বাজারের ব্যাগে মিলল নবজাতকের লাশ

আগের সংবাদ

দেশীয় জ্বালানি উত্তোলনে গুরুত্ব : অনুসন্ধান ও উত্তোলনে মহাপরিকল্পনা > ২০২৫ সালের মধ্যে ৪৬টি কূপ খনন করার উদ্যোগ পেট্রোবাংলার

পরের সংবাদ

লন্ডনে জাতির পিতার ভাস্কর্য ও একজন আফছার খান সাদেক : আবদুল গাফ্ফার চৌধুরী

প্রকাশিত: সেপ্টেম্বর ৩, ২০২২ , ১২:০০ পূর্বাহ্ণ
আপডেট: সেপ্টেম্বর ৩, ২০২২ , ১২:০০ পূর্বাহ্ণ

লন্ডনের একটি হাসপাতালে চিকিৎসাধীন অবস্থায় গত ১৯ মে শেষ নিশ্বাস ত্যাগ করেন কিংবদন্তি সাংবাদিক, প্রখ্যাত কলাম লেখক ও অমর একুশে গানের রচয়িতা আবদুল গাফ্ফার চৌধুরী। এর আগে দীর্ঘদিন ধরে বার্ধক্যজনিত নানা জটিলতায় ভুগছিলেন বঙ্গবন্ধুর আদরের ‘গাফ্ফার’। ২৫ এপ্রিল জীবনের শেষ লেখাটিও লিখেছিলেন বঙ্গবন্ধুকে নিয়েই। প্রয়াত এই কিংবদন্তির শেষ লেখাটি তুলে ধরা হলো ভোরের কাগজের পাঠকের জন্য

বর্ণ বৈষম্যের দেশ এই ইংল্যান্ড। এখানে মাল্টিকালচার আছে, মানুষ মানুষকে ভালোবাসে। এমন কি সব ধরনের জীবজন্তুকেও ভালোবাসে। আমি বলি ভালোবাসা এদেশ থেকে শিখতে হবে। বাংলাদেশ স্বাধীন হওয়ার ৫০ বছর পার হয়েছে। আর জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের জন্মশতবর্ষ চলছে বিশ্বজুড়ে। আমি লিখছি, পড়ছি, দেখছি। জীবনে একটা স্বপ্ন ছিল ব্রিটেনের বুকে যদি বঙ্গবন্ধুর একটা ভাস্কর্য করতে পারতাম তবেই বাঙালির স্বার্থকতা আসতো।
স্বাধীনতার স্থপতি জাতির পিতা বঙ্গবন্ধুর ভাস্কর্য বিদেশে কেউই করতে পারেনি। আমরা অনেকেই চেষ্টা করে ব্যর্থ হয়েছি। এমন কি বাংলাদেশ হাইকমিশনও। হাই কমিশনার সাইদুর রহমান কেমডেনে ব্রান্স উইক পার্কে বঙ্গবন্ধুর ভাস্কর্য স্থাপনের চেষ্টা করেছিলেন ২০১৫ সালে, খরচ করেছিলেন ২ লাখ ৮০ হাজার পাউন্ড। শেষ পর্যন্ত কাউন্সিল অনুমোদন দেয়নি।

এদিকে ইস্ট লন্ডনে বসবাসকারী লন্ডন আওয়ামী লীগের যুগ্ম সম্পাদক সাবেক ছাত্র নেতা আফছার সাদেক, পিতা এম এ খান ইঞ্জিনিয়ার বাড়ি বিয়ানীবাজার, সিলেট, ২০০৯ সাল থেকে একক প্রচেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছেন। জাতির পিতার ভাস্কর্য স্থাপনে অনুমোদনের জন্য। ওই টাওয়ার হ্যামলেটসে আবার বাঙালি মেয়র লুৎফুর রহমান, কেউ কেউ লুৎফুরকে অন্য ঘনানার লোক বলে মনে করতেন, আমিও মনে করতাম। এটা ছিল ভুল। অবশেষে ২০১৪ সালে সাদেক খান টাওয়ার হ্যামলেটস থেকে ভাস্কর্য স্থাপনের অনুমতি পান। যা আমি দেখেও মুগ্ধ। সঙ্গে সঙ্গে বঙ্গবন্ধু কন্যাদয়কে অবগত করে দেখান। ভাস্কর্য বানানোর অনুমতি নিয়ে লন্ডন থেকে ইন্ডিয়া চলে যান ভাস্কর্য শিল্পীর সঙ্গে দেখা করতে। জাতির পিতার ভাস্কর্য বানানোর প্রয়োজনীয় কাগজপত্র হস্তান্তর করে একটা জমি নিয়ে এসে আমার দেখান। সাদেকের এই দূরদর্শিতা দেখে আমি বলেছিলাম, ‘তুমি তো দেখি সংগ্রামী মানুষ, তুমি পারবা।’
সাদেকের একটা গুণ- মানুষকে খুব ভালোবাসে আর বিশ্বাস তার পুঁজি, তাদের ভাইদের মধ্যে সে ছোট কিন্তু বিশ্বস্ত, ব্যবসার সব দায়িত্ব তার ওপর। জাতির পিতার ভাস্কর্য করতে সব খরচ সাদেক নিজে জুগিয়েছে, এটা অসাধারণ। আমার এখন চরণ চলে না, না হয় প্রতিদিন গিয়ে জাতির পিতাকে ছুঁয়ে দেখে আসতাম।
২০১৬ সালের ১৭ ডিসেম্বর ভাস্কর্য উম্মুক্ত করা হয় সর্ব সাধারণের জন্য। উম্মুক্ত করেন রেলমন্ত্রী সুরঞ্জিত সেন গুপ্ত এমপি। উপস্থিত ছিলেন বাংলাদেশ হাই কমিশনার নাজমুল কাউনাইনসহ কমিউনিটির হাজারো মানুষ। এর পরপরই মুজিব বিরোধীরা মামলা দিয়ে দিল আফছার খান সাদেকের ওপর। ভাস্কর্য এক মাসের মধ্যে তুলে ফেলতে হবে বলে এনফোর্নসমেন্ট নোটিস জারি করে। আফছার খান সাদেক নিরুপায়, পারমিশন থাকা সত্ত্বেও এ অন্যায় কি মেনে নেবেন কী করে? মুজিব ঘরানার কিছু সংখ্যক লোকজনও খুশি, এখন সাদেক কি করবেন? কেউ কেউ গালি গালাজ করছেন সাদেক খানকে। এমন কি এই দেশের কিছু বাংলা পত্রিকা ফলাও করে নিউজ করলো ‘বঙ্গবন্ধুর ভাস্কর্য তুলে দেয়ার নির্দেশ’ শিরোনামে। বেচারা নিরুপায় হয়ে বঙ্গবন্ধুর কন্যা শেখ রেহানা ও লন্ডনে নিযুক্ত বাংলাদেশ হাই কমিশনারের সহযোগিতা চাইলেন, পেলেনও। এমনকি হাই কমিশনার নাজমুল কাউনাইন সাদেককে বলেছিলেন, প্রয়োজনে তিনি টাকা-পয়সা দিয়েও সাহায্য করবেন। সাদেক খান কোনো ধরনের আর্থিক সহযোগিতা চাননি। টাওয়ার হ্যামলেটসের মেয়র জন বিগস বা তার প্রশাসন কোনো কথাই শুনলেন না। শেষমেষ আপিল করলেন উচ্চ আদালতে। উচ্চ আদালত রায় দিল- এটা ‘ল’ ফুল আইনানুগ ডেভলপমেন্ট। এই ভাস্কর্য আইন কানুন মেনেই হয়েছে, এটা থাকবে আজীবন। কাউন্সিলের দায়েরকৃত মামলা কুয়াসমেন্ট করে দেন। রায় আসে ২০১৭ সালের জুন মাসে।
বঙ্গবন্ধুর ভাস্কর্য ঘিরে সিসিটিভি আছে। হিংসা মানুষকে ধ্বংস করে, আর আদর্শ মানুষকে চ্যালেঞ্জ মোকাবিলা করতে শেখায়। সাদেক খান সেদিক থেকে একজন পরীক্ষিত ‘মুজিব প্রেমিক’। নিখাঁদ ভালোবাসা জাতির পিতার প্রতি, শেখ হাসিনা ও শেখ রেহানার প্রতি। ইতোমধ্যে সাদেক বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রীর বাণী, ব্রিটেনের রাণী এলিজাবেথ এবং ব্রিটেনের প্রধানমন্ত্রীর বাণীসহ কবি, সাহিত্যিক, রাজনৈতিক নেতাদের লেখা দিয়ে বড় এক পাবলিকেশন প্রকাশ করেছেন- নাম ‘মেমোরিজ অব বঙ্গবন্ধু’ যা আমার দৃষ্টিতে খুবই মূল্যবান। এরকম প্রকাশনা আমি খুব কমই পেয়েছি।
ইংল্যান্ডের ট্যুরিস্ট গাউড ব্লুবেইজ হ্যারি জ্যাক্সনে বঙ্গবন্ধুর ভাস্কর্য দর্শনীয় স্থান হিসেবে পরিগণিত হয়েছে। কতশত দেশি-বিদেশি মানুষ এই ভাস্কর্যে এসে বাংলাদেশকে জানতে পারছে। সাদেককে একটু সহযোগিতা করা দরকার, উৎসাহ দেয়া দরকার। সাদেকের ৬ বেড রুমের এ বাড়ি মুজিব প্রেমিদের আড্ডাখানা। কত মন্ত্রী, এমপি, রাজনৈতিক নেতারা আসেন বঙ্গবন্ধুর প্রতি সম্মান দেখাতে। সাদেক পরিবারের কাছ থেকে পেয়ে যান সম্মান ও আদর আপ্যায়ন। পরিদর্শন বইতে দেখলাম যারা পদির্শন করে গেছেন- তাদের সুন্দর সুন্দর মন্তব্য। এতো মন্ত্রী, এমপি, রাজনৈতিক নেতারা পরিদর্শন করে সুন্দর সুন্দর করে মন্তব্য করে গিয়েছেন। কিন্তু অতিব দুঃখের বিষয় হলো, তারা কেউই বাংলাদেশের মহান জাতীয় সংসদে আফছার খান সাদেকের প্রবাসে এতো বড় মহতী উদ্যোগের জন্য কোন ধন্যবাদ প্রস্তাবও রাখেননি। তবে কি ভাববো, লন্ডন ছেড়ে দেশের মাটিতে পা ফেলে প্রবাসের কথা তারা বেমালুম ভুলে যান? এ বিষয়টি আমাকে আহত করেছে। অনেক প্রভাবশালী, ধনী ব্যক্তি, লন্ডনে আছেন। কিন্তু বঙ্গবন্ধুর ভাস্কর্য তৈরি করে বাংলাদেশকে বিশ্ব সভায় উপস্থাপন করার মতো সাহস একমাত্র সাদেক খানই দেখিয়েছে।
আফছার খান সাদেক মুজিব পাগল। ভাস্কর্য সংলগ্ন বাড়িটি ‘বঙ্গবন্ধু হাউস’ হবে। হয়তো করোনা মহামারির কারণে হচ্ছে না- তবে অচিরেই হবে এটা আমার বিশ্বাস। আফছার খান সাদেক আমাদেরকে ইতিহাসের অংশীদার করেছেন। আমার জীবদ্দশায় বঙ্গবন্ধুর ভাস্কর্য লন্ডনে দেখতে পেলাম- এর চেয়ে বড় পাওয়া কি আছে?
আর যে দেশের জন্য বঙ্গবন্ধু সপরিবারে প্রাণ দিলেন- সে দেশে বঙ্গবন্ধুর ভাস্কর্য ভেঙে দেয়া হয়। এর চাইতে দুঃখের ঘটনা আর কি আছে? এ লজ্জা আমরা রাখবো কোথায়? এতো সাহস তোদের! শেখ হাসিনা কি নিরাপদ? একই প্রশ্ন বার বার মনে আসে! আমার সময় বেশি নেই, নেত্রীর নিরাপত্তার জন্য সাদেকদের প্রয়োজন। এরা আপসহীন, অদম্য সাহসী।

মন্তব্য করুন

খবরের বিষয়বস্তুর সঙ্গে মিল আছে এবং আপত্তিজনক নয়- এমন মন্তব্যই প্রদর্শিত হবে। মন্তব্যগুলো পাঠকের নিজস্ব মতামত, ভোরের কাগজ লাইভ এর দায়ভার নেবে না।

জনপ্রিয়