মির্জা ফখরুল : বিদ্যুতের দাম বৃদ্ধির সিদ্ধান্ত গণবিরোধী

আগের সংবাদ

সতর্ক-সংকুলানমুখী মুদ্রানীতি : আমানত সুদের ঊর্ধ্বসীমা প্রত্যাহার > নীতি সুদহার বাড়ল > রেপো সুদহার বেড়েছে ২৫ বেসিস পয়েন্ট

পরের সংবাদ

রাজনীতিতে কেন ভালো ও সৎ লোক আসে না

প্রকাশিত: জানুয়ারি ১৫, ২০২৩ , ১২:০০ পূর্বাহ্ণ
আপডেট: জানুয়ারি ১৫, ২০২৩ , ১২:০০ পূর্বাহ্ণ

রাজনীতিতে ভালো মানুষ আসতে চায় না। রাজনীতিকরা রাজনীতিতে ভালো ও সৎ মানুষকে আকৃষ্ট করতে পারেনি, পারছে না। এই ব্যর্থতার দায় সবার। অকপটে এমন কিছু সত্য বললেন বাংলাদেশ আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক এবং বর্তমান সরকারের সড়ক পরিবহন ও সেতুমন্ত্রী ওবায়দুল কাদের। জাতীয় পার্টির (জেপি) ত্রিবার্ষিক সম্মেলনে বক্তৃতা প্রদানে তিনি এমন উপলব্ধিমূলক কথা বলেন, যা আমরা জানতে পেরেছি পত্রিকায় প্রকাশিত সংবাদের মাধ্যমে। একজন প্রবীণ রাজনীতিবিদ তিনি। অভিজ্ঞতা কম নয়। তিনি যে কেবল বিরোধী দলকে উদ্দেশ্য করেই এমন কথা বলেছেন, তা মনে হয় না। যেভাবে ও যে ভাষায় তিনি কথাগুলো বলেছেন তাতে পরিষ্কার হয় যে, তিনি সব রাজনৈতিক দলের রাজনীতিবিদকে উদ্দেশ্য করেই কথাগুলো বলেছেন। এমনকি তার নিজের ব্যর্থতার কথাও আছে এর মাঝে। রাজনৈতিক অঙ্গনে এতটা স্পষ্ট করে এমন প্রসঙ্গে কেউ কখনো কথা বলেছে কিনা, কিংবা অকপটে এমন আত্মোপলব্ধি আগে দেখা গেছে কিনা, সেই বিষয়ে সন্দেহ আছে বৈকি। রাজনীতি নিয়ে জনসাধারণের মনে অনেক সংশয় ও বিরক্তি রয়েছে। যার পেছনে রাজনীতিকদের কার্যকলাপই দায়ী। অনাকাক্সিক্ষত কার্যকলাপ সক্রিয় থেকেছে, থাকছে। রাজনীতিতে দোষারোপ আর মিথ্যাচারে ভরপুর থাকে- এই বিষয়ে কোনো দ্বিমত নেই। যাই হোক, ওবায়দুল কাদের সাহেব দৃঢ়চিত্তে বড় সত্য বললেন। বড় প্রয়োজন ছিল এমন সত্য উচ্চারণের। কাউকে না কাউকে সত্য তো বলতেই হয়। এজন্য তাকে সাধুবাদ জানাই।
শিক্ষিত, ভালো মানুষ বা চরিত্রবান মানুষ রাজনীতিতে আসে না। কথাটা স্বীকার করতেই হয়। গবেষণা করা সম্ভব হলে সত্যটা আরো পরিষ্কার হতো এবং এক্ষেত্রে ভয়াবহ ফলাফল পাওয়া যেত। যদিও না আসার কারণ কী হতে পারে তা কিন্তু সহজেই অনুমেয়। গবেষণা ছাড়াই যে কেউ এর কারণ বলতে পারবে। রাজনীতির ভেতর যে নীতি-বিবর্জিত মনোভাব, হিংসা-বিদ্বেষ, প্রতিহিংসা ও ক্রোধ, তা কিন্তু নেতৃস্থানীয় রাজনীতিকদের নেতিবাচক আচার-আচরণের যে সংস্কৃতি চর্চা, তারই ফলে ও তারই ভয়ংকর প্রভাব। যেখানে উপযুক্ত শিক্ষার লেশমাত্র নেই, দেখা যায় না। নেই উন্নতর চিন্তা-চেতনার বাধ্যবাধকতা। কারণ উপযুক্ত শিক্ষাগত যোগ্যতা, অভিজ্ঞতা নিয়ে এই শ্রেণির ব্যক্তিরা রাজনীতিতে নাম লেখায় না। যাওবা আছে তা অতি নগণ্য। একটা বড় অংশের রাজনীতিতে অনুপ্রবেশ ঘটে ব্যক্তিস্বার্থে। কখনোবা পারিবারিক স্বার্থে। উত্তরাধিকারী সূত্রে রাজনৈতিক ক্ষমতা হস্তান্তর হয়। আবার পেশিশক্তি, অবৈধ অর্থ, মাস্তানি ইত্যাদির প্রভাব, প্রতাপকে পুঁজি করে উক্ত বৈশিষ্ট্যকে শক্ত, দৃঢ়, বিস্তৃত ও স্থায়ী করতে তারা রাজনীতিতে নাম লেখায়। ফলে রাজনীতি কখনো-সখনো হয়ে ওঠে পেশিশক্তি, সন্ত্রাস ও অবৈধ অর্থের আখড়া। কোনো কোনো রাজনীতিক রাজনীতিকে পারিবারিক সম্পদ হিসেবে মূল্যায়ন করে। এমন সব আচরণ কখনোই অন্যদের কাছে তথা অরাজনৈতিক ব্যক্তিদের কাছে সুস্থ মানসিকতার পরিচয় দেয় না, তাদের আকৃষ্ট করে না তো বটেই এবং দলকেও ইতিবাচকভাবে এগোতে সহায়তা করে না। বরং এমন নেতিবাচক আচরণের কারণে দেশ ও জনগণ একাধারে রাজনীতিক ও রাজনীতির ওপর ক্রমশ আস্থা হারায়, রাজনীতিকে ভয় পায়। বলতে হয় যে, জ¦ালাও-পোড়াও রাজনৈতিক আচরণের পেছনে এমন রাজনৈতিক মনোভাব কাজ করে থাকে।
একটা সময় ছিল, শিক্ষিত, সৎ ও দেশপ্রেমিক ব্যক্তিরা রাজনীতিতে জড়াতেন। তারা মহৎ এক আদর্শ নিয়ে রাজনীতিতে নিজেদের জীবন বিসর্জন দিতেন, দিয়েছেন। সক্রিয় থেকেছেন এবং থাকতেন। তাদের জীবনযাপনে, আচার-আচরণে রাজনৈতিক আদর্শ ও দেশপ্রেম দৃশ্যমান থাকত। পঞ্চাশ ও ষাট দশকের রাজনীতিকদের যোগ্যতা ছিল উন্নত ও ন্যায়ভিত্তিক আদর্শের। মাতৃভাষা হিসেবে বাংলা ভাষায় কথা বলতে পারা এবং ’৭১-এ অর্জিত মহান স্বাধীনতা তারই উৎকৃষ্ট উদাহরণ। কিন্তু ১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্ট থেকে রাজনীতিতে অন্য ধারার প্রবেশ ঘটে, যা মুক্তিযুদ্ধের চেতনার বিপরীত ও পরিপন্থি। তখন থেকেই এদেশের রাজনীতিতে ভিন্ন ধরনের আদর্শের মিশ্রণ ঘটে। ১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্ট বঙ্গবন্ধুকে পরিবারসহ হত্যার যে রাজনীতি তা ছিল এক নৃশংস সন্ত্রাসী রাজনীতির উত্থান ও সূচনা। রাজনীতির সুস্থতা নষ্ট তখন থেকেই বলে অনেকে মনে করে থাকেন।
জরিপ করলে দেখা যাবে রাজনৈতিক দলগুলোতে শিক্ষিত ও যোগ্যতাসম্পন্ন অভিজ্ঞ ব্যক্তির সংখ্যা কতটা। নিশ্চয়ই ফলাফল সন্তোষজনক হবে না। এক অংশের রাজনীতিকরা যেভাবে ও যে বোধে কথা বলে তাতে সন্তুষ্টি বাড়াবে না নিশ্চিত। আবার যারা শিক্ষিত ও যোগ্যতাসম্পন্ন তারাইবা কী ভূমিকা রাখছে যাতে কিনা অরাজনৈতিক ব্যক্তি রাজনীতিতে সম্পৃক্ত হতে উৎসাহবোধ করে বা করবে। ওবায়দুল কাদের যে কথাগুলো বলেছেন তা যদি সবাই বোঝার চেষ্টা করেন ও বুঝে থাকেন তাহলে অন্তত নিজেদের আচার-আচরণ সম্পর্কে আরো সচেতন হবেন। হওয়ার কথা। আবার রাজনীতিতে ভালো লোক নেই বলেই কি ভালো লোক আসে না, এমন প্রশ্নের জবাবইবা কী হতে পারে। নিশ্চয়ই ভালো লোক আছে। ভালো লোক বলতে যা বোঝায় তা হলো, সামাজিক ও অর্থনৈতিকভাবে সৎ, নৈতিক মূল্যবোধসম্পন্ন একজন মানুষ। হাতে গোনা কিছুসংখ্যক রাজনীতিক আছেন যারা এই কাতারে পড়েন। কিন্তু মন্দের ব্যাপ্তি ও সংখ্যার আধিক্য এতটাই প্রবল ও প্রকট যে, ভালো যা কিছু তা আড়ালে পড়ে, আড়াল থাকে। সহজে ও সহসাই সামনে আসে না। তখন রাজনৈতিক মন্দটাই সবার চোখে পড়ে। ফলে মানুষ যা প্রত্যক্ষ করে সেটাকেই মানুষ সত্য হিসেবে গ্রহণ করে।
আবার কিছু অদক্ষ, অযোগ্য রাজনীতিক রাজনীতিকে পণ্যে পরিণত করেছেন। আদর্শ নয়, অর্থের বিনিময়ে এরা রাজনীতি করেন। রাজনীতিকে বেচাকেনা করেন, রাজনীতি নিয়ে বাণিজ্য করেন। রাজনীতি মানেই যেন আখের গুছিয়ে নেয়ার এক মহাসুযোগ। প্রয়োজনে এরা এক দল ত্যাগ করে অন্য দলে যোগ দেন। নাম লেখান। সাপের খোলস বদলের মতো এরা ক্ষণে ক্ষণে আদর্শ বদলান। এমন ধারণাও প্রচলিত আছে সমাজে, রাজনৈতিক দলগুলোর মাঠ, স্থানীয় ও কেন্দ্রীয় পর্যায়ের বিভিন্ন পদ বেচাকেনা হয় অনেক চড়ামূল্যে। এমনও শোনা যায় এই পদগুলো সাংসদ, মন্ত্রী, এমনকি প্রশাসনের চেয়েও বেশি ক্ষমতাধর ও শক্তিশালী হয়ে থাকে। রাজনীতির মাঠ যেন এরাই নিয়ন্ত্রণ করেন, পরিচালিত করেন। এসব পদের জন্য নাকি চলে বিভিন্ন ধরনের তদবির ও তোষামোদী। এমনকি পদ নিয়ে বাণিজ্যের কথাও শোনা যায়। রাজনৈতিক দলের একটি পদে থাকা মানে অনেক কিছু। আর ক্ষমতাসীন দলের পদ হলে তো আর কথা নেই। বিচক্ষণ ব্যক্তিরা মনে করেন, তৃণমূল পর্যায় থেকে শুরু করে কেন্দ্র পর্যন্ত যদি আদর্শবান রাজনীতিককে স্থান দেয়া যায় এবং তা যাচাই-বাছাই করে পরীক্ষিতভাবে তাহলে রাজনীতি সম্পর্কে জনগণের ধারণা বদলে যাবে, উন্নত হবে।
ছাত্র সংগঠন নিয়েও জনসাধারণের মনে অনেক অস্বস্তি ও বিব্রতকর অভিজ্ঞতা রয়েছে। ছাত্ররাও ব্যক্তি ও গোষ্ঠীর স্বার্থে রাজনীতিতে জড়ায়, রাজনীতি করে। রাজনীতি নয়, বরং বিভিন্ন সরকারি ও বেসরকারি প্রতিষ্ঠানের টেন্ডারবাজি, দখলদারিত্ব, সিট বাণিজ্য, চাঁদাবাজি ইত্যাদি নানা বিষয়ে চলে ছাত্র সংগঠনের কাজকারবার। পড়ালেখার বয়স শেষ হলেও এদের ছাত্রত্ব রয়ে যায় শুধু রাজনীতির প্রয়োজনে এবং নিজেদের ফায়দা লুটতে। শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের কর্তৃপক্ষ বিষয়টি জেনেও না জেনে থাকে।
এখানে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের কর্তৃপক্ষেরও রাজনৈতিক স্বার্থ রয়ে যায়। এমন অনেক বিবিধ কারণে রাজনীতির ভেতর যে সততা, নৈতিকতা ও স্বচ্ছতার অভাব তা সাধারণ জনগণকে টানে না। একজন পড়–য়া ও সচেতন ছাত্র চায়, পড়ালেখার সুস্থ পরিবেশ ও তার মৌলিক অধিকার ভোগ করতে। অতিরিক্ত কিংবা অবৈধ কোনো কিছুর প্রতি সে দুর্বল হয় না। আবার দেখা যায়, রাজনৈতিক দ্ব›দ্ব ছাত্রদের জীবননাশের কারণ হয়ে দাঁড়ায়। রক্তক্ষয়ী সংঘর্ষ সুখকর অভিজ্ঞতার জন্ম দেয়নি কখনো। ক্যাম্পাসে যত অপ্রীতিকর ঘটনার সূচনা তার পেছনেই রয়েছে রাজনৈতিক সংঘর্ষ ও দ্ব›দ্ব। ফলে সাধারণ শ্রেণির ছাত্ররা রাজনীতি থেকে দূরে সরে থাকে।
পরিশেষে বলব, রাজনীতিতে ভালো ও সৎ লোক নেয়ার জন্য প্রয়োজন বিদ্যমান আবর্জনা পরিষ্কার করা। চিন্তা-চেতনার ময়লা পরিষ্কার হলে একজন রাজনীতিকের যেমন গ্রহণযোগ্যতা বাড়বে, ঠিক তেমনি তার কারণে একজন শিক্ষিত ও যোগ্য ব্যক্তি রাজনীতিতে আসতে স্বাচ্ছন্দ্যবোধ করবে। এটা তো সত্য যে, মানবজাতি যা প্রত্যক্ষ করে তা-ই সে ধারণ করে এবং সেই মোতাবেক আচরণ করে। অপছন্দ বা ভীতিটা মানুষের অভিজ্ঞতারই ফলাফল।

স্বপ্না রেজা : কথাসাহিত্যিক ও কলাম লেখক।
[email protected]

মন্তব্য করুন

খবরের বিষয়বস্তুর সঙ্গে মিল আছে এবং আপত্তিজনক নয়- এমন মন্তব্যই প্রদর্শিত হবে। মন্তব্যগুলো পাঠকের নিজস্ব মতামত, ভোরের কাগজ লাইভ এর দায়ভার নেবে না।

জনপ্রিয়