প্রতিবন্ধী ব্যক্তিদের জন্য চাকরি মেলা

আগের সংবাদ

গুচ্ছের ২২ বিশ্ববিদ্যালয়ে ক্লাস শুরু হয়নি : অনিশ্চয়তায় ২১ হাজার শিক্ষার্থী

পরের সংবাদ

পররাষ্ট্রমন্ত্রীর কূটনীতিকদের নিয়ে আক্ষেপ যুক্তিসঙ্গত

প্রকাশিত: জানুয়ারি ৯, ২০২৩ , ১২:০০ পূর্বাহ্ণ
আপডেট: জানুয়ারি ৯, ২০২৩ , ১২:০০ পূর্বাহ্ণ

বাংলাদেশের পররাষ্ট্রমন্ত্রী ড. এ কে আব্দুল মোমেন একটা ক্ষুব্ধ প্রশ্ন করেছেন, সুযোগ-সুবিধা সর্বোচ্চ পেয়েও বিদেশে নিয়োগপ্রাপ্ত আমাদের কূটনীতিকরা নিজ দেশের জন্য কী কাজ করছেন? তাদের কী কী করার কথা? সে প্রসঙ্গে মন্ত্রীমশাই পরিষ্কার বলেছেন, কূটনীতিকদের তিনটি কাজ- বিদেশে নিজ দেশের ভাবমূর্তি উজ্জ্বল করার উদ্যোগ নেয়া, অপপ্রচার হলে কারা করছে তাদের বুঝিয়ে নিবৃত্ত করা ও দেশের উন্নয়নের কাজ প্রচার করা। গত রবিবার আন্তঃমন্ত্রণালয় কমিটির বৈঠকের পর মিশনপ্রধানদের সঙ্গে ভার্চুয়াল বৈঠকে এই কথাগুলো বলেছেন পররাষ্ট্রমন্ত্রী ড. এ কে মোমেন। বর্তমানে বিদেশে বাংলাদেশের মোট ৪৯টি আবাসিক কূটনৈতিক মিশন ও ১১টি সাব-মিশন আছে। প্রচলিত নিয়ম অনুযায়ী, মিশনপ্রধানের ৭০ ভাগ পেশাজীবী কূটনীতিকদের মধ্য থেকে এবং বাকি ৩০ ভাগ সরকারপ্রধানের ইচ্ছা অনুযায়ী অকূটনীতিক ব্যক্তিদের মধ্য থেকে নিয়োগ দেয়া হয়। কোনো বন্ধুরাষ্ট্রে রাষ্ট্রদূত বা হাইকমিশনার বাংলাদেশের রাষ্ট্রপতির প্রত্যক্ষ প্রতিনিধি হিসেবে নিয়োগ পান এবং স্বাগতিক দেশের রাষ্ট্রপ্রধান দ্বারা স্বীকৃত হন। সে জন্য তিনি ওই দেশের ঊর্ধ্বতন মহলে অবাধ যাতায়াতের সুযোগ পান এবং উভয় দেশ ও সরকারের দ্বিপক্ষীয় সম্পর্ক উন্নয়নের জন্য সম্পূর্ণ দায়ী থাকেন। তার আক্ষেপ, এরই মধ্যে সরকারবিরোধী একটি চক্র বিদেশে বসে বাংলাদেশের বিরুদ্ধে ষড়যন্ত্র করছে। বিশেষ করে গণতন্ত্র, মানবাধিকার, আইনের শাসন নিয়ে অপপ্রচার চালাচ্ছে। এর ফলে আন্তর্জাতিক বিশ্বে বাংলাদেশের ভাবমূর্তি ক্ষুণ্ন হচ্ছে এবং বাংলাদেশ সম্পর্কে বহির্বিশ্বে অপপ্রচার ঠেকাতে আমাদের কূটনীতিকদের একটি অংশ নির্বিকার। ফলে বাংলাদেশের প্রশাসনের ‘এলিট’ ক্যাডার হিসেবে পরিচিত পররাষ্ট্র ক্যাডারের কর্মকর্তাদের সক্ষমতা, যোগ্যতা এবং দেশপ্রেম নিয়ে নতুন করে প্রশ্ন উঠেছে। আন্তর্জাতিক রাজনীতি নিয়ে দীর্ঘদিন চর্চার পরে আমার মনে হয়েছে, বাংলাদেশের পররাষ্ট্রমন্ত্রী ড. এ কে আব্দুল মোমেন একটা রূঢ় সত্য হাটের মাঝে বলে ফেলেছেন। এ কথায় অবশ্যই অনেক আমলাই ক্ষুব্ধ হবেন কিন্তু মন্ত্রীমশাইয়ের প্রত্যাশা অবাস্তব নয়।
প্রথম কাজ নিয়ে তিনি বলেছেন, বিদেশে কূটনীতিকদের প্রথম কাজ হলো নিজ দেশের ভাবমূর্তি উজ্জ্বল করার উদ্যোগ নেয়া। এটা সব দেশে সব কূটনীতিকের কাজ। কিন্তু করবেন কী করে? সংবাদ মাধ্যমে বিজ্ঞাপন দিয়ে? নাকি সমাজের প্রভাবশালী ব্যক্তিবর্গের কাছে নিজ দেশের উজ্জ্বল দিক তুলে ধরতে হবে এবং তারা যাতে তার প্রচার করেন সে বিষয়ে সচেষ্ট হতে হবে। এখানে সবচেয়ে বড় মার খাচ্ছে বাংলাদেশের কূটনীতিকরা। সাম্প্রতিক কয়েকটি ঘটনা বলি।
প্রথম ঘটনা : কলকাতায় অনুষ্ঠিত বাংলাদেশ চলচ্চিত্র উৎসব। গত ২৯ নভেম্বর, ২০২২, পাঁচ দিনব্যাপী বাংলাদেশ চলচিত্র উৎসব অনুষ্ঠিত হলো বাংলাদেশ সরকারের তথ্য ও সম্প্রচার মন্ত্রণালয়ের উদ্যোগে এবং কলকাতার বাংলাদেশ উপহাইকমিশনের ব্যবস্থাপনায়। কিন্তু প্রচারের পুরো আলো টেনে নিয়ে গেল চঞ্চল চৌধুরী অভিনীত, মেজবাউর রহমান সুমন পরিচালিত ‘হাওয়া’ ছবিটি। তা নিক। কিন্তু যেটা লক্ষণীয় তা হলো বাকি ৩৬টি ছবি নিয়ে কোনো মাধ্যমে কোনো আলোচনা নেই। ‘হাসিনা : আ ডটার’স টেল’ পিপলু খানের ছবি ২০১৮ সালের নভেম্বরে মুক্তি পাওয়া, যা ছিল প্রচার থেকে অনেক দূরে। ২০২১ সালের বাংলাদেশি বাংলা ভাষার জীবনীমূলক চলচ্চিত্র ‘চিরঞ্জীব মুজিব’ প্রদর্শনের জন্যে ছিল। কিন্তু প্রচারহীন ছিল। ‘পরাণ’, ‘গুণীন’, ‘কালবেলা’, ‘বিউটি সার্কাস’, ‘শাটল ট্রেন’ ও ‘লাল মোরগের ঝুঁটি’ সম্পর্কে একই কথা বলা যায়। প্রখ্যাত চিত্রপরিচালক সত্যজিৎ রায় বলেছিলেন, একটি দেশের আর্থসামাজিক ও রাজনৈতিক চিত্রের প্রতিনিধিত্ব করে সে দেশের ছবি, যার সার্বিক প্রচার প্রয়োজন। বাংলাদেশ চলচ্চিত্র উৎসবে বাংলাদেশের আর্থসামাজিক অগ্রগতির চিত্র, আপসহীন ধর্মনিরপেক্ষতা, বন্ধুত্বের মানসিকতার সব উপাদান নিয়ে আসা এতগুলো চলচ্চিত্র থাকা সত্ত্বেও সেভাবে প্রতিফলিত হয়নি।
দ্বিতীয় ঘটনা : ঘটনাটা ঘটে গেছে কিনা জানা নেই। তবে ঘটার উদ্যোগ নেয়া হয়েছে। বাংলাদেশের উন্নয়নের পথে নতুন গর্বের নাম পদ্মা সেতু ও মেট্রোরেল। এপার বাংলার কিয়দংশ সংবাদ পেয়েছে অবশ্যই, কিন্তু প্রমত্ত পদ্মা নদীর উপরে এই পদ্মা সেতু নির্মাণ যে বাংলাদেশের শ্লাঘার শিরদাঁড়া, আত্মবিশ্বাসের মেরুদণ্ড সেই অনুভূতিটা জানতে পারেননি। তারা জানতে পারেননি পদ্মা সেতু নির্মাণের বাধা ও ইতিহাস। কেন? কারণ এপার বাংলায় প্রচার নেই। একই কথা প্রযোজ্য মেট্রোরেল সম্পর্কে। বাংলাদেশের তথ্য ও সম্প্রচার মন্ত্রণালয় কলকাতা প্রেস ক্লাবকে সম্প্রতি বার্তা পাঠিয়েছে যে, তাদের সরকারি আতিথেয়তায় কিছু সাংবাদিককে পাঠাতে গর্বের পদ্মা সেতু দেখানো হবে। হয়েছে কিনা জানা নেই বা কবে হবে, তাও জানা নেই। তবে এর আগে এ রকম দল বেঁধে অনেকেই সরকারি আতিথ্যে গেছেন এবং খেয়ে দেয়ে মুখ মুছে চলে এসেছেন কিন্তু প্রচারে কৃপণ থেকেছেন। লাভের লাভ কিছু হয়নি। সরকার যদি জনগণের অর্থ ব্যয় করে পদ্মা সেতু দেখাতেই চায়, তাহলে বেছে নিন সেই সব মানুষকে, যাদের প্রভাব সমাজে আছে এবং তারা ফিরে এসে এই সাফল্যের কথা লিখবেন ও বলবেন।
তৃতীয় ঘটনা : বাংলাদেশের ভিসা পেতে গেলে কলকাতায় (অন্য কোনো শহরে নয়) আবেদন করতে হয় একটি বেসরকারি সংস্থার মাধ্যমে। সেখানে প্রসেসিং ফি ৮২৫ টাকা, ফর্ম পূরণ করে দিতে ৩০০ টাকা আর যদি আপনি সামান্য বেশিদিনের ভিসা প্রত্যাশা করেন, তাহলে আপনার বাসায় ভিসাসহ পাসপোর্ট পাঠানোর জন্যে ৪০০ টাকা দেবেন। যদি নিজে ফর্ম ফিলআপ করে কোনো সুবিধা না নিয়ে জমা দেন, তাহলে ৩ মাসের ভিসা পাবেন। রেফারেন্স থাকলে ৬ মাস। কূটনৈতিক কেউ চেনা হলে ১ বছর। কলকাতায় ভিসা হাতে পেতে কমপক্ষে ১৫ থেকে ২২ দিন লাগে। কিন্তু দিল্লি, আগরতলা, গৌহাটি কোথাও কোনো টাকা লাগে না। ১-২ দিনের মধ্যে ভিসা পাওয়া যায়। এপার বাংলার বাঙালিদের সঙ্গে ওপার বাংলার আত্মিক টান আছে। বিশেষত সাংস্কৃতিক ক্ষেত্রে। আগামী ২১ ফেব্রুয়ারি এবং অমর একুশে গ্রন্থমেলায় যাওয়ার জন্য অনেকেই ভিসার আবেদন করবেন। সে ক্ষেত্রে এই বিলম্ব আবেদনকারীকে হতাশ করবে, যদি সে না যেতে পারে।
চতুর্থ ঘটনা : কলকাতায় গত ডিসেম্বরের শুরুতে হওয়া বইমেলা। হল কোথায়? কলেজ স্কোয়ার সংলগ্ন চত্বরে। মেট্রোরেল স্টেশন দূরে। বই ব্যবসায়ী ছাড়া সাধারণ পাঠক যায় কি? নন্দন চত্বরে কেন হলো না? কেন অনুমতি পাওয়া গেল না? প্রকাশকরা যে এত খরচ করে ও কষ্ট করে এলেন, তাতে তাদের লাভ তো দূরের কথা কতটা ক্ষতি শিকার করতে হয়েছে, তা সংশ্লিষ্ট কূটনীতিকরা জানেন? অথচ নন্দন চত্বরে হলে ভিড়ে পা রাখার জায়গা পাওয়া যেত না। পশ্চিমবঙ্গের মুখ্যমন্ত্রীর সাহায্য চাওয়া হয়েছিল? আর যদি সিদ্ধান্ত মনমতো না হয়, তাহলে মেলা না করলে কী এমন মহাভারত অশুদ্ধ হতো? মন্ত্রীমশাইয়ের দ্বিতীয় নিদান হলো- অপপ্রচার হলে কারা করছে তাদের বুঝিয়ে নিবৃত্ত করা ও দেশের উন্নয়নের কাজ প্রচার করা। বাংলাদেশের অপপ্রচার রাজনৈতিক উদ্দেশ্যপ্রণোদিত না হলে কলকাতায় হয় না। বাংলাদেশের সংখ্যালঘু সংগঠনের নেতাকর্মীদের নিয়ে আগে কলকাতায় সেমিনার হয়েছিল এবং হতো। ইদানীং তা হয়েছে বলে জানা নেই। এই উদ্যোগের পুনর্জীবন দরকার। বাংলাদেশের ধর্মনিরপেক্ষতার চর্চা নিয়ে আমি নিঃসন্দেহ বারবার বাংলাদেশে গেছি ও মানুষের সঙ্গে মিশেছি বলে। কিন্তু সবাই তো তা নয়। মন্ত্রীমশাইয়ের তৃতীয় নিদান হলো- দেশের উন্নয়নের কাজ প্রচার করা। এই ক্ষেত্রে একটা কথা সোচ্চারে বলব, তা হলো এর আগে যারা এখানে কূটনীতিকের ভূমিকা পালন করেছেন, তারা স্থানীয় বিভিন্ন সাংস্কৃতিক ও সামাজিক অনুষ্ঠানে অংশ নিতেন। তাদের সঙ্গে কলকাতার সব বুদ্ধিজীবী ও সমাজে প্রভাবশালী মানুষের অত্যন্ত ভালো সম্পর্ক ছিল। বিভিন্ন অনুষ্ঠানে তারা প্রধান অতিথির ভূমিকা পালন করতেন। তারা বিভিন্নভাবে বাংলাদেশের উন্নয়নের কথা ও বঙ্গবন্ধুর বাণী প্রচার করতেন। বিজয় দিবসে দেখেছি, নেতাজী ইনডোর স্টেডিয়াম বা রবীন্দ্র সদনে অনুষ্ঠান করতেন। এখন আর সেসব চোখে পড়ে না। রেজওয়ানা চৌধুরী বন্যা বা বাংলাদেশের নামি পুরনো ব্যান্ড (যারা বামবা’র সদস্য) নিয়ে অনুষ্ঠান করে দেখুন রবীন্দ্র সদনে। ভিড় উপচে পড়বে। দেশের উন্নয়নের কাজ প্রচার করতে হলে মানুষ চাই। চাই জমায়েত। অন্যান্য দেশের রসায়ন বলতে পারব না, তবে বাংলাদেশ নিয়ে বাড়তি আবেগ এপারের বাঙালিদের তুমুল। এখানে সহজেই মানুষ সঙ্গে চলে আসে। এখানে উদ্যোগ থাকলে কাজ করা সহজ। বরং দিল্লিতে নিযুক্ত কূটনীতিকরা অনেক প্রতিবন্ধকতার মুখোমুখি হন অথচ তারা নিঃশব্দে যেভাবে কাজ করে চলেছেন, তা প্রশংসার দাবি রাখে।

অমিত গোস্বামী : কবি ও লেখক।

মন্তব্য করুন

খবরের বিষয়বস্তুর সঙ্গে মিল আছে এবং আপত্তিজনক নয়- এমন মন্তব্যই প্রদর্শিত হবে। মন্তব্যগুলো পাঠকের নিজস্ব মতামত, ভোরের কাগজ লাইভ এর দায়ভার নেবে না।

জনপ্রিয়