত্য আজ বহুধা বিস্তৃত। সমাজের আদি রূপ অবিকৃত নেই কোথাও, ক্রমাগত রদবদল হচ্ছে। পরিবর্তনের প্রবহমানতায় চিন্তন প্রক্রিয়া এবং সৃজনশীলতায়ও পরিবর্তন ঘটছে- অন্তরঙ্গে যেমন বহিরঙ্গেও। এর ঢেউ এসে লাগছে সাহিত্যেও। জাগতিক পরিবর্তনের অভিসংঘাতে এবং নিজের প্রয়োজনে সাহিত্যে রূপান্তর ঘটছে নিরন্তর। ফলত নানা বাঁক পরিবর্তনে সাহিত্যের ভাষা, বিষয়, আঙ্গিক, প্রকরণ, ভঙ্গি ঘষে মেজে আজ অনেক বৈভবপূর্ণ, পরিশীলিত। ফলত সময়ের সাথে এগিয়ে চলা সাহিত্য আমাদেরও এগিয়ে নিচ্ছে। রসকষহীন গতানুগতিক সাহিত্য আজ অপাঙ্ক্তেয়। সাহিত্য আজ যেমন দেশানুগ, তেমনি এতে আছে বিশ্ব চেতনার স্ফূরণ। সাহিত্যে আলোর ঝলকানি বা আলোর নাচন থাকা চাই, তা গদ্য, কবিতা, প্রবন্ধ, রম্যরচনা, গল্প, উপন্যাস, নাটক- যা-ই হোক না কেন। প্রাকৃতিক আলোর সাথে চৈতন্যের জ্যোর্তিময় আলোর যুগলবন্দিতা ও মিথস্ক্রিয়ায় এ নাচন দোলা দেয়। যে কোনো মূল্যবান লেখা নির্দিষ্ট অন্তর্দৃষ্টি থেকে আসে, তা একান্তই লেখকের নিজস্ব চেতনাপ্রসূত। লেখা ছাড়া অন্য কোনো উপায়ে তা জানানো যায় না বলেই লেখক লেখালেখির সাহিত্যের দ্বারস্থ হন। লেখক নিজের ভেতরের তাড়নায় যে সাহিত্য সৃষ্টি করে থাকেন, তার সর্বজনীন আবেদন পাঠক হৃদয়ে অবশ্যই পৌঁছাতে হয়। লেখক-পাঠক সম্পর্কের বিষয়টি সাহিত্য সৃষ্টির শুরু থেকেই স্বীকৃত; তাই বলে কেবলমাত্র পাঠকের দিকে দৃষ্টি রেখে সাহিত্য সৃষ্টিও বাঞ্ছনীয় নয়। আবার সাহিত্যে যদি সত্যের কতকটা তীর্যক কিন্তু অন্তর্গূঢ় না থাকে, তবে তা মহৎ সাহিত্যের পর্যায়ে পড়ে না। সাহিত্যের প্রতিটি ধারাই কোনো না কোনোভাবে এক ধরনের স্বতঃসিদ্ধ ব্যাপার। আসলে সৃজন-মননের মিথস্ক্রিয়া তথা আলোর নাচন থাকলে একটা লেখা অতি অবশ্যই সাহিত্য হয়ে উঠবে, যা সর্বজনগ্রাহ্য। পাঠকের কথা লেখক চিন্তা করুন বা না করুন- পাঠক তা লুফে নেবেই।
গদ্যের সংসার
সাহিত্যের নানা আঙ্গিকের মধ্যে গদ্যও একটা আঙ্গিক। গদ্যের সংসারে প্রবন্ধ হলো সাহিত্যের এক বিশাল ও অবিচ্ছেদ মাধ্যম, যার সাহায্যে সাহিত্যের অন্য শাখাগুলোর মূল্যায়ন করা যায়। প্রবন্ধ শব্দের বুৎপত্তিগত অর্থ হলো ‘প্রকৃষ্ট বন্ধন’। লেখক যখন তার লিখিত বিষয় বা বক্তব্যে পূর্বাপর সঙ্গতিসম্পন্ন যুক্তিতর্ক, বিশ্লেষণ, তথ্য-প্রমাণের মাধ্যমে চিন্তায়, ভাবে, ভাষায় ধারাবাহিকভাবে সুসঙ্গত সিদ্ধান্তে উপনীত হন, তখন তা প্রবন্ধ হিসেবে বিবেচিত হয়। নিবন্ধ, সন্দর্ভ, রচনা প্রভৃতি প্রতিশব্দও প্রবন্ধ অর্থে ব্যবহৃত হয়। প্রবন্ধ হলো ভাব ও ভাষার প্রকৃষ্ট বন্ধন। প্রবন্ধ দুধরনের হয়ে থাকে- ১. বস্তুনিষ্ঠ বা তন্ময় (ঙনলবপঃরাব) ও ২. আত্মগত বা মন্ময় (ঝঁনলবপঃরাব) প্রবন্ধ। বস্তুনিষ্ঠ প্রবন্ধ চিন্তাপ্রধান। এতে প্রবন্ধকার বিষয়বস্তুর প্রাধান্য স্বীকার করে তার চিন্তা শক্তি, পাণ্ডিত্য, মননশীলতা প্রয়োগ করে তথ্য-তত্ত্বের আলোকে উপসংহারে পৌঁছান। আত্মগত বা ব্যক্তিগত প্রবন্ধ ভাবপ্রধান। এতে লেখকের হৃদয়ানুভূতি, ব্যক্তিগত চিন্তা-ভাবনা মুখ্য ভূমিকা পালন করে। প্রবন্ধে বা গদ্যে বিষয়বস্তুই মুখ্য। কিন্তু বিষয়মাত্রই চিরপুরাতন ও সীমাবদ্ধ। একে চলিষ্ণু ও প্রাণবন্ত করে প্রকাশ করতে হয়। এক্ষেত্রে লেখকের অনন্য সাধারণ চিন্তাশীলতা তথা পাণ্ডিত্য, বুদ্ধির প্রখরতা ও জ্ঞানের বিস্তৃতি গদ্য বা প্রবন্ধকে করে শানিত। বস্তুনিষ্ট প্রবন্ধে বিষয়বস্তু সাধারণত গুরুগম্ভীর, তত্ত্ব-তথ্যে ভরা আর ব্যক্তিগত প্রবন্ধে বিষয়বস্তু লেখকের অনুভূতি রসে সিক্ত হয়ে থাকে। প্রবন্ধে বক্তব্যটাই প্রধান এবং তা পাওয়া যায় উপসংহারে। তবে এতে শুরুর এবং মধ্যবর্তী অংশও গুরুত্বপূর্ণ; সবচেয়ে মূল্যবান শেষের অংশ। এই শেষের অংশ বা উপসংহার যে কেবল রচনার সমাপ্তি ঘোষণা করে তা কিন্তু নয়। উপসংহার প্রবন্ধের প্রতিপাদ্য বিষয়ও জানিয়ে দেয়। প্রবন্ধ সাধারণত আকৃতির দিক দিয়ে সংক্ষিপ্ত হয়ে থাকে, তবে বিষয়বস্তুর ব্যাপকতায় তা দীর্ঘও হতে পারে। প্রবন্ধ যেহেতু বুদ্ধিবৃত্তিক মননশীল গদ্যরীতির সাহিত্য, তাই তা হতে হয় হৃদয়গ্রাহী, যুক্তিগ্রাহ্য ও সর্বজনগ্রাহ্য। এতে লেখকের দার্শনিক অবস্থানও জানান দিতে হয়।
বাংলা সাহিত্যে প্রবন্ধের সংযোজন অপেক্ষাকৃত আধুনিক কালে। উনবিংশ শতকের পূর্বে বাংলা সাহিত্য ছিল পদ্যআচ্ছন্ন। পূর্বে কিছু কিছু সরকারি চিঠিপত্র, দলিল-দস্তাবেজে, কড়চা লিখা হতো মাত্র গদ্যে। এভাবে এই উপমহাদেশে শুরুতে রাষ্ট্রীয় কার্যাদি সম্পন্ন করার জন্য গদ্য ভাষা ব্যবহৃত হলেও পরে তা বহুমাত্রিকতা লাভ করে। একসময় পর্তুগিজ পাদ্রি ও খ্রিস্টান মিশনারির হাত ধরে ধর্ম প্রচার এবং পরে শাসকদের প্রশাসন পরিচালনার সুবিধার্থে যে গদ্যের আমাদের ভাষার সংসারে অনাহূত প্রবেশ ঘটেছিলো, তা আজ সময়ের প্রয়োজনে খোলস পাল্টিয়ে নব পুষ্প-পল্লবে নবরূপে বিকশিত। শুরুতে রাষ্ট্রীয় কার্যাদি সম্পন্ন করার জন্য গদ্য ভাষা ব্যবহৃত হলেও পরে তা বহুমাত্রিকতা লাভ করে। ইংরেজদের নিজেদের গরজে তৈরি গদ্যকে আজ আমরা নিজেদের মতো করে নিয়েছি। নানা মনীষীর কলম ছুঁয়ে গদ্য আজ মার্জিত, নিজস্ব স্বর চিহ্নিত। সাধু গদ্যের সাথে তৈরি হলো চলিত গদ্য। তৈরি হলো লেখকদের নিজস্ব কণ্ঠস্বর, ভাষাভঙ্গি, ভাষাশৈলীও। লেখকদের এই স্বকীয় গদ্যভঙ্গিই চিনিয়ে দেয় লেখককে। গদ্য বা প্রবন্ধ এখন রসকষহীন বিষয় নয়। এতে এখন গতি বা প্রবহমানতা আছে, আছে দেহে লাবণ্যের মতো অন্তলগ্ন ছন্দ, আছে সমুদ্রের ঢেউয়ের মতো তরঙ্গের নাচন, বিষয়ের ধারাবাহিকতার কূল পর্যন্ত এসে উপচে পড়া, দৃষ্টিভঙ্গির স্বচ্ছতা। গদ্যের গতি বা প্রবহমানতাসমৃদ্ধ ছন্দ একেক লেখকের হাতে একেক রকমভাবে উদ্ভাসিত হয়। নিজস্ব তাড়নায় তারা নিজেরাই নির্মাণ করে নেন তাদের নিজস্ব ছন্দ। গদ্য স্রেফ কোনো কাহিনীনির্মাণ নয়; এটা আসলে ভাব, চিন্তা ও রসের এক ব্যঞ্জনাময় ও শিল্পিত প্রকাশ। এক্ষেত্রে একজন গদ্যকার বা প্রবন্ধকারকে যথেষ্ট সর্তকতার সাথে এগুতে হয়, সীমানাচ্যুত হলে তা আর বিশুদ্ধ থাকে না। তবে এতে তুলনামূলকভাবে সৃজনশীলতার চাইতে স্বাধীনতা বেশি। এতে নিজের চিন্তা ও উপলব্ধির কথা বলা যায়। অভিজ্ঞতার ব্যবহার চলে, মানটাও থাকে নিজস্ব।
গদ্যের সংসারে প্রবন্ধের বাইরে সমালোচনা সাহিত্য, আত্মজীবনী, ভ্রমণ গদ্য, রম্য রচনা, নাটক, ভাষণ-প্রহসন ইত্যাদি অনেক সাহিত্যের প্রকরণও একীভূত। (ক) আত্মজীবনী- গদ্য সাহিত্যের সংসারে আত্মজীবনী একটি গুরুত্বপূর্ণ বিষয়। এখনে লেখকই মুখ্য। লেখককে নিয়েই আবর্তিত হয় পুরো বিষয়। তিনি এ ধরনের লেখায় বর্ণনার চমক সৃষ্টির মাধ্যমে নিজেকে পরিভ্রমণ করান। এক্ষেত্রে লেখকের জীবনের অংশ বিশেষ উপস্থাপনায় মুন্সিয়ানার উপরই এর গ্রহণযোগ্যতা নির্ভর করে। (খ) ভ্রমণ গদ্য- ভ্রমণ গদ্য চরিত্র, সংলাপ ও পরিবেশ বর্ণনার মাধ্যমে গড়ে ওঠে। এতে চরিত্রগুলো বাস্তব। লেখকের পরিবেশ বর্ণনায় বাস্তবতার ছোঁয়া থাকতে হয় বেশি, যাতে ভ্রমণ গদ্য হয়ে উঠে ইতিহাসের দলিল। (গ) রম্যরচনা- রম্যরচনা হাস্যরসাত্মক সাহিত্য। মূলত হাস্যরসাত্মক গদ্য সাহিত্যেই রম্যরচনা হিসেবে বিবেচিত। তবে রম্য কবিতা, রম্য প্রবন্ধ, রম্য কাহিনীও লেখা যেতে পারে। এসব ক্ষেত্রে হাস্যরস সৃষ্টি করাই মুখ্য বিষয়। (ঘ) নাটক- নাটক সাহিত্যের একটি গুরুত্বপূর্ণ শাখা। এটাকে দুরূহ সাহিত্য শিল্প বললেও অত্যুক্তি হবে না। কারণ এতে নাচ, গান, বাদ্যযন্ত্র, অভিনয়, অঙ্গসজ্জা দৃশ্যপট, শব্দ সংযোজন, আলোক প্রক্ষেপণ ইত্যাদির একটা সমন্বিত রূপ খাড়া করতে হয়। নাটকে দৃশ্য রীতিতে অভিনয়ের মাধ্যমে ঘটনা পরম্পরা সংলাপ আকারে উপস্থাপিত হয়। এতে দেখা ও শোনা দুটিই গুরুত্ববহ। নাটকে কাহিনী, চরিত্র, সংলাপ, ভাবনা, দৃশ্য (সাজসজ্জা) ও গান/নাচ ইত্যাদি উপাদান থাকে; মূলত এগুলোর ওপরই নাট্য রসের সার্থক স্ফূরণ ঘটে। নাটক বাণিজ্যিক ভিত্তিতে জনপ্রিয় এবং মঞ্চসফল হলেই কেবল এর সাহিত্যমূল্য রয়েছে- তা মনে করার কোনো কারণ নেই। নাটক কেবল নাট্যমঞ্চের জন্য- এ ধারণাও ভুল। সার্থক নাটকের কিছু মানদণ্ড রয়েছে। সেখানে চরিত্র চিত্রন, ঘটনার বিন্যাস ও জীবন সত্যের উপস্থিতিকে বিশ্বাসযোগ্যভাবে উপস্থাপন করতে হয়। নাটকে শিল্পোকর্ষ থাকলে তা পাঠের মাধ্যমে রস আহরণ করা যায়। শেক্সপিয়ার, ইবসেন, বার্ণাড’শর নাটক আমরা পড়ে মুগ্ধ হই। আবার এ ধরনের সাহিত্য মানসম্পন্ন নাটক মঞ্চ সফলও হয়। এক্ষেত্রে লেখকের দৃষ্টিভঙ্গি নাটক রচনায় গুরুত্বপূর্ণ অনুষঙ্গ।
পদ্য বা কবিতা
সহিত্যে গদ্যেরও আগে পদ্য বা কবিতার অধিষ্ঠান। পৃথিবীতে এ পর্যন্ত যত পুরাতন দলিল-দস্তাবেজ পাওয়া গেছে, তার প্রায় সবকিছুই কাব্যিক ঢঙে লিখিত। পৃথিবীর প্রাচীনতম মহাকাব্য গিলগামেশ কবিতার ফর্মে রচিত। পৃথিবীর প্রথম মহিলা কবি মেসোপটোমিয়ার এনহেদুয়ান্নার সাঁইত্রিশ প্রস্তরখণ্ডে লিখিত কবিতা আজো মানুষকে ভাবায়। যখন সাহিত্যের লিখিতরূপ আবিষ্কৃত হয়নি, তখন মানুষ মুখে মুখে সাহিত্য চর্চা করতো, তার ভঙ্গিও ছিল কাব্যিক। বাংলা সাহিত্যের প্রাচীনতম নিদর্শন ‘চর্যাপদ’ পদ্যে বা কবিতায় রচিত। কবিতা এক বৈচিত্র্যময় শিল্প মাধ্যম, যা প্রাচীনতম এবং খেয়ালি। রবীন্দ্রনাথের কথায়, ‘কবিতা বুনো পাখি, তাকে আয় আয় বলে ডাকলে ধরা দেয় না’। কবিতা নানা ধরনের হতে পারে। তা যেমন মন্ময় বা আত্মগত ভাবানুভূতি প্রধান, তেমনি তন্ময় বা নৈব্যক্তিক বস্তুনিষ্টও হতে পারে। তবে আধুনিক সাহিত্যবোদ্ধারা কবিতার শ্রেণিকরণে বিষয়বস্তু কিংবা রীতিনির্ভর, আকার কিংবা আয়তননির্ভর, উদ্দেশ্য কিংবা ছন্দবৈশিষ্ট্য নির্ভর প্রক্রিয়াকে গুরুত্ব দিয়ে থাকেন।
কবিতা হলো চেতনার অধিক্ষেপ। কবিতা হলো অসীম বিস্ময়, যার জন্মকালে কবি আচ্ছন্ন থাকেন, উত্তেজনায় কাঁপেন। নিজের মাাঝে জেগে ওঠা পঙ্ক্তি আপন মনে বার বার আওড়ান। একজন কবির মনের গহিনে কখন কবিতা এসে ধরা দেয়, তা বলা মুশকিল। কারণ কবিতা বাক্যের কাব্যিক প্রকাশ, যা বিমূর্ত অভিজ্ঞতা আর কল্পনায় ধমনীতে মিশে অধিবিদ্যায় রক্ত সঞ্চালন ঘটায়। আসলে কবির অবচেতন মনে কবিতার সৃজন হয় অনেকটা সহজাত প্রণোদনা, অনুভূতি প্রকাশের কাব্যিক চাপ বা ইচ্ছা থেকে। এতে কবিতার ডালপালা কবির হৃদয় উৎসারিত ভাষার ব্যঞ্জনায় আবেগ-আশ্রিত হয়ে অনেকটা স্বয়ংক্রিয়ভাবেই কবির আরোপিত ছন্দ, বিন্যাস, কাব্যভাষা, শব্দচয়ন কিংবা উপমায় ভর করে বহুগামী হয়, যেতে চায় বহুদূর। কাব্য সৌন্দর্য নির্ভর করে কবিতার ভাব-ঐশ্বর্যের প্রায়োগিক কলা-কৌশলের ওপর। উপমা-উৎপ্রেক্ষা-কল্পচিত্র-চিত্রকল্পের অভিনবত্ব ও উপস্থাপনার নিপুণতায় কবিতা প্রাণবন্ত হয়ে উঠে। একজন প্রকৃত কবি সর্বদা শব্দের সাথে বসত করেন, শুনেন শব্দের পারস্পরিক কথোপকথন। শব্দের ভিতর দিয়ে কবি নিজেও কথা বলেন। শব্দের নিজস্ব ভর, গতি ও আপাতসংশ্লেষ প্রবণতা থাকে। এই প্রবণতা এক এক মানসিক পর্যায় ও সময় পরিবেশে এক এক পরিণতি পায়। তাই বলে কবিতা শুধু শব্দের ইমারত নয়। শব্দের শরীরে সংকেত ও নতুন বিভা কিংবা কবিতায় দ্যুতিময় শব্দের ব্যবহার হলেও কবিতা হয়ে ওঠার পর শব্দকে আর দেখা যায় না, শোনাও যায় না। শব্দ তখন কবিতায় বিলীন হয়ে বিমূর্তায়িত হয়ে যায়। অন্যদিকে প্রকরণ চাতুর্যও কবিতা নয়। মনে রাখতে হবে, কবিতায় এখন আর কোনো একক ছত্রের গুরুত্ব নেই, একক শব্দেরও নয়; প্রত্যেকটি পঙ্ক্তি ও শব্দ সমান গুরুত্ববহ।
কবিতার কাজ নিঃশব্দে, অগোচরে, সংগোপনে কিন্তু স-মানসেই চলে। অমিয় চক্রবর্তীর কথায়, মনোনায়কই কবিতাকে লিখিয়ে নেয়। কবিতা হলো এমন এক শিল্প বা সৃষ্টি, যা ক্রমব্যস্ত পৃথিবীতে নিয়ত নিজেকে বদলায় নিজস্ব ভাষা ও ভঙ্গিতে। শিল্প বা সৃষ্টি মাত্রই অপূর্ণ। এজন্য প্রতিভাবান কবিদের কোন আত্মতুষ্টি নেই। নিরন্তর নিজের মধ্যে ভাঙচুর চালান। কবিতায় যখন কোন শব্দ ব্যবহৃত হয়, মনে রাখতে হয় আসলে ওটি পুরানো; কিন্তু কবির কাজ হচ্ছে এতে নতুন অর্থের দ্যোতনা সৃষ্টি করা, সাধারণ শব্দকে অসাধারণ বা বিশেষ করা। আগেকার সরল কবিতায় এখন মানুষের আগ্রহ ও আকর্ষণ কম। এখনকার কবিতাকে হতে হয় রহস্যময়, দ্যুতিময়, ইশারার আর কিছুটা খেয়ালি। চেনা চেনা অথচ অচেনা। কবি কিছুটা বলেন, বাকিটা পাঠক নিজের মতো করে বুঝে নেন। ড. আলাউদ্দিন আল আজাদ কবিতার ভাষা সম্পর্কে বলেন, ‘কিন্তু যখন কবিতা লিখতে বসব, তখন তার হতে হবে অন্যরূপ; সেখানে দেখব তাকে অবগুণ্ঠনবতী, রহস্যময়ী, চতুরা সেখানেও সে কথা বলবে, বরং আরো অনেক বেশি করে বলবে, কিন্তু মুখরা হয়ে নয়, বলবে আধো আলো আধো ছায়ায় বসে আভাসে, ইঙ্গিতে, ইশারায়।’ কবিতার ভাষা গোপনও করা যায়। কারণ কবিতা অপ্রকাশেরও ভার নেয়। তাই বলে কবিতা হালকা চটুল হলে চলবে না; তাতে থাকতে হবে ভরকেন্দ্র, সমুদ্রের গভীরতা, যাতে পাঠক সাগর সেঁচে মুক্তো আনার মতো তা থেকে নির্যাস গ্রহণ করতে পারে। আসলে উৎকৃষ্ট কবিতা আবেদন, অভিনবত্ব ও সৌন্দর্যে বহুমাত্রিকতা ও বহুরৈখিকতাকে ধারণ করে। ফলে একই কবিতা পাঠভেদে ভিন্নার্থ নিয়ে উন্মোচিত হয়। কবিতা আসলে শেষ পর্যন্ত একটা শিল্প। শিল্পের কারুকাজ ও চমকে বিষয়হীনতার নির্মাণ ও স্তব্ধতার অনুবাদ এক ধরনের কবিতা। কবিতার ভাষাবিদ্ধ যা কিছু নির্মাণ, সে তো একজন কবির নিজস্ব দুর্বোধ্যতাকে স্পর্শ করার জন্যই! কিছু না থাকাটাও তো এক ধরনের থাকার সংকেত।
কবিতার রয়েছে যাদুকরী শক্তি। এ সম্পর্কে ২০১৭ সালে ‘অক্সফোর্ড একাডেমিক জার্নাল’-এ প্রকাশিত এক প্রতিবেদনে বলা হয়, ‘কবিতার রয়েছে মারাত্মক যাদুকরী শক্তি’। জার্মানির বার্লিন ফ্রি বিশ্ববিদ্যালয়ে করা এ গবেষণায় গবেষকরা শ্রোতাদের কবিতা শোনার সময় তাদের ত্বকের সংকোচন ও প্রসারণ, হৃৎস্পন্দন, মুখের পেশির নড়াচড়া- রীতিমতো যন্ত্র বসিয়ে পর্যবেক্ষণ করে সিদ্ধান্তে উপনীত হন যে, প্রকৃত কবিতা শুনলে গা শিউরে ওঠে। ত্বকে কাঁটা দেয়, লোম খাড়া হয়ে যায়। কবিতা পড়ার সময়ও মস্তিষ্কে অনুরণন হয় তীব্র। জার্মানির ম্যাক্স প্লান্ক ইনস্টিটিউট ফর ইম্পেরিয়ালের একদল গবেষক জানিয়েছেন আরো চমকপ্রদ তথ্য। তাদের মতে, ‘কবিতা মানুষকে সবচেয়ে বেশি উদ্দীপ্ত করে। সক্রিয় হয় মস্তিষ্কের ডানপাশ, যা মানুষের স্মৃতি শক্তি জাগিয়ে দেয়।’ (দৈনিক প্রথম আলো- ১৫ অক্টোবর ২০২১, পৃষ্ঠা-১১)। সাহিত্য সমালোচক স্টেফেন বার্ড কবিতার গভীরে প্রবেশ করেন বলেই উচ্চকিত কণ্ঠে বলেছেন, ‘কবিতা আমায় বেঁচে থাকতে সাহায্য করে’। কবি জীবনানন্দ দাশ মনে করেন, কোনো একটি অনশ্বর কবিতা প্রচুর অভিজ্ঞতা দাবি করে পাঠকের কাছে। খারাপ কবিতা থেকে ভালো কবিতা বেছে নেয়ার কুশলতা, কবিতার জাতি ও স্তর নির্ণয় করার ক্ষমতা সকলের এক থাকে না। তাই তার পরামর্শ, দেশ সময়ের যত বেশি সম্ভব শ্রেষ্ঠ সব কবিতা পড়া দরকার- ক্রমেই বেশি বোধ লাভ করতে হলে। সৈয়দ শামসুল হক মনে করেন, কবি জীবনানন্দের এ পরামর্শ কেবল পাঠকের জন্য নয়, তারও আগে- কবিতা যারা লিখতে চায় তাদেরই জন্য প্রযোজ্য। (মার্জিনে মন্তব্য- সৈয়দ শামসুল হক, অন্যপ্রকাশ, ঢাকা, চতুর্থ মুদ্রণ ২০২০, পৃষ্ঠা-২১৪)।
কবিতায় কাব্যরস থাকা চাই। কাব্যরস তা-ই, যা কবিতার শরীরে পাঠক বা আলোচকের মনঃদৃষ্টি আবদ্ধ রাখে। কবিতা বাস্তবের প্রতিচ্ছবি, কিন্তু অনিবার্যভাবে তা শৈল্পিক। এই শৈল্পিকতায় ঋদ্ধ বাংলা কবিতা আজ অন্তর্লোকের অদ্ভুত এক মায়াবী জগতে পা রেখেছে। আজকাল কবিতায় বেশ পরিবর্তন এসেছে। উপমা-উৎপ্রেক্ষা-অনুপ্রাস-যমক-শ্লেষ-রুপকের বনেদি কাঠামোতেও ছোঁয়া লেগেছে নতুন ভাবনা, উপলব্ধি ও দৃষ্টিভঙ্গির। আজকাল কবিতার বিষয়, আঙ্গিক, ভঙ্গি, অন্তর্বয়ন, খাপ খাইয়ে নেয়ার ক্ষমতা, আত্ম-নবায়নের ঐশ্বর্য হাতে হাত ধরে চলে। কবিতা আজ প্রচলিত ডিকশন ভেঙে নতুন টেক্সট তৈরি করার ক্ষমতায় ক্ষমতায়িত। জীবনের নেতিবাচক ও প্রথাগতভাবে অসুন্দর দিকগুলোও আজ কবিতার হাতিয়ার। এগুলো পুরনো হতে চায় না, হারায় না তার আকর্ষণ ক্ষমতা। বরং সৃষ্টি করে অভিনব আবেদন, অনিঃশেষ সম্মোহন। অতীন্দ্রিয় অনুভূতির এই স্বপ্নাতুর তন্ময়তা আচ্ছন্ন প্রাণরসে ভরা এমন কাব্যভাষা এর আগে বাংলা কবিতার ইতিহাসে খুব কমই দেখা গেছে। শব্দের অঙ্গার থেকে স্ফূলিঙ্গের মতো বেরিয়ে আসছে এ কাব্য ভাষা। কবিতার সাথে যারা গেরস্তালি করেন, তারা এগুলো সাথে নিয়েই কবিতায় আলোর নাচন তোলেন।
ছোট গল্প
সাহিত্যে আদিকাল থেকেই গল্পের প্রচলন ছিল। তবে তা ছিল কথনের আদলে। লেখকরা নকশা জাতীয় কাহিনী বলতেন। সমাজের নানা অসঙ্গতির প্রতি ব্যঙ্গ- বিদ্রুপ থাকতো এতে। এসব ছিলো মূলত উপকথা, কেচ্ছা-কাহিনী। এরপর অনেক ধাপ পেরিয়ে আসে ছোটগল্প। লিখন পদ্ধতি আবিষ্কারের পর সংক্ষিপ্ত পরিসরে কাহিনী উপস্থাপনের চিন্তা থেকে এর উদ্ভব। আধুনিককালে ছোটগল্প একটি উন্নত শিল্প-সাহিত্য হিসেবে এর ঐশ্বর্যময় আত্মসমৃদ্ধি ও দেহ সৌষ্ঠব নিয়ে সুপ্রতিষ্ঠিত। আধুনিক গল্পে প্রধান হয়ে ওঠে জীবনবোধ, জীবনের সাথে শিল্পযোগ, যদিও চরিত্রের ক্রিয়াকলাপ ও ভাবনা-চিন্তা বিন্যাসের অপর নাম গল্প। সত্যিকার ছোটগল্পকার অনেকটা কবির মতো। মানুষ, প্রকৃতি, পরিবেশের টানাপোড়েন, ঘটনা-দুর্ঘটনা, স্মৃতি-বিস্মৃতির অনুষঙ্গ থেকে তার সৃষ্টিশীল মনে জেগে উঠে গল্পবীজ। ছোটগল্প লেখার জন্য চাই বিশেষ মন ও মনোযোগ। এখানে গল্পের সূত্রগুলো নিজের ভেতরে তৈরি হতে হবে। তিনটি বিষয়ে নিজের স্বকীয়তা থাকলে একটা গল্প সত্যিকার গল্পে পরিণত হয়। (১) গল্পের গল্পত্ব- গল্পের ভেতর টান টান একটা গল্প থাকতে হয়, যার কারণে পাঠক মূল গল্পটি একটানা পড়তে বাধ্য হন। ছেড়ে উঠতে মন চাইবে না। (২) বর্ণনা ভঙ্গি- গল্পের বর্ণনা ভঙ্গি এমন নিজস্বতায় সিক্ত হতে হয়, যাতে গল্পটি পড়া শেষ করলেও শেষ না হয়। গল্পের নানা ব্যঞ্জনা, নানা দ্যোতনার রেশ পাঠককে তাড়িয়ে বেড়ায়। (৩) ভাষা- গল্পের ভাষায় কোনো শিথিলতা না থাকা চাই। সহজতা থাকলেও ভাষা হতে হবে চলিষ্ণু, যাতে আখ্যানটি পাঠকের প্রত্যাশার চাইতেও বেশি অথবা সমান্তরাল হয়। গল্প লিখার সময় গল্পকারদের মনে রাখতে হয় যে, গল্পটা তার ভেতরেই আছে, তার কাজ তাকে বের করে আনা। এই বের করে আনাটাই গল্পের স্বতঃস্ফূর্ততা। এছাড়া সৃজনশীল সাহিত্যের জন্য সংশ্লেষ শক্তি প্রয়োজন।
ছোটগল্প শুধু খণ্ডকালীন জীবনের অভিব্যক্তি নিয়েই হয় না; খণ্ড ঘটনাংশকে সমগ্র জীবনের ব্যঞ্জনায় রূপায়িত করার মধ্যেই ছোটগল্পের সার্থকতা। ছোটগল্পের কাঠামো হলো প্লট বা ঘটনাক্রম, যা পর পর ঘটে যাওয়া অনেকগুলো ছোট ছোট পরস্পর সম্পর্কিত ঘটনা বা চিন্তাপ্রবাহ নিয়ে এগিয়ে যায়। এগুলো এলোমেলো বা ক্রমানুসারে না ঘটলেও গল্পে এগুলোকে সাজিয়ে ঘটনা-শৃঙ্খল বা যুক্তি-শৃঙ্খলা তৈরি করতে হয়, যাতে গল্পের প্রতিটি মুহূর্ত নতুন নতুন উত্তেজনা বা চিন্তা প্রবাহ তৈরি বা প্রশমনে ভরপুর থাকে। এগুলো গল্পের প্রধান চরিত্রকে কেন্দ্র করে গল্পের দাবি বা প্রয়োজনকে সামনে রেখে আবর্তিত হয়। গল্পে পারিপার্শ্বিক অবস্থা, পটভূমি ও স্থান-কালের উল্লেখও গুরুত্বপূর্ণ অনুষঙ্গ। তবে তা খুব দীর্ঘ বা বিস্তারিত না হওয়াই উত্তম।
একজন কথাশিল্পীর সত্যিকার শক্তিমত্তা বোঝা যায় ছোটগল্পে। কল্পনা ও চিন্তার সংহত প্রকাশ ঘটে এতে। ছোটগল্প হচ্ছে সিন্ধুর মাঝে বিন্দু। শেষ হয়েও হয় না শেষ। খুব বড় একটা জীবন ধরার আগ্রহ নিয়ে এগুলে ছোটগল্পের কেন্দ্রে যাওয়া সহজ হয়। ছোটগল্পে একটি সময়কে তুলে ধরে একটি নির্দিষ্ট বিন্দু লক্ষ্য করে কাহিনী এগিয়ে যায়, সেই বিন্দুটি এমনই অদ্ভুত যে এখান থেকে ভবিষ্যৎ পরিষ্কার দেখা যায়, আবার ব্যক্ত থাকে অতীতও। ছোটগল্পে সময় একটি গুরুত্বপূর্ণ ফ্যাক্টর। এতে অনাবশ্যক কথা ও প্রলম্বিত ঘটনা পরিত্যাজ্য। গল্পের ফ্রেমে সময় যদি দীর্ঘতর হতে থাকে, তাহলে সময়ের সে অপচয় হয়ে দাঁড়ায় অস্বস্তিকর। ছোটগল্প লেখকদের একটি বড়ো দুর্বলতা হলো, তারা অনেক সময় একে আরো আকর্ষণীয় করতে বাড়তি রং চড়ান, অনাবশ্যক রূপকের মাধ্যমে ভয়াবহ ও কৃত্রিম করে তোলেন, যা অনাকাক্সিক্ষত। আজকাল ছোটগল্পের নামে এমন লেখাও নির্মিত হচ্ছে- যেখানে না আছে গল্প, না আছে গদ্যের স্বাদ। গল্পকারকে মনে রাখতে হবে, তার গল্পে যদি গল্পই না থাকে, তাহলে সে দায় তার। এ ধরনের লেখকের সাহিত্য চর্চা না করাই বরং ভালো।
উপন্যাস
উপন্যাস হচ্ছে এমন এক শিল্প মাধ্যম, যেখানে মানুষকে ভেতরের অনেক কথা বলে দেয়া যায়, যা তারা আগে জানতো না। উপন্যাসের বক্তব্য হতে হয় শক্তিশালী; এর ভেতরে থাকতে হয় এমন কিছু, যা আলোকময় বোধের নতুন দরোজা খুলে দেয়। জাপানের জনপ্রিয় কথাসাহিত্যিক হারুকি মুকারামি উপন্যাস রচনা প্রসঙ্গে বলেন, ‘মানুষের মন হচ্ছে দালানের মতো, যার রয়েছে অনেকগুলো তলা। আর উপন্যাস রচনা হচ্ছে চৈতন্যের গভীরে ঢোকা, অনেকটা সিঁড়ি ভেঙে দালানের ভূগর্ভস্থ গভীর অন্ধকার তলার পরেরটিতে নামার মতো। যিনি নামছেন, তার জানা নেই কোথায় রয়েছে করিডোরটি, যেটা দিয়ে নিচের তলায় পৌঁছানো যায়।’- স্বার্থক উপন্যাস রচনার মন্ত্র অন্তত এটাই হওয়া উচিত। উপন্যাসে কাহিনীর স্পর্শময়তা একজন মানুষকে শিহরিত করে রাখতে পারে। কবিতা, দর্শন বা বৈজ্ঞানিক তত্ত্বে তা ততটা হয়ে উঠে না।
উপন্যাস হলো= উপ+ নি?অস+অ। উপ অর্থ কাহিনী ন্যাস অর্থ বিন্যাস; এভাবে বললে উপন্যাস মানে বিন্যস্ত কাহিনী। এক্ষেত্রে সাধারণভাবে উপন্যাসে ‘উপসৃজন’-এর ব্যাপার থাকলেও তা কল্পিত আখ্যান বা প্লট এ সীমায়িত করা উপন্যাস নয়। আজকাল উপন্যাস হচ্ছে প্রবহমান সময় ও সমাজ-অন্তর্গত জীবনের রূপকল্প। এতে যেমন থাকতে পারে বাস্তব কাহিনী, তেমনি অতিবাস্তব বর্ণনাও। কোনো সুনির্দিষ্ট শৃঙ্খলার বন্ধনে উপন্যাসের শিল্পরীতি গণ্ডিবদ্ধ করা যায় না। অভ্যন্তরীণ চাহিদার তাগিদেই উপন্যাসের প্যাটার্ন বা পদ্ধতির রূপান্তর ঘটে। উপন্যাসে জীবনের সামগ্রিক পটভূমি ফুটে ওঠে বলে এর পটভূমি হয় বিস্তৃত। উপন্যাসে বর্ণিত ঘটনার মধ্যে একটা ধারাবাহিকতা থাকতে হয়- যা পরবর্তী ঘটনার জন্ম দেয় এবং কাহিনীর মধ্যে যোগসূত্র রচনা করে। ঘটনাই কাহিনীকে বেগবান করে এবং পরিণতির দিকে নিয়ে যায়। উপন্যাসে কাহিনী নির্মাণের কৌশল, বলবার ভঙ্গি, চরিত্রের মুখে সংলাপের বণ্টন- এসব ক্ষেত্রে চমৎকারিত্বের প্রয়োগে কথাসাহিত্য অনন্য হয়ে উঠে। আমরা যখন কোনো উপন্যাস পড়ি- আমাদের মনের ভেতর ক্রমান্বয়ে ছবি তৈরি হয়, চরিত্রগুলো আবছা আলোয় আমাদের চোখে ভেসে ওঠে। প্রকৃত উপন্যাসে এ ধরনের বাতাবরণ তৈরি হয়ই। এক্ষেত্রে কোনো ব্যত্যয় কথাকারের দায়।
উপন্যাসে স্বপ্নের হাতছানি থাকতে হয়। ঔপন্যাসিক নিজে স্বপ্ন দেখবেন এবং অন্যদের সাথে তা ভাগাভাগি করে নেবেন। উপন্যাসে যোগ করার মতো ঘটনা, উপাদান, নিত্য ব্যবহার্য জিনিসপত্র ইত্যাদি অবশ্যই থাকবে। আসলে উপন্যাস হচ্ছে ধৈর্য ও আত্মবিশ্বাসের সাথে সব জোড়া দেয়ার একটা বিশাল ব্যাপার; যেখানে জাদুমন্ত্রের মতো জোড়া দেয়া বিষয়গুলো রূপান্তরিত হবে বিস্ময়কর বিষয়ে। উপন্যাস লেখার সময় নিজেকে সম্মোহিত করে রাখতে হয়। কারণ একটা বড়ো উপন্যাস লিখতে মাসের পর মাস সময়ও লাগতে পারে। এক্ষেত্রে ঘটনার পরম্পরা রক্ষা করার মতো মানসিক-শারীরিক শক্তি, মেধা ও মনোযোগ কথাকারের থাকতে হয়।
উপন্যাস জীব দেহের মতো সজীব এবং এর প্রতিটি অঙ্গই সচেতন ও অন্য অঙ্গের সাথে সম্পর্কযুক্ত হয়। উপন্যাসে কথাকার ধীরগতিতে যুক্তির আলোকে কাহিনীর একটার পর একটা পর্ব উন্মোচন করে যান, টুকরো টুকরো কাহিনী অদ্ভুত রসায়নপ্রাপ্ত হয়ে একটা অনিবার্য পরিণতির দিকে এগুতে থাকে। শরৎচন্দ্র চট্টোপাধ্যায় মনে করেন, উপন্যাসে চরিত্র, প্লট এবং পারিপার্শ্বিক অবস্থা- এই তিনটি বিশেষ প্রয়োজনীয়। উপন্যাসকে সাধারণত চার শ্রেণিতে ভাগ করা যায়- ১. ঐতিহাসিক ২. সামাজিক ৩. রোমান্টিক ও ৪. রহস্য উপন্যাস। এ ধরনের সবকটি উপন্যাসেই ব্যক্তি বা লেখক সৃজনশীলতা দিয়ে তার অস্তিত্বের জানান দিতে পারেন। কারণ, উপন্যাসের জীবন বহু অর্থে ব্যক্তিরই জীবন। এতে ব্যক্তি তার বিকাশ, নির্মাণ, ভাঙচুর, জীবনের গড়ন-পোড়ন ইত্যাদি ব্যক্ত করে নিজেকে চেনান। এতে লেখক তার লেখনীর মাধ্যমে এক জীবনে অনেক জীবন বা দ্বিতীয় জীবন তৈরি করেন। এই শৈলী আসলে লেখকের অন্তর্জগতের ছবি বা মনোছাপ। এতে লেখকের প্রখর কল্পনাশক্তি, উদার-গভীর অন্তদর্শন এবং চমৎকার নির্মাণশৈলী দৃশ্যমান হয়। নারায়ণ চৌধুরীর মতে, ‘উপন্যাস জীবনের একটা অখণ্ড রূপায়ন এবং সমগ্রতাই তার মর্মবস্তু।’ উপন্যাসই পারে একজন মানুষের দীর্ঘ জীবনের সবদিক সমানভাবে তুলে ধরতে। উপন্যাসে মানুষের আচরিত কার্যকলাপ শিল্পসম্মতভাবে উপস্থাপিত হয়। তাই বলে উপন্যাস কোন কেসস্টাডি, ব্যক্তির আত্মজীবনী নয়। উপন্যাসে বহু মানুষের কণ্ঠস্বর একসাথে বাজে। প্রকৃত উপন্যাস এমন একটা শিল্প, যেখানে একজন পাঠক নিঃশব্দে পড়লেও এর কথা সে শুনতে পায়, মনে ও কানে বাজে; যেন পাঠক নিজেও এর অংশ হয়ে ডুবে যান এর মায়াজালের অতলান্তে। উপন্যাস এতো জনপ্রিয় বলেই এর কথকতার ধরন, ভাষাসৈকর্য ও আঙ্গিক নিয়ে পরীক্ষা-নিরীক্ষা চলছে নিরন্তর আজকাল উপন্যাসে কুহক, জাদু, স্বপ্নবাস্তবতা, দ্রোহ ও জটিল বাক্য বিন্যাসের প্রয়োগ হচ্ছে।
সমালোচনা সাহিত্য
সমালোচনা সাহিত্য সাহিত্যের যথার্থতা যাচাইয়ের একটি চলমান প্রক্রিয়া। সাহিত্যের বিকাশ ও উৎকর্ষ সাধনে সমালোচনার গুরুত্ব অনস্বীকার্য। সাহিত্যের প্রতি মানুষের কৌতূহল থেকেই এ ধরনের সাহিত্য বিচারের বিচিত্র রূপ ও পদ্ধতির অনুসন্ধান ও উদ্ভব হয়েছে। সমালোচনার কাজ সাহিত্যের নিয়ম-শৃঙ্খলার দিকে লেখককে মনোযোগী করা। একজন লেখক সাহিত্যে সৃজন- মননের মাধ্যমে কতোটা আলোর নাচন সৃষ্টি করতে পেরেছেন তা সাহিত্য সমালোচনায় উঠে আসে। সাহিত্যে লেখকের মানস দৃষ্টি, রচনার ভাব, বস্তু, রূপ, রস, অলংকার, সৌন্দর্য কতটুকু রক্ষিত হয়েছে, লেখকের স্খলন কতটুকু হয়েছে, তার পথ-নির্দেশনা ও সতর্কতা থাকে সমালোচনা সাহিত্যে। লেখকের সাথে পাঠকের মেলবন্ধন ঘটাতে সমালোচনা সাহিত্য অনুঘটকের ভূমিকা পালন করে। লেখকের মনোজগৎকে অধ্যয়ন করতে না পারলে সাহিত্যের যথার্থ বিচার করা যায় না। সাহিত্য সমালোচনা তখনই সম্ভব, যখন সাহিত্যিকের নিজের কল্পনা আবেগহীনভাবে পাঠকের কল্পনায় সঞ্চালিত হয়। অর্থাৎ যখন কোনো সাহিত্যিকের দেখা-শোনা পাঠকের ‘দর্শনে’ ও ‘শ্রবণে’ রূপান্তিত হয়, তখনই ঐ সাহিত্যিকের সাহিত্য সমালোচনা যথাযথ ও স্বচ্ছ হয়। অন্যথায় চিন্তাগত স্ববিরোধিতায় তা একপেশে অথবা অবমূল্যায়িত হয়। সমালোচনার সময় লেখার ব্যাখ্যা (ওহঃবৎঢ়ৎবঃধঃরড়হ), বিচার-বিশ্লেষণ (ঔঁফমবসবহঃ) ও রস-আস্বাদন (ধঢ়ঢ়ৎবপরধঃরড়হ) অত্যাবশ্যক। একমাত্র অন্তর্দৃষ্টি, কল্পনা শক্তি ও সহৃদয়তার মাধ্যমে তা সম্ভব। শার্ল বোদলেয়ারের মতে, ‘… একজন কবির মধ্যে যদি একজন সমালোচক জেগে না থাকে সেটা আরো আশ্চর্যের।’ আমাদের দেশে কিছু কিছু সাহিত্য-সমালোচক কোনো বিষয়ে সমালোচনা করতে গিয়ে অনেকটা অহংয়ের সাথে রায় দিয়ে বসেন, এটা যেন, ‘গাঁয়ে মানে না আপনি মোড়ল’ ধরনের কর্মকাণ্ড। আসলে এ ধরনের রায় দেয়ার জন্য তো তাকে কেউ বিচারক নিয়োগ করেননি। সমালোচনা করার সময় মূল শিল্প আত্মস্থ করতে হয়। আসলে সব সমালোচনাই মূলের ব্যাখ্যা, মূলকে পাঠকের সম্মুখে খোলাসা করা, স্পষ্ট করায় নিবেদিত থাকে। এজন্য বর্ণিত বিষয়ে নিজের পুঁজি দিয়ে সুস্থির, আত্মবিশ্বাসের সাথে এগুতে হয় সমালোচককে। তখনই সত্যিকার সমালোচনা হয়, যা গ্রহণ করে লেখক সমৃদ্ধ হন এবং লেখায় আলোর স্ফূরণ ঘটে।
কোন সাহিত্যই মহৎ সাহিত্য হয় না, যদি তার ভিতরে কোনো গভীরতা না থাকে। এই গভীরতা আসে লেখকের দার্শনিকতা থেকে। দার্শনিকতার কারণেই সাহিত্যে বক্তব্য আসে। অনেক সময় এমনও দেখা যায় যে, লেখক যা বলতে চাইছেন, তার লেখা তা বলছে না। ভেতরে একটা দ্ব›দ্ব প্রবহমান। এই দ্ব›দ্ব লেখাকে প্রাণবন্ত করলেও এক্ষেত্রে সাহিত্য সমালোচকের অনেক বলার থাকে। কিন্তু আমাদের দেশে সাহিত্য সমালোচনার ধারাটি তেমন বিস্তৃত বা বিকশিত হয়নি। যদিও সমাজে বস্তুগত উন্নতি ঘটছে, এই উন্নতি ভোগবাদী মানসিকতার। এটি শুধু মুনাফা চেনে, সংবেদনশীলতা বোঝে না। বর্তমানে সাহিত্যের পঠন- পাঠনের দৈন্যতায় সমালোচনা সাহিত্য প্রাণবন্ত নয়।
সাহিত্যে সজীবতা
লেখক ভাবনার দ্বারা নিয়ন্ত্রিত, স্বপ্ন-কল্পনা ও অভিজ্ঞতার দ্বারা প্রভাবিত। লেখকের সব সৃষ্টিকর্ম, শিল্প, সাহিত্য এ পথ বেয়েই শেকড় খুঁজে নেয়। সাহিত্য হলো শব্দযোগে এক ধরনের নির্মিতি, যা আমাদের বোধকেন্দ্র (ঝবহংব ঙৎমধহ) নাড়া দেয়। এক্ষেত্রে লেখকের সৃষ্টি করা শব্দ সহযোগে গঠিত বাক্য কতটুকু প্রত্যক্ষভাবে (ঈড়হপৎবঃব) এবং বিমূর্ততায় (অনংঃৎধপঃ) পাঠকের মনঃসংযোগ সৃষ্টি করতে পারছে, তার উপরই নির্ভর করে সহিত্যের আবেদন বা সৌন্দর্য। বস্তুত সাহিত্যের উদ্ভাবনী তৈরি হয় ভাষার যোগসূত্রে। ভাষা হলো সাহিত্যের বাহন। শুধুমাত্র কথার গ্রন্থনা নয়, যথার্থ সাহিত্য সৃষ্টি করতে হলে এই বাহনকে পরিশীলিত করতে হয়। উন্নত সাহিত্যের একটি অন্যতম দিক হলো লেখককের লেখার স্টাইল বা বাচনভঙ্গি। যার বচনভঙ্গি বা স্টাইল পাঠককে যত বেশি আকর্ষিত করতে পারে, তিনি তত বেশি সফল সাহিত্যিক। একজন লেখক ভাষার বৈচিত্র্যময় প্রয়োগ এবং সৃজন-মননের মাধ্যমে পাঠকের মনে কতটুকু চিন্তাস্রোত তৈরি করতে পেরেছেন, তার উপর নির্ভর করে সাহিত্যের সজীবতা। এক্ষেত্রে সাহিত্যের শরীরে ধারণ করা বিষয়গত ও ভাবগত বিকল্প প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষ চিন্তনে মেতে থেকে পাঠককে তাতে সচল ও নিবিষ্ট রাখে। চিন্তায় বৈচিত্র্য ও পরিপক্বতার কারণে সাহিত্যও হয়ে উঠে বিচিত্র ও সমৃদ্ধ। নিথর, নিস্তেজ, একঘেয়ে সাহিত্য মানুষকে পাঠবিমুখ করে দেয়। আমরা যখন কোন বই পড়ি, আসলে তখন আমরা সেই লেখকের চিন্তাকে পড়ি, তার সৃজন-মননকে পড়ি। সেই চিন্তা-সৃজন-মনন আমাদের কাছে ধরা দেয় লেখকের ভাষা শৈলীর চমৎকারিত্বে।
ভালো লেখকরাও অনেক সময় খারাপ লিখেন। আবার এমন অনেক লেখকও আছেন যারা সাহিত্যকে বিক্রি করেন, খদ্দেরের মন মতো সাহিত্য তৈরি করেন। এসব লেখায় সম-সাময়িকতা থাকে সত্যি, কিন্তু এতে চিরকালীনতা থাকে না। কারণ পেট চালাবার জন্য সাহিত্যকে পেশা হিসেবে গ্রহণ করার সাথে সাথে সাহিত্যিক তার সাহিত্য চর্চার প্রয়োজনীয় স্বাধীনতা অনেকখানি হারিয়ে ফেলেন। তাছাড়া একসঙ্গে বেশি লিখতে বাধ্য হওয়া, সম্পাদকীয় তাগাদা, ডেডলাইন, দ্রুত খ্যাতি প্রত্যাশা ইত্যাদি কারণেও অনেক সময় ভালো লেখকরাও পিছলে পড়েন। আবার অনেক লেখক কিছুটা পরিচিত পাওয়ার পর জৌলুসের অহংকারে অযথা পৃষ্ঠার পর পৃষ্ঠা লিখে বাড়ান গ্রন্থের আকার, সেইসঙ্গে গ্রন্থমূল্যও। কিন্তু গ্রন্থে প্রবেশ করলে দেখা যায়, তার এতদিনের সৎশিল্প সৃজনের উৎসমূলে পচন ধরেছে। রচনার মান-অবনয়ন ঘটেছে। এক্ষেত্রে খারাপ লেখা পাঠকরা বেশিদিন সহ্য করেন না। কিছুদিন দেখে তারা লেখক-সমেত ঐ লেখা আবর্জনার স্তূপে ছুড়ে ফেলেন। কালস্রোত তা কুড়িয়ে নেয়। পড়ে থাকে ক’একটা ভালো লেখা। একসময় খারাপের সাথে তাও মুছে যায়। মুছে যান লেখকও। আসেন নতুন লেখক, ভালো লেখক। শুরু হয় তাকে নিয়ে মাতামাতি। কিন্তু লেখক সত্তার যথাযথ পরিচর্যার অভাবে তিনিও ফুরিয়ে যান।
ভালো লেখার জন্য প্রয়োজন অন্তর্মুখীনতা। তবে অনেক সাহিত্যিককে দেখা যায়, সাহিত্যিক পরিচয় প্রচার পাওয়ার জন্য বহির্মুখী হয়ে থাকেন। বেশি লৌকিক ও মিশুক হলে সভা-সমিতি, পুরস্কার বিতরণী, লৌকিক অনুষ্ঠানে একজন সাহিত্যিকের ডাক পড়া স্বাভাবিক। কিন্তু এতে সময়ের অপচয় হয়। সময়াভাবে লেখালেখির প্রতি একনিষ্ঠ থাকা যায় না। এতে লেখার অবনতি ঘটে। লেখক হয়ে যান দীপ্তিহীন, বিবর্ণ ও খেলো। কিন্তু অন্তর্মুখী লেখক ঠিকই লেখালেখির পসরা সাজিয়ে নিজেকে কালজয়ী করে গড়ে তোলেন। কবি জীবনানন্দ দাশ কোনো সভা-সমিতিতে যেতেন না, কোনো আড্ডায় তাকে দেখা যেত না। তাই বলে তিনি হারিয়ে যাননি। তার সদা উন্মুক্ত চোখ থাকতো বাংলার প্রকৃতিতে, ভিতরে ভিতরে তার সদা জাগ্রত মন ধ্যানস্থ থেকে আত্মনুসন্ধানে নিমগ্ন ছিল, যা কালজয়ী কবিতা হয়ে তার কলমে ফুল ফুটিয়েছে। একইভাবে ভালো লেখার জন্য প্রয়োজন বেশি বেশি বই পড়ার অভ্যাস, যা অভিজ্ঞতার ভাণ্ডার সমৃদ্ধ করে, ভেতর থেকে তাগিদ সৃষ্টি করে ভালো লেখার। এটা লেখকের সৃষ্টিধর্মী কল্পনা-শক্তিকে শানিত করে। কবি-সমালোচক কোলরিজের মতে, সাহিত্যিকের সৃষ্টিধর্মী কল্পনা (ঈৎবধঃরাব ওসধমরহধঃরড়হ) যতক্ষণ পাঠককে ভর না করে ততক্ষণ সাহিত্যের উপলব্ধি বিশ্বস্ত ও অনুকূল হয় না।
সুন্দরের প্রতি আকর্ষণ মানুষের সহজাত প্রবৃত্তি। সাহিত্য শিল্পের কাজ সৌন্দর্য সৃষ্টি করা। লেখক যদি সৌন্দর্য সৃষ্টির কাজটি
যথাযথভাবে করতে না পারেন, তবে তিনি ব্যর্থ লেখক। তার লেখালেখির জগতে না আসাই বাঞ্ছনীয়। একবার ভেবে দেখেছেন কি, স্বয়ং সৃষ্টিকর্তাও সৌন্দর্যের প্রতি যতœশীল! তিনি মানুষের শরীরের সৌন্দর্য যাতে নষ্ট না হয় তজ্জন্য নির্গমন পথকে মূল শরীর কাঠামো থেকে দূরে নিচে রেখেছেন। সাহিত্য চর্চা বা লেখালেখির ক্ষেত্রে একটা অলৌকিক প্রণোদনা বা প্রেরণা কাজ করে; যা ভাবনা, অনুভূতি, বোধ, জিজ্ঞাসা- এগুলোর ভেতর জমে থেকে একটা প্রবল চাপ সৃষ্টি করে। লেখক বা সাহিত্যিক এই চাপের তাড়নায় একসময় তা উগড়ে দেন, যা কবিতা, গল্প, উপন্যাস, প্রবন্ধ, রম্যরচনা, নাটক, অনুবাদ ইত্যাদি রূপে পাঠকের সামনে হাজির হয়। এতে একপ্রকার সত্য বা সৌন্দর্য লেপ্টে থাকে, যা একে সাহিত্য মানসম্পন্ন করে। এক্ষেত্রে একজন সৃজনশীল-মননশীল সাহিত্যিককে যথেষ্ট সতর্ক, সজাগ ও নিজের রচনার প্রতি যতœবান হতে হবে। তখন সাহিত্য আপনাতেই দ্যুতি ছড়াবে।
সাহিত্যে জীবনের যাবতীয় আয়োজন ও চলমানতা যেমন থাকে, তেমনি সাহিত্যে দ্রোহও থাকা চাই। দ্রোহ জীবনকে বিশুদ্ধ করে। প্রথাগত ও অনুকরণ প্রিয় হলে মৌলিক ও স্বকীয় হওয়া যায় না। নিজের মতো হওয়া, স্বতন্ত্র হওয়ার মাঝেই লেখক জীবনের সার্থকতা। মনে রাখতে হবে, জীবনের মতোই লেখালেখি এক ধরনের ভ্রমণ। জীবন-জগৎ, লৌকিক-অলৌকিক, পার্থিব-অপার্থিব, মূর্ত-বিমূর্ত- সব কিছুই এর বিচরণক্ষেত্র। সাহিত্য এ বিস্তৃত ক্যানভাসেরই এক শিল্পভূমি। লেখক-কবি এর স্রষ্টা।
সাহিত্যের প্রতি নিবেদিত সাহিত্যিকের নিবিষ্টতার কারণে বাংলা সাহিত্য আজ অনেক দূর এগিয়েছে। দিনে দিনে বাংলা সাহিত্যের মানচিত্র বড়ো হচ্ছে, যদিও রাজনৈতিক মানচিত্র স্বাতন্ত্র্য চিহ্নিত, ছিন্ন-ভিন্ন। রাজনৈতিক মানচিত্রের ভিন্নতার মাঝেও বাংলা সাহিত্যের চর্চা ও গুরুত্ব বিশ্বের দেশে দেশে উত্তরোত্তর বৃদ্ধি পাচ্ছে- এটা একবিংশ শতাব্দীর নতুন বাস্তবতা।

তৌফিকুল ইসলাম চৌধুরী
লেখক ও গবেষক

মন্তব্য করুন

খবরের বিষয়বস্তুর সঙ্গে মিল আছে এবং আপত্তিজনক নয়- এমন মন্তব্যই প্রদর্শিত হবে। মন্তব্যগুলো পাঠকের নিজস্ব মতামত, ভোরের কাগজ লাইভ এর দায়ভার নেবে না।

জনপ্রিয়