সাগর-রুনি হত্যা মামলা : তদন্ত প্রতিবেদন দাখিলের তারিখ পেছাল ৯৩ বার

আগের সংবাদ

গ্যাস সংকট তীব্র হওয়ায় শঙ্কা : ৩৮০ কোটি ঘনফুট চাহিদার বিপরীতে বিতরণ ২৬০ কোটি ঘনফুট

পরের সংবাদ

কেন আওয়ামী লীগ ও বিএনপি দেশের স্বার্থে এক হয় না?

প্রকাশিত: নভেম্বর ২, ২০২২ , ১২:০০ পূর্বাহ্ণ
আপডেট: নভেম্বর ২, ২০২২ , ১২:০০ পূর্বাহ্ণ

দেশে রাজনৈতিক বিভাজন, মতবিরোধ ও সহিংসতা রয়েছে। নির্বাচন প্রাক্কালে যা প্রকট ও ভয়াবহ আকার ধারণ করে। সাম্প্রতিককালে অতীতের মতো তারই নমুনা দেখা যাচ্ছে এবং তা ক্রমেই বৃদ্ধি পাচ্ছে। এ জাতীয় রাজনৈতিক সহিংসতার শিকার হয় সাধারণ জনগণ এবং সেটা পথে-ঘাটে ও বিভিন্ন সামাজিক প্রতিষ্ঠানে। দোষারোপের সংস্কৃতিতে কোনো রাজনৈতিক দলই কম যায় না, পিছে থাকে না। রাজনৈতিক মঞ্চ থেকে শুরু করে সড়ক ও টিভি টকশো সবখানেই চলে দোষারোপ ও বাকযুদ্ধ। রীতিমতো হাতাহাতির পর্যায়ে পড়ে। পাল্টাপাল্টি হুঙ্কার, বিদ্বেষ, দেখে নেয়ার তর্জন-গর্জন চলতেই থাকে। দেশ ও দশের স্বার্থে, কল্যাণে তা থামে না, বন্ধ হয় না। একজন প্রবীণ দিনমজুর বলছিলেন, ‘পঞ্চাশ বছরে বাংলাদেশ যতটুকু, যেটুকু আগাইছে তারও বেশি আগাইতে পারত যদি না আওয়ামী লীগ ও বিএনপি দেশের জন্য একই কথা বলত। মিইলা-মিইশা কাম করত।’ সেটা কেমন জানতে চাইলে তার অভিমত, ‘কেউ কারোর কাজের প্রশংসা করার চায় না। দেশের জন্য এক পথে হাঁটেও না। মুখ চাওয়াচাওয়ি করে না। সতীনের লাহান থাকে। দুই দলের কাছে যেন এক বাংলাদেশ দুইটা। করোনার মতো কঠিন সময়েও এক হয় নাই। এখন তো যুদ্ধ চলতাছে। শুনতাছি পৃথিবী ধরাই সমস্যা চলতাছে। জিনিসপত্রের দাম বাড়তাছে। কন, এই সমস্যাগুলান সমাধান কী একসঙ্গে বইস্যা করা যায় না? যায়। কিন্তু হেরা করব না। একদল ক্ষমতায় বইস্যা থাকবার চায়, আরেক দল তাগো নামাইয়া ক্ষমতায় বসবার চায়। যারা বইস্যা আছে তারা ভাবতাছে ক্ষমতায় থাইক্যা নির্বাচন করলে তারা নির্বাচনে জিতব, আরেক দল ভাবতাসে ওই দল ক্ষমতায় থাইক্যা নির্বাচন করলে তারা হাইরা যাইব। দুই দলের কাছে ক্ষমতাই বড়, আর বাকি সব জিরো। কোনো দলই আস্থা আর ভরসা লইয়া ভাবতাছে না। আজব, না? সত্যিই আজব রাজনীতি বাংলাদেশের।’ বেশ রাজনৈতিক সচেতন দিন এনে দিন খাওয়া এই দিনমজুরের। সরাসরি কোনো রাজনৈতিক সংগঠনের সঙ্গে জড়িত না হলেও তার নিজস্ব রাজনৈতিক মতাদর্শ আছে। সে মুক্তিযুদ্ধের চেতনায় বিশ্বাসী একজন নাগরিক।
অনেকে মনে করেন, মুক্তিযুদ্ধের চেতনাকে দলীয়করণ করা হয়েছে। সেটা এমন, ১৯৭১ সালের মুক্তিযুদ্ধের বিষয়ে আওয়ামী লীগ যতটা সক্রিয়, তৎপর এবং প্রচারমুখী, বিএনপি ততটা নয়। বাংলাদেশের স্বাধীনতার জন্য যিনি মুক্তিযুদ্ধের আহ্বান করেছিলেন সেই মহান নেতা বঙ্গবন্ধুর ঐতিহাসিক অবদানের কথা কখনই স্বীকার করে না। বঙ্গবন্ধুর আহ্বান ছাড়া মুক্তিযুদ্ধের সূচনা হতো না, এমন কথাও দলটি বিশ্বাস করে না। এমনকি মুক্তিযুদ্ধের সঠিক ইতিহাস সংরক্ষণেও রয়েছে দ্বিধাদ্ব›দ্ব, অনিচ্ছা। মুক্তিযুদ্ধের চেতনা বলতে বিএনপি মনে করে থাকে, এটা কেবল আওয়ামী লীগের, বিএনপির নয়। বরং তারা জাতীয়তাবাদী চেতনায় জাগ্রত থাকে, থাকতে ভালোবাসে। এতে নিরপেক্ষ বিজ্ঞজনদের মনে প্রশ্ন উদিত হয় যে, মুক্তিযুদ্ধের চেতনা স্বীকৃত না হলে জাতীয়তাবোধের বিকাশ হয় কী করে? সেই অর্থে বিএনপির জাতীয়তাবাদের যে চেতনা তা প্রকৃতার্থে বাঙালি ও বাংলাদেশের শেকড় থেকে উৎকলিত কি না, এ নিয়ে কেউ কেউ সংশয় পোষণ করেন। এমন ভাবাভাবি আর ধারণার কারণে মুক্তিযুদ্ধের চেতনা গিয়ে দাঁড়িয়েছে আওয়ামী লীগের সীমানায়। আর জাতীয়তাবাদ গিয়ে পড়েছে বিএনপির সীমানায়। একটি দেশকে ঝুঁকিতে ফেলতে এমন বিভাজনই যথেষ্ট কি না সেটাও কেউ দেখছে না।
সবচেয়ে ভয়ংকর দিকটি হলো, যারা রাজনীতির সঙ্গে জড়িত তারা সবাই পূর্ণাঙ্গভাবে বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাস জানেন না। তাদের যারা অনুসরণ করে তারাও এই আধা-ইতিহাস বয়ে রাজনৈতিক চেতনা বয়ে বেড়ায়, একসময়ে রাজনীতিক হিসেবে আত্মপ্রকাশ ঘটায়। ফলে দেশের প্রকৃত ইতিহাস না জানায় দেশের সার্বভৌমত্ব, ঐতিহ্য, কৃষ্টি ও সংস্কৃতির প্রতি মমত্ব, ভক্তি, শ্রদ্ধা বাড়ে না। এই আবেগতাড়িতরা গায়ের জোরে, গলার জোরে রাজনীতি করে। লক্ষ করেছি তরুণ প্রজন্মের অনেকেই পারিবারিক রাজনৈতিক মতাদর্শে প্রভাবিত হয়। যেমন- অভিভাবক যে দল সমর্থন করে তার সন্তানও সেইদিকে যায়। পারিবারিক আবেগ নতুন প্রজন্মকে সেইদিকে টেনে নেয়, যা সে দেখে পরিণত হয়েছে।
ক’জন শিক্ষিত ছেলেমেয়ে বা শিক্ষার্থী রাজনীতিতে জড়ায় বা জড়াতে চায়, প্রচলিত রাজনীতি প্রত্যক্ষ করে এমন প্রশ্নের উত্তর খুঁজলে দেখা যাবে, ফলাফল আশাব্যঞ্জক মোটেও নয়। পঞ্চাশ বা ষাট দশক, এমনকি আশির দশকে শিক্ষার্থীরা ও শিক্ষিত ছেলেমেয়েরা রাজনীতিতে সম্পৃক্ত হতো মহান লক্ষ্য ও আদর্শ নিয়ে। পরাধীনতার থেকে মুক্তি, ভাষার অধিকার, স্বৈরাচারীবিরোধী আন্দোলনে সম্পৃক্ত হতে পারার ব্রত ছিল মহান। সময়ের সঙ্গে সঙ্গে রাজনীতি পরিণত হয়েছে বিত্তবান হওয়ার এক উত্তম পেশায়। কেন এমন হলো, এর জবাব প্রবীণ রাজনীতিবিদরাই ভালো বলতে পারবেন। তবে সমাজের সাধারণ মানুষ যা দেখে, যা বোঝে, তা হলো রাজনীতি। যেখানে সম্পৃক্ত বা নিয়োগপ্রাপ্ত হতে শিক্ষাগত যোগ্যতা লাগে না, লাগে না মেধা, দক্ষতা বা অভিজ্ঞতা। বরং অনেকেই মনে করে যে, পড়াশোনায় ভালো ফলাফল করে, অভিজ্ঞতা অর্জন করে ভালো বেতনের চাকরি যতটা না দ্রুত একজন তরুণকে ধন, সম্পদ, বিত্ত দিতে পারে না- রাজনীতি রাতারাতি তা পারে। শুধু ধনসম্পদ নয়, উপরন্তু ক্ষমতাপ্রাপ্ত হওয়া যায়, যা সমাজে ব্যক্তির অবস্থানের জৌলুস বাড়ায়।
রাজনীতির এই বিবর্তন ভয়ংকর। দ্ব›দ্ব ও বিভাজনের রাজনৈতিক দর্শন রাষ্ট্রের ঝুঁকি বাড়ায়, নিরাপত্তার সংকট বাড়ায়। রাষ্ট্রে যে মৌলবাদ, ধর্মীয় আগ্রাসন মনোভাব এবং ধর্মীয় অসম্প্রীতি, অসহিষ্ণুতা তার জন্য রাজনৈতিক অনৈক্য, বিভাজন দায়ী বলে অনেকেই মনে করেন। পাশাপাশি সামাজিক অবক্ষয়ের একটি কারণ ও মূল্যবোধ তৈরি হওয়ার অন্তরায় হিসেবেও ভাবা হয়। প্রচলিত রাজনীতি সমাজকে স্থিতিশীল হতে বাধা দেয়। অস্থিতিশীল অবস্থা সৃষ্টির মধ্য দিয়ে রাজনৈতিক ফায়দা লাভের পাঁয়তারা চলে, যা অত্যন্ত দুঃখজনক। রাজনীতি শুধু ক্ষমতাকেই আঁকড়ে থাকেনি, শিক্ষা ও সংস্কৃতিকে দংশন করেছে। বাংলাদেশের ইতিহাসকে বিকৃত করতে ঔদ্ধ্যত দেখানো হয়েছে। যে শ্রেণি-গোষ্ঠী মুক্তিযুদ্ধকালীন সময়ে বাংলাদেশের স্বাধীনতার বিরোধিতা করেছিল তার সঙ্গে সখ্য গড়া হয়েছিল এবং সেটা করা হয়েছিল রাজনৈতিক মতাদর্শের সঙ্গে সমন্বয় রেখে ক্ষমতায় বসার জন্য। স্বাধীনতা বিরোধীদের রাষ্ট্রের ক্ষমতায় বসিয়ে তাদের গাড়িতে বাংলাদেশের পতাকা উড়ানোর সুযোগ করে দেয়াটাও ছিল কিন্তু মারাত্মক রাজনৈতিক ধৃষ্টতা। জাতির সুবিধাবাদি অংশ এটা জেনেও চুপ থেকেছে।
আপসোস, এখনো কিছু মানুষ প্রাদেশিক চিন্তায় নিমগ্ন। পাকিস্তান প্রীতিতে মোহাচ্ছন্ন। তাদের এই মোহ রাজনীতিকরণ হয়েছে এবং সেটা করা হয়েছে দলীয় ব্যানারে। আরেক দল দাঁড়িয়ে গেছে বিপরীতে, ভারত প্রীতিতে। যুক্তি হলো, ভারত ছিল মুক্তিযুদ্ধ চলাকালীন সময়ে বাংলাদেশের অন্যতম বন্ধু রাষ্ট্র। কঠিন সত্য। ইতিহাস চাইলে তো কেউ তুড়ি মেরে উড়িয়ে দিতে পারে না, পারবে না। যাই হোক, বাংলাদেশের বিদ্যমান রাজনৈতিক যে সংস্কৃতি তা কোনোভাবেই জাতি গঠনে, উন্নয়নে বড় অবদান রাখছে না। বিশেষ করে উন্নত ও সুস্থ দৃষ্টভঙ্গি গড়ে উঠতে দিচ্ছে না। সবকিছুর মূলেই অপরাজনীতির উঁইপোকা। সাম্প্রতিককালে টিভি চ্যানেলগুলোতে যে রাজনৈতিক ইস্যু নিয়ে টকশো হয় এবং তাতে যে রাজনৈতিক সংগঠনের নেতৃবৃন্দ কথা বলেন তা দেখে মনে হয়, রীতিমতো ধস্তাধস্তি দেখছি। পর্দার বাইরে দর্শক শ্রোতা না থাকলে তারা মনুষ্যত্ব হারাতেন। নতুন ধরনের রেসলিংয়ের অংশ নিতেন। আর টিভি চ্যানেলগুলোও মনে করে যে, তারা গণতন্ত্র চর্চার মেগাশপ খুলে বসেছে। কী পায় বা পাচ্ছে দর্শকশ্রোতা এসব থেকে? বাকোয়াজগিরি করার কায়দাকানুন ছাড়া আর কী।
সবচেয়ে ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে আমাদের শিশু-কিশোর ও তরুণ সমাজ। মিথ্যে কথা বলার প্রবণতা তাদের ভেতর জাগ্রত হচ্ছে। অস্থিতিশীল পরিবেশ ও পরিস্থিতিতে তারা বেড়ে উঠছে। সমাজে যা তারা প্রত্যক্ষ করছে সেসব তার ভেতর স্থান পাচ্ছে। একটা পর্যায়ে সমাজকে তারা সেটাই ফেরত দিচ্ছে। সবশেষে দেশের কী থাকছে? কিসসু না। দেশের যে কত বড় সর্বনাশ করছে রাজনৈতিক দলগুলো তা বোঝার ন্যূনতম বোধ তাদের নেই। একটা জাতির বড় সম্পদ হলো, তার সুস্থ আগামী প্রজন্ম, যা ধারাবাহিকভাবে চলমান থাকে, তৈরি হয়।

স্বপ্না রেজা : কথাসাহিত্যিক ও কলাম লেখক।
[email protected]

মন্তব্য করুন

খবরের বিষয়বস্তুর সঙ্গে মিল আছে এবং আপত্তিজনক নয়- এমন মন্তব্যই প্রদর্শিত হবে। মন্তব্যগুলো পাঠকের নিজস্ব মতামত, ভোরের কাগজ লাইভ এর দায়ভার নেবে না।

জনপ্রিয়