মৃত্যুবার্ষিকী আজ : সাবেক মেয়র হানিফ স্মরণে নানা কর্মসূচি

আগের সংবাদ

সমাবেশ ঘিরে দুপক্ষের হুঙ্কার : বিএনপি নেতাদের বক্তৃতায় প্রচ্ছন্ন হুমকি > ছাড় না দেয়ার ঘোষণা আওয়ামী লীগ নেতাদের

পরের সংবাদ

ঋণখেলাপিরা কি রাষ্ট্রীয় আইনের ঊর্ধ্বে?

প্রকাশিত: নভেম্বর ২৯, ২০২২ , ১২:০০ পূর্বাহ্ণ
আপডেট: নভেম্বর ২৯, ২০২২ , ১২:০০ পূর্বাহ্ণ

অর্থনীতি একটি দেশের মূল চালিকাশক্তি। অর্থনৈতিক কার্যকলাপ একটি আইনি কাঠামোর ভেতর চলা উচিত এবং সেই আইনি কাঠামো সবার জন্য সমান হতে হবে। যখন এই আইনের ব্যত্যয় ঘটে, তখনই রাষ্ট্রের সব যন্ত্র অকেজো হয়ে পড়ে। ভুল নীতির কারণে দেশের অর্থনীতি যদি ভঙ্গুর হয়ে পড়ে, তাহলে দেশ ও জাতি দেউলিয়া হতে বাধ্য। আর এই অর্থনৈতিক দেউলিয়াত্বকে ত্বরান্বিত করে খেলাপি ঋণ। খেলাপি ঋণ দেশের ব্যাংকিং ব্যবস্থায় একটি অন্যতম বড় সমস্যা। বাংলাদেশে মুষ্টিমেয় কিছু ঋণখেলাপি দেশের অর্থনীতিকে প্যারালাইজড করে ফেলেছে। অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ড সঠিক পথে চলতে পারছে না। কোনো আলাদিনের দৈত্যের জাদুতে খেলাপি ঋণগ্রহীতারা বারবার পার পেয়ে যায়। ঋণখেলাপিরা রাষ্ট্রীয় যন্ত্র ব্যবহার করে বিভিন্ন ধরনের সুযোগ-সুবিধা নিয়ে ধরাছোঁয়ার বাইরে থাকে সব সময়। ব্যবসায়ীদের হাতে যখন রাজনৈতিক ক্ষমতা যায়, তখন রাজনৈতিক ক্ষমতা অর্থ উপার্জনের সিঁড়ি হিসেবে ব্যবহার করে বেশুমার অর্থের মালিক বনে যায়।
এই দেশের রাজনীতি ও অর্থনীতি দুটোই ব্যবসায়ীদের হাতের মুঠোয় বন্দি হয়ে পড়েছে। ইচ্ছা থাকলেও এখান থেকে পরিত্রাণের উপায় সরকারের কাছে নেই। সরকারি হিসাব মতে, বর্তমানে দেশে খেলাপি ঋণের পরিমাণ দাঁড়িয়েছে ১ লাখ ৩৪ হাজার ৩৯৭ কোটি টাকায়। তবে আইএমএফের ভাষ্য মতে, খেলাপি ঋণের পরিমাণ আরো অনেক বেশি। তা প্রায় ৩ লাখ কোটি টাকা ছাড়িয়ে গেছে বলে তাদের ধারণা। তবে দেশের অনেক অর্থনীতিবিদের মতে, খেলাপি ঋণের পরিমাণ প্রকৃত পক্ষে সাড়ে ৪ লাখ কোটি টাকার মতো। রাষ্ট্রীয় মালিকানাধীন সোনালী, রূপালী, অগ্রণী, জনতা, বিবিডিএল, বেসিক- এই ছয়টি ব্যাংকের খেলাপি ঋণের পরিমাণ মতো ঋণের ২৮.৬৬ শতাংশ। এই ৬টি ব্যাংকের খেলাপি ঋণ প্রায় ৬০ হাজার কোটি টাকা। সরকারি মালিকানাধীন ব্যাংকগুলো মধ্যে সবার উপরে বেসিক ব্যাংকের খেলাপি ঋণ। প্রায় ৫৯ শতাংশ ঋণখেলাপি। অন্যান্য ব্যাংকের খেলাপি ঋণ যথাক্রমে, বিডিবিএলের খেলাপি ঋণ ৪০ শতাংশ, জনতা ব্যাংকের খেলাপি ঋণ ২৮ শতাংশ, অগ্রণী ব্যাংকের খেলাপি ঋণ ১৯ শতাংশ, রূপালী ব্যাংক ১৭ শতাংশ ও সোনালী ব্যাংকের খেলাপি ঋণের পরিমাণ ১৭ শতাংশ। একটি সমীক্ষায় দেখা গেছে, বাংলাদেশে এক দশকের প্রতি বছর গড়ে প্রায় ৯৫০০ কোটি টাকা ঋণখেলাপি হয়েছে।
আইএমএফের ৪৫০ কোটি ডলার ঋণ পাওয়ার জন্য সরকারকে ব্যাংক খাতের সংস্কারের ওপর জোর দিয়েছে। তার মধ্যে খেলাপি ঋণ আগামী দুই বছরে ১০ শতাংশে নামিয়ে আনতে হবে। এটা কীভাবে করা হবে সেই পদ্ধতিও বাংলাদেশ ব্যাংকের নিকট জানতে চেয়েছে আইএমএফ। খেলাপি ঋণ কমুক এটা সবাই চায়। কিন্তু দেখতে হবে সরকার এ ব্যাপারে কতটা আন্তরিক। ইতিহাস ঘেঁটে দেখা যায়, বাংলাদেশে স্বাধীনতা পরবর্তী প্রত্যেকটি সরকার ক্ষমতায় আসার পর সরকারের ভিতর কিছু সুবিধাবাদী গ্রুপের সৃষ্টি হয়। তারা মূলত অর্থনৈতিক অনিয়মের সঙ্গে জড়িয়ে নিজেদের আখের গোছানোতে ব্যস্ত থাকে এবং এ ধরনের লোকজন সব সময় দেশ ও সরকারের ক্ষতির কারণ হয়। এরা চিহ্নিত গোষ্ঠী হওয়া সত্ত্বেও তারা ধরাছোঁয়ার বাইরে থেকে যায়।
দেখা যাচ্ছে, দেশের ৭ জন শীর্ষ ঋণগ্রহীতা ঋণখেলাপি হলে ৩৫টি ব্যাংক এবং ১০ জন ঋণখেলাপি হলে ৩৭টি ব্যাংক মূলধন সংকটে পড়বে। মাত্র হাতেগোনা কয়েক ব্যক্তি বা প্রতিষ্ঠানের নিকট বিশাল অঙ্কের ঋণের টাকা। একই ব্যক্তি বা প্রতিষ্ঠান বিভিন্ন নামে কৌশলে বা ব্যাংকে কিছু অসাধু কর্মকর্তার যোগসাজশে বিপুল পরিমাণ ঋণ নিয়েছে। এটা রাজনৈতিক হস্তক্ষেপ ও ব্যবসায়িক প্রভাব এবং কেন্দ্রীয় ব্যাংকের তদারকি কাজে অনিয়মকে এসব ঋণ দুর্নীতির অন্যতম কারণ হিসেবে চিহ্নিত করা হয়েছে। বাংলাদেশের শীর্ষ ১০ ঋণখেলাপি হলো- সামানাজ সুপার ওয়েল লিমিটেড (১ হাজার ৪৯ কোটি টাকা) গ্যালাক্সি সোয়েটার এন্ড ইয়ার্ন ডাইং লিমিটেড (৯৮৪ কোটি টাকা), রিমেক্স ফুডওয়্যার লিমিটেড (৯৭৬ কোটি টাকা), কোয়ান্টাম পাওয়ার সিস্টেম লিমিটেড (৮২৮ কোটি টাকা), মাহিন এন্টারপ্রাইজ লিমিটেড (৮২৫ কোটি টাকা), রূপালী কম্পোজিট লেদার ওয়্যার লিমিটেড (৭৯৮ কোটি টাকা), ক্রিসেন্ট লেদার প্রোডাক্টস লিমিটেড (৭৭৬ কোটি টাকা), এসএ ওয়েল রিফাইনারি লিমিটেড (৭০৭ কোটি টাকা), সুপ্রভ কম্পোজিট নিট লিমিটেড (৬১০ কোটি টাকা) ও গ্রামীণ শক্তি (৬০১ কোটি টাকা)। বড়ই পরিতাপের বিষয় হচ্ছে একজন কৃষক যখন ২৫-৩০ হাজার টাকা ঋণ নিয়ে সময়মতো পরিশোধ করতে ব্যর্থ হয়, তখন তাকে জেলে যেতে হয়। অথচ ব্যাংক থেকে ২৫-৩০ হাজার কোটি টাকা ঋণ নিয়ে যারা পরিশোধ করে না, তখন রাষ্ট্রের কিছুই করার থাকে না। রাষ্ট্রযন্ত্র এখানে পুরোপুরি অচল। জনগণের প্রশ্ন- তাহলে কি বড় ঋণখেলাপিরা রাষ্ট্রের আইনের ঊর্ধ্বে? সব আইন শুধু গরিব কৃষক ও ছোটখাট ব্যবসায়ীদের বিচারের জন্য তৈরি? বড় ঋণখেলাপিরা কি রাষ্ট্রীয় আইনের ঊর্ধ্বে? তাদের ধরেন না কেন? বিসমিল্লাহ গ্রুপের ঋণ জালিয়াতির মামলায় ব্যাংকটির সাবেক কর্মকর্তা এ এস এম হাসানুল কবিরের জামিন বাতিল চেয়ে আবেদনের শুনানির সময় হাইকোর্টের একটি বেঞ্চ দুদকের আইনজীবীদের উদ্দেশ করে এ মন্তব্য করেন।
বড় ঋণখেলাপিদের বাঁচানোর জন্য বাংলাদেশ ব্যাংক নতুন নতুন অধ্যাদেশ জারি করে তাদের বাঁচিয়ে দিচ্ছে বারবার। খেলাপি ঋণ পরিশোধ করার জন্য ১০-১২ শতাংশ হারে দুই বছরে পরিশোধ করার বিধান থাকলেও পুনঃতফসিল ঘোষণা করে ২-৬ শতাংশ হারে ৮ বছরে পরিশোধের ব্যবস্থা করেছে বাংলাদেশ ব্যাংক। বিভিন্ন ধরনের অনিয়মের সমালোচনার সম্মুখীন হওয়ার কারণে বাংলাদেশ ব্যাংক নতুন সার্কুলার জারি করেছে। এ বিষয়ে বাংলাদেশ ব্যাংক থেকে সার্কুলার জারি করে আর্থিক প্রতিষ্ঠানগুলোর প্রধান নির্বাহীদের কাছে প্রেরণ করা হয়েছে। এই নির্দেশ অবিলম্বে কার্যকর হবে বলেও সার্কুলারে উল্লেখ করেছে বাংলাদেশ ব্যাংক। এতে আরো জানানো হয়েছে, আর্থিক প্রতিষ্ঠানগুলোর ঋণ নিয়ে বড় ধরনের জালিয়াতির ঘটনা সম্প্রতি প্রকাশিত হওয়ায় কেন্দ্রীয় ব্যাংক এ খাতে তদারকি জোরদার করেছে। সেই কারণেই সার্কুলারটি জারি করা হয়েছে। এছাড়া আর্থিক প্রতিষ্ঠান আইনকে আরো শক্তিশালী করার তাগিদে এই উদ্যোগ নেয়া হয়েছে। আর্থিক খাতের অনিয়মগুলো শনাক্ত করতে কেন্দ্রীয় ব্যাংক উচ্চ পর্যায়ের কমিটি গঠন করেছে। এসব বিষয়ে এখন কাজ চলছে। ঋণ জালিয়াতির কারণে ৫টি আর্থিক প্রতিষ্ঠান বড় ধরনের অর্থ সংকটে পড়েছে। তারা আমানতকারীদের অর্থও ফেরত দিতে পারছে না। এ নিয়ে কেন্দ্রীয় ব্যাংকও সমালোচনার মুখে পড়েছে। এসব প্রেক্ষাপট বিবেচনায় কেন্দ্রীয় ব্যাংক আর্থিক খাতে তদারকি বাড়ানোর ওপর গুরুত্ব দিয়েছে। এজন্য তদারকির আওতায় প্রচলিত নিয়মনীতিতেও বেশ কঠোরতা আরোপ করছে কেন্দ্রীয় ব্যাংক।
কেন্দ্রীয় ব্যাংকের সার্কুলারে বলা হয়, আর্থিক খাতে ঋণের যথাযথ ব্যবহার নিশ্চিত না হলে, তা পুরো খাতের ওপর নেতিবাচক প্রভাব ফেলে। একই সঙ্গে সুশাসন বাধাগ্রস্ত করে। এ লক্ষ্যে আর্থিক প্রতিষ্ঠানগুলো থেকে বিতরণ করা লিজ বা ঋণের অর্থ নির্দিষ্ট খাতেই বিতরণ করতে হবে। অন্য কোনো খাতে ব্যবহার করা যাবে না। ঋণের সদ্ব্যবহার নিশ্চিত করার লক্ষ্যে নিয়মিত তদারকি কার্যক্রম চালাতে হবে। একই সঙ্গে তদারকি জোরদার করতে হবে। এক প্রকল্পের ঋণ নিয়ে অন্য কোনো প্রকল্পের ঋণ পরিশোধ করা যাবে না। অর্থাৎ ঋণ নিয়ে ঋণ শোধ করা যাবে না। কিস্তিভিত্তিক প্রকল্পের ঋণ আগের কিস্তির অর্থ যথাযথ ব্যবহার হয়েছে কিনা, তা তদন্ত করে নিশ্চিত হয়ে পরের কিস্তির অর্থ ছাড় করতে হবে। এক খাতের ঋণ অন্য খাতে ব্যবহারের ঘটনা জানার সঙ্গে সঙ্গে সংশ্লিষ্ট গ্রাহকের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নিতে হবে। এতে আরো বলা হয়, ঋণের ব্যবহার নিশ্চিত করা এবং তদারকির বিষয়টি প্রতিষ্ঠানের অভ্যন্তরীণ ঋণ নীতিমালা অন্তর্ভুক্ত করতে হবে। এ লক্ষ্যে অভ্যন্তরীণ তদন্ত কমিটি গঠন করতে হবে এবং তদন্ত করে এর প্রতিবেদন ঋণগ্রহীতার নথিতে অন্তর্ভুক্ত করতে হবে। একই সঙ্গে কোনো অনিয়ম থাকলে তার বিরুদ্ধে কঠোর ব্যবস্থা গ্রহণ হবে।
ঋণের সদ্ব্যবহার সম্পর্কিত চুল পরিমাণ অনিয়ম ধরা পড়লে তা তাৎক্ষণিকভাবে কেন্দ্রীয় ব্যাংককে অভিহিত করতে হবে। চাপে পড়ে মাঝে মাঝে বাংলাদেশ ব্যাংক এ ধরনের কঠোর পদক্ষেপ নেয়ার সিদ্ধান্ত নিলেও শেষ পর্যন্ত অজানা কারণে আবার সব কিছু শিথিল হয়ে পড়ে। যতদিন ব্যাংক খাত রাজনৈতিক প্রভাব মুক্ত না হবে, ততদিন এ ধরনের ঋণখেলাপির সংখ্যা বাড়তেই থাকবে। এর কুফল রাষ্ট্র ও জনগণ ভোগ করে যাবে।

রবি রায়হান : কবি ও কলাম লেখক।
[email protected]

মন্তব্য করুন

খবরের বিষয়বস্তুর সঙ্গে মিল আছে এবং আপত্তিজনক নয়- এমন মন্তব্যই প্রদর্শিত হবে। মন্তব্যগুলো পাঠকের নিজস্ব মতামত, ভোরের কাগজ লাইভ এর দায়ভার নেবে না।

জনপ্রিয়