পদ্মা সেতু : মোটরসাইকেল চলাচল চেয়ে হাইকোর্টে রিট

আগের সংবাদ

আইসিসি অনূর্ধ্ব-১৯ নারী টি-টোয়েন্টি বিশ্বকাপ : বিশ্বকাপে অপ্রতিরোধ্য টাইগ্রেসরা

পরের সংবাদ

সাম্প্রদায়িকতার বহুমাত্রিকতা

প্রকাশিত: জানুয়ারি ১৬, ২০২৩ , ১২:০০ পূর্বাহ্ণ
আপডেট: জানুয়ারি ১৬, ২০২৩ , ১২:০০ পূর্বাহ্ণ

মানুষে মানুষে সম্পর্ক-সম্প্রীতি এবং দ্ব›দ্ব-সংঘাত, হানাহানি আদি যুগ থেকে চলে এসেছে। এত কিছুর পরও মানুষ একে অপরের জন্য অপরিহার্য এবং পরিপূরক। বড় কথা হচ্ছে, মানুষ সমাজবদ্ধ প্রাণী। সামাজিক প্রাণী বিবেচনায় মানুষকে পরিবার-সমাজ সবাইকে নিয়েই চলতে হয়। মানুষ সামাজিক জীব বলেই একে অন্যের সাহায্য-সহযোগিতা ছাড়া বাঁচতে পারে না। পরিবার ও সমাজের সবার সঙ্গে সব বিষয়ে বাঁটোয়ারা-বিনিময় করেই বাঁচে। জনবিচ্ছিন্ন মানুষ সুস্থ-স্বাভাবিক মানুষ হিসেবে গণ্য হতে পারে না। মানুষ তার সামাজিক বন্ধনের ভেতর দিয়েই বেড়ে ওঠে। এটাই মানুষের স্বাভাবিক জীবনাচার বা জৈব প্রবৃত্তি। আদিকাল থেকে মানুষকে প্রকৃতির বৈরিতার বিরুদ্ধে লড়াই করে অস্তিত্ব রক্ষা করতে হয়েছে। এখনো করতে হয় বৈকি। বিজ্ঞান-প্রযুক্তির নানাবিধ সুবিধায় মানুষ অনেক ক্ষেত্রেই প্রকৃতিকে বশে এনেছে। প্রকৃতিকে এই বশে আনার কারণে অনেক ক্ষেত্রে মারাত্মক পরিবেশগত প্রভাব পড়েছে। ব্যক্তিবিশেষের কায়েমি স্বার্থ চরিতার্থে প্রকৃতির স্বাভাবিক গতি-প্রকৃতি ব্যাহত করে সমষ্টিগত মানুষদের বিপদের মুখে ঠেলে দেয়ার নানা নজির সৃষ্টি হয়েছে। উন্নত বিশ্ব নিজেদের উন্নতির স্বার্থে প্রকৃতির ওপর বিরূপ আচরণে জলবায়ু দূষণে অনুন্নত গরিব রাষ্ট্রগুলোকে বিপদাপন্ন করে তুলেছে। এসব ক্ষেত্রে আর্থিক মুচলেকা দেয়ার ও নেয়ার দর কষাকষি চললেও দূষণ প্রক্রিয়া বন্ধের কোনো আলামত দেখছি না। বরং দূষণের মাত্রা ভয়াবহরূপে বেড়েই চলেছে। বসবাস অনুপযোগী হয়ে পড়েছে গরিব বিশ্ব।
মানুষ একে অন্যের জন্য অপরিহার্য। সখ্য-সম্প্রীতি যেমন সত্য, বিপরীতে মানুষই মানুষের চরম ও পরম শত্রæ। বৈষম্যপূর্ণ রাষ্ট্র ব্যবস্থায় দুর্বলের ওপর সবলের কর্তৃত্ব, নিষ্ঠুরতা, নিপীড়ন যুগ-যুগান্তর হতে চলে এসেছে। এর থেকে পরিত্রাণ পেয়েছে সেই সমাজ ও রাষ্ট্রের মানুষ, যেখানে সমতার সমাজ প্রতিষ্ঠা সম্ভব হয়েছে। দুর্বল এবং সবলের ভেদাভেদ-বৈষম্যের মূলে অর্থনৈতিক বৈষম্য। এই বৈষম্যই মানুষের স্বাভাবিক জীবনের প্রধান অন্তরায়। শ্রেণি বিভক্ত সমাজ ও রাষ্ট্রে সমানে সমান না হলে কোনো সম্পর্কই সুসম্পর্কে গড়ায় না এবং স্থায়ীও হয় না। শ্রেণিগত অবস্থানের কারণেই নিকট আত্মীয় দূরের আর দূরের অনাত্মীয় কাছের হয়ে যায়। একই পরিবারের কেউ একজন অন্যদের তুলনায় অধিক বিত্তশালী এবং সুপ্রতিষ্ঠিত হলে ওই পরিবারের অন্য সদস্যদের সঙ্গে দূরত্বের সৃষ্টি হয়। শ্রেণি উত্তরণের সঙ্গে পাল্টে যায় সম্পর্ক-সম্প্রীতির সব বন্ধন। এসব আমাদের সমাজের অতি চেনা ছবি। যা আমরা নিয়মিত দেখে থাকি। মানুষে মানুষে স্বাভাবিক সম্পর্ক-সম্প্রীতি বিনষ্টের মূলে শ্রেণিবিভক্তি। এই বৈষম্য নিরসন না হওয়া পর্যন্ত সমাজের সর্বস্তরের মানুষের নির্মল সম্পর্ক-সম্প্রীতি আশা করা যায় না। সমাজ ও রাষ্ট্রের বৈষম্য দূর করতে হলে বিজ্ঞানসম্মত সমতার উপায় নির্ধারণ করতে হবে। যার সফল প্রয়োগ ও দৃষ্টান্ত বিশ্বে বিরল নয়। অনেক দেশেই সমতার রাষ্ট্র ও সমাজ প্রতিষ্ঠার অনুকরণীয় দৃষ্টান্ত রয়েছে। সাম্রাজ্যবাদী রাষ্ট্রগুলো দুর্বল রাষ্ট্রগুলোর ওপর কর্তৃত্ব করে থাকে। ইচ্ছামতো যখন-তখন হামলা করে। দেশ দখল করে, সম্পদ লুণ্ঠনে নিজেদের শ্রীবৃদ্ধি করে। আজকের বিশ্বের দানব রাষ্ট্র মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র তার মিত্রদের নিয়ে তাবৎ বিশ্বকে দাবড়িয়ে বেড়াচ্ছে। সোভিয়েত ইউনিয়নের পতনের সুযোগে একতরফা বিনা বাধায় বিশ্ব ব্যবস্থাকে খর্ব করেছে, পুঁজিবাদী রাশিয়ার আগমনে একতরফা কর্তৃত্ব খর্ব হয়েছে সত্য, তবে এদের নৃশংসতায় বিশ্বের শান্তি-স্থিতি বিপর্যয়ের মুখে। আশার কথা লাতিন আমেরিকা ও এশিয়ার কয়টি দেশ সাম্রাজ্যবাদের কাছে নতি স্বীকার না করে আত্মমর্যাদায় মাথা উঁচু করে দাঁড়িয়ে অনন্য দৃষ্টান্ত রেখে চলেছে। সাম্রাজ্যবাদের কাছে আত্মসমর্পণ না করে আত্মমর্যাদায় মেরুদণ্ড সোজা রেখে কীভাবে ঘুরে দাঁড়াতে হয়, বিশ্ববাসীকে সে শিক্ষাও দিয়েছে তারা। মানুষে মানুষে জাতিভেদ, বর্ণভেদ, সম্প্রদায়গত ভেদাভেদেও মানুষের স্বাভাবিক সম্পর্ক-সম্প্রীতি বিনষ্টের কারণ হয়ে দাঁড়িয়েছে। এই ভেদাভেদ সৃষ্টির মূলে রয়েছে শক্তিধর-ক্ষমতাধরদের দুরভিসন্ধি, শাসন ও শোষণের স্বার্থে মানুষকে পরস্পর থেকে বিচ্ছিন্ন করার চাতুর্যপূর্ণ ফন্দি। ব্রিটিশ সাম্রাজ্যবাদ আমাদের উপমহাদেশে সম্প্রদায় বিভাজন উসকে দিয়ে নির্বিঘেœ দীর্ঘ মেয়াদে শাসন-শোষণ করেছে এবং নিজ দেশে ফেরার পূর্বে চাতুর্যের সঙ্গে হিন্দু-মুসলিম দুই পক্ষের মধ্যে সাম্প্রদায়িক বিরোধ-সংঘাত বাধিয়ে খণ্ডিত করে গেছে ভারতবর্ষকে। মানুষে মানুষে বিভাজন সৃষ্টি করে ফায়দা লোটার এই কৌশল শাসক-শোষকরা এখনো জিইয়ে রেখেছে।
ব্রিটিশরা বাধ্য হয়ে ভারতবর্ষ ছেড়ে গিয়েছিল, এটা সত্য। তবে ভিন্ন আবরণে থেকে গেছে, এটাও অসত্য নয়। দ্বিগুণ শক্তিতে সাম্রাজ্যবাদ-পুঁজিবাদ ফিরে এসেছে। যে শাসক শ্রেণি পালাক্রমে তিন খণ্ডে খণ্ডিত রাষ্ট্র তিনটি শাসন করেছে তারা তো সেই সাম্রাজ্যবাদ ও পুঁজিবাদের অনুগত এবং আজ্ঞাবহ প্রতিনিধি। ব্রিটিশের আইন, কালা-কানুন, নিয়ম-নীতি, আমলাতন্ত্র, রাষ্ট্রীয় কাঠামো সবই আগের নিয়মেই আছে এবং চলছেও। সে ক্ষেত্রে ব্রিটিশ বিদায় হয়েছে, বলি কীভাবে। উপনিবেশিক শাসকের স্থলে স্বদেশি শাসক পেয়েছি। রাষ্ট্র ব্যবস্থাও অটুট রয়েছে। বদলায়নি সামান্যও। যেমনটি ব্রিটিশ আমলে, পাকিস্তানি আমলে এবং ৫০ বছরের বাংলাদেশেও একই নিয়মে একই ধারায় শাসক শ্রেণি দেশ শাসন করছে। সমষ্টিগত মানুষের দুর্ভোগ-দুর্দশা কমেনি। ক্ষেত্রবিশেষে বেড়েছে। মানুষের ঐক্য-সম্প্রীতি বিনষ্ট করে পরস্পরকে বিচ্ছিন্ন করার সাবেকি কৌশল এখনো বলবৎ রয়েছে এবং থাকবেও। বৈষম্য কমেনি বরং বেড়েছে। নতুন নতুন আরোপিত বৈষম্য-বিভাজন সৃষ্টি করে সংখ্যাগরিষ্ঠ মানুষের ওপর শ্রেণিগত সংখ্যালঘু শ্রেণির শাসন-শোষণ পালাক্রমে চলছে।
নীহাররঞ্জন রায়। আমাদের পরিচিত নীহার বাবু। কাজের স্বার্থে প্রায়ই দেখা হয়, কিন্তু কুশলাদি জিজ্ঞেস করা হয় না। নিজ থেকেও ব্যক্তিগত সুবিধা-অসুবিধার কোনো কথা কখনো বলেননি। মাত্র সেদিন সাক্ষাতে কেমন আছেন জিজ্ঞেস করা মাত্র হাউমাউ করে উঠলেন, ‘দাদাগো মোটেও ভালো নেই। নিজেতো কিছু করতে পারি নাই। বাপ-দাদার আমলের জমিজমা রক্ষায় প্রাণ আসে-যায়। দুই দলের যে দল ক্ষমতায় আসে তাদেরই চোখ পড়ে আমার জমির ওপর। তাদের হাতে-পায়ে ধরে আর্থিক মুচলেকা দিয়ে কোনোক্রমে টিকে আছি। ভালো যে নাই সেতো বুঝতেই পারছেন।’ অনর্গল একসঙ্গে এতগুলো কথা বলে চুপ হয়ে যান। পরে যা বললেন তার সার হচ্ছে পৈতৃক জমির পরিমাণ ঈর্ষণীয়। প্রধান দুই দলের যে দল ক্ষমতায় থাকে সে দলের স্থানীয় নেতাদের মোটা অঙ্কের টাকা দিয়ে নিজের জমি রক্ষা করে আসছেন। জ্ঞাতি স্বজনরা প্রায় সবাই ১৯৫০ সালে ভারতে চলে গেলেও নীহারের বাবা দেশ ছেড়ে যাননি। মাটি কামড়ে দেশেই ছিলেন এবং দেশেই মারা গেছেন। নীহারদের ষোলো বিঘা ফসলি জমি বর্গা চাষিদের দেয়া আছে। অর্ধেক ফসলের ভাগ নীহার পেয়ে থাকেন। ঢাকায় চাকরি করলেও জমির আয়ে অনেকটা সচ্ছল নীহার। তবে হঠাৎ হঠাৎ জমি বেদখলের সংবাদ পেয়ে ছুটতে হয় গ্রামে। বারবার একই উৎপীড়নে অসহ্য হয়ে উঠেছেন। গত ৫০ বছর ধরে মুখ বুজে সহ্য করে আসছেন। আর সইতে পারছেন না বলেই মৃত বাবার উদ্দেশে খিস্তি দিতেও দ্বিধা করছেন না। মৃত বাবার প্রতি তীব্র ক্ষোভ, কেন দেশ ছেড়ে তার বাবা ভারতে যাননি। আত্মীয়রা ভারতে গিয়ে শুরুতে কষ্ট করলেও এখন ভালোই আছে। অন্তত উটকো নানা চাপে নিয়মিত হয়রানি আর অমর্যাদাকর পরিস্থিতির শিকার হতে হয় না।
দেশ স্বাধীন হওয়ার পর সব সম্প্রদায়ের মানুষের শান্তিপূর্ণ সহাবস্থান নিশ্চিত হবে তেমনটি সংখ্যালঘু সম্প্রদায়ের সবাই আশা করলেও বাস্তবে তা হয়নি। সংখ্যালঘু নিপীড়নের মাত্রা বেড়েছে। ২০০১-এর ১ অক্টোবরের নির্বাচনের পরপরই দেশের বিভিন্ন স্থানে নির্বাচনে বিজয়ী বিএনপি-জামায়াত কর্তৃক নির্বিচারে সংখ্যালঘু সম্প্রদায়ের ওপর হত্যা, ধর্ষণ, গৃহে অগ্নিসংযোগসহ নানা অপকীর্তি সংঘটিত হয়েছিল, যা ১৯৫০-এর মাত্রাকেও ছাড়িয়ে যায়। সে সময়ের ক্ষমতাসীন তত্ত্বাবধায়ক সরকার সংখ্যালঘুদের নিরাপত্তা দিতে ব্যর্থ যেমন হয়েছে, তেমনি দোষীদের বিরুদ্ধে কোনো ব্যবস্থা নেয়নি। জয়ী জোট সরকারও ক্ষমতায় গিয়ে দোষীদের বিরুদ্ধে একটি মামলা পর্যন্ত করেনি। সংখ্যালঘু নিপীড়ন উপমহাদেশজুড়ে চলছে। ভারতের গুজরাট, পাঞ্জাব, কাশ্মীরসহ অনেক স্থানেই। পাকিস্তানে শিয়া-সুন্নি দাঙ্গা, সংখ্যালঘু কাদিয়ানীদের ওপর নির্যাতন-নিপীড়ন ইত্যাদিতে রাষ্ট্রের নিরপেক্ষতা আমরা দেখতে পাই না। দেখতে পাই না ক্ষমতাসীন সরকারগুলোর কার্যকর ভূমিকাও। বাবরি মসজিদ ভাঙা এবং এ নিয়ে দাঙ্গায় তৎকালের ক্ষমতাসীন নরসিমা রাওয়ের কংগ্রেস সরকারের নির্লিপ্ততায় আমরা বিস্মিত হয়েছিলাম। সাম্প্রদায়িক দাঙ্গার যত কুফল সাধারণ মানুষ ভোগ করলেও সুফলভোগী শাসকরা স্বীয় স্বার্থে নির্লিপ্ত থাকার নজির রেখে চলেছে।

মযহারুল ইসলাম বাবলা : নির্বাহী সম্পাদক, নতুন দিগন্ত।
[email protected]

মন্তব্য করুন

খবরের বিষয়বস্তুর সঙ্গে মিল আছে এবং আপত্তিজনক নয়- এমন মন্তব্যই প্রদর্শিত হবে। মন্তব্যগুলো পাঠকের নিজস্ব মতামত, ভোরের কাগজ লাইভ এর দায়ভার নেবে না।

জনপ্রিয়