বুয়েটে ছাত্রলীগের ব্যানারে সভা, বিক্ষোভ শিক্ষার্থীদের

আগের সংবাদ

উত্তরায় গার্ডার চাপায় নিহত ৫

পরের সংবাদ

একটি কবিতার ব্যবচ্ছেদ ও বঙ্গবন্ধু

প্রকাশিত: আগস্ট ১৫, ২০২২ , ১২:০০ পূর্বাহ্ণ
আপডেট: আগস্ট ১৪, ২০২২ , ১১:২৯ অপরাহ্ণ

প্রত্যেক মানুষ অবকাশে কখনো নিজের সম্পর্কে ভাবে, সেই ভাবনায় কখনো আত্মপক্ষ সমর্থনের প্রসঙ্গটিও থাকে; আমি তো ব্যতিক্রম কিছু নই, আমিও নিজের সম্পর্কে ভাবি; নিজের সম্পর্কে ভাবতে গিয়ে কখনো আমার সময়, পরিপার্শ্ব, বন্ধু-বান্ধব, আত্মীয়-পরিজন, গোষ্ঠী-গোত্র, প্রজন্ম, সমাজ-সংসার, দেশ-বিদেশ নিয়েও ভাবি। আমার এসব ভাবনা থেকেই একদিন মনে হলো, আমি এবং আমার প্রজন্ম ‘দুঃসময়ের অযোগ্য সন্তান’। তখনই একটা কবিতার খসড়া তৈরি হলো। আসুন, সে কবিতাটি একবার পাঠ করে আলোচনার সূত্রপাত করা যাক-

ক্রমশ আমার দায়িত্ব ফুরিয়ে যায়
অবহেলা পেয়ে যাই কখনো ইচ্ছায় কখনো বা অনিচ্ছায়!
আমাদের পদচ্যুতির কলঙ্ক আর আছে লজ্জা কপর্দকশূন্যতার
মিথ্যের পিছনে অনর্থক করি সত্য অঙ্গীকার!
পুষ্পের মৌসুমে ঘাম ঝরিয়েছি আনাজের ক্ষেতে
স্বপ্নের বেসাতি নিয়ে কেন এলাম এ দুঃস্বপ্নের পৃথিবীতে!
চোখের সমুখে নব্য মীরজাফর জগৎ শেঠদের দেখেছি সন্ত্রাস
কেউ হলো পিতৃঘাতী হন্তারক লোভী ইডিপাস!
তেরো শত রক্তাক্ত নদীর গৌরব করেছি খুন
ধর্মের লেবাস পরে পৃথিবীর শান্তিকুঞ্জে লাগাই আগুন!

আমি এবং আমার সমকালে দেখি বিপর্যয়ের প্রজন্ম
অধঃপতনের গান পল্লবিত হলে দেখি স্খলন প্রণম্য।
আমাদের রক্তস্নাত বিজয়ী একাত্তরের শৌর্য হয়েছে বিপন্ন
পঁচাত্তরে বাংলাদেশ ঘাতকের বুলেটে হয়েছে ছিন্নভিন্ন!
অতঃপর ক্রমাগত মিথ্যাচার সর্বব্যাপী দেখেছি পতন
আমরা সে দুর্ভাগা প্রজন্ম যারা চাক্ষুষ করেছি সংক্রমণ।
কূপমণ্ডূকতা আর অন্ধতার ক্রম বিস্ফোরণ
মেহফিলে দেখেছি স্পর্ধা সোচ্চার মূর্খের আস্ফালন
জেনে বুঝে প্রতিদিন শত গরল করেছি পান
আমরা দুঃসময়ের অযোগ্য সন্তান!
(প্রজন্মের অনুতাপ \ ফরিদ আহমদ দুলাল)

অনিবার্যভাবে কবিতায় এসে গেল বঙ্গবন্ধু প্রসঙ্গ; আমাদের প্রজন্মের স্বপ্ন-আবেগ, আন্দোলন-সংগ্রাম, যা-কিছু ত্যাগ- যা-কিছু অর্জন, সব কিছুর সাথে কোনো না কোনোভাবে শেখ মুজিবের নাম যুক্ত। বঙ্গবন্ধু এমন একজন নেতা যাঁকে শুধু মার্চ বা আগস্টে নয়, তাঁকে স্মরণ করতে হয় বছরের যে কোনো সময়। আমরা যারা সৃজন আঙিনায় সত্তরের প্রজন্ম, তাদের অনেকেই ১৯৭১-এ মুক্তিযোদ্ধা; আমরা দেখেছি আইয়ুব খানের মৌলিক গণতন্ত্রের ছলনা, ১৯৬৬-এর ৬ দফা আন্দোলন, ১৯৬৯-এর গণঅভ্যুত্থান, সত্তরের নির্বাচন, ১৯৭১-এর মুক্তিযুদ্ধ, ১৯৭৫-এর নির্মমতা, এর পর দীর্ঘদিন ধরে ইতিহাস বিকৃতি, দেখেছি পরাজিত শত্রæর পুনর্বাসন, সাম্প্রদায়িক শক্তির উত্থান, ষড়যন্ত্র। ত্রিশ লাখ বাঙালির রক্তস্রোত প্রত্যক্ষ করেছি আমরা, সম্ভ্রম হারানো মায়েদের-বোনেদের করুণ চোখের আর্তি দেখেছি আমরা, আগুনে পুড়েছে গৃহস্তের ঘর- সে আগুনের উত্তাপ আজো আমাদের বুকে জ্বালা ধরায়; আমাদের হৃদয় মাত্রাতিরিক্ত আন্দোলিত হবে, সে-ই তো স্বাভাবিক; এবং সে কারণেই আজকের আলোচনায় ব্যবচ্ছেদ করতে চাইবো উপরের কবিতাটি; যে কবিতার মূল সুর বঙ্গবন্ধুর জীবন সংগ্রাম আর আত্মত্যাগ।
১৯৭৫-এর ১৫ আগস্ট বাঙালি হারিয়েছে তার অবিসংবাদিত নেতা জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানকে। বঙ্গবন্ধুকে সপরিবারে হত্যার ষড়যন্ত্রে যারা লিপ্ত ছিলো এবং যারা সেদিন সশস্ত্র হয়ে ধানমন্ডির ৩২ নম্বরে সশরীরে উপস্থিত হয়ে গুলিবিদ্ধ করেছিলো জাতির মহান নেতাকে, যারা শিশু রাসেলকে মিথ্যা প্রতিশ্রæতি দিয়ে দোতলায় মায়ের ঘরে নিয়ে গুলি করে হত্যা করেছিলো, যারা হত্যা করেছিলো শেখ কামাল-শেখ জামালকে, হত্যা করেছিলো দুই নববধূকে, বঙ্গমাতাসহ বেশ ক’জন নিরপরাধ মানুষকে; ইতোমধ্যে জাতি তাদের পরিচয় জেনে গেছে। আমরা জেনে গেছি, সেদিনের জঘন্য নৃশংসতার সাথে যারা যুক্ত ছিলো, সেই পিশাচদের অনেকেই ১৯৭১-এ মুক্তিযোদ্ধা ছিলেন, কেউ মন্ত্রী আর প্রশ্নবিদ্ধ সেক্টর কমান্ডার ছিলেন। ১৯৭১-এর কথা আমরা যারা জানি, তারা প্রত্যক্ষ করেছি ৭১-এর ৭ মার্চ বঙ্গবন্ধুর ঐতিহাসিক ভাষণের পর বাঙালি কী ভীষণ ঐক্যবদ্ধ ছিলো। সাত কোটি বাঙালি নিশ্চিত মৃত্যু জেনেও স্বাধীনতা যুদ্ধে আত্মনিবেদন করেছিলো। ৯ মাস ধরে অবর্ণনীয় যন্ত্রণা আর লাখ লাখ মানুষের প্রাণ এবং দুই লক্ষাধিক নারীর সম্ভ্রমের বিনিময়ে দেশ পাকিস্তানি দুঃশাসন আর আগ্রাসন থেকে মুক্তি লাভ করেছিলো। তাহলে সাড়ে তিন বছরের মাথায় কী এমন ঘটেছিলো, যাতে মহান মুক্তিযুদ্ধের সাথে যুক্ত কতিপয় দুর্বৃত্ত বিশ্বাসঘাতক জাতির গৌরবোজ্জ্বল ইতিহাসে এমন লজ্জাজনক কলঙ্কের কালি লেপন করে দিলো!
বঙ্গবন্ধুকে সপরিবারে হত্যা করেই ওরা ক্ষান্ত হয়নি, ওরা জেলখানায় ঢুকে হত্যা করেছে চার জাতীয় নেতাকে; যাদের একজন ছিলেন সৈয়দ নজরুল ইসলাম, যিনি ১৯৭১-এ যুদ্ধ চলাকালে বিপ্লবী সরকারের অস্থায়ী রাষ্ট্রপতি ছিলেন; দ্বিতীয়জন ছিলেন তাজউদ্দীন আহমদ, যিনি ছিলেন স্বাধীন বাংলাদেশের প্রথম প্রধানমন্ত্রী। তৃতীয়জন ছিলেন ক্যাপ্টেন (অব.) মনসুর আলী; যিনি ছিলেন যুদ্ধকালীন সময়ের অর্থমন্ত্রী এবং ১৯৭৫-এ মনোনীত হয়েছিলেন বাংলাদেশ সরকারের প্রধানমন্ত্রী; আর শেষ জন ছিলেন এ এইচ এম কামারুজ্জামান, যিনি ছিলেন ১৯৭১-এর বিপ্লবী সরকারের স্বরাষ্ট্র ও কৃষিমন্ত্রী। দুর্বৃত্তরা হত্যা করেছে অসংখ্য দেশপ্রেমিক মুক্তিযোদ্ধাকে, যারা সেনাবাহিনীতে কর্মরত ছিলেন। পরবর্তী সময়ে ওরা ইনডেমনিটি অধ্যাদেশ জারি এবং সেই অধ্যাদেশকে বিল আকারে পাস করে আইনে পরিণত করে; যার ফলে অপরাধীদের বিচারের পথ বন্ধ হয়ে যায়। এসব অসভ্যতার পাশাপাশি ওরা ইতিহাস বিকৃতি এবং বঙ্গবন্ধু ও তাঁর ঘনিষ্ঠজনদের নামে চালাতে থাকে অপপ্রচার ও মিথ্যাচার; গোয়েবলীয় চিন্তায় ওরা মিথ্যাকে সত্যে রূপান্তরিত করতে চেয়েছিলো।
দীর্ঘদিনের অপপ্রচার ও মিথ্যাচারে স্বাধীন বাংলাদেশের কয়েকটি প্রজন্ম ভ্রান্তির মধ্যে বেড়ে উঠেছে। ফলশ্রæতিতে আজ বাঙালির শৌর্য-বীর্য আর গৌরবের ইতিহাসকে নতুন প্রজন্মের মানুষকে বিশ্বাস করানো কঠিন হয়ে পড়েছে। দীর্ঘ ২১ বছর পর মহান মুক্তিযুদ্ধে নেতৃত্বদানকারী রাজনৈতিক দল রাষ্ট্রীয় ক্ষমতায় এলেও সত্য আর বিশ্বাস প্রশ্নবিদ্ধ হয়ে আছে; অন্যদিকে একাত্তরের পরাজিত শত্রæরা ধর্মের আলখাল্লা পরে কৌশলে মগজধোলাই করে চলেছে অহর্নিশ। এখন প্রশ্ন হলো- বাঙালির জীবনে বঙ্গবন্ধুর অবস্থান কোথায়? বাঙালির জন্য অনিবার্য কেন বঙ্গবন্ধু? নতুন প্রজন্মের জন্য দিকনির্দেশনা কী হবে? এবং কারা দায়িত্ব নিয়ে বঙ্গবন্ধুর কাক্সিক্ষত মুক্তির দিশা দিতে জাতিকে পথ দেখাবে? এই চারটি প্রশ্নের মীমাংসা করতে চাই আজকের রচনায়।
আমি মনে করি প্রথম ও দ্বিতীয় প্রশ্নের উত্তর জানা হয়ে গেলে তৃতীয় এবং চতুর্থ প্রশ্নের উত্তর সহজ হয়ে যায়। মানুষের জীবন চালনার মূল অনুষঙ্গ হলো বিশ্বাস এবং চর্চা; ইসলামি পরিভাষায় যা ইমান ও আমল। নিজের ইচ্ছা ও রুচিমাফিক স্বচ্ছন্দ্য স্বাধীন জীবন-যাপনই মানুষের প্রত্যাশা। এখন প্রশ্ন হলো এই প্রত্যাশার প্রতি আমরা আস্থাশীল কি-না? যদি আস্থাশীল থাকি তাহলে আমার বিশ্বাসকে চিহ্নিত করা গেল; এবার পরবর্তী অংশ- চর্চা বা আমল; নিজের প্রত্যাশা পূরণ করার জন্য যেন অন্য কারো প্রত্যাশা বিপন্ন না হয়, সেটা নিশ্চিত করাও ভদ্র-শিষ্ট-আধুনিক মানুষের দায়িত্ব। বঙ্গবন্ধুর সংগ্রামী জীবন, বিশেষ করে ১৯৪৫ থেকে ১৯৭১ এবং স্বাধীনতা পরবর্তী তাঁর সাড়ে তিন বছরের দেশ পরিচালনা, বাঙালির অর্থনৈতিক ও সাংস্কৃতিক মুক্তির লক্ষ্যে তাঁর নানান কর্মসূচি আর দিকনির্দেশনা, এবং সর্বোপরি আপামর বাঙালির জন্য তাঁর ভালোবাসার স্বরূপ সন্ধান করা গেলে সহজেই ধারণা করা যাবে বঙ্গবন্ধুর জীবনসৌন্দর্য; বিশেষ করে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান রচিত তিনটি গ্রন্থ- অসমাপ্ত আত্মজীবনী, কারাগারের রোজনামচা এবং আমার দেখা নয়া চীন, মনোযোগ দিয়ে পাঠ করলেই একজন দেশপ্রেমিক মহান নেতাকে চিনে নেয়া যাবে। বোঝা যাবে কিউবার নেতা ফিদেল কাস্ত্রোর বিবেচনার কথা, আসুন স্মরণ করি ১৯৭৩-এ আলজেরিয়ায় অনুষ্ঠিত জোট নিরপেক্ষ আন্দোলনের (ন্যাম) চতুর্থ সম্মেলনে কথা। সম্মেলনে অংশগ্রহণকারী দেশগুলোর মধ্যে বাংলাদেশও ছিলো, কিউবাও ছিল। সেখানে বঙ্গবন্ধুর সাথে দেখা হয় কিউবার বিপ্লবী নেতা ফিদেল কাস্ত্রোর। সে সময় তিনি বঙ্গবন্ধুকে আলিঙ্গন করে বলেছিলেন, ‘আই হ্যাভ নট সিন দ্য হিমালয়েজ। বাট আই হ্যাভ সিন শেখ মুজিব। ইন পারসোনালিটি এন্ড ইন কারেজ, দিস ম্যান ইজ দ্য হিমালয়েজ। আই হ্যাভ দাজ হ্যাড দ্য এক্সপিরিয়েন্স অব উইটনেসিং দ্য হিমালয়েজ।’ অর্থাৎ ‘আমি হিমালয় দেখিনি। তবে শেখ মুজিবকে দেখেছি। ব্যক্তিত্ব ও সাহসে এই মানুষটি হিমালয়ের সমান। এভাবে আমি হিমালয় দেখার অভিজ্ঞতাই লাভ করলাম।’ বঙ্গবন্ধু সম্পর্কে যথার্থ মন্তব্যই করেছিলেন ফিদেল কাস্ত্রো; কিন্তু আমাদের দুর্ভাগ্য, আমরা তাঁর এতো কাছে থেকে, ঘনিষ্ঠভাবে মিশেও চিনতে পারলাম না তাঁকে! তাঁর কথায় কী এমন জাদু ছিলো, যে জাদুতে সাড়ে সাত কোটি বাঙালি হৃদয় দুলে উঠলো! নিশ্চিত মৃত্যু জেনেও যুদ্ধে ঝাঁপিয়ে পড়লো! কী মন্ত্র ছিলো তাঁর কথায়, যে কথায় ইন্দিরা গান্ধীর মতো নেতা স্বল্পতম সময়ের মধ্যে ভারতীয় সৈন্যদের দেশে ফিরিয়ে নিয়ে দৃষ্টান্ত স্থাপন করলেন বিশ্বে! আসলেই কি আমরা তাঁকে চিনতে পারিনি? আমাদের লোকবাংলায় একটা প্রবাদ আছে, ‘বিচার মানি, কিন্তু তালগাছ আমার!’ যারা বঙ্গবন্ধুকে হত্যার সাথে জড়িত ছিলো, তাদের ষড়যন্ত্রটা ছিলো গভীর। ইতোমধ্যেই আদালতে অনেক তথ্যই প্রমাণিত হয়ে গেছে। আমি এখানে সংক্ষেপে একটি কথাই বলবো, ওরা লোভে অন্ধ হয়ে ছিলো, উচ্চাভিলাষে ওরা উন্মত্ত হয়ে ছিলো, ঈর্ষায় ওরা দিশাহারা হয়ে ছিলো, ওরা অন্ধতার পায়ে ক্রীতদাস হয়ে ছিলো, ওরা অপরিণামদর্শী এবং কাণ্ডজ্ঞানশূন্য হয়ে ছিলো! তাই পিশাচেরা এমন এক কাণ্ড করলো, যার ফলে প্রশ্নবিদ্ধ হলো বাঙালির সাহস ও সংগ্রাম; প্রশ্নবিদ্ধ হলো ১৯৭১; প্রশ্নবিদ্ধ হলো বাঙালি জাতি! বাঙালির মুক্তিযুদ্ধ প্রশ্নবিদ্ধ হলো! ত্রিশ লাখ মানুষের আত্মত্যাগ- অগণন নদী ভরা বাঙালির রক্ত প্রশ্নবিদ্ধ হলো; দুই লক্ষাধিক মা-বোনের সম্ভ্রম প্রশ্নবিদ্ধ হলো ১৯৭১-এর ১৫ আগস্ট। ১৯৭১-এ পরাজিত দেশি এবং আন্তর্জাতিক শত্রæদের এই তো আকাক্সক্ষা ছিলো। ধিক! ধিক! ঘৃণা ওদের জন্য, যারা প্রমাণ করলো জগৎ শেঠ, মীরজাফর, উমিচাঁদরা আবার জন্মেছে এই বাংলায়, নতুন নামে- নতুন চেহারায়! কখনো কখনো কারো কারো মুখে শুনি বা রচনায় পড়ি- ‘শেখ মুজিব যদি বড় নেতাই হতেন, তাহলে তাঁর মৃত্যুতে দেশের কোত্থাও কোনো প্রতিবাদ হলো না কেন!’ আমি বলি, মূর্খ! প্রতিবাদের ভাষা কাকে বলে, তা-ই তো তোরা জানিস না! প্রতিবাদ মানে মিডিয়ায় কভারেজ নয়। মৌনতার ভাষা তোরা পড়তে শিখিসনি; নৈঃশব্দ্যের হাহাকার কতটা বিদীর্ণ করে বুক, তা তোরা জানিস না; তাই তোরা শুনতে পাসনি ১৯৭৫-এ বঙ্গবন্ধুর মৃত্যুতে ব-দ্বীপ বঙ্গভূমি শোক-বিহ্বল-স্তব্ধ হয়ে পড়ে ছিলো; যে বিহ্বলতার হাহাকার ধ্বনি আজো শোনা যায় মেঠোপথের বাঁকে বাঁকে; শোনা যায় বিনম্র গ্রাম্য নদীর ঘাটে ঘাটে।
আমি তাই ইতিহাস থেকে শিক্ষা গ্রহণ করতে বলি। যখন নিজেকে প্রশ্ন করি-
আমি কি নিজেকে একজন দেশপ্রেমিক হিসেবে পরিচিত করতে চাই?
আমি কি আমার দেশের ইতিহাস-ঐতিহ্য জানতে চাই?
আমি কি আমার দেশের মানুষের আনন্দ-বেদনা, দুঃখ-বঞ্চনার কথা জানতে চাই?
আমি কি নিজেকে একজন সৎ-সাহসী মানুষ হিসেবে দেখতে চাই?
আমি কি নিজেকে একজন সহিষ্ণু পরোপকারী মানুষ হিসেবে গড়ে তুলতে চাই?
তাহলে আমার বঙ্গবন্ধুকে জানতে হবে, তাঁর জীবন থেকে শিক্ষা গ্রহণ করতে হবে। বাঙালির গৌরব-সম্মান, শৌর্য-বীর্যের প্রকৃতি জানতে, ১৯৭১-এর চেতনায় মুক্তি আর প্রগতির চাকাকে গতিশীল রাখতে, নিজেদের শিষ্ট-সংস্কৃত করতে আর সম্প্রীতি-সৌহার্দের সৈনিক হিসেবে প্রতিষ্ঠিত করতে বাঙালির কাছে বঙ্গবন্ধুর জীবনাদর্শের বিকল্প নেই! তাই বলি, আসুন সবাই বঙ্গবন্ধু পাঠে ব্রতী হই; নিজেদের গড়ে তুলি আদর্শ জাতির আদর্শ সন্তান হিসেবে। সমস্বরে উচ্চারণ করি, শচীন সেনগুপ্ত রচিত নবাব সিরাজদৌলা নাটকে সিরাজের শেষ সংলাপ- ‘যদি সত্যি জেনে থাকো তোমাদের সাথে আমার সম্বন্ধ অচ্ছেদ্য; তাহলে এসো ভাইসব, আর একবার চেষ্টা করে দেখি, যে রতœ আমরা হেলায় হারিয়েছি তা আবার বঙ্গজননীর স্বর্ণ কিরিটে পরিয়ে দিতে পারি কী-না!’ বঙ্গবন্ধুকে নিয়ে গদ্য আর কবিতা কম লেখা হয়নি; আরো হবে এবং হতেই থাকবে। যতদিন বাংলা ভাষা ও সাহিত্য থাকবে ততদিন বঙ্গবন্ধু উচ্চারিত হবেন প্রতিদিন। পোস্টারে-ফেস্টুনে-ব্যানারে লেখা হবে, ‘মুজিব আদর্শ অনিঃশেষ/ মুজিব মানেই বাংলাদেশ’। হ্যাঁ বঙ্গবন্ধুকে নিয়ে অনেকেই কবিতা লিখেছেন; মনে পড়ছে জসীম উদ্দীনের ‘বঙ্গবন্ধু’ শিরোনামের কবিতার কথা, বেগম সুফিয়া কামালের কবিতার কথা, কবি শামসুর রাহমানের ‘ধন্য সেই পুরুষ’ কবিতার কথা; মনে পড়ছে সৈয়দ শামসুল হক, দিলওয়ার, কায়সুল হক, বেলাল চৌধুরী, ফয়েজ আহমদ, ওমর আলী, শহীদ কাদরী, সিকদার আমিনুল হক, হুমায়ুন আজাদ, আসাদ চৌধুরী, রফিক আজাদ, নির্মলেন্দু গুণ, মহাদেব সাহা, মোহাম্মদ রফিক, হায়াৎ মামুদ, মুহম্মদ নূরুল হুদা, রুবী রহমান, হাবীবুল্লাহ সিরাজী, শামসুল ইসলাম, অসীম সাহা, কাজী রোজী, আবিদ আজাদ, দাউদ হায়দার, ত্রিদিব দস্তিদার, শিহাব সরকার, ফারুক মাহমুদ, কামাল চৌধুরী, রুদ্র মোহাম্মদ শহীদুল্লাহ, খন্দকার আশরাফ আহমদ, আসলাম সানী, লুৎফর রহমান রিটনসহ অসংখ্য খ্যাতিমান কবি যেমন বঙ্গবন্ধুকে নিয়ে কবিতা লিখেছেন; তেমনি অপেক্ষাকৃত তরুণ মেহেদী ইকবাল, বাবুল আনোয়ার, কামরুজ্জামান, সালমা বেগ বা সুদীপ্ত সাইদের মতো কবিরাও কবিতা লিখেছেন বঙ্গবন্ধুকে নিয়ে। সহস্রের মাঝে মাত্র কয়েকজনের নাম উল্লেখ করা হলো।
আশা করি রচনার শুরুতে উত্থাপিত চার প্রশ্নের উত্তর পেয়ে গেছি আমরা। বলেছিলাম, প্রথম ও দ্বিতীয় প্রশ্নের উত্তর জানা হয়ে গেলে, তৃতীয় এবং চতুর্থ প্রশ্নের উত্তর সহজ হয়ে যাবে। আমরা যখন বঙ্গবন্ধুকে জানবো, বঙ্গবন্ধুর চেতনায় নিজেদের গড়ে তুলবো, তখন আমরা প্রত্যেকেই হবো বঙ্গবন্ধুর প্রতিনিধি; সুতরাং আমরা সবাই মিলে ষড়যন্ত্রকারী শত্রæদের মুখে ছাই দিয়ে এই বাংলাদেশকে সোনার বাংলা হিসেবে গড়ে তুলবো, এবং আমরাই সম্মিলিতভাবে বঙ্গবন্ধুর স্বপ্নকে বাস্তব করবো।

যে প্রত্যয় এবং বিশ্বাস থেকে ১৯৭১ খ্রিস্টাব্দের জুলাই মাসে মুক্তিযুদ্ধ চলাকালে অন্নদাশঙ্কর রায় লিখেছিলেন-

যতদিন রবে পদ্মা যমুনা
গৌরী মেঘনা বহমান
ততদিন রবে কীর্তি তোমার,
শেখ মুজিবুর রহমান!

দিকে দিকে আজ অশ্রæগঙ্গা
রক্তগঙ্গা বহমান
তবু নাই ভয়, হবে হবে জয়,
জয় মুজিবুর রহমান।
(বঙ্গবন্ধু \ শালি ধানের চিঁড়ে \ অন্নদাশঙ্কর রায়)
প্রতিবেশী দেশের বুদ্ধিজীবী হয়ে বঙ্গবন্ধু সম্পর্কে অন্নদাশঙ্কর রায়ের যদি এমন উপলব্ধি হয়ে থাকে, আমরা সমগ্র বাঙালি জাতি বঙ্গবন্ধু জীবন সাধনা এবং ত্যাগের অগণন সুবিধা ভোগী হয়েও কি তাঁর প্রতি শ্রদ্ধাশীল হবো না? আমরা কি অতটাই অকৃতজ্ঞ!

মন্তব্য করুন

খবরের বিষয়বস্তুর সঙ্গে মিল আছে এবং আপত্তিজনক নয়- এমন মন্তব্যই প্রদর্শিত হবে। মন্তব্যগুলো পাঠকের নিজস্ব মতামত, ভোরের কাগজ লাইভ এর দায়ভার নেবে না।

জনপ্রিয়