ব্যারিস্টার নাজমুল হুদার বিরুদ্ধে সাক্ষ্যশুরু

আগের সংবাদ

অর্থ পাচার উৎসাহিত হবে! পাচার হওয়া টাকা অর্থনীতির মূল¯্রােতে আনতে চান অর্থমন্ত্রী > বৈষম্যের শিকার হবেন সৎ করদাতারা : বিশ্লেষকদের অভিমত

পরের সংবাদ

সাবওয়ে ব্যয়বহুল ও সময়সাপেক্ষ

প্রকাশিত: জুন ১১, ২০২২ , ১২:০০ পূর্বাহ্ণ
আপডেট: জুন ১১, ২০২২ , ১২:০০ পূর্বাহ্ণ

দেব দুলাল মিত্র : বুলেট ট্রেন প্রকল্প থেকে সরকার সরে এলেও এখন আবার ‘সাবওয়ের’ মতো আরো একটি মেগা প্রকল্প গ্রহণের সিদ্ধান্ত নেয়া হয়েছে। এই সাবওয়ের অন্য নাম স্বপ্নের ‘পাতাল রেল’। সাবওয়ে নির্মাণের জন্য স্পেনের একটি প্রতিষ্ঠানের মাধ্যমে ‘ঢাকা শহর সাবওয়ে নির্মাণের সম্ভাব্যতা সমীক্ষা’ একেবারেই শেষ পর্যায়ে রয়েছে। ইতোমধ্যেই ৯৫ শতাংশ কাজ শেষ। পুরো সমীক্ষা শেষ হলেই প্রকল্প বাস্তবায়নের কাজ শুরুর সিদ্ধান্ত সরকারের রয়েছে। সাবওয়ে নির্মাণের পরিকল্পনা বাস্তবায়িত হলে ২০৩০ সালে ৪টি রুট চালুর পরিকল্পনা রয়েছে। ২০৫০ সালে ঢাকায় মাটির নিচ দিয়ে বিভিন্ন রুটে রেল চলাচল করবে বলে আশা করা হচ্ছে।
তবে পরিবহন বিশেষজ্ঞরা সাবওয়ে নির্মাণ পরিকল্পনাকে ব্যয়বহুল ও সময়সাপেক্ষ বলে মত দিয়েছেন। তারা বলছেন, নির্ধারিত সময়ের মধ্যে সাবওয়ে প্রকল্পও বাস্তবায়নের সম্ভাবনা কম। নির্মাণের পাশাপাশি রক্ষণাবেক্ষণ খরচ হবে অন্যান্য সব পরিবহন প্রকল্পের খরচের চেয়ে ৩ গুণ বেশি। আলাদাভাবে বিদ্যুতের ব্যবস্থা করতে হবে। এ কারণে যানজট নিরসনের যে আশা করা হচ্ছে তার সুফল সহজেই জনগণ পাবে না। বাস সার্ভিস শৃঙ্খলায় না আনলে সাবওয়ের সুফল আসবে না। স্টেশন পর্যন্ত যেতেও গণপরিবহনের প্রয়োজন হবে। বিদেশি ঋণে এই প্রকল্প নির্মাণ করা সঠিক সিদ্ধান্ত হবে না।
সাবওয়ে কী : খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, ঢাকায় বর্তমানে মেট্রোরেলের যে প্রকল্পের কাজ চলছে, সাবওয়ে ঠিক তার বিপরীত। মেট্রোরেল মাটির উপর দিয়ে নির্মিত লাইনে চলবে। অন্যদিকে সাবওয়ে হচ্ছে মাটির নিচ দিয়ে দ্রুতগতির রেললাইন। বর্তমানে ইউরোপ-আমেরিকাসহ বিশ্বের বিভিন্ন দেশ যোগাযোগ ব্যবস্থা সহজ করতে সাবওয়ে নির্মাণ করেছে। দূরবর্তী স্থানে দ্রুততম সময়ে যোগাযোগ স্থাপন ও যানজটের ভোগান্তি থেকে বাঁচতে সাবওয়ে নির্মাণে বর্তমান সরকার উদ্যোগ নিয়েছে। ইতোমধ্যেই ‘ঢাকা সাবওয়ে নির্মাণের সম্ভাব্যতা জরিপ ৯৫ শতাংশ শেষ হয়েছে।
সড়ক পরিবহন ও সেতুমন্ত্রী ওবায়দুল কাদের বলেছেন, রাজধানীর যানজট নিরসনে সাবওয়ে বড় ধরনের ভূমিকা রাখবে। পর্যায়ক্রমে সাবওয়ের ১১টি রুট চালু হবে। এর মধ্যে প্রথম পর্যায়ে ২০৩০ সালের মধ্যে ৪টি রুটে চলাচলের পথ উদ্বোধন করা হবে।
কীভাবে তৈরি হবে : সেতু বিভাগ সূত্রে জানা গেছে, সাবওয়ের জন্য ভূপৃষ্ঠ থেকে কমপক্ষে ২৫ থেকে ৭০ মিটার নিচে টানেল নির্মাণ করতে হবে। এরপর এই টানেলের ভেতর দিয়েই লাইন তৈরি হবে। চট্টগ্রামে কর্ণফুলী নদীর নিচ দিয়ে নির্মিত বঙ্গবন্ধু টানেলের আদলেই ঢাকার সাবওয়ের টানেল নির্মাণ হবে। সাবওয়ে নির্মাণ হলে রাজধানীর যানজট সমস্যা থাকবে না বলেই সংশ্লিষ্টরা মনে করছেন। তবে এই সাবওয়ে নির্মাণের জন্য বিপুল অর্থের প্রয়োজন হবে। ২০৭০ সালের মধ্যে ঢাকা ঘিরে ১১টি রুটে ২৩৮ কিলোমিটার দৈর্ঘ্যরে সাবওয়ে নির্মাণ পরিকল্পনা সরকারের রয়েছে। এরই অংশ হিসেবে ২০৩০ সালের মধ্যে অগ্রাধিকার ভিত্তিতে ৪টি রুটে ১০৫ কিলোমিটার নির্মাণের পরিকল্পনা রয়েছে। সাবওয়ে নির্মাণে সম্ভাবতা যাচাইয়ে স্পেনের একটি প্রতিষ্ঠানের

মাধ্যমে সমীক্ষা কাজ চলছে। সমীক্ষার কাজ ৯৫ শতাংশ শেষ হয়েছে। বাকি ৫ শতাংশ শেষ হলেই নির্মাণের সম্ভাব্যতা নিয়ে সরকারের নীতিনির্ধারকরা বৈঠকে বসবেন। তারা সাবওয়ে নির্মাণে প্রয়োজনীয় অর্থের নিশ্চয়তা পেলেই প্রকল্প বাস্তবায়নে কাজ শুরু করা হবে। এই প্রকল্পে প্রাথমিকভাবে ৯ লাখ কোটি টাকা ব্যয় ধরা হয়েছে।
বিশেষজ্ঞরা কী বলেন : নগর পরিবহন বিশেষজ্ঞ, ঢাকা ম্যাস ট্রান্সজিট কোম্পানি লিমিটেডের (ডিএমটিসিএল) পরিচালক এবং বুয়েটের অধ্যাপক ড. এম হাদিউজ্জামান বলেন, সাবওয়ে আমরা নির্মাণ করতেই পারি। কিন্তু প্রশ্ন হচ্ছে কেন এটি নির্মাণ করব? সাবওয়ে নির্মাণ হলেই যে রাজধানীর যানজট কমবে- এটা আমি মনে করি না। যেখানে ৮ হাজার কোটি টাকা ব্যয় করে পুরো ঢাকা শহরের ৪০ শতাংশ যাত্রী সিটি বাসের মাধ্যমে পরিবহন করতে পারি, সেখানে আমাদের কেনো সাবওয়ে লাগবে? ‘কৌশলগত পরিবহন পরিকল্পনার (আরএসটিপি)’ দর্শনটা খেয়াল করলে দেখা যাবে পরিবহনের যে উন্নয়ন হবে তা ধাপে ধাপে হবে, একবারে নয়। প্রথমে সিটি বাস সার্ভিস, তারপর বিআরটি, মেট্রোরেল এবং সর্বশেষে সাবওয়ে হবে। কিন্তু সিটি বাস সার্ভিসকে এখনো শৃঙ্খলায় না এনে ভারি কিছু চাপানোর চেষ্টা করা ভুল হবে। যেখানে ভিত্তিটা দুর্বল সেখানে ভারী কিছু কাজ করা সুফল আনবে না। যে সময়ে সাবওয়ের চালুর কথা বলা হচ্ছে, ওই সময় ঢাকায় মানুষ ও যানবাহনের সংখ্যাও বাড়বে। তখনো সিটিবাস সার্ভিসের চাহিদা থেকেই যাবে। সাবওয়ের স্টেশন পর্যন্ত পৌঁছতেও সিটি বাসের প্রয়োজন হবে। সিটি সার্ভিস উন্নত না করে সাবওয়ের সফলতা আসবে না।
ড. হাদিউজ্জামান আরো বলেন, সাবওয়ে নির্মাণের সক্ষমতা যদি আমাদের থেকেও থাকে তাহলেও এই প্রকল্প পাবলিক-প্রাইভেট পার্টনারশিপের (পিপিপি) আওতায় নির্মাণ করা যেতে পারে। অথবা জিওবি ফান্ডের আওতায় করা যেতে পারে। সাবওয়ের মতো এত বড় প্রকল্প বিদেশি ঋণ নিয়ে নির্মাণ করার কোনো প্রয়োজন নেই।
সম্প্রতি ইনস্টিটিউট ফর প্ল্যানিং এন্ড ডেভেলপমেন্ট (আইপিডি) নামে একটি সংগঠনের উদ্যোগে আলোচনায় সাবওয়ে নির্মাণের বিষয়েও বক্তারা ‘ঢাকাসহ বাংলাদেশের অর্থনৈতিক ও পরিকল্পনাগত বিশ্লেষণে অপরিণামদর্শী’ বলে মন্তব্য করেছেন। তারা বলেছেন, ঢাকার আশপাশের অন্যান্য অঞ্চলের ভূতাত্ত্বিক বৈশিষ্ট্য সাবওয়ে নির্মাণের জন্য যথাযথ নয়। ঢাকার ভেতরের চেয়ে আশপাশে সাবওয়ের নেটওয়ার্ক গড়ে তুলতে তুলনামূলক অনেক বেশি ব্যয় হবে। সাবওয়ে প্রকল্পের সঙ্গে সংশ্লিষ্ট অনেক বিদেশি পরামর্শকদের বাংলাদেশ ও ঢাকা মহানগরের পরিকল্পনা ও উন্নয়ন বাস্তবতা সম্পর্কে সুস্পষ্ট ধারণার অভাব রয়েছে।
আইপিডির নির্বাহী পরিচালক এবং জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের নগর ও অঞ্চল পরিকল্পনা বিভাগের অধ্যাপক ড. আদিল মুহাম্মদ খান বলেছেন, ঢাকার কয়েকটি রুটে সাবওয়ে নির্মাণে সরকারের প্রস্তাবনায় অর্থনৈতিক ও পরিকল্পনাগত দিক নিয়ে বিশদ বিশ্লেষণ এবং অংশীজন আলোচনা সেভাবে করা হয়নি। এর বাইরে গিয়ে ঢাকা শহরের কেন্দ্রীয় এলাকা ও আঞ্চলিক এলাকাগুলোর সঙ্গে যোগাযোগ পরিকল্পনার অংশ হিসেবে বিস্তৃত সাবওয়ে নেটওয়ার্ক গড়ে তোলার যে প্রকল্প সরকার নিতে যাচ্ছে, তা ঢাকাসহ বাংলাদেশের অর্থনৈতিক ও পরিকল্পনাগত বিশ্লেষণে অপরিণামদর্শী।
বাংলাদেশ ইনস্টিটিউট অব প্ল্যানার্সের (বিআইপি) সাধারণ সম্পাদক পরিকল্পনাবিদ শেখ মুহাম্মদ মেহেদী আহসান বলেন, দেশের উন্নয়ন বাজেটের তুলনায় সাবওয়ে প্রকল্প খুবই ব্যয় বহুল। এ প্রকল্প ভবিষ্যতে দেশের জন্য বোঝা হয়ে দাঁড়াতে পারে। ঢাকার পরিবহন পরিকল্পনা ও নগর পরিকল্পনার মূল দলিলে পাতাল রেলের প্রস্তাবনা ছিল না।
সমীক্ষায় লেগেছে ৩২১ কোটি : সাবওয়ে নিয়ে স্বপ্ন দেখতেই অর্থাৎ সম্ভাব্যতা যাচাইয়েই খরচ হচ্ছে ৩২১ কোটি টাকা। চলতি বছরের জুনে সম্ভাব্যতা যাচাই ও প্রাথমিক নকশার কাজ শেষ হওয়ার কথা রয়েছে। এর মধ্যে ৩১৭ কোটি টাকা খরচ হচ্ছে পরামর্শক খাতে। তবে এখনো নির্মাণে অর্থের সংস্থান না হলেও সাবওয়ে নির্মাণে ৯ লাখ কোটি টাকা ব্যয় হতে পারে বলে প্রাথমিকভাবে ধারণা করা হচ্ছে। এই বিপুল অর্থের সংস্থান কীভাবে হবে তা নিয়ে ভাবছেন সরকারের সংশ্লিষ্টরা।
এর আগে ঢাকা-চট্টগ্রাম রুটে বুলেট ট্রেন চালুর স্বপ্ন দেখেছিল সরকার। সেই স্বপ্ন বাস্তবে রূপ নেবে কিনা তা পরীক্ষা করতে রেলওয়ে একটি সম্ভাব্যতা যাচাই বা সমীক্ষা প্রকল্প হাতে নেয়। এই প্রকল্পের সম্ভাব্যতা যাচাইয়ে প্রায় ১০০ কোটি টাকা খরচ হয়েছে। এরপর সরকারের পক্ষ থেকে ঘোষণা দেয়া হয়, ‘বাংলাদেশ এই মুহূর্তে বুলেট ট্রেন চলাচলের জন্য উপযুক্ত নয়। তাই এই প্রকল্প আপাতত বাতিল করা হলো।’ অথচ সরকারের এই বুলেট ট্রেনের স্বপ্ন দেখতে ১০০ কোটি টাকা খরচ হয়েছে। এখন সাবওয়ে নির্মাণের স্বপ্ন বাস্তবে কতটা রূপ নেবে তা বোঝা যাবে সম্ভাব্যতা যাচাইয়ের পর।
প্রথমে ৪টি রুট চালু হবে : সংশ্লিষ্ট মন্ত্রণালয় সূত্রে জানা গেছে, প্রথমে সাবওয়ের অগ্রাধিকারভিত্তিক ৪টি রুটের নির্মাণ কাজ শেষ করা হবে। এই রুটগুলো হলো- ৩৪ দশমিক ৯২ কিলোমিটার দীর্ঘ কেরানীগঞ্জের ঝিলমিল প্রকল্প থেকে টঙ্গী রেলস্টেশন রুট। এই রুটে ২৪টি স্টেশন থাকবে। দ্বিতীয় রুটটি হলো- ১৪টি স্টেশন বিশিষ্ট ২২ দশমিক ৮৯ কিলোমিটার দীর্ঘ গাবতলী থেকে বেলাবো ইউনিয়ন রুট। তৃতীয় রুটটি হলো- ২৫ দশমিক ২২ কিলোমিটার দীর্ঘ ১৫টি স্টেশন বিশিষ্ট কেরানীগঞ্জ থেকে সোনাপুর ইউনিয়ন রুট এবং চতুর্থ রুটটি হলো- ৪৫ দশমিক ১১ কিলোমিটার দীর্ঘ এবং ৩২টি স্টেশন বিশিষ্ট জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়-নারায়ণগঞ্জ রুট। প্রতিটি রুটেই প্রতি কিলোমিটারের সম্ভাব্য নির্মাণ ব্যয় গড়ে প্রায় দুই হাজার ২৫০ কোটি টাকা। এই ৪টি রুট নির্মাণে ব্যয় হবে দেশের চলতি অর্থবছরের মোট বাজেটের অর্ধেকের বেশি।
সম্ভাবনা ও সফলতা কতটুকু : সরকারের সংশ্লিষ্টদের ধারণা, সাবওয়ে নির্মাণ শেষ হলে ঢাকার প্রায় ৪০ লাখ মানুষ মাটির নিচ দিয়ে যাতায়াত করতে পারবে। এরফলে ওপরের মূল সড়কে যানবাহনের চাপ কমবে। কোথাও কোনো যানজটের সৃষ্টি হবে না। সড়ক যোগাযোগ ও সেতুমন্ত্রী ওবায়দুল কাদের জানিয়েছেন, ঢাকা শহরের যানজট নিরসনে শিগগিরই সাবওয়ে নির্মাণ হচ্ছে। ৯৫ শতাংশ সমীক্ষা শেষ। সমীক্ষা শেষ হলে অর্থায়ন নিশ্চিত সাপেক্ষে সাবওয়ে নির্মাণ প্রকল্প বাস্তবায়নের কাজ খুব তাড়াতাড়ি শুরু হবে। ‘ঢাকা শহরে সাবওয়ে নির্মাণের সম্ভাব্যতা সমীক্ষা’ শীর্ষক প্রকল্পের খসড়া চূড়ান্ত প্রতিবেদন নিয়ে ইতোমধ্যেই মতামত গ্রহণ শুরু হয়েছে। ঢাকা উত্তর ও দক্ষিণ সিটি করপোরেশনের মেয়রদের মতামতও চাওয়া হয়েছে।

মন্তব্য করুন

খবরের বিষয়বস্তুর সঙ্গে মিল আছে এবং আপত্তিজনক নয়- এমন মন্তব্যই প্রদর্শিত হবে। মন্তব্যগুলো পাঠকের নিজস্ব মতামত, ভোরের কাগজ লাইভ এর দায়ভার নেবে না।

জনপ্রিয়