আ.লীগ নেতা টিপু হত্যার প্রতিবেদন পেছাল

আগের সংবাদ

মাদকের বিরুদ্ধে ‘নতুন যুদ্ধ’ : তালিকায় ৯৩ শীর্ষ মাদক কারবারি, এক লাখ মাদকাসক্ত, জনসচেতনতা বাড়াতে প্রস্তুত অ্যাপ

পরের সংবাদ

পাকিস্তানে ক্ষমতার রশিটি কার হাতে?

প্রকাশিত: জানুয়ারি ১৩, ২০২৩ , ১২:০০ পূর্বাহ্ণ
আপডেট: জানুয়ারি ১৩, ২০২৩ , ১২:০০ পূর্বাহ্ণ

প্রকাশ্যে গুলিবিদ্ধ হয়েছিলেন পাকিস্তানের প্রাক্তন প্রধানমন্ত্রী এবং বর্তমানে ক্ষমতাচ্যুত ইমরান খান। এ নৃশংস ঘটনার সাক্ষী রয়েছে পাকিস্তানের ওয়াজিরাবাদ। রাজধানী ইসলামাবাদ থেকে প্রায় ২০০ কিলোমিটার দূরে গুজরানওয়ালা জেলার ওয়াজিরাবাদ শহরে ভিড়ে ঠাসা লংমার্চ থেকে হয়েছিল এ প্রাণঘাতি হামলা। এলোপাথাড়ি গুলির লক্ষ্য ছিলেন সদ্য প্রাক্তন প্রধানমন্ত্রী ইমরান খান। কিন্তু ভাগ্যজোরে তিনি প্রাণে বেঁচে গিয়েছেন। তার ডান পায়ে গুলি লেগেছিল। ঘটনায় মৃত্যু হয়েছে অন্য এক ব্যক্তির। আহত হয়েছিলেন ইমরানঘনিষ্ঠ সিনেটর ফয়জল জাভেদসহ আরো কয়েকজন পিটিআই নেতাকর্মী। পিটিআই কর্মীরা ভিড় থেকে গ্রেপ্তার করে হামলাকারীকে। আক্রমণকারী যুবক জানিয়েছে, ‘ইমরান খানকে খতম করতে এসেছিলাম। কারণ ও মানুষকে ভুল বোঝাচ্ছে।’ ঠিক একই কায়দায় ২০০৭ সালের ২৭ ডিসেম্বর রক্তাক্ত স্মৃতির ঘটনা মনে করিয়ে দেয় পাকিস্তান। সেদিনও ভিড় থেকে চলেছিল গুলি। টার্গেট ছিলেন সেদিনের প্রাক্তন প্রধানমন্ত্রী বেনজির ভুট্টো। নির্বাচনী প্রচার সভা শেষে সেদিন আততায়ীর গুলিতে প্রাণ গিয়েছিল বেনজির ভুট্টোর। পাকিস্তানের ওয়াজিরাবাদ যেন সেই নির্মম ঘটনারই হুবহু পুনরাবৃত্তি।
হামলার নেপথ্যে তিনজনের হাত থাকতে পারে বলে অভিযোগ করেন ইমরান খান। পাকিস্তানের প্রধানমন্ত্রী শাহবাজ শরিফ, অভ্যন্তরীণ মন্ত্রী রানা সানাউল্লা এবং আইএসআইয়ের প্রধান মেজর জেনারেল ফয়জল নাসির। ইমরান খানকে নিশ্চিত মৃত্যুর হাত থেকে বাঁচিয়েছেন বছর তিরিশের এক পিটিআই কর্মী। যখন ইমরানের ওপর গুলি হামলা চালানো হচ্ছে, তখন হামলাকারীর পেছনেই ছিলেন তিনি। ঠিক সময়ে হামলাকারীর বন্দুক ধরা হাতটি টেনে নেন তিনি। লক্ষ্যভ্রষ্ট হয় ছয় রাউন্ড গুলি। ফলে গুলি বুকে না লেগে ইমরানের পায়ে লাগে। ইমরানের সঙ্গীদের গুলিতে গুরুতর আহত ওই হামলাকারী যুবকের কিছুক্ষণ পরই মৃত্যু হয় বলে সংবাদ সংস্থা এফপিআই নিশ্চিত করে। পাকিস্তানের প্রাক্তন প্রধানমন্ত্রী ইমরান খান রোড শোয়ে গুলিবিদ্ধ হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে কিছু প্রশ্ন উত্থাপিত হয় পাকিস্তানজুড়ে। পাকিস্তানের সেনাপ্রধান জেনারেল বাজওয়ার অবসর নেয়ার কথা ছিল সে মাসেই। পাকিস্তানের রাজনৈতিক পরিস্থিতি যখন নৈরাজ্যের পথে যাচ্ছিল, পাকিস্তানের সর্বোচ্চ আদালত ঠিক তখনই বলেছিল- দেশের আর্থিক সংকট যখন চরমে, তখন এভাবে রাজনৈতিক অস্থিরতাকে নৈরাজ্যের পথে ঠেলে না দিয়ে যথোচিত ব্যবস্থা নিতে হবে। আপাতত সেনাশাসন প্রতিষ্ঠিত করে রাজনৈতিক সংকটের নিরসন হোক। পাকিস্তান ঘরপোড়া গরু। পাক আদালত যে সেখানকার সেনাবাহিনী দ্বারা কতটা নিয়ন্ত্রিত, সে কথা পাকিস্তানে কারো অবিদিত নয়। তাই সর্বোচ্চ আদালতের ইঙ্গিত, পাক সেনাপ্রধানের পদে নতুন কেউ আসা, প্রধানমন্ত্রী শাহবাজ শরিফ এবং প্রাক্তন প্রধানমন্ত্রী ইমরান খানের বৈরিতা- সব মিলিয়ে পাকিস্তানকে একটি অনিশ্চয়তার পথে ঠেলে দিয়েছিল সে সময়টা।
ষড়যন্ত্রের কথা বারবার আলোচনায় আসে। কারণ দেশটির নাম পাকিস্তান। পাকিস্তানের প্রথম প্রধানমন্ত্রী লিয়াকত আলী খানের আততায়ীর হাতে ১৯৫১ সালে হত্যা দিয়ে শুরু তাদের রাজনীতিবিদদের ওপর আক্রমণের ইতিহাস। প্রাক্তন প্রধানমন্ত্রী ইউসুফ রাজা গিলানিও আক্রান্ত হন একই কায়দায়। বেনজিরকে আততায়ী হত্যা করলেও তার বাবা জুলফিকার আলী ভুট্টোকে ১৯৭৯ সালে এক সামরিক অভ্যুত্থানের পর ফাঁসি দেয়া হয়। এমন গোলমেলে রাজনৈতিক পরিস্থিতিতে পাকিস্তানে সবচেয়ে বড় প্রশ্ন ছিল- কে হবেন সেনাপ্রধান? পাকিস্তানের সংবিধান অনুযায়ী প্রধানমন্ত্রী নাম দেন এবং প্রেসিডেন্ট সেনাপ্রধানকে মনোনীত করেন। শরিফ ও ইমরান এ ব্যাপারে বোঝাপড়ার চেষ্টা করেন। এর মধ্যে বিদায়ী সেনাপ্রধান চারটি নাম দিয়েছিলেন- লেফটেন্যান্ট জেনারেল আসিম মুনির, লেফটেন্যান্ট জেনারেল আজহার আব্বাস, লেফটেন্যান্ট জেনারেল ফইজ হামিদ, লেফটেন্যান্ট জেনারেল শামশাদ মির্জা। এদের সঙ্গে সঙ্গে আরো নাম এসেছিল লেফটেন্যান্ট জেনারেল মুহম্মদ আমির এবং জেনারেল কামার জাভেদ বাজওয়ার। ঠিক এ সময়ে জেনারেল বাজওয়া ওয়াশিংটনে সফরে যান এবং অবসরে যাওয়ার অঙ্গীকার তাদের ব্যক্ত করেন। তার সফরসঙ্গী ছিলেন চিফ অব জেনারেল স্টাফ আজহার আব্বাস। ইমরান খানের প্রার্থী ছিলেন ফইজ হামিদ। ইমরান প্রধানমন্ত্রী থাকা অবস্থায় ফইজ হামিদকে আইএসআই প্রধান হিসেবে নিয়োগ দিতে চেয়েছিলেন। কিন্তু সেনাপ্রধান বাজওয়ার বাধার কারণে তা করতে পারেননি। তা নিয়েই বাজওয়ার সঙ্গে ইমরানের বিরোধ সবার সামনে আসে।
জেনারেল বাজওয়া পাকিস্তানের সেনাপ্রধান হিসেবে দুটো টার্মে ছিলেন। এবার এ পদে থাকবেন না- এমনটাই নিশ্চিত করে এসেছেন আমেরিকায় গিয়ে। জেনারেল জিয়া ও আসলাম বেগের পর জেনারেল বাজওয়া সবচেয়ে ক্ষমতাশালী সেনাপ্রধান ছিলেন পাকিস্তানে। পাকিস্তানে এ কথা সবাই বিশ্বাস করে, সেনাপ্রধানের হাত ধরেই ইমরান পাকিস্তানের প্রধানমন্ত্রী হতে পেরেছিলেন। কিন্তু শেষ সময়ে বিশেষ করে আইএসআই প্রধান নিয়োগ নিয়ে বিরোধ বাধে বাজওয়া এবং ইমরানের মধ্যে। এ বিরোধের বড় রকম ঝাঁকুনিতেই ইমরান খানকে ঝরে পড়তে দেখা যায়। গদিচ্যুত হতেও সময় লাগে না। ইমরান ক্ষমতাচ্যুত হয়ে বারবার আঙ্গুল তোলেন সেনাবাহিনীর ওপর। এবার এসেছেন নতুন সেনাপ্রধান পাকিস্তানে। পাকিস্তানের পরবর্তী সেনাপ্রধান হিসেবে লেফটেন্যান্ট জেনারেল আসিম মুনিরকে বেছে নিয়েছেন প্রধানমন্ত্রী শাহবাজ শরিফ। বিদায়ী সেনাপ্রধান বাজওয়ার ঘনিষ্ঠ হিসেবে পরিচিত মুনির ছিলেন পাকিস্তানি সেনার কোয়ার্টার মাস্টার জেনারেল পদে। ২০১৮-এর অক্টোবর থেকে ২০১৯-এর জুন পর্যন্ত তিনি ছিলেন আইএসআইয়ের ডিজি। পাকিস্তানে সেনাপ্রধানের নিয়োগটি বেশ গুরুত্বপূর্ণ বিষয়। সব স্টকহোল্ডারই তা নিয়ে ভাবেন। অনেক সময় তা অধিক গুরুত্ব পায়। এমনকি কে হবেন পরবর্তী প্রধানমন্ত্রী তার থেকেও বেশি। বিষয়টি এজন্যই এমনভাবে ভাবতে অভ্যস্ত পাকিস্তানের জনসাধারণ, সরকারি কর্মকর্তা এবং অন্য বাহিনীর কর্মকর্তারা। কেননা তাদের বিশ্বাস- সেনাবাহিনীর হাতেই থাকবে ক্ষমতার মূল রশি। স্টিফেন ফিলিপ কোহেনের বিখ্যাত বই ‘দ্য আইডিয়া অব পাকিস্তান’-এ লেখা সেই উক্তিটি মানুষ বিশ্বাস করে- ‘পাকিস্তানের সেনাবাহিনী যে পথে চলে, সে পথেই চলে পাকিস্তান।’ তার এ মন্তব্যটি পাকিস্তানের কেউ উড়িয়ে দিতে পারেনি কখনো। ইমরানের ক্ষমতা গ্রহণের সময়ও এমনটা বলা হতো- সামনে থাকবেন ইমরান, কিন্তু ক্ষমতার পেছনে পাকিস্তানের সেনাবাহিনী। ঠিক তাই যেন প্রতিফলিত হলো তার শাসনামলে। যখন তার সঙ্গে সেনাবাহিনীর মতবিরোধ দেখা দিল বিশেষভাবে আইএসআই প্রধান নিয়োগের সময়, ইমরানকে বাধ্য হতে হলো সেনাবাহিনী প্রধানের নিয়োগকেই মেনে নিতে। শুধু সেখানেই শেষ নয়, তাকে বিদায় নিতে হয় রাজনৈতিক ধূম্রজালের মধ্যে এবং বিদায় শেষে ঠিক ইমরান তার গদিচ্যুত হওয়ার কারণ হিসেবে সেনাবাহিনীকেই দায়ী করেন।
পাকিস্তান যেন ঘরপোড়া গরু। কিছু একটা হলেই সবাই মনে করে বসে- এই বুঝি সেনাশাসন এলো। ইমরান ক্ষমতাচ্যুত হলে এবং বিশেষভাবে গুলিবিদ্ধ হলে পাকিস্তানের রাজনৈতিক অবস্থায় নতুন প্রশ্ন যোগ হয়ে যায়। প্রধানমন্ত্রী শাহবাজ শরিফকে সরিয়ে আবার সেনাবাহিনী ইমরানের সঙ্গেই ক্ষমতায় প্রতিষ্ঠিত হবে এমনটা জোরেসোরে শোনা যায়। পাকিস্তানের আদালত যে সেখানকার সেনাবাহিনী দ্বারা কতটা নিয়ন্ত্রিত, তার একটি প্রমাণ ইদানীং লক্ষ্য করা গেল। ইমরান গুলিবিদ্ধ হওয়ার পর পাকিস্তানের অভ্যন্তরীণ রাজনীতি হোঁচট খেলে পাকিস্তানের সর্বোচ্চ আদালত বলে দিল- ‘দেশের আর্থিক সংকট যখন চরমে, তখন এভাবে রাজনৈতিক অস্থিরতাকে নৈরাজ্যের পথে ঠেলে না দিয়ে যথোচিত ব্যবস্থা নিতে হবে। আপাতত সেনাশাসন প্রতিষ্ঠিত করে রাজনৈতিক সংকটের নিরসন হোক।’ তাদের প্রেসক্রিপশন অনুযায়ী শেষ পর্যন্ত অবশ্য তা বাস্তবায়ন হয়নি। অদৃশ্য হাতের ইশারায় সেনাশাসন আসেনি কিংবা সেনার মনোনীত অন্তর্বর্তীকালীন সরকার আসেনি; সেনাপ্রধান বাজওয়া অবসরে গিয়েছেন এবং নতুন সেনাপ্রধান মুনির আপাতত ক্ষমতা গ্রহণের কোনো চেষ্টা করেননি। কিন্তু তা না হলেও পাকিস্তানের মানুষের সেনাশাসন কিংবা সেনাক্ষমতার রশিটির গল্প থেকেই গিয়েছে সবসময়।
কে না জানে, প্রাক্তন পাক প্রধানমন্ত্রী ইমরান খানের ঘনিষ্ঠ এবং সেনার সমালোচক হিসেবে পরিচিত শরিফ আরশাদকে খুন করা হয় আফ্রিকার দেশ কেনিয়ার রাজধানী নাইরোবিতে। রাষ্ট্রদ্রোহের অভিযোগ থেকে বাঁচতে দেশ ছেড়ে কেনিয়ায় পালিয়েছিলেন শরিফ। পাকিস্তানের টিভি চ্যানেল এআরওয়াইর সঙ্গে যুক্ত ছিলেন শরিফ। গত আগস্ট ২০২২ তারিখে ওই চ্যানেলের প্রতিনিধি হিসেবে সাক্ষাৎকার নিয়েছিলেন বিরোধী নেতা শাহবাজ গিলের। সেই সাক্ষাৎকারে গিল জানিয়েছিলেন, সংখ্যাগরিষ্ঠের বিরুদ্ধে যায় এমন নির্দেশ মানা উচিত নয় সেনাবাহিনীর জুনিয়ার অফিসারদের। ওই সাক্ষাৎকারের জেরে সরকারি রোষের মুখে পড়ে এআরওয়াই টিভি চ্যানেল এবং তা সাময়িকভাবে বন্ধ করে দেয়া হয়। শরিফের বিরুদ্ধে জারি করা হয় গ্রেপ্তারি পরোয়ানা। এর পরই দেশ ছেড়েছিলেন তিনি। কিন্তু তাতেও তার প্রাণ রক্ষা হয়নি।
পাকিস্তান নামের দেশটি ক্রমান্বয়ে ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে, ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে তাদের আর্থিক অবস্থার, তাদের রাজনৈতিক স্থিতিশীলতার এবং সামাজিক উন্নয়নের। বাধাগ্রস্ত হচ্ছে তাদের হৃত গৌরব আর সম্মানের। অধঃপতনের খাতায় তাদের নাম বড়সড় করে উচ্চারিত হচ্ছে বিশ্ব রাজনীতিতে। আর পাল্লা দিয়েই চলছে তাদের অভ্যন্তরীণ রাজনীতি আর বিচার ব্যবস্থায় পাকিস্তান সেনাবাহিনীর বলিষ্ঠ নিয়ন্ত্রণ। কেউ বলে না দিলেও পাকিস্তানের মানুষ ইতোমধ্যে বুঝে নিয়েছে, তাদের দেশের মূল ক্ষমতার রশিটি তাদের সেনাবাহিনীর হাতেই।

সুধীর সাহা : কলাম লেখক।
[email protected]

মন্তব্য করুন

খবরের বিষয়বস্তুর সঙ্গে মিল আছে এবং আপত্তিজনক নয়- এমন মন্তব্যই প্রদর্শিত হবে। মন্তব্যগুলো পাঠকের নিজস্ব মতামত, ভোরের কাগজ লাইভ এর দায়ভার নেবে না।

জনপ্রিয়