বুয়েটে ছাত্রলীগের ব্যানারে সভা, বিক্ষোভ শিক্ষার্থীদের

আগের সংবাদ

উত্তরায় গার্ডার চাপায় নিহত ৫

পরের সংবাদ

শুদ্ধতম জাতীয়তাবাদী, শ্রেষ্ঠতম নেতা

প্রকাশিত: আগস্ট ১৫, ২০২২ , ১২:০০ পূর্বাহ্ণ
আপডেট: আগস্ট ১৫, ২০২২ , ১২:০০ পূর্বাহ্ণ

কিছু নাম থাকে, যা অবিনশ্বর। সে নামকে উপেক্ষা করার শক্তি কারো হয় না, যদিও কেউ কেউ সে মূর্খতা দেখায়। এ নাম কবরের, কালের সীমা ছাড়িয়ে সোচ্চার ও শক্তিধর হয়ে মহাকালের আঙিনায় টিকে থাকে। এ নাম মহাপুরুষের। এঁদের যা কীর্তি- তা অস্বীকার করার জো নেই কারো; যদিও কেউ কেউ আত্মপ্রবঞ্চক বা আত্মঘাতী হয়ে শাশ্বত সত্যকে অস্বীকার করতে উদ্যোগী হয়!
শেখ মুজিবুর রহমান, বঙ্গবন্ধু নামে উচ্চারিত না হলে যে নাম অসম্পূর্ণ থেকে যায়, তেমনি এক নাম। এ নামকে জোর করে প্রতিষ্ঠা দেয়ার প্রয়োজন হয় না, জোর করে মুছে দেয়াও সম্ভব হয় না। যুক্তরাষ্ট্রের জর্জ ওয়াশিংটন, ভারতের মহাত্মা গান্ধী, চীনের মাও সেতুং, ভিয়েতনামের হো চি মিন, ইন্দোনেশিয়ার সোয়েকর্ন, আফ্রিকার প্রথম মুক্ত উপনিবেশ ঘানার পেট্রিস লুমাম্বা, কওমি নক্রুমা, দক্ষিণ আফ্রিকার নেলসন মেন্ডেলা, সাবেক সোভিয়েত ইউনিয়ন এবং যুগোসøাভিয়ার লেনিন ও মার্শাল টিটো যেমন- তেমনি বাংলাদেশের বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান। নামে এঁরা এক নয় কিন্তু কীর্তির অসীমতায় এঁরা প্রায় অভিন্ন; আপন গৌরবে ভাস্বর।
যে নাম শেখ মুজিবের- তার সাথে মিশে আছে বাংলাদেশ; সব ধর্ম, সব বর্ণের মানুষের কল্যাণে আধুনিক রাষ্ট্রচিন্তার ফসলবাহী বাঙালির প্রথম রাষ্ট্র পত্তনের ইতিহাস। হাজার বছরের যে বাঙালি, কখনো বিচ্ছিন্ন, কখনো পরাজিত, কখনো নিরবচ্ছিন্ন লড়াকু কিংবা জাতিসত্তা অন্বেষণে বিভ্রান্ত অথবা বিপর্যস্ত- সেই বাঙালির জন্য আধুনিক স্বাধীন রাষ্ট্রের স্থপতির নাম বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান। এ নাম স্বমহীমায় দীপ্যমান; না হয় কারো কারো মূর্খতায় তাঁকে অস্বীকারের কদর্যতাও চলে কখনো কখনো!
অনেক প্রতিবন্ধকতা, সংকট-সীমাবদ্ধতা এবং পরিশেষে আকাশচুম্বী সাফল্য নিয়ে শেখ মুজিব সর্বকালের সর্বশ্রেষ্ঠ বাঙালি, যিঁনি তাঁর একনিষ্ঠ দেশপ্রেম, প্রগাঢ় মেধা ও বিস্ময়কর ত্যাগে পাকিস্তান রাষ্ট্রের সামরিক স্বৈরাচার, ধর্মীয় মিথ্যাচার, রাজনৈতিক এবং সাংস্কৃতিক দুর্বৃত্তায়নের বিরুদ্ধে পূর্ব বাংলার মানুষকে অধিকার সচেতন করে তুলেছিলেন। সেদিনকার পূর্ব বঙ্গ বা পূর্ব পাকিস্তানে বাঙালিদের জাতীয়তাবাদী আন্দোলনকে প্রায় একচ্ছত্রভাবে বেগবান ও অপ্রতিরোধ্য করে তুলেছিলেন এবং মুসলমান প্রধান একটি জনপদে জনগণতান্ত্রিক রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠা করার সাফল্য অর্জন করেছিলেন। বিশ্বের মুসলমান প্রধান দেশগুলোর মধ্যে সে কারণেই ব্যতিক্রম বাংলাদেশ এবং এই ব্যতিক্রমের জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান।
অসামান্য রাজনীতিবিদ তিনি। রাজনীতির কীর্তিমান এই কবি একাত্ম হয়ে ওঠেছিলেন বাঙালি মানস ও বঙ্গের মাটির সাথে, তাদের দীর্ঘলালিত আশা ও আকাক্সক্ষার সাথে। আমাদের দুর্ভাগ্য- সে ইতিহাস কেউ জানতে চাই, কেউ চাই ঢাকতে! অথচ বাংলাদেশ যতদিন থাকবে ততদিনই জাগরূক ও প্রাসঙ্গিক থাকবেন শেখ মুজিবুর রহমান। কারণ তিনি জেগে উঠলেই উগ্র-ধর্মবাদী, উগ্র-তত্ত্ববাদী সাম্প্রদায়িক রাজনীতির অন্তরাত্মা কেঁপে ওঠে; ১৯৭৫-এর নির্মম হত্যাকাণ্ডের অনেক যুগ পরেও সে কারণে শেখ মুজিব আমাদের সেক্যুলার সমাজশক্তির মুখ্য অনুপ্রেরণা।
সাহিত্য, শিল্প ও দর্শনে বাঙালিকে প্রথম বিশ্বনন্দিত করেছিলেন রবীন্দ্রনাথ। নেতাজি সুভাষ চন্দ্র বসু তার দুর্দমনীয় সাহস ও দেশপ্রেমে বিকশিত হয়েছিলেন ব্রিটিশ উপনিবেশবাদবিরোধী সর্বভারতীয় গণমানুষের মহানন্দিত মহানায়কে। এরপর আসেন বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান, বাঙালির ইতিহাসে যিঁনি স্বাধীন-সার্বভৌম আধুনিক রাষ্ট্রের রূপকার-স্থপতি এবং জাতীয় মুক্তিযুদ্ধের সর্বাধিনায়ক। বিস্ময়কর হলেও সত্য যে, পাকিস্তান হানাদার বাহিনীর হাতে বন্দি হয়ে সেদিনকার পশ্চিম পাকিস্তানের কারাগারে অবস্থান করেও তাঁরই নেতৃত্বে, তাঁরই নাম ও আদর্শে পরিচালিত হয়েছে বাংলাদেশ প্রতিষ্ঠার সফল মুক্তিযুদ্ধ ১৯৭১ সালে।
ইতিহাস সাক্ষ্য দেয়, এক জাতি হয়েও বাঙালি কখনো এক হয়নি, হতে পারেনি। স্বশাসিত হবার বড় বেশি সুযোগ ঘটেনি বাঙালির ইতিহাসে। ধর্মীয় কুসংস্কার, সংকট, ষড়যন্ত্র, লোভ-দাসত্ব ইত্যাদি বারবার আঘাত করেছে বাঙালিকে। এক হয়ে মাথা তুলে দাঁড়াতে পারেনি বাঙালি, স্বশাসিত হবার স্বপ্ন তাই মøান হয়েছে বারংবারের দুর্ভাগ্যে। শেখ মুজিবই প্রথম সবল-সফল মহান রাজনীতি-পুরুষ, যিঁনি তাঁর অনন্য সাধারণ নেতৃত্ব গুণে জাতির অসাম্প্রদায়িক চেতনাকে পরিপূর্ণ বিকশিত করেন। গোঁড়ামি ও কুসংস্কারের ঊর্ধ্বে ওঠে এক দেহ, এক আত্মায় সমার্পিত করে জাতীয় মুক্তিযুদ্ধে ঝাঁপিয়ে পড়তে উদ্বুদ্ধ করেন বাঙালিকে।
শেখ মুজিব ছিলেন এমনই মহানায়ক যাঁর রাজনীতি কখনোই গোপন পথে বিচরণ করেনি। একটি স্বশস্ত্র জনযুদ্ধে জাতিকে এগিয়ে নিতেও তিনি বেছে নিয়েছিলেন পরিপূর্ণ গণতান্ত্রিক ও নিয়মতান্ত্রিক পথ। ফলে বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধকে বিচ্ছিন্নতাবাদী বলে চিত্রিত করতে পারেনি কেউই, এমনকি পাকিস্তানি শাসকচক্রও। রাজনীতির সন্ত্রাসবাদী পথকে তিনি সযতনে পরিহার করেছেন সারাজীবন। বুলন্দ কণ্ঠের মতোই তাঁর আদর্শ ছিল মুক্ত, স্পষ্ট ও নীতির প্রশ্নে আপসহীন। বছরের পর বছর তিনি পাকিস্তানি শাসকদের হাতে কারা-নির্যাতন ভোগ করেছেন; অসংখ্যবার গ্রেপ্তার হয়েছেন, অসংখ্য মামলায় জড়িয়ে তাঁকে নিবৃত্ত করতে চেষ্টা হয়েছে। কিন্তু চরম নির্যাতনেও শেখ মুজিব ভাঙেননি, মোচড়াননি, পরাজিত হননি। নেতাজি সুভাষ বসুর পর তাই তিনি হয়ে ওঠেন বাংলার অবিভাজিত নিষ্কলুষ যৌবন-শক্তির প্রতীক; অধিকারবঞ্চিত মানুষের আশা-আকাক্সক্ষা ও সাহসের প্রতীক। সে কারণেই বাংলাদেশ নামের
প্রিয় কবিতার অমর কবি হতে পেরেছিলেন তিনি।
ইতিহাস সাক্ষ্য দেয়, ব্যক্তিত্বের সম্মোহনী শক্তি, ত্যাগ ও আদর্শনিষ্ঠায় পরিণত হয়েছিলেন তিনি ইতিহাসের গণদেতবতায়। এমন অসাধারণ জনপ্রিয়তা আর কোনো রাজনৈতিক নেতার ভাগ্যে জোটেনি বঙ্গে। বিদেশিরা তাঁকে বলেছে ‘পোয়েট অব পলিটিক্স’। কিন্তু শেখ মুজিব একই সঙ্গে ছিলেন ‘পোয়েট অব হিউমেনিটি এন্ড জাস্টিস’। জাতিকে তিনি আত্মসচেতন করে তুলেছিলেন, বাঙালির জাতীয়তাকে তিনি ভাষা দিয়েছিলেন,
নিপীড়িত মানুষের আশা-আকাক্সক্ষাকে গ্রামগঞ্জ থেকে শহর-নগর-বন্দরে পৌঁছে দেয়ার সাফল্য অর্জন করেছিলেন। এমন বিস্ময়কর অর্জন খুব কম ঘটে।
১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্ট বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানকে হত্যা করা হয়। রক্তাক্ত শেষ নিশ্বাসে প্লাবিত করা হয় তার পরিবারের প্রায় সকলকে; শিশু, বয়োবৃদ্ধ, নববধূ পর্যন্ত! এ হত্যাকাণ্ড ইতিহাসের বর্বরতম সন্দেহে নেই কোনো। কিন্তু প্রসঙ্গ এখানে ভিন্ন। মানুষ জন্মায়, তাই মৃত্যু তার অবধারিত। বাঙালির দুর্বার জাতীয়তাবাদী আন্দোলনের নেতৃত্ব দিচ্ছিলেন যখন তখনো পাকিস্তানি স্বৈরশাসকদের হাতে প্রাণ দিতে পারতেন শেখ মুজিব। মুক্তিযুদ্ধকালে যখন তাঁকে বন্দি রাখা হয় পাকিস্তানের মাটিতে তখনো তাঁর প্রাণ সংহার অসম্ভব কিছু ছিলো না।
অতএব মৃত্যু এখানে বড় নয়, বড় শেখ মুজিবের হত্যার পেছনের কারণ, তার ফলাফল এবং পরবর্তীতে বেরিয়ে আসা থলের বিড়াল। এই হত্যাকাণ্ডের কুশীলব ও তাদের সঙ্গোপন সমর্থকরা আজো, এত যুগ পরেও, প্রতিটি পদক্ষেপে বুঝিয়ে দেয়, কেন তারা শেখ মুজিবকে হত্যা করেছিল, কেন তারা ভয় পায় এ নামকে!
বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান বাঙালির ইতিহাসে, এযাবৎকালের শ্রেষ্ঠতম রাজনীতি পুরুষ- সন্দেহ নেই এ উচ্চারণে। তিনি সশরীরে মুক্তিযুদ্ধের নেতৃত্ব দিতে পারেননি, কিন্তু তিনিই ছিলেন বাংলাদেশের প্রথম রাষ্ট্রপতি, এবং মুক্তিযোদ্ধাদের সকল অনুপ্রেরণার উৎস। পাকিস্তানের বন্দি জীবন শেষে স্বদেশে ফিরে সদ্য স্বাধীন দেশের কর্ণধার হিসেবে তাঁর সরকারকে চরম সংকটময় সময় অতিবাহিত করতে হয়েছে। যুদ্ধবিধ্বস্ত দেশের সামাজিক ও অর্থনৈতিক পরিকাঠামো পুনরুদ্ধারে সর্বশক্তি নিয়োগ করতে হয়েছে তাঁকে। একদিকে নতুন রাষ্ট্রের প্রত্যক্ষ বিরোধিতাকারী ভিনদেশি তস্কর, অন্যদিকে মুক্তিযুদ্ধের পরাজিত দেশীয় অনুচর- যারা প্রতিপদে আঘাত করেছে স্বাধীনতা-উত্তর বাংলাদেশ রাষ্ট্রকে।
কিন্তু বঙ্গবন্ধু হত্যার কারণ, যে কোনো ইতিহাস সচেতন মানুষই স্বীকার করবেন, তাঁর নেতৃত্বের সরকারের সংকট বা সীমাবদ্ধতার মধ্যে সীমাবদ্ধ ছিলো না। এই হত্যাকাণ্ড ছিল জনগণতান্ত্রিক বাংলাদেশ রাষ্ট্রের জনকের বিরুদ্ধে স্বাধীনতাবিরোধীদের প্রথম প্রত্যক্ষ প্রতিশোধ। স্বাধীনতার মাত্র সাড়ে তিন বছরের মাথায় তাঁকে হত্যা করে ষড়যন্ত্রকারীরা সদ্য স্বাধীন রাষ্ট্রের স্থিতিশীলতাই কেবল বিনষ্ট করতে চায়নি, একই সঙ্গে গুঁড়িয়ে দিতে চেয়েছিল বাঙালির অমর সব গৌরবগাথা; পাল্টে দিতে চেয়েছিল মহান মুক্তিযুদ্ধের সব সাফল্য ও সব অর্জন। তারা সফলও হয়েছিল, আমার ধারণা, যতটা চেয়েছিল, হয়তো তার চাইতেও বেশি! নিঃসন্দেহে সে ছিল এক জাতীয় ট্র্যাজেডি।
আমার বিশ্বাস, বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানকে হত্যার যে পাপ জাতিকে গ্রাস করেছিল তার প্রায়শ্চিত করতে হয়েছে জাতিকে অনেককাল। ওই হত্যা বাঙালিকে ঘাতক জাতিতে পরিণত করে, অগণিত মৃত্যু দিয়ে কেনা স্বাধীনতাকে ভূলুণ্ঠিত করে; ওই হত্যা স্বাধীনতার মাত্র কয়েক বছরের মাথায় পুনঃপ্রতিষ্ঠিত করে পরিত্যক্ত, পরাজিত সেই পাকিস্তানি রাজনীতিধারা, সেই সংস্কৃতি; ধর্মের চাতুরি দিয়ে, অসাংবিধানিক শাসন দিয়ে মুক্তচিন্তার সমাজ- প্রগতিকে বিনাশ করার সর্বনাশা সেই পুরনো ধারাকে- যাকে পরাজিত করা হয়েছিল ১৯৭১-এর ঐতিহাসিক জাতীয় যুদ্ধের মধ্য দিয়ে।
জাতীয় শোকের এই মাসে, অনেক কাল পরেও, তাই প্রশ্ন করতে হবে, এবং সকলকে : কেন হত্যা করা হয়েছিল বাংলাদেশের রাষ্ট্রের জনককে। যারা ওই হত্যায় সেদিন নীরব ছিলেন, যারা সাময়িক স্বার্থসিদ্ধির জন্য প্রতিবাদ পর্যন্ত করেননি, আমার বিশ্বাস, তারাও বুঝতে সক্ষম হবেন যে- ১৯৭৫-এর নির্মম হত্যাকাণ্ড তাদের প্রিয় জন্মভূমিকে, জাতীয় মুক্তিযুদ্ধকে, অসাম্প্রদায়িক জাতিসত্তাকে, লাখো শহীদের রক্তকে, সর্বোপরি বাংলা ভাষা-সাহিত্য ও তার সংস্কৃতিকে কতটা বিপন্ন করেছিল।
এটি বিশ্বাস করাই সঙ্গত যে, বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবের হত্যাকাণ্ড সামরিক ও সাম্প্রদায়িক আধিপত্যবাদী স্বৈরতান্ত্রিক পাকিস্তানকে পরাজিত করে উদার জনগণতান্ত্রিক সংস্কৃতির নতুন রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার প্রত্যক্ষ প্রতিশোধ। ওই হত্যা মুক্তিযুদ্ধের মাঠে রাজনৈতিক ইসলামবাদী ও ধর্মীয় সন্ত্রাসবাদীদের পরাজয়ের পাল্টা আঘাত। যার মধ্য দিয়ে একাত্তরের ঘাতক-দালাল, উগ্র-ধর্মবাদীরা নতুন করে রাষ্ট্র ক্ষমতায় আসে, যুদ্ধাপরাধীরা পরিকল্পিত ধারায় পুনর্বাসিত হয়, শহীদের আত্মা বিক্ষত হয়, এবং সে ধারা অব্যাহত থাকে কয়েক যুগ ধরে। বিজাতীয় এই আগ্রাসনে নতুন প্রজন্মের মনে বিকৃত ইতিহাস প্রবেশ করানো হয়েছে, তাদের শেকড়শূন্য করার চেষ্টা হয়েছে। জাতির সৌভাগ্য যে- বাংলাদেশের নতুন প্রজন্মের মধ্যে নতুন এক মনোজাগতিক বিপ্লব সম্পন্ন হয়েছে- তারা মাটি খুঁড়ে বের করে এনেছে জাতীয় স্বাধীনতার অবিকৃত ইতিহাস। এর পরও বলতে হবে, না, ষড়যন্ত্র থামেনি আজো।
যাই হোক, ইতিহাস ঘাতকদের নানাবিধ দানবীয় ধ্বংসযজ্ঞের পরেও, আমার বিশ্বাস, জাতির জনক কিংবা মহান মুক্তিযুদ্ধের মৃত্যু ঘটানো সম্ভব হয়নি। বাঙালির আত্মসম্মান ও আত্মরক্ষার তাগিদেই মুক্তিযুদ্ধকে যেমন আঁকড়ে ধরতে হবে, তেমনি উগ্রবাদীদের হাত থেকে রক্ষা পেতে, অসাম্প্রদায়িক জাতিসত্তাকে প্রতিরক্ষা দিতে বঙ্গবন্ধু ও মুক্তিযুদ্ধকে নিয়েই প্রতিরোধে নামতে হবে বাঙালিকে। দেশের মাটিতে মৌলবাদীদের তৎপরতা যত বাড়বে, যত ওরা শক্তি সঞ্চয় করবে, যত ওরা গ্রাস করতে চাইবে, ততই দ্রুত আশ্রয় খুঁজতে হবে আমাদের জয় বাংলার কাছে, মুক্তিযুদ্ধের কাছে, এবং বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবের কাছে। কারণ এরাই আমাদের জাতীয় অস্তিত্ব ও আত্মবিশ্বাসের প্রতীক, জাতীয় অহংকারের প্রতীক।
পাকিস্তানি সাম্প্রদায়িক রাষ্ট্র কাঠামো ও সামরিকতন্ত্রের বিরুদ্ধে বঙ্গবন্ধু এক সফল জনবিদ্রোহের নেতৃত্ব দেন- যা বাংলাদেশের জন্ম দেয়। সেই গণবিদ্রোহ এতোটাই তীব্র ছিল যে, একদিকে তা শোষণ-বঞ্চনা ও স্বৈরতন্ত্রী পাকিস্তান ভেঙেছে, অন্যদিকে ধর্মনিরপেক্ষ, গণতান্ত্রিক আধুনিক একটি রাষ্ট্রকে সাংবিধানিকভাবে ভিত্তি দান করেছে। ভুললে চলবে না যে, ১৯৭২-এর রাষ্ট্রীয় সংবিধান অনুযায়ী বিশ্বের গোটা মুসলিম প্রধান জনপদের মধ্যে বাংলাদেশই একমাত্র গণতান্ত্রিক ও অসাম্প্রদায়িক রাষ্ট্র হিসেবে বিবেচিত।
বঙ্গবন্ধু যথার্থই উপলব্ধি করেছিলেন ধর্ম ব্যক্তি জীবনের বড় অবলম্বন; কিন্তু রাষ্ট্র হচ্ছে ধর্ম-বর্ণ, ছোট-বড় নির্বিশেষ সকলের সমান অধিকারের ক্ষেত্র। রাষ্ট্রপিতা এটিও উপলব্ধি করেছিলেন যে, ধর্মভিত্তিক রাষ্ট্রনীতি ধর্মের ঔদার্যকেই কেবল খর্ব করে না, সব মানুষের রাষ্ট্রকেও সীমিত করে, জনজীবন বিভাজিত করে। তাই একজন খাঁটি ধর্মানুসারী হয়েও ধর্মের রাজনীতিকে সমর্থনের কারণ খুঁজে পাননি তিনি। পাকিস্তানের বন্দিদশা থেকে স্বদেশে ফিরে ১৯৭২ সালের ১০ জানুয়ারি তিনি উচ্চারণ করেছিলেন, ‘আমি স্পষ্ট ভাষায় বলে দিতে চাই যে, বাংলাদেশ একটি আদর্শ রাষ্ট্র হবে। আর তার ভিত্তি বিশেষ কোনো ধর্মীয়ভিত্তিক হবে না। রাষ্ট্রের ভিত্তি হবে গণতন্ত্র, সমাজতন্ত্র ও ধর্মনিরপেক্ষতা। এ দেশের কৃষক-শ্রমিক-হিন্দু-মুসলমান সুখে থাকবে, শান্তিতে থাকবে।’
তাঁর বড় কৃতিত্ব হচ্ছে রাজনীতিকে তিনি সাম্প্রদায়িক ও সামরিক কর্তৃত্ববাদী আবর্ত থেকে উদ্ধার করে আধুনিক ধারায় প্রবাহিত করেছিলেন। ১৯৭০-এর দশকের বাঙালি মানসে যে অভূতপূর্ব দেশপ্রেম, তা ছিল জাতি-ধর্ম-বর্ণ নির্বিশেষে সব সম্প্রদায়ের মানুষকে অভাবিত উজ্জীবিত করার; আগে যা সম্ভব হয়নি, তাই সম্ভব করেছিলেন শেখ মুজিব। কাজেই শেখ মুজিবকে বুকে টানতে হবে, কারণ তিনি চিরজাগ্রত মহানায়ক। টুঙ্গিপাড়ায় মাটিতে শুয়েও তিনি সর্বাধিনায়ক; বেঁচে থাকার, সামনে এগিয়ে যাবার মূল অনুপ্রেরণা।
বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব আজ কোনো দলের নন। তিনি গোটা জাতির, এবং এ কথাও বিশ্বাস করতে রাজি নই যে, ওই মহাপ্রাণকে শ্রদ্ধা জানাতে বিশেষ দলভুক্ত হবার প্রয়োজন আছে। বাংলাদেশ নামে যার আস্থা, হৃদয়ে যার বাংলাদেশ, তার কাছেই তিনি শ্রদ্ধা, ভালোবাসা ও অহংকারের। যে বাঙালির হৃদয়ে দাসত্ব নেই, পরাধীনতা ও উগ্র-ধর্মীয় উন্মাদনা নেই, সে বাঙালিকেই গ্রহণ করতে হবে শেখ মুজিবকে। এ নামের কোনো বিকল্প নেই।
ইতিহাসের এই সত্য অনুধাবন করা জরুরি যে, শেখ মুজিবের নেতৃত্বে বাঙালির মুক্তিযুদ্ধ শুধু পাকিস্তান হটিয়ে একটি নতুন দেশ প্রতিষ্ঠার যুদ্ধ ছিলো না, ছিল ধর্ম-বর্ণ-গোত্র নির্বিশেষে এই ভূখণ্ডের অধিকারহীন মানুষের মুক্তির যুদ্ধ। সে স্বপ্নপূরণ বাধাগ্রস্ত হয়েছে। পাল্টা আঘাত এসেছে। সাত চল্লিশের দৈত্য একাত্তরের চেতনাকে পর্যুদস্ত করেছে। অতএব বাংলাদেশের মতো একটি রাষ্ট্রের যাত্রাপথ অবারিত করতে প্রয়োজন একটি রেনেসাঁ, একটি নবজাগৃতি, একটি সাংস্কৃতিক নবজাগরণ, যা সাম্প্রদায়িকতার গ্রাস থেকে জাতিকে মুক্ত করবে, মানবিক করবে, সেøাগানের রাজনীতির বাইরে বেরিয়ে যুবতারুণ্যকে মানুষ করবে- বাঙালি করবে।

মন্তব্য করুন

খবরের বিষয়বস্তুর সঙ্গে মিল আছে এবং আপত্তিজনক নয়- এমন মন্তব্যই প্রদর্শিত হবে। মন্তব্যগুলো পাঠকের নিজস্ব মতামত, ভোরের কাগজ লাইভ এর দায়ভার নেবে না।

জনপ্রিয়