বুয়েটে ছাত্রলীগের ব্যানারে সভা, বিক্ষোভ শিক্ষার্থীদের

আগের সংবাদ

উত্তরায় গার্ডার চাপায় নিহত ৫

পরের সংবাদ

জনকের বেদনাদায়ক প্রস্থান

প্রকাশিত: আগস্ট ১৫, ২০২২ , ১২:০০ পূর্বাহ্ণ
আপডেট: আগস্ট ১৪, ২০২২ , ১১:২৯ অপরাহ্ণ

একটি জাতির জনক গোটা জাতির সর্বাধিক অমূল্য সম্পদ। জনকের প্রতি শ্রদ্ধা, তাঁর আদর্শ অন্তরে ধারণ করা এবং তা সযতনে লালন ও বাস্তবায়ন করা যে কোনো জাতির জীবনের এক অপরিহার্য বৈশিষ্ট্য। পৃথিবীর দিকে দিকে তাকালে আমরা তার বেশ কিছু নজির দেখতে পাই। আবার বিপরীতে তার সংখ্যা নেহায়েত কম নয়।
বঙ্গবন্ধু তর্কাতীতভাবে বাঙালি জাতির অমূল্য সম্পদ। তাঁর ধারাবাহিক অবদান আমাদের মহামূল্যবান স্বাধীনতা ও মহান মুক্তিযুদ্ধের সীমাহীন প্রেরণা। ইতিহাস সে সাক্ষ্য দেয় দেশে-বিদেশে তা স্বীকৃত পরম শ্রদ্ধার সঙ্গে।
বাংলাদেশে স্বাধীনতার শত্রæপক্ষ অবশ্য নানাভাবে ঐতিহাসিক ওই সত্যটিকে বারবার বিকৃত করতে চেয়েছে নানাভাবে দীর্ঘদিন যাবত সে অপচেষ্টা চালিয়েছে। কিন্তু সে অপচেষ্টা প্রতিবারই ব্যর্থতায় পর্যবসিত হয়েছে। তারা বলতে চেয়েছে, যেহেতু শেখ মুজিবুর রহমান মুক্তিযুদ্ধাকালে পাকিস্তানের কারাগারে আবদ্ধ ছিলেন এবং তাঁর উপস্থিতি ব্যতিরেকেই যেহেতু নয় মাসব্যাপী সশস্ত্র মুক্তিযুদ্ধ পরিচালিত হয়েছে তাদের অবর্তমানেই ওই যুদ্ধের মাধ্যমে বাংলাদেশ স্বাধীনতা অর্জন করেছে সেহেতু তিনি বাঙালি জাতির জনক হতে পারেন না।
এ বক্তব্য যে উদ্দেশ্যমূলক এবং পাকিস্তান ফিরে পাওয়ার আশায় উন্মাদ নানামহলের উদ্দেশ্যমূলক ভাবনার প্রকাশ মাত্র তা বুঝতে কারও বেশি একটা সময় লাগেনি। ক্ষমতায় এসে এমন প্রচার করায় কিছুসংখ্যক মানুষ সাময়িকভাবে বিভ্রান্ত হলেও ইতিহাস তার নিজের শক্তিতেই সে বিভ্রান্তি দূর করেছে।
কিন্তু যারা এ জাতীয় অপপ্রচার বা বিভ্রান্তির শিকারে কোনোদিনই সামান্যতম প্রভাবিত হননি, জাতির জনকের অকাল এবং নির্মম হত্যালীলা বা তার ষড়যন্ত্র প্রতিরোধে কতটুকু ভূমিকা রেখেছেন- তা বঙ্গবন্ধু প্রয়াণের দীর্ঘ চার দশক পর নির্মমভাবে ভাবনার সময় নিশ্চয়ই এসেছে।
১৫ আগস্ট জাতীয় শোক দিবস। আগস্ট মাস শোকের মাস। এই মাসে আজ থেকে ৪৬ বছর আগে একটি মর্মান্তিক হত্যাকাণ্ডের মাধ্যমে সপরিবার নির্মমভাবে হত্যা করার পর তাৎক্ষণিক আমরা কতটা কী করেছি- তাও অপরিহার্যভাবে ভাবার বিষয়। সর্বাধিক গুরুত্ব দিয়ে ভাবার বিষয়টি হলো এই মৃত্যু কি অবধারিত ছিল বা অপ্রতিরোধ্য ছিল? এর উত্তরে এক কথায় ‘হ্যাঁ’ বা ‘না’ বলা সম্ভব হলেও তা অনুচিত, কারণ তাতে পূর্ণাঙ্গ সত্য মানুষের সামনে অনুপস্থিত থেকে যাবে।
এই আলোচনায় এটা উল্লেখ করা অপরিহার্য যে মুক্তিযুদ্ধকে বানচাল করে, বাঙালির স্বাধীনতা অর্জনের লালিত আকাক্সক্ষাকে ব্যর্থ করে দিতে ষড়যন্ত্র বেশ জোরেসোরেই শুরু হয়েছিল মুক্তিযুদ্ধ চলাকালেই মুজিবনগর থেকে। শহীদ তাজউদ্দিনের নেতৃত্বাধীন বাংলাদেশের প্রথম মন্ত্রিসভার বিদেশবিষয়ক মন্ত্রী আওয়ামী লীগের তৎকালীন সহ-সভাপতি খোন্দকার মোশতাক এই ষড়যন্ত্রের হোতা। কলকাতার মার্কিন দূতাবাসে তিনি গোপনে যাতায়াত করতেন এবং আমেরিকা ও পাকিস্তানের সঙ্গে সমঝোতা করে একটি হালকা কনফেডারেশনের অন্তর্ভুক্ত থেকে পাকিস্তানের অন্তর্ভুক্ত একটি প্রদেশ হিসেবেই থাকতে বাংলাদেশ সরকারকে রাজি করানো। এই ষড়যন্ত্র ভারত সরকারের গোয়েন্দা বাহিনী উদ্ধার করে তাদের প্রধানমন্ত্রী এবং বাংলাদেশের অকৃত্রিম সুহৃদ শ্রীমতি ইন্দিরা গান্ধীকে অবহিত করলে তিনি তৎক্ষণাৎ বিষয়টি তাজউদ্দিন আহমদকে অবহিত করলে তিনি খোন্দকার মোশতাককে বিদেশ মন্ত্রীর পদ অপসারণ না করে বিদেশ মন্ত্রণালয়ের তাবৎ দায়িত্ব থেকে তাকে অব্যাহতি দিয়ে বিচারপতি আবু সাঈদ চৌধুরীকে ওই দায়িত্ব অর্পণ করেন। ভারত সরকার খোন্দকার মোশতাককে গৃহবন্দি করে রাখেন যাতে তিনি কোনো বৈদেশিক শক্তির সঙ্গে যোগাযোগ রক্ষা করতে না পারেন। এভাবেই সে ষড়যন্ত্র আঁতুড়েই বানচাল করে দিয়ে সশস্ত্র যুদ্ধ চালিয়ে স্বাধীনতা অর্জন করা হয়।
খোন্দকার মোশতাকের যুক্তি ছিল- একমাত্র কনফেডারেশনের প্রস্তাব মেনে নেয়ার মাধ্যমেই পাকিস্তানে আটক শেখ মুজিবকে বাঁচানো সম্ভব। এই কথাও যে ওই ষড়যন্ত্রেরই অংশ তা বুঝতে ভারত বা বাংলাদেশ সরকারের কোনো কষ্ট হয়নি। তাই প্রস্তাবটি সরাসরি প্রত্যাখ্যান করে মুক্তিযুদ্ধ সফল করে তুলে তার মাধ্যমেই রাষ্ট্রপতি শেখ মুজিবকে মুক্ত করে আনার সিদ্ধান্ত গ্রহণ করা হয়।
অতীতের এ ইতিহাসের বয়ানকে সামনে রেখে সফল মুক্তিযুদ্ধের পর আন্তর্জাতিক চাপের মাধ্যমেই বঙ্গবন্ধুকে মুক্ত করা হয় এবং ১৯৭২-এর ১০ জানুয়ারি ড. কামাল হোসেনসহ লন্ডন, দিল্লি হয়ে ঢাকা এসে পৌঁছান। সমগ্র জাতির দুশ্চিন্তার অবসান হয়।
বঙ্গবন্ধু ঢাকা বিমানবন্দরে আবেগাপ্লুত লাখো মানুষের শ্রদ্ধা-ভালোবাসায় সিক্ত হয়ে তাঁর বাসভবনে ফিরলেন। পরদিনই রাষ্ট্রপতি হিসেবে আনুষ্ঠানিকভাবে কাজ শুরু করেন। পরবর্তীতে তিনি রাষ্ট্রপতি থেকে পদত্যাগ করে প্রধানমন্ত্রীর দায়িত্ব গ্রহণ করেন।
বিস্ময়কর হলেও সত্য, ওই মন্ত্রিসভার একজন গুরুত্বপূর্ণ সদস্য হিসেবে স্থান পেলেন সেই কনফেডারেশন-প্রত্যাশী খোন্দকার মোশতাক আহমেদ। ততোধিক বিস্ময়ের, মুজিবনগর থেকে ঢাকা ফিরে তাজউদ্দিন যে সম্প্রসারিত মন্ত্রিসভা গঠন করেন তাতেও স্থান পেয়েছিলেন ওই ষড়যন্ত্রকারী নেতা।
বছর আড়াই যেতে না যেতেই মুক্তিযুদ্ধের সফলতম পরিচালনাকারী, মুজিবনগর সরকার তথা বাংলাদেশের প্রথম প্রধানমন্ত্রীকে বঙ্গবন্ধুর ইচ্ছে অনুযায়ী মন্ত্রিসভা থেকে পদত্যাগ করতে হলো। বিশ্বস্ত মন্ত্রী হিসেবে দিব্যি থেকে গেলেন খোন্দকার মোশতাক। ফলে বিষয়টা দাঁড়াল- পাকিস্তান-আমেরিকা-চীনের সঙ্গে বাংলাদেশের বিরুদ্ধে ষড়যন্ত্রের মূল হোতা মন্ত্রিসভায় থাকার সুবাদে সরকারের সব সিদ্ধান্ত অবহিত করার সুযোগ পেলেন আর ওই ষড়যন্ত্র মুজিবনগরে বানচাল করে দেয়ার প্রধান কাণ্ডারি তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী এবং বঙ্গবন্ধুর প্রতি সর্বাধিক শ্রদ্ধা ও আনুগত্যশীল তাজউদ্দিন চলে গেলেন বিচ্ছিন্ন হয়ে।
সবারই জানা, ১৯৭১-এ ব্যর্থ হলেও মুক্তিযুদ্ধের বা বাংলাদেশের অভ্যুদয়ের সক্রিয় বিরোধিতা করেছিল সেই দেশি-বিদেশি শক্তিগুলো পরাজয় মেনে নেয়নি, বরং নতুন উদ্যমে বাংলাদেশ ও বঙ্গবন্ধুর বিরুদ্ধে ষড়যন্ত্র অব্যাহত রেখেছে।
এই দেশি-বিদেশি ষড়যন্ত্র সম্পর্কে বন্ধুসুলভ দেশগুলোর গোয়েন্দা বাহিনী খবর পাওয়া মাত্রই তাদের নিজ নিজ সরকারকে অবহিত করেছে। সোভিয়েত গোয়েন্দা সংস্থা কেজিবি, ভারতের ‘র’ বুলগেরিয়ার তৎকালীন ঢাকাস্থ রাষ্ট্রদূত খবর পেয়ে যায়, বাংলাদেশের শত্রæরা বঙ্গবন্ধুকে শীঘ্রই হত্যা করবে- এমন ষড়যন্ত্র এঁটেছে। সে খবর নানা সূত্রের মাধ্যমে যেমন ভারতের প্রধানমন্ত্রী শ্রীমতি ইন্দিরা গান্ধী, বুলগেরিয়ার রাষ্ট্রদূতের অনুরোধে ন্যাশনাল আওয়ামী পার্টির তৎকালীন সাধারণ সম্পাদক পঙ্কজ ভট্টাচার্য্য স্বয়ং বঙ্গবন্ধুকে অবহিত করলে তিনি বলেন, কোনো বাঙালি সন্তান আমার গায়ে হাত তুলবে না। তোমরা বরং সাবধানে থেকো। এমনকি, বঙ্গবন্ধুকে যখন তাঁর আপন ভাগিনা শেখ ফজলুল হক মণি অনুরোধ করেন, ‘এই মুহূর্তে খোন্দকার মোশতাককে মন্ত্রিসভা থেকে পদচ্যুত করে তাকে এবং অপরাপর ষড়যন্ত্রকারী শাহ মোয়াজ্জেম হোসেন, তাহের উদ্দিন ঠাকুরকে (এরাও ছিলেন মন্ত্রিসভার সদস্য) পদচ্যুত করে গ্রেফতার করে জেলে না পাঠালে দেশটা ভয়াবহ পরিস্থিতির সম্মুখীন হবে এবং তাঁর জীবন বিপন্ন হতে পারে। শেখ মণিকেও তিনি পাত্তা দেননি এবং একই কথা বলে বিদায় দেন।
আমেরিকা তার আগে ওই মন্ত্রীদের এবং সামরিক বাহিনীর কিছু তরুণ কর্মকর্তার সঙ্গে ঢাকাস্থ দূতাবাসে ঘন ঘন বৈঠক করার খবরও জানতে পারা গেছে; কিন্তু বঙ্গবন্ধু থাকলেন তাঁর সিদ্ধান্তে অটল।
অপরদিকে ক্যান্টনমেন্টও হয়ে দাঁড়িয়েছিল বঙ্গবন্ধু হত্যার ষড়যন্ত্রের অন্যতম নিরাপদ কেন্দ্র। পরবর্তীতে আত্মস্বীকৃত খুনিরা যেমন মেজর ডালিম প্রকাশ্যেই বঙ্গবন্ধু হত্যার কথা স্বীকার করেছিলেন।
১৫ আগস্ট ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে স্বাধীনতা-উত্তর প্রথম সমাবর্তন অনুষ্ঠিত হওয়ার কথা ছিল। বিশ্ববিদ্যালয়ের চ্যান্সেলর হিসেবে তিনি তাতে যোগ দেবেন, ফলে এই প্রস্তুতির কারণে বিশ্ববিদ্যালয় ও তৎসংলগ্ন এলাকায় ছাত্র-শিক্ষক কর্মচারীদের স্বাভাবিক ব্যবস্থা। বঙ্গবন্ধু যাবেন সে কারণে অতিরিক্ত নিরাপত্তার ব্যবস্থা হয়েছে বলে সামরিক বাহিনীর গাড়ি ঘোড়া এমনকি ট্যাংক চালানো হলেও মানুষ তাতে সাদাচোখে দেখে সন্দেহের কিছু পাননি।
কিন্তু পেল রাইফেলের আওয়াজ অতি প্রত্যুষে যখন ভেসে এলো- তখন সবার মনে সন্দেহ উদ্রেক করল। মুখে মুখে ছড়িয়ে পড়ল বঙ্গবন্ধু নেই- তাঁকে হত্যা করা হয়েছে। পৃথিবী বিস্মিত, বাংলাদেশ স্তব্ধ। ৩২নং বাড়ির দিকে যাওয়ার সব গতিপথ সামরিক বাহিনীর সদস্যরা ব্যারিকেড করে রাখায় কেউ চাইলেও সেদিকে যেতে পারেননি।
সন্ধ্যায় সব কিছু আরও স্পষ্ট হলো। বেতার টেলিভিশনে ভাষণ দিলেন স্বঘোষিত রাষ্ট্রপতি খোন্দকার মোশতাক। তিনি বঙ্গবন্ধুর হত্যাকারীদের সূর্যসন্তান বলে অবিহিত করলেন। আর শেখ মুজিব ইসলাম ধ্বংস করতে উদ্যত হওয়ায় তাঁকে হত্যা করা ব্যতীত ইসলাম রক্ষা করা সম্ভব ছিল না বলে উল্লেখ করলেন। বঙ্গবন্ধু ও তাঁর পরিবারবর্গের হত্যাকারীকে বিচারের আওতায় আনা যাবে না এমন বিধান রেখে ইনডেমনিটি অধ্যাদেশ জারি করলেন- খুনিদের বিদেশে বাংলাদেশের নানা দূতাবাসে চাকরি দিয়ে পুরস্কৃতও করেন মোশতাক।
বিষ্ময়কর হলেও সত্য, তিন বাহিনী প্রধান ও পুলিশ প্রধান ওই ১৫ আগস্টেই মোশতাক সরকারের প্রতি আনুষ্ঠানিকভাবে আস্থা ব্যক্ত করেন।
মুহূর্তেই সরাসরি রাজনৈতিক দলটির নেতৃত্ব পর্দার অন্তরালে চলে গেল। কোনো প্রতিরোধ হলো না।
আবার বঙ্গবন্ধুর মন্ত্রিসভার অল্প কয়েকজন মন্ত্রী বাদে সবাই মোশতাকের নতুন মন্ত্রিসভায় যোগ দিলেন। ষোলকণা পূর্ণ হলো।
একই সঙ্গে বাংলাদেশ হারালো তার শ্রেষ্ঠ সন্তানকে। পৃথিবী হারালো একজন সাম্রাজ্যবাদ বিরোধী নেতাকে। জনগণ হারালো মুক্তিযুদ্ধের সুমহান আদর্শকে। সে শূন্যতা আজো অপূরণীয়।

মন্তব্য করুন

খবরের বিষয়বস্তুর সঙ্গে মিল আছে এবং আপত্তিজনক নয়- এমন মন্তব্যই প্রদর্শিত হবে। মন্তব্যগুলো পাঠকের নিজস্ব মতামত, ভোরের কাগজ লাইভ এর দায়ভার নেবে না।

জনপ্রিয়