প্রাথমিকের শিক্ষক নিয়োগের ফল ১৪ ডিসেম্বর

আগের সংবাদ

১৭২ দেশে শ্রমবাজার : রেমিট্যান্স কমছে যে কারণে

পরের সংবাদ

শিশু আয়াত হত্যার উদ্দেশ্য ও কৌশল পুরনো : হত্যা রোধে নতুন ভাবনা কী

প্রকাশিত: নভেম্বর ৩০, ২০২২ , ১২:০০ পূর্বাহ্ণ
আপডেট: নভেম্বর ৩০, ২০২২ , ১২:০০ পূর্বাহ্ণ

পাঁচ বছরের আয়াতের ছবি সোশ্যাল মিডিয়ায় ঘুরছে। ফুটফুটে এক শিশু। হাসিমাখা চেহারা। চোখজোড়া যেন কথা বলে। দ্যুতি ছড়ানো চোখ। সোশ্যাল মিডিয়ায় ঘোরাফেরা বেশ ক’টি ছবির মধ্যে একটা ছবিতে তার পরনে ছিল সম্ভবত আর্জেন্টিনার জার্সি। মনে হলো ফুটবল বিশ্বকাপকে কেন্দ্র করে সম্প্রতি তোলা এই ছবিটা। এই ছবি দেখে আয়াতের বয়সটা অনুমান করা যায় সহজে। তার শিশুসুলভ উচ্ছলতা অনুধাবন করা যায়। তার আদুরে চেহারায় কমবেশি সবার চোখই আটকে পড়েছে। এই নির্মল, নিষ্পাপ শিশুকে কীভাবে শ্বাসরুদ্ধ করে হত্যা করে কয়েক টুকরো করা সম্ভব! এমন বিস্ময় প্রকাশ করা, আকাশ থেকে পড়া মনোভাবের মানুষগুলোর মন ভেঙে তছনছ হলেও পাষণ্ড হত্যাকারীর মন বিন্দুমাত্র কাঁপেনি, কাঁপে না। আয়াতকে মুক্তিপণের দাবিতে অপহরণ করার পর হত্যা করা হয়েছে বলে অভিযোগ উঠেছে। যে নিকৃষ্ট ব্যক্তি এই নৃশংস হত্যাকাণ্ড ঘটিয়েছে সে স্বীকার করেছে হত্যার বিষয়টি এবং কী কারণে, কীভাবে হত্যা করেছে তারও বর্ণনা দিয়েছে।
আয়াত কিন্তু নৃশংস হত্যার শিকার প্রথম ও একমাত্র শিশু নয়। আয়াতকে যেভাবে হত্যা করা হয়েছে, তাও হত্যার নতুন ধরন বা কৌশল নয়। ইন্ডিয়ার ক্রাইম পেট্রোল বা সিআইডি সিরিয়াল দেখে হত্যার কারণ ও কৌশল শেখার কথা এর আগেও অনেক হত্যাকারী বলেছে। স্বীকার করেছে এবং সেটা আটক হওয়ার পর। সাধারণত দেখা যায় যে, তদন্তকারীরা তদন্ত করে তেমন তথ্য দিয়ে থাকে। এটা ঠিক যে, অপরাধ একটা বেপরোয়া সংক্রমণ প্রক্রিয়া, যা প্রত্যক্ষ বা দেখে শেখা হয় প্রাথমিকভাবে। তারপর তার সঙ্গে লাগে দুঃসাহস, যা সমাজের অব্যবস্থাপনা ও অনিয়ন্ত্রিত পরিবেশ থেকে সে পেয়ে থাকে। যা হোক, পরিপূর্ণভাবে প্রতিরোধমূলক ব্যবস্থা গ্রহণ করা না হলে এই সংক্রমণ প্রক্রিয়া বহুগুণে পোক্ত হয় এবং তা বিস্তার লাভ করে। ইন্ডিয়ার ক্রাইম পেট্রোল বা সিআইডি দেখে অপরাধের কৌশল শেখা ও অপরাধ করা যদি সত্যি হয়ে থাকে তাহলে এই বিষয়ে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর সুপারিশ কী কিংবা তারা এসব সিরিয়াল প্রদর্শনীর বিরুদ্ধে কী ব্যবস্থা নেয়ার জন্য তৎপর থেকেছে বা কাজ করেছে, সেই বিষয়টি জানা জনসাধারণের দাবির পর্যায়ে পড়ে বৈকি। কিছুদিন আগে দেখা গেছে, ইউটিউবে হিরো আলম রবীন্দ্রসংগীত সঠিকভাবে না গাওয়ায় তাকে ডিবি কার্যালয়ে ডেকে এনে মুচলেকা নেয়া হয়েছে। জনগণ বুঝে নিয়েছে এতে, অপসংস্কৃতির বিরুদ্ধে দেশের আইন সোচ্চার। যদিও হিরো আলমের এই সংগীত পরিবেশনায় কেউ মারা গেছেন বলে কোনো অভিযোগ ওঠেনি। ডিবি থেকে তেমন তথ্য দেয়া হয়নি। কিংবা তিনি মানুষ হত্যার দুর্ধর্ষ কৌশলও দেখাননি। ক্রাইম পেট্রোল বা সিআইডি যদি হত্যার কৌশল শেখায়, হত্যাকাণ্ডে ইন্ধন জোগায়, তাহলে এই দুই সিরিয়ালকে কীভাবে দেখছে নিরাপত্তা প্রদানকারী সংশ্লিষ্টরা, বিশেষজ্ঞরা, শিশুদের সুরক্ষার জন্য সেই প্রশ্নই সামনে এসে দাঁড়িয়েছে। অপরাধীকে আটক করে শাস্তির আওতায় আনা তেমন একটা কঠিন বিষয় নয় যদি না সেখানে ব্যক্তি, গোষ্ঠী কর্তৃক কোনো প্রতিবন্ধকতা না থাকে। কিন্তু অপরাধ সংঘটিত হতে না দেয়াটাই বড় কৃতিত্বের কাজ এবং অন্যতম হওয়া দরকার। সংশয় থেকে যায় বিচারিক ব্যবস্থা নিয়ে। প্রশ্ন, শিশু হত্যার পর, এমন ব্যবস্থা গ্রহণের পর কী দাঁড়ায়? শিশু হত্যা কমে যায়? শিশুরা নিরাপদ হয়? নিশ্চয়ই সবাই একমত হবে যে, শিশু হত্যা কমে না। শিশুরা নিরাপদ হয় না, কোনোভাবেই নয়। তাহলে? বাংলাদেশে সরকারি ও বেসরকারি অনেক প্রতিষ্ঠান আছে যেসব প্রতিষ্ঠান শিশুর অধিকার, শিশুর নিরাপত্তা, শিশুর স্বাস্থ্য সুরক্ষা ও শিক্ষা নিয়ে কাজ করছে। শিশু হত্যার বিচার দাবি, দিবস উদযাপন, অধিকার আদায়ে প্রচলিত ও নির্ধারিত, সীমিত কর্মকাণ্ড ছাড়া এসব সংগঠন এমন কী কাজ করছে যে, যাতে করে শিশু হত্যা রোধ করা যায়, কিংবা এমন জঘন্য কাজ করতে অপরাধীরা ভীত হতে পারে? তারাই ভালো বলতে পারবে। তবে এটা দুঃখজনক হলেও সত্য যে, এসব সংগঠনের কাজকর্মে শিশু হত্যা বন্ধ হয় না, শিশু নির্যাতন কমে না, শিশু ধর্ষণ রোধ হয় না।
সঠিক পরিসংখ্যান হলে শিশু হত্যার সংখ্যা কম হবে না। নিপীড়ন, নির্যাতনের ভয়াল চিত্র দৃশ্যমান হবে বলে অনেকেই মনে করে। সেই সঙ্গে গবেষণা হলে শিশু নিপীড়নের কারণ জানা সম্ভব হবে। গবেষণা করেই তো কত মুশকিল আসান হয়, সমস্যা সমাধানের পথ খোঁজা হয়। বিভিন্ন বিষয়ে গবেষণার আগ্রহ, অর্থ বরাদ্দ হলেও শিশুদের সুরক্ষা ও নিরাপত্তার স্বার্থে তেমন কিছু হতে চোখে পড়ে না। এমন একটি সংবেদনশীল বিষয় সামনে আসে না। সমাজটা এখন ব্যক্তি, গোষ্ঠী লাভের পেছনে ছোটে। ব্যবসায়িক সংজ্ঞা রচনা করে। বোধের চেয়ে বিত্ত ও অর্থের হিসাবটা মুখ্য হয়ে দাঁড়িয়েছে। প্রসঙ্গক্রমে একটা গল্প বলি। গল্পটা শোনা। পথশিশুদের নিয়ে কাজ করে এমন একটি সংগঠনের একজন কর্মকর্তা নিজের সন্তানকে পথশিশু বানিয়ে বিদেশ ভ্রমণে গেছে। ব্যক্তির এমন অনৈতিক কাজ বলে দেয়, সমাজের প্রকৃত চেহারাটা কী। এমন কাজ করা সম্ভব বলেই তো ঘটনাটি ঘটেছে। এমন ছোট ছোট অসংখ্য অপরাধ প্রায় প্রতিদিনই ঘটছে পোশাকি মানুষ কর্তৃক। এদের সমর্থন ও সহায়তাকারীও আছে, যাদের দ্বারা অন্য ধরনের অপরাধ সংঘটিত হচ্ছে।
এটা পরিষ্কার যে, মুক্তিপণ, ধর্ষণ, পারিবারিক শত্রæতা, সম্পত্তির ভাগভাটোয়ারা, রাজনৈতিক সহিংসতা ইত্যাদি কারণে শিশুরা হত্যার শিকার হয়, নিপীড়ন, নৃশংসতার শিকার হয়। প্রতিহিংসা হাসিল করার জন্য শিশুদের জিম্মি করা একটা উত্তম উপায়ে পরিণত হয়েছে। কারণ শিশুরা প্রতিবাদ, প্রতিরোধ করতে পারে না। সরল বিশ্বাসে সবাইকে আপন ভেবে নেয়। পরিণত ব্যক্তির চতুরতা এরা সহজে বুঝতে পারে না। ফলে এদের টার্গেট করা সহজ হয়। আবার বিচারিক প্রক্রিয়ার দীর্ঘসূত্রতা, তদন্তে গড়িমসি, আইনের শাসনকে প্রভাব ও অর্থের বিনিময়ে আয়ত্তে রাখা ইত্যাদি কারণও শিশু নির্যাতনের পথকে প্রশস্ত ও সহজ করে বলে সমাজে ধারণা রয়েছে। এমন ধারণা অভিজ্ঞতালব্ধ, অনুমানভিত্তিক নয়।
শিশু হত্যা, নিপীড়ন কেনো সর্বোচ্চ শাস্তিযোগ্য অপরাধ হতে পারছে না, জিরো টলারেন্স করা হচ্ছে না এমন প্রশ্নের জবাব খুঁজে বের করার দরকার, খুঁজে বের করতে হবে। আর এটা করা সম্ভব হলেই ‘শিশুদের সুরক্ষার জন্য কী করতে হবে এবং সেটা করার ক্ষেত্রে প্রতিবন্ধকতাই বা কী’ সেটা পরিষ্কার হবে। অনুষ্ঠান, আয়োজন নির্ভরতা শিশুদের নিরাপত্তা নিশ্চিত করবে না, করে না বরং আয়োজকদের ও সংগঠনের পরিচিতি বাড়ায় কেবল। দেশে শিশু ও মহিলাবিষয়ক একটি মন্ত্রণালয় আছে, শিশু একাডেমি আছে, অধিদপ্তর আছে। আছে শিশু অধিকার ফোরামসহ বিভিন্ন প্রতিষ্ঠান। বছর বছর পরিকল্পনা অনুযায়ী অনেক টাকা বরাদ্দ হয়। কিন্তু শিশুদের সুরক্ষার জন্য কী করা হয় বা কী ভাবা হয়, বিশ্লেষণ করলে যে তথ্য উঠে আসবে তা স্বস্তিকর নয় মোটেও। শিশুদের প্রতি ইতিবাচক সামাজিক দৃষ্টিভঙ্গি, শিশুদের নিরাপত্তায় দৃঢ়ভাবে আইনের শাসন প্রতিষ্ঠায় সম্মিলিতভাবে কাজ না করলে শিশুদের জীবন সুরক্ষিত হবে না। শিশুদের প্রতি সহিংসতা রোধে সামাজিক ভীতির বিষয়টি রাষ্ট্রকে সুনিশ্চিত করতে হবে এবং সেটি করতে হবে দলমত ভেদে সবাইকে নিয়ে। সমাজে সেই আচরণেরই প্রচলন ঘটুক, যা দেখে শিশুদের প্রতি সবার ভালোবাসা জেগে ওঠে। শিশুদের প্রতি সবারই কমবেশি দায়িত্ববোধ জাগে।
পরিশেষে বলব, আয়াত হত্যা সামাজিক অব্যবস্থাপনা ও অবক্ষয়ের এক ধারাবাহিকতা। যার জন্য কমবেশি সবার ব্যর্থতা রয়েছে। রাষ্ট্রসহ এক কথায়, সবাই দায়ী। একবার ভাবুন, কী করছেন আপনি ও আপনার প্রতিষ্ঠান শিশুদের নিরাপত্তার জন্য, শিশুদের জীবনকে সুরক্ষিত করবার জন্য। সমাজ নিয়ে ভাবনায় আপনার, আমার সমন্বয়হীনতা, ব্যক্তি-গোষ্ঠী স্বার্থপরতা সমাজকে অরক্ষিত করে দিয়েছে। সমাজ চলে গেছে নিয়ন্ত্রণের বাইরে। যার শিকার অবুঝ শিশুরা। আসুন, অন্তত শিশুদের জীবনকে সুরক্ষিত করতে, সুস্থভাবে বেড়ে উঠতে দিতে প্রতিটি নাগরিক সচেষ্ট হই। সচেতন হই, হই উদ্যোগী। ঘর থেকেই শুরু হোক এই প্রচেষ্টা। পৌঁছে যাক পাড়া, মহল্লা থেকে জেলা-উপজেলা ও প্রত্যন্ত অঞ্চলে। আয়াতের মতো আর কোনো শিশুকে আর না হারাই।

স্বপ্না রেজা : কথাসাহিত্যিক ও কলাম লেখক।
[email protected]

মন্তব্য করুন

খবরের বিষয়বস্তুর সঙ্গে মিল আছে এবং আপত্তিজনক নয়- এমন মন্তব্যই প্রদর্শিত হবে। মন্তব্যগুলো পাঠকের নিজস্ব মতামত, ভোরের কাগজ লাইভ এর দায়ভার নেবে না।

জনপ্রিয়