৫ জন গ্রেপ্তার : বিমানের নিয়োগ পরীক্ষার প্রশ্নফাঁস

আগের সংবাদ

ব্যর্থ মেটার হরাইজন ওয়ার্ল্ডস

পরের সংবাদ

‘আবার আসব, গাইব এই বাংলায়’

প্রকাশিত: অক্টোবর ২২, ২০২২ , ১২:০০ পূর্বাহ্ণ
আপডেট: অক্টোবর ২২, ২০২২ , ১২:০০ পূর্বাহ্ণ

‘অমরত্বের প্রত্যাশা নেই, নেই কোনো দাবিদাওয়া
এই নশ্বর জীবনের মানে, শুধু তোমাকেই চাওয়া’

আহা কী আবেগ, কী সৃষ্টি! এ গানের যিনি স্রষ্টা, তার দিকে অপলক দৃষ্টিতে তাকিয়ে থাকব এমন সুপ্ত আশাটা মনের গহিনে লুকিয়ে ছিল। সুপ্ত বাসনাটা হঠাৎই তীব্র হয়ে উঠল, যখন সংবাদ শিরোনামে দেখলাম ‘এক যুগ পর ঢাকায় আসছেন কবীর সুমন।’ খবরটি পড়তে পড়তেই শিরদাঁড়া বেয়ে বয়ে যায় শীতল শিহরণ। মনের সেই ইচ্ছাটা হঠাৎই যেন বলে উঠল ‘পূরণ হচ্ছে রে পাগলা, তোর আশা পূরণ হচ্ছে।’
নানান ঝক্কিঝামেলা মিটিয়ে ‘সুমনের খেয়ালে ঢাকা’র টিকেটও নিলাম। কিন্তু সুখের পালে যেন কোত্থেকে একটু শঙ্কার কালো মেঘ এসেছিল। শোনা গেল ‘কনসার্টের অনুমতি পাচ্ছেন না কবীর সুমন।’ বুকটা হু হু করে উঠল। মনের হতাশাবাদী অংশটুকু বলেই ফেলল, তবে কী এবারো হবে না? কিন্তু না, দেখা দিল আশার আলো, মিলল অনুমতি।
আমি কিশোরবেলা থেকে সুমনের ভক্ত। আমার শিরায় শিরায় তার কিছু গান গুনগুন করে আনমনে। এক কথায় হৃদয়কে হরণ করে নিয়েছে। ভেতরে একটা অবশ অনুভূতির দেয়াল তুলেছে। মনপাখিটা আমার রক্ত-মাংসের খাঁচা ভেঙে ফেলতে চাইছে তাকে সামনে থেকে দেখার জন্য। তার লেখা ‘জাতিস্মর’ গানটা শোনার জন্য। মনে মনে বলেই ফেললাম, ‘আমি দেখব, আমি তোমাকে দেখব!’
১৩ অক্টোবর কবীর সুমন শরতের উষ্ণতা মিশিয়ে তিলোত্তমা ঢাকায় আসেন। জটিলতার অবসান ঘটিয়ে খবর এলো রাজধানীর ইঞ্জিনিয়ার্স ইনস্টিটিউশন মিলনায়তনে হবে তার কনসার্ট। আমি কি বসে থাকব, মোটেও না। শত ব্যস্ততা ভুলে আমি ছুটে যাব তাকে একপলক দেখতে। শুনব ‘তোমাকে চাই’, ‘তোমাকে অভিবাদন প্রিয়তমা, গানওয়ালা, বাংলার ধনুকের ছিলায় ছিলায়সহ কত কত গান!
অবশেষে হাজির হলো সেই বিশেষ দিন। ১৫ অক্টোবর কনসার্টে প্রবেশ করে সামনের সারিতে বসে তার গান শোনার জন্য এগিয়ে যেতে লাগলাম। কবীর সুমন মঞ্চে উঠবেন ঘোষণা আসতেই ইনস্টিটিউটজুড়ে শুরু হয় করতালি। আমার হাতও থেমে ছিল না। যত শব্দ করে পারা যায়, আমিও শামিল হয়েছি সেই করতালিতে। অতপর ঢাকাকে কুর্নিশ জানিয়ে মঞ্চে এলেন কবীর সুমন!
কিশোরবেলা থেকে যে কবীর সুমনকে শুনছি, তিনি আজ আমার সামনে, আহা! আমি যেন হারিয়েছিলাম এক কল্পনার জগতে। মঞ্চে হাজির হতেই বড় বড় আলোর ঝলকানি তার দিকে। সেই সাদাকালো যুগের সুমন এখনো যেন তেমনই আছেন। তবে চোখেমুখে বয়সের ছাপ স্পষ্ট। মাইকটা সামনে টেনে নিয়ে তিনি বললেন, ‘সব আলো আমার দিকে না দিয়ে, সামনের মানুষগুলোর দিকে একটু দাও, আমি একটু দেখি। তাদের দিকে আলো দাও।’
কিছু আলাপের পর শুরু করলেন শব্দ বিলাপ। মাঝে মাঝে তাকে ইনহেলার নিতে দেখেছি। পীড়া হয়তো তার কণ্ঠকে বধ করতে চেয়েছে, গানের লাগাম টানতে চেয়েছে। কিন্তু তিনি তো বাঙালি। বাংলার শব্দ নিয়ে সুর বাঁধতে ভালোবাসেন। তাকে বধ করা কী এত সহজ! শুরু হলো সুরের মূর্ছনা।
‘কখনো সময় আসে জীবন মুচকি হাসে’ গানটা শুরু সঙ্গে সঙ্গে চারদিক নিস্তব্ধ হয়ে যায়। গানের সঙ্গে সুরের আওয়াজ কানকে কোমল স্পর্শ দিচ্ছে। একটা গান শেষে হলে কিছু গল্প, আবার গান। এভাবেই চলছে তালমাতাল হাওয়া। এভাবেই একে একে একুশটা গান গাইলেন গানওয়ালা। কথায় কথায় বললেন, ‘আমি বড় হইনি, বুড়ো হয়েছি।’ মুগ্ধ দর্শকদের উচ্ছ¡াস যেন থামছে না তার কথা শুনে। উচ্ছ¡াস আবার হাওয়ায় মিলিয়ে গেল যখন তিনি শুরু করলেন, ‘তোমাকে চাই।’
যে গানের ৩০ বছর পূর্ণ হলো সেই গানের মাধ্যমে তিনি যেন নিজেকে মেলে ধরেছেন। তার গানপাখির ডানা যেন ঝাপ্টাচ্ছে। ঝাপ্টানো বাতাস আমাদের দোলা দিচ্ছে। অনেকে তার সঙ্গে সুরও মেলাচ্ছেন। গান থামার সঙ্গে সঙ্গে করতালিতে যখন চারপাশ মুখরিত, ঠিক কথক সুমনের রসিকতা, ‘আমাকে তুলে দেয়ার জন্য কি হাততালি দিচ্ছেন?’ স্তম্ভিত সবাই সমস্বরে বলে উঠল, ‘না, না।’ আবার খুলে যায় গল্পের ডালি, খুলে যায় সুরের ভাণ্ডার।
সুমন তার শ্রোতাদের দাওয়াত দিলেন ১৮ তারিখ ‘বাংলা খেয়াল’ শোনার। এদিন গানের ফাঁকে ফাঁকে গল্পে গল্পে জানালেন নিজের বেঁচে থাকার কারণ, জানালেন বেঁচে থাকার আকুতি। দিয়ে গেলেন সুখের সন্ধান। দরাজ কণ্ঠের ‘এখনো দেখতে পাই, পায়রা ডাকাডাকি করছে, কাক উড়ছে। তাদের তো কেউ থামাতে পারিনি। সেই দৃশ্য দেখার জন্য আমি বেঁচে আছি। আর বেঁচে আছি বাংলা ভাষায় খেয়ালের জন্য। কথা যেন দিয়ে গেল বেঁচে থাকার প্রেরণা।
খেয়াল পরিবেশনের মঞ্চের পাশে দুটি ব্যানার দেখা

যায়। যার একটি ছিল আচার্য সত্যকিঙ্কর বন্দ্যোপাধ্যায়ের এবং অন্যটি সংগীতজ্ঞ আজাদ রহমানের। গল্প-গানের ফাঁকে এক আলাপে কবীর সুমন স্মরণ করেন সত্যকিঙ্কর বন্দ্যোপাধ্যায় ও বাংলাদেশের প্রয়াত সংগীতগুরু আজাদ রহমানকে।
একে একে গেয়ে যান, ‘এই নাগরিক জীবন আর নাগরিক মন, দিন ফুরিয়ে গেছে সংগীতায়োজন।’ ‘এ মোহ-আবরণ খুলে দাও’, ‘দাঁড়িয়ে আছ তুমি আমার গানের ওপারে’, ‘সেই যে ছোঁয়া সন্ধ্যের বাঁকে’।
এখানেই থামেননি সুমন। আমাদের মুগ্ধ করে শুনিয়েছেন, ‘বনের চামেলি ফিরে আয়’, ‘নাচে সখীগণ কুঞ্জে’, ‘কিছু নেই তবু আছে একা নীল তারা’। সবশেষে ‘ডেকেছি কত সাড়া দিলে না’ গেয়ে শেষ করেন নিজের আয়োজন।
২১ অক্টোবর ছিল তিন দিনের আয়োজনের শেষ দিন। সুমন গাইলেন আধুনিক বাংলা গান। একে একে শোনালেন ২৩টি গান। মঞ্চে প্রবেশ করে যথারীতি শ্রোতাদের কুর্নিশ জানিয়ে হাত রাখলেন কীবোর্ডে। দর্শকের করতালিতে মুখোর তখন অডিটোরিয়াম। সুমন বললেন, ‘আসুন,আমরা ভেদাভেদ ভুলে ভালোবাসাটাকে আগে দেখি।’ ‘আজ জানলার কাছে ডেকে গেছে পাখির মতো সকাল’- গানিটি দিয়েই শুরু হলো সুমনের শেষ দিনের পরিবেশনা। তারপর নিজের জন্ম ও শৈশবের স্মৃতি আওড়ানোর ফাঁকে ফাঁকে গাইলেন ‘খোদার কসম জান’। জানালেন, প্রেমে পড়তে ভীষণ ভালোবাসেন তিনি। ভীষণভাবে প্রেমের ফাঁদে আটকে দিয়ে তিনি লিখেছিলেন তার ‘জাতিস্বর’ গানটি। শোনালেন, ‘অমরত্বের প্রত্যাশা নেই, নেই কোনো দাবি দাওয়া’। মুগ্ধ শ্রোতারাও ঠোঁট মেলালেন তার সঙ্গে।
সামনের সারিতে ঢাকার বন্ধুদের বসে থাকতে দেখে স্মৃতিচারণ করলেন ফেলে আসা দিনগুলোর। আমেরিকা কিংবা জামার্নিতে থাকার দিনগুলোতে যেভাবে বন্ধুত্ব হয়েছিল ঢাকার এই মানুষগুলোর সঙ্গে। তাদেরকে এতো বছর পর পেয়ে অনেকটা আবেগী হয়েই শুরু করলেন ‘দিনটা আজকে অন্যরকম ছিল’।
বাংলাদেশি দর্শকদের এতো উচ্ছ¡াস, তার গান নিয়ে এতো আবেগ মুগ্ধ করলো তাকে। গল্পে গল্পে বললেন, ‘আমি কতটা মুসলিম, কতটা মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়, কতটা নকশাল- পশ্চিমবঙ্গে তাই নিয়ে আলোচনা বেশি হয়; আমি কতটা গান-বাজয়ায় মিশে তা নিয়ে আলোচনা হয় না। এদেশের মানুষের মাঝে গানের জন্য এতো ভালোবাসা আমার সত্যিই ভীষণ ভালো লাগছে।’
তারপর শোনালেন, ‘চেনা দুঃখ, চেনা সুখ’; ‘হাল ছেড়োনা বন্ধু’, ‘তোমাকে অভিবাদন’, ‘আমি চাই’, ‘সারারাত জ্বলেছে নিবিড়’, ‘তুমি আসবেই আমি জানি’, ‘আমি যাই দূরে’, ‘কে তৈরি করেছিল তাজমহল’, ‘তুমি ছিলে প্রথম প্রেমিকা’, ‘আমি যাকে ভালোবাসি’, ‘পেটকাটি চাঁদিয়াল’।
দর্শকের সারি থেকে একের পর এক অনুরোধ আসতে থাকতে জনপ্রিয় গানগুলো গেয়ে শুনানোর। সুমন চেষ্টা করেন সে আবদার রাখার। দর্শকের অনুরোধে শোনালেন ‘বাঁশরিয়া’, ‘ খাতা দেখে গান গেও না’, ‘গড়িয়াহাটার মোড়’, ‘এক মুহূর্ত ফিরিয়ে দিয়ে’। মঞ্চের এক কোণে মুগ্ধ হয়ে কবীর সুমনের গান শুনছিল এক ছোট্ট শিশু। সুমন তাকে ডাকলেন মঞ্চে। বড় আদরে কাছে টেনে নিয়ে বললেন, ‘আমি তোমার জেঠু হই। ভারি মিষ্টি দেখতে তুমি।’ নিজের পরিচয় দিলেন ‘কবীর’ বলে। তারপর গাইলেন ঢাকা আসরের শেষ গান ‘তোমাকে চাই।’ সুমনের সঙ্গে গলা মেলালো শত-শত কণ্ঠস্বর। সুমনকে ওই মুহূর্তে আরো বেশি উচ্ছ¡সিত লাগছিল। শ্রোতাদের উদ্দেশ্যে বললেন, ‘গলা ছেড়ে গান না, আপনারা। আমি একটু দেখি…।’
‘তোমাকে চাই’-এর ৩০ বছরের আয়োজনে কবীর সুমনকে এই দেখার পর মনের কোনে এখনো গুনগুনিয়ে ওঠে-
‘আমার স্বপ্নে বিভোর হয়েই জন্মেছ বহুবার,
আমি ছিলাম তোমার কামনা বিদ্রোহ চিৎকার
বারবার আসি আমরা দুজন, বারবার ফিরে যাই
আবার আসব, আবার বলব শুধু তোমাকেই চাই।’

তুমি আবার এসো গানওয়ালা এই বাংলায়…।

মন্তব্য করুন

খবরের বিষয়বস্তুর সঙ্গে মিল আছে এবং আপত্তিজনক নয়- এমন মন্তব্যই প্রদর্শিত হবে। মন্তব্যগুলো পাঠকের নিজস্ব মতামত, ভোরের কাগজ লাইভ এর দায়ভার নেবে না।

জনপ্রিয়