বুটেক্স ভর্তি পরীক্ষার ফল প্রকাশ

আগের সংবাদ

কাতারকে অর্থনৈতিক অঞ্চলে জমি দেয়ার প্রস্তাব প্রধানমন্ত্রীর

পরের সংবাদ

ইতিহাসের কালো অধ্যায়

প্রকাশিত: আগস্ট ২২, ২০২২ , ১২:০০ পূর্বাহ্ণ
আপডেট: আগস্ট ২২, ২০২২ , ১২:০০ পূর্বাহ্ণ

বাংলাদেশের রাজনৈতিক সংস্কৃতিতে ২১ আগস্টের গ্রেনেড হামলা একটি কালো অধ্যায় হিসেবে পৃথিবীব্যাপী পরিচিতি পেয়েছে। জাতি হিসেবে যা আমাদের জন্য লজ্জার ও অস্বস্তির। স্বাধীন বাংলাদেশের ইতিহাসে প্রকাশ্য জায়গায় কোনো রাজনৈতিক দলের সমাবেশে এ ধরনের নজিরবিহীন ঘটনা কোনো সরকারের সময়ই ঘটেনি, একমাত্র ব্যতিক্রম ২০০৪ সালের ২১ আগস্ট বঙ্গবন্ধু এভিনিউতে আহূত আওয়ামী লীগের সমাবেশটি। সমাবেশ উপলক্ষে দলের বিভিন্ন পর্যায়ের নেতৃবর্গ মিছিল নিয়ে সমাবেশস্থলে জড়ো হয় এবং ব্যাপক লোকসমাগম হয় জনসভাটিতে। সমাবেশে দলটির সভানেত্রী ও তৎকালীন বিরোধীদলীয় নেত্রীর ভাষণ প্রদানের সময় রাজনৈতিকভাবে অপশক্তি, ষড়যন্ত্রের হোতা, জঙ্গিবাদী গোষ্ঠীর মদদদাতাদের আশ্রয়-প্রশ্রয়ে হামলাটি পরিচালিত হয়। কেউ কিছু বুঝে ওঠার আগেই মুহুর্মুহু গ্রেনেড বিস্ফোরণে মানুষ হতবিহ্বল হয়ে পড়ে। ইতিহাসের এ জঘন্য হামলায় ২৩ জন মানুুষ নিহত হন এবং আহত হন ৫০০ জন। অবাক করার মতো বিষয় হচ্ছে, আহতদের যেন ঠিকভাবে চিকিৎসা প্রদান করা না হয় সে ব্যবস্থাও প্রতিক্রিয়াশীল চক্রটি সম্পন্ন করেছিল। মহিলা লীগের নেত্রী আইভি রহমানের চিকিৎসার গাফিলতির চিত্র তাদের স্বজনদের মাধ্যমে আমরা জেনেছি। আহতদের অনেকেই এখনো এ হামলার স্মৃতি বয়ে বেড়াচ্ছেন, প্রত্যেক বছরে ২১ আগস্টের প্রাক্কালে আহতদের করুণ আর্তনাদের চিত্র সংবাদ মাধ্যমে প্রকাশিত হয়। বর্তমান প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা এ হামলায় কানে ব্যাপকভাবে আঘাত পান এবং সেটির রেশ তিনি এখনো বয়ে বেড়াচ্ছেন। হামলাকারীদের মূল টার্গেটই ছিল শেখ হাসিনাকে হত্যা করা এবং সেই উদ্দেশ্যকে সফল করতে সব পক্ষ একত্রিত হয়ে হামলাটি পরিচালনা করে। কিন্তু সৃষ্টিকর্তার অসীম কৃপায় ভাগ্যগুণে বঙ্গবন্ধুকন্যা প্রাণে বেঁচে যান, তবে বঙ্গবন্ধুকন্যাকে রক্ষা করতে গিয়ে আওয়ামী লীগের প্রবীণ নেতারা যে মানবঢাল তৈরি করেছিলেন বাংলাদেশের রাজনৈতিক ইতিহাসে সেটি খুবই তাৎপর্য বহন করে।
১৫ আগস্টে যেভাবে জাতির পিতাকে সপরিবারে হত্যা করা হয় (বঙ্গবন্ধুর দুই কন্যা বিদেশে থাকায় প্রাণে বেঁচে যান) ঠিক তেমনিভাবে মুক্তিযুদ্ধ পরিচালনাকারী রাজনৈতিক দল আওয়ামী লীগের নেতৃত্বকে নিশ্চিহ্ন করার মানসিকতায় প্রতিক্রিয়াশীল গোষ্ঠী ২১ আগস্টের সমাবেশে গ্রেনেড হামলা ঘটিয়ে ন্যক্কারজনক পরিস্থিতির সৃষ্টি করে। এ দিনে উদ্দেশ্যপ্রণোদিতভাবে জাতির জনকের জ্যেষ্ঠ কন্যা, আওয়ামী লীগ সভাপতি শেখ হাসিনাসহ দলের নেতাদের পুরোপুরি নিঃশেষ করার সব প্রক্রিয়া সম্পন্ন করেছিল চক্রটি। অথচ হামলার পরপরই জাতীয় সংসদে এ ঘটনার জন্য তৎকালীন সরকারপ্রধান আওয়ামী লীগকেই দোষারোপ করে। এখন সবকিছুই প্রকাশ্যে চলে এসেছে, মিথ্যা জজ মিয়া নাটকেরও অবসান হয়েছে। মামলার রায়ে যে সব রাঘববোয়ালের শাস্তি হয়েছে তাতে সহজে প্রতীয়মান হয় যে, ওই সময়ে বিরোধীদলীয় নেত্রীর রাজনৈতিক সমাবেশে হামলার সঙ্গে রাষ্ট্রযন্ত্র সরাসরি জড়িত ছিল। এ মামলার অন্যতম মুখ্য আসামি হিজবুত তাহরীর নেতা মুফতি হান্নানের সাক্ষ্য গ্রহণের মাধ্যমেই মামলার গতিবিধি নতুন রূপ পায় এবং মামলার রায়ে বিজ্ঞ আদালত তৎকালীন সময়ের দায়িত্বপ্রাপ্তদের দোষী সাব্যস্ত করেন।
সংসদীয় রাজনৈতিক সংস্কৃতিতে শক্তিশালী বিরোধী দল গণতন্ত্রের সৌন্দর্যকে বৃদ্ধি করে, সেক্ষেত্রে বিরোধী দল সরকারের নানাবিধ ভুল-ত্রæটিকে সামনে নিয়ে এসে সরকারকে সঠিক সিদ্ধান্ত গ্রহণে সহায়তা করে। এমনটিই হয়ে থাকে সাধারণত, কিন্তু একটি রাজনৈতিক দলকে ধ্বংস করে দেয়ার যে মহাপরিকল্পনা সেটির সুস্পষ্ট উদাহরণ ২১ আগস্টের গ্রেনেড হামলার মাধ্যমে নির্ণয় করা সম্ভব হয়। এ ঘটনার সঙ্গে সঙ্গে ঢাকাসহ পুরো দেশের মানুষ ভয়ে ভীতসন্ত্রস্ত হয়ে পড়েছিল, যে কোনো সময় যে কোনো ধরনের বোমাবাজি কিংবা হামলার শিকার হওয়ার সম্ভাবনা ছিল আপামর জনসাধারণের। কেননা ২০০১-২০০৫ সরকারের শাসনামলে জঙ্গিদের কার্যক্রম পরিচালনার স্বর্ণযুগ ছিল, পুরো দেশে তারা তাদের কার্যক্রমকে বেগবান করতে সক্ষম হয়েছিল। জেএমবির শীর্ষস্থানীয় দুই নেতা বাংলা ভাই ও আব্দুর রহমানের সঙ্গে তৎকালীন সময়ের মন্ত্রীদের যোগসাজশের বিষয়টি পরবর্তীতে খোলাসা হয়। ক্ষমতাকে দীর্ঘায়িত করার সিঁড়ি হিসেবে তারা জঙ্গিদের মদদ দিয়েছিল। এদিকে মুফতি হান্নানের সাক্ষ্যের ভিত্তিতে গ্রেনেড হামলায় অভিযুক্ত তৎকালীন মন্ত্রী লুৎফুজ্জামান বাবর ও আব্দুস সালাম পিন্টুকে মৃত্যুদণ্ড প্রদান করা হয়।
মৌলবাদী অপশক্তি সাধারণ মানুষকে জিম্মি করে ফায়দা লোটার প্রচেষ্টায় লিপ্ত থাকে, রাষ্ট্রীয় ক্ষমতায় ভাগ বসানোর উদ্দেশ্যকে সামনে রেখে জনবিরোধী কর্মকাণ্ড পরিচালনা করে থাকে। তাদের এ প্রচেষ্টাকে যখন রাষ্ট্রযন্ত্র মদদ প্রদান করে তখন সেটি নিশ্চিতভাবেই রাষ্ট্রীয় সন্ত্রাস (ংঃধঃব ঃবৎৎড়ৎরংস)। সুতরাং ২১ আগস্টের ঘটনাটিকে রাষ্ট্রীয় সন্ত্রাস হিসেবে আখ্যায়িত করা যায়। কেননা তাদের যে দুরভিসন্ধি ছিল সেটি সম্পূর্ণরূপে বাস্তবায়িত হলে সাধারণ মানুষ ভয়ের সংস্কৃতিতে নিমজ্জিত হয়ে যে কোনো সময় যে কোনো পরিস্থিতিতে আক্রান্ত হওয়ার ভয়ে তটস্থ থাকত। ২১ আগস্টের ঘটনাটি ছিল পূর্বপরিকল্পিত, দীর্ঘদিন ক্ষমতায় টিকে থাকার কৌশলের অংশ, দেশি-বিদেশি চক্রান্তের মিলিত উদ্যোগ, বিরোধী শক্তিকে নেতৃত্বশূন্য করে দেয়া ইত্যাদি বিষয়ের একীভূত ইন্ধনই গ্রেনেড হামলার ক্ষেত্রে ক্রীড়নক হিসেবে কাজ করেছে। তাছাড়া স্বাধীনতাবিরোধীরা বঙ্গবন্ধুকন্যাকে চিরতরে নিঃশেষ করে দেয়ার জন্য অসংখ্যবার চেষ্টা করেছে, কারণ তারা জানে বঙ্গবন্ধুর রক্ত যার শরীরে তিনি স্বাধীনতাবিরোধীদের জন্য শক্তিশালী প্রতিপক্ষ হয়ে জনগণকে একাত্ম করে গণআন্দোলনের ডাক দেবেন। তাই তাদের মুখ্য উদ্দেশ্য ছিল বর্তমান প্রধানমন্ত্রীকে শেষ করে দিয়ে আওয়ামী লীগকে নেতৃত্বশূন্য করে দেয়া এবং রাজনৈতিক অঙ্গনে স্থায়ী সংকট সৃষ্টি করে ক্ষমতার মসনদ পাকাপোক্ত করা।
এবারের আগস্টে আমাদের প্রত্যাশা থাকবে, গ্রেনেড হামলার বিচারে যাদের শাস্তি প্রদান করা হয়েছে তাদের প্রত্যেককে বিচারের মুখোমুখি করে শাস্তি নিশ্চিত করতে হবে। ঘোষিত রায়ে যাদের পলাতক দেখানো হয়েছে কিংবা যারা পলাতক আছে তাদের দেশে ফিরিয়ে আনার ব্যাপারে বিশেষ উদ্যোগ গ্রহণ করতে হবে। সাম্প্রতিক সময়ে জঙ্গিরা অনলাইনের মাধ্যমে প্রচার-প্রচারণার পাশাপাশি প্রশিক্ষণও প্রদান করে থাকে এবং উচ্চশিক্ষিত বিপথগামী ছেলেমেয়েরা যুক্ত হচ্ছে। এছাড়া মধ্যপ্রাচ্যের বিভিন্ন দেশ থেকে জঙ্গিরা প্রশিক্ষণ নিয়ে বাংলাদেশে এসে তাদের কর্মপরিধিকে বিস্তৃত করার প্রচেষ্টা আমরা বিভিন্ন সময়ে দেখেছি। তবে বর্তমান সরকার জঙ্গিবাদ মোকাবিলায় বিশ্বে রোল মডেল এবং যে কেউ এক বাক্যে এতে সরকারের সাহসিকতা ও বিচক্ষণতার প্রশংসা করতে বাধ্য।
পচা আপেল তত্ত্বানুযায়ী, যখন কোনো আপেল পচে যায় তখন সেই পচা আপেলটিকে সরিয়ে ফেলতে হয়, না হলে পচা আপেলের কারণে অন্যান্য আপেল নষ্ট হয়ে যায়। ঠিক তেমনিভাবে যারা ২১ আগস্টের গ্রেনেড হামলার অভিযোগে অভিযুক্ত তাদের থেকে দেশকে রক্ষা করতে হবে, উদীয়মান তরুণ সমাজকে রক্ষা করতে হবে, দেশের মানুষকে রক্ষা করতে হবে এবং তার জন্যই তাদের বিচারকাজ আইন, বিধি-বিধান ও প্রক্রিয়া অনুসরণ করে দ্রুত রায় কার্যকর করতে হবে। অন্যদিকে যে বিষয়টি খুবই জরুরি তা হচ্ছে জঙ্গি সংশ্লিষ্ট যারা জামিনে আছেন তাদের বিষয়ে ব্যাপক খোঁজখবর রাখতে হবে। কেননা জঙ্গিবাদ সবসময় একটি বৈশ্বিক হুমকি হিসেবে আমাদের মোকাবিলা করতে হবে। স্কুল-কলেজের পাঠ্যপুস্তকে জঙ্গিবাদ নিয়ে প্রবন্ধ, গল্প অন্তর্ভুক্ত করে এর ভয়াবহতা ও প্রভাব নিয়ে শিক্ষার্থীদের সচেতন করার কাজটি জোরালোভাবেই করতে হবে।
জঙ্গিবাদের বিরুদ্ধে শূন্য সহিষ্ণু নীতির যে ধারাবাহিকতা চলমান সেটি বজায় রাখতে হবে, আপনি যেই হোন না কেন জঙ্গি কার্যক্রমে অংশগ্রহণ করা, জঙ্গিদের মদদ দেয়া, আর্থিক সাহায্য প্রদান, তথ্যসহ জঙ্গিদের যে কোনো ধরনের সহযোগিতার প্রমাণ সাপেক্ষে আপনার বিরুদ্ধে রাষ্ট্রীয় আইনে দ্রুতগতিতে বিচারকাজ শেষ করে শাস্তি প্রদান করতে হবে। তড়িৎগতিতে আইনি প্রক্রিয়ায় শাস্তি প্রদানের মাধ্যমে সাধারণত অন্যদের জন্য বার্তা ও উদাহরণ সৃষ্টি করা যায়। আমরা মনে-প্রাণে চাই, বাংলাদেশ কখনোই অপরাধীদের অভয়ারণ্য হিসেবে প্রতিষ্ঠিত না হোক, ২১ আগস্টের ন্যক্কারজনক ঘটনার পুনরাবৃত্তি না ঘটুক এ দেশে এবং সঙ্গে সঙ্গে ২১ আগস্টের হোতাদের যারা প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষভাবে জড়িত এবং যাদের বিরুদ্ধে রায় ঘোষিত হয়েছে তাদের প্রত্যেকের শাস্তি নিশ্চিত করা হোক।

মো. সাখাওয়াত হোসেন : সহকারী অধ্যাপক, চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়।

মন্তব্য করুন

খবরের বিষয়বস্তুর সঙ্গে মিল আছে এবং আপত্তিজনক নয়- এমন মন্তব্যই প্রদর্শিত হবে। মন্তব্যগুলো পাঠকের নিজস্ব মতামত, ভোরের কাগজ লাইভ এর দায়ভার নেবে না।

জনপ্রিয়