করোনার প্রাদুর্ভাব নিয়ন্ত্রণে বেইজিংয়ে ফের স্কুল বন্ধ

আগের সংবাদ

রাজধানীর আইনশৃঙ্খলা রক্ষায় ১৯ দফা নির্দেশনা : ঝুঁকি মোকাবিলায় নজরদারিতে চাকরিচ্যুত পুলিশরা

পরের সংবাদ

পাপ

প্রকাশিত: মে ৬, ২০২২ , ১২:০০ পূর্বাহ্ণ
আপডেট: মে ৬, ২০২২ , ১২:০০ পূর্বাহ্ণ

লজ্জায়, রাগে, দুঃখে, অপমানে, ক্ষোভে মরে যেতে মন চাইছে সামিনার।
সারা শরীরে কেউ যেন কেরোসিন দিয়ে আগুন ধরিয়ে দিয়েছে। দাউ দাউ করে জ্বলছে সারা শরীর। পুড়ে পুড়ে অঙ্গার হয়ে যাচ্ছে। কিন্তু নিজেকে সেই আগুন থেকে রক্ষা করতে পারছে না। তার হাত, পা সবই যেন শক্তভাবে বাঁধা। সেই ভয়াবহ আগুন থেকে রক্ষা পেতে কিছু করতে পারছে না সে। মুখটাও কেউ যেন ট্যাপ দিয়ে বন্ধ করে দিয়েছে। আত্মরক্ষার্থে গলা ফাটিয়ে চিৎকার, আর্তনাদ করতে চেয়েও ব্যর্থ হচ্ছে।
নিজের দোষে এতো বড় শাস্তি পেতে হবে তাকে, ভাবেনি সে। আজকের এই পরিণতির জন্য সামিনা নিজেই অনেকটাই দায়ী। নিজের অসহায়ত্বের কথা, দুঃখ, বেদনা, কষ্টের যন্ত্রণা মুখ ফুটে প্রকাশ করতে পারছে না সে। শুধুই ছটফট করে মরছে সে।
জীবনে এমন এক ভয়ংকর বিপদের মধ্যে পড়ে যাবে দুঃস্বপ্নেও ভাবেনি সে আগে।
ছিমছাম সুন্দর গোছানো সংসার ছিল তার। স্বামী এবং একমাত্র মেয়ে দোলাকে নিয়ে সুখে-দুঃখে, আনন্দ-বেদনায় মোটামুটি কেটে যাচ্ছিলো। টুকটাক সাংসারিক বিড়ম্বনা, ঝামেলা, দুঃশ্চিন্তা থাকলেও সেগুলোকে নিয়ে চলতে তেমন কোনো সমস্যা ছিল না। এ রকম সব সংসারেই থাকে। অস্বাভাবিক কোনো ব্যাপার নয় এসব। অথচ এ মুহূর্তে মনে হচ্ছে, পৃথিবীতে তার মতো বিপদগ্রস্ত আর কেউ নেই। এ বিপদ থেকে উদ্ধারের কোনো পথ খোলা নেই তার কাছে। সামিনা নিজেই তার এই বিপদ ডেকে এনেছে। ভয়ানক পাপ করেছে সে। আর সেই পাপের প্রায়শ্চিত্ত তাকে করতে হবে। কিন্তু কীভাবে? জানে না সে।
কোন কুক্ষণে যে জায়েদের সঙ্গে তিন বছর আগে তার দেখা হয়েছিল। তারপর আলাপ এবং পরিচয়।
যশোর থেকে বাসে ঢাকায় ফিরছিল সামিনা। গ্রামের বাড়িতে জায়গা-সম্পত্তি নিয়ে সমস্যা হয়েছিল। নিজের বাপের বাড়ির ঝামেলা। ভাইবোনদের সঙ্গে সম্পত্তি ভাগ-বাটোয়ারা নিয়ে গণ্ডগোল। আরিফ তার সঙ্গে যেতে পারবে না। অফিসে যখন-তখন ছুটি ম্যানেজ করা সম্ভব নয়, স্পষ্ট বলে দিয়েছিল। আর বউয়ের বাপের বাড়ির ঝামেলায় সে নাক গলাতে চায় না কোনো সময়েই।
অগত্যা মেয়ে দোলাকে নিয়ে যশোর যেতে হয়েছিল সামিনাকে। বাসে ঢাকায় ফেরার সময় পাশের সিটে বসা জায়েদ নিজেই উৎসাহী হয়ে তার সঙ্গে কথা বলে পরিচিত হয়েছিল। সুদর্শন যুবকটিকে দেখে, কথা বলে নম্র-ভদ্র, ভালো মানুষই মনে হয়েছিল।
সাধারণ আটপৌরে গৃহবধূ হলেও সামিনা গম্ভীর হয়ে থাকা মহিলা নয় মোটেও। তাকে বেশ মিশুক, আন্তরিক বলা যায়। কারো সঙ্গে আগ বাড়িয়ে কথা না বললেও কেউ যদি তার কাছে এগিয়ে এসে কথা বলে তাহলে আলাপ জমাতে বেশি সময় লাগে না তার। সে নারীই হোক কিংবা পুরুষ। জায়েদ একটা সরকারি অফিসে চাকরি করে। পোস্টিং চট্টগ্রামে। অফিসের কাজে যশোর যেতে হয় তাকে মাঝে মাঝে। জায়েদ তখন নিজের পরিচয় দিতে গিয়ে এসব বলেছিল।
অবিশ্বাস করার মতো কিছুই ছিল না ছেলেটির মধ্যে। সরল বিশ্বাসে তার সব কথা সত্যি বলে ধরে নিয়েছিল সামিনা।
কথায় কথায় সামিনা বলেছিল, সে জামায়-শাড়িতে কারুকাজ, কারচুপি, সেলাইয়ের কাজ ভালো জানে। বিভিন্ন বুটিক দোকান, টেইলারিং শপ, ফ্যাশন হাউসের ফরমায়েশ মতো নিজে কাজ করে, অন্যান্য মেয়েদের দিয়ে কাজ করায়। তার অনেক দিনের ইচ্ছে নিজের আলাদা একটি ব্যবসা দাঁড় করানোর। কিন্তু যথেষ্ট পরিমাণ পুঁজি না থাকায় পারছে না। এজন্য ভালো একজন পার্টনার পেলে কাজটা সে এগিয়ে নিয়ে যেতে পারতো। ঢাকা শহরে সাধারণ চাকরিজীবী স্বামীর উপার্জনে সংসার চালানো, মেয়ের কলেজে পড়াশোনার খরচ বহন করা বেশ কঠিন। যে কারণে, নিজে কিছু একটা করার চেষ্টা করে যাচ্ছে মোটামুটিভাবে। আলাদাভাবে নিজের একটা ব্যবসা শুরু করতে পারলে বেশ ভালো করতে পারতো- তেমন আত্মবিশ্বাস রয়েছে সামিনার।
তার কথার পিঠে জায়েদ বলেছিল, চাকরিতে ভালো লাগছে না। একা একা চট্টগ্রাম শহরে পড়ে থাকতে মন চাইছে না। তার ইচ্ছে, চাকরি-বাকরি বাদ দিয়ে ঢাকায় এসে ব্যবসা-বাণিজ্যের ধান্ধা করার।
প্রায় দুই মাস পর হঠাৎ অপরিচিত নম্বর থেকে মোবাইলে ফোন পেয়ে প্রথমে ধরেনি সামিনা। অচেনা, অজানা নম্বর থেকে আসা ফোন সাধারণত সে ধরে না। পাছে আবার কোন বিপদে পড়ে যায় সে। উটকো ঝামেলায় জড়িয়ে অশান্তি সৃষ্টি হয়- তেমন আশঙ্কা থেকে অপরিচিত নম্বর থেকে আসা ফোন সাধারণত সে ধরতে চায় না।
কিন্তু পর পর বেশ কয়েকদিন ধরে একই নম্বর থেকে আসা ফোনটি তাকে কৌতূহলী করে। হয়তো চেনাজানা কেউ হতে পারে, তার নম্বরটি সেভ করা হয়নি। জরুরি কোনো প্রয়োজনে কথা বলতে চাইছে তার সঙ্গে। তেমন ভাবনা থেকে এক সময় সামিনা ফোন রিসিভ করে ‘হ্যালো’ বলতেই ও-প্রান্ত থেকে পুরুষকণ্ঠটি বলে ওঠে, ‘আপা, এতোদিন পর তাও আমার ফোন রিসিভ করলেন, অনেক ধন্যবাদ আপনাকে। আমি তো ভেবেছিলাম- আর বোধহয় আপনার সঙ্গে কথা হবে না, দেখাও হবে না।’
‘আপনি কে বলছেন? ও-প্রান্তের গলাটা তেমন পরিচিত না হলেও মানুষটা কথা বলছে অনেক চেনাজানা কারো মতো করে। কে হতে পারে সে- দ্রুত ভাবতে থাকে সে। কিন্তু ঠিক স্থির করতে পারে না তার পরিচয়।’
‘আমি জায়েদ, জায়েদুল হক। সেই যে যশোর থেকে কয়েক মাস আগে বাসে ঢাকায় ফেরার সময় আপনার সঙ্গে আলাপ হয়েছিল। মনে পড়ছে আমার কথা? চিনতে পারছেন আমাকে? আপা, আপনারা সবাই কেমন আছেন?
এবার সত্যি সত্যি লজ্জা পেয়ে যায় সামিনা। অহেতুক সন্দেহ, সংশয় শঙ্কা থেকে মানুষটির গত কয়েকদিন ধরে করা ফোন কল রিসিভ করেনি সে। ইস, জায়েদ কী মনে করে বসে আছে, কে জানে।
যশোর থেকে ঢাকায় পৌঁছে বাস থেকে গাবতলীতে নামার পর নিজে তৎপর হয়ে তাদের সিএনজিতে তুলে দিয়েছিল। তখন সে-ই সামিনার মোবাইল নম্বর নিয়েছিল বিশেষ আগ্রহ দেখিয়ে। ঢাকায় এলে আগামীতে কথা বলা যাবে- তেমন সুযোগ হলে তার সঙ্গে মিলে ব্যবসা-বাণিজ্যের চেষ্টা শুরু করা যাবে, তেমন চিন্তা-ভাবনা থেকে, জায়েদ অন্তরঙ্গ হয়ে সহজ-সরলভাবে সামিনার মোবাইল নম্বরটি চেয়েছিল।
দীর্ঘ কয়েক ঘণ্টার আলাপচারিতায় সহযাত্রী জায়েদকে ভালোই মনে হয়েছিল তার। সন্দেহজনক, খারাপ কিছু ভাববার মতো কিছু ছিল না। সামিনাও সরল বিশ্বাসে তার মোবাইল নম্বরটি অবলীলায় দিয়েছিল জায়েদকে। এর পর তার কথা প্রায় ভুলেই গিয়েছিল সে।
ওহ, ভাই আপনি! আমি বেশ দুঃখিত। অপরিচিত নম্বর দেখে ধরছিলাম না। আপনার নম্বর তো আমি জানি না। সেদিন আমারটা দিয়েছিলাম, আপনার নম্বরটা নেয়া হয়নি তখন তাড়াহুড়োর কারণে। আপনার নম্বর সেভ করা থাকলে এ অবস্থা হতো না।’
‘নাহ্, ঠিক আছে। এটাই স্বাভাবিক। অপরিচিত নম্বর থেকে আসা ফোন না ধরাটাই উচিত। আজকাল কত কী সমস্যা হয়। সামিনা আপা, আপনারা ভালো আছেন? বাসার সবাই ভালো তো?’
‘হ্যাঁ, আমরা ভালো আছি। আপনি কেমন আছেন? এখনো কি চট্টগ্রামে আছেন? ঢাকায় আসা হয় না বুঝি?’
‘আমি তো এখন ঢাকায়। চাকরি ছেড়ে চলে এসেছি একেবারে। এখানেই বিজনেস-টিজনেস কিছু করবো, ভাবছি।’
‘আচ্ছা, তাহলে ভালোই হলো। ঢাকায় ব্যবসা-বাণিজ্য, চাকরি-বাকরির ম্যালা সুযোগ আছে অন্যান্য জায়গার তুলনায়, একটু চেষ্টা করলে এখানে অনেক কিছু করার সুযোগ আছে’, সামিনা বলে।
‘আপা, সেজন্যই তো আপনাকে খুঁজছি। আপনি যদি কিছু একটা পথ দেখাতেন-’
জায়েদের তেমন কথায় বেশ লজ্জা পেয়ে যায় সামিনা।
‘ওমা কী যে বলেন। আমি আপনাকে পথ দেখাবো কীভাবে? আমি একজন সাধারণ মেয়ে মানুষ। ঘরের বউ। বাইরের ব্যবসা-বাণিজ্যের পথ দেখাবো কীভাবে? আমি কি কিছু জানি? না বুঝি?’ লাজুক কণ্ঠে বলে সে।
আপনার না কি বুটিক শপে শাড়ি-জামা কাপড়ের কারুকাজ, কারচুপির কাজ করে সাপ্লাইয়ের কাজ রয়েছে। নিজে আলাদাভাবে বিজনেস স্টার্ট করার চিন্তা-ভাবনা করছেন, এজন্য পার্টনারের সন্ধান করছেন, বলেছিলেন সেদিন। আমি চিন্তা করেছি ঢাকায় প্রথমে আপনার সঙ্গে মিলে কাজ শুরু করি। তারপর দেখা যাক, কতদূর কী করা যায়।
জায়েদের প্রস্তাব শুনে শুরুতে চমকে উঠলেও পরে বেশ খুশি অনুভব করে সামিনা।
অনেকদিন ধরে নিজের ছোটখাটো ব্যবসার আকার বড় করার স্বপ্ন দেখে আসছে সে। শাড়ি, জামায় কারচুপি আর কারুকাজ করে সাপ্লাইয়ের ব্যবসাটা আরো বড় করার কথা ভাবলেও পুঁজির অভাবে তা সম্ভব হচ্ছে না। চেনা-জানা, পরিচিত, আত্মীয়স্বজনদের মধ্যে কয়েকজনকে বলেছেও সে। তার সঙ্গে ব্যবসার পার্টনার হওয়ার প্রস্তাবও দিয়েছে। শুরুতে কেউ কেউ আগ্রহ দেখালেও শেষ পর্যন্ত নানা কারণ দেখিয়ে পিছিয়ে গেছে তারা। যে কারণে এক ধরনের হতাশা ভেতরে ভেতরে তাকে কুরে কুরে খাচ্ছে বেশ কিছুদিন থেকে।
সেদিন যশোর থেকে ঢাকা ফেরার সময় কথায় কথায় সহযাত্রী জায়েদের সঙ্গে এ বিষয়ে আলাপ করেছিল সে। যার প্রেক্ষিতে জায়েদ তার সঙ্গে ব্যবসায় পার্টনার হতে চাইছে। মানুষটিকে সে ভালোভাবে চেনে না। একদিন বাসে মাত্র কয়েক ঘণ্টার আলাপ। তার সম্পর্কে বেশি কিছু জানে না সে। তার আর্থিক সামর্থ্য কেমন, কতোটা পুঁজি খাটাতে আগ্রহী হবে সে ইত্যাদি না জেনেই নিজের আবেগ দমন করতে না পেরে উচ্ছ¡সিত হয়ে বলে, সত্যি বলছেন? আমার ব্যবসায় পার্টনার হবেন আপনি? তাহলে তো খুব ভালো হয়। আমি তো এতোদিন একজন পার্টনারের অভাবে ব্যবসাটা শুরু করতে পারছিলাম না। তেমন একজনের খোঁজ করছিলাম আমি বেশ কিছুদিন ধরে।
এরপর সামিনার ব্যবসায় কয়েক লাখ টাকা পুঁজি দিয়ে যৌথভাবে ব্যবসাটা শুরু করেছিল জায়েদ। বিভিন্ন ফ্যাশন হাউস, বুটিক শপের অর্ডার এনে তাদের ফরমায়েশ অনুযায়ী কাজ করে যথাসময়ে সাপ্লাই দেয়ার কাজটি কঠিন হলেও এ লাইনে কাজ করার পূর্ব অভিজ্ঞতা থাকায় সামিনা অল্প সময়ে বেশ এগিয়ে যায়। ব্যবসায় বেশ ভালো অঙ্কের টাকা মুনাফাও হাতে থাকে।
একসঙ্গে ব্যবসা চালাতে গিয়ে সামিনা এবং তার পরিবারের অন্য সবার সঙ্গে বেশ অন্তরঙ্গ হয়ে যায় জায়েদ। এ বাসায় নিয়মিত যাতায়াত চলতে থাকে তার। শুরুতে দূরে একটি মেসে থাকলেও এক পর্যায়ে ব্যবসার কাজে যোগাযোগের সুবিধার জন্য সামিনাদের বাসার কাছাকাছি একই এলাকায় দুই রুমের ফ্ল্যাট ভাড়া নেয় জায়েদ। সে একলা মানুষ, থাকার জন্য দুই রুমের বাসা প্রয়োজন না থাকলেও ব্যবসার কাপড়-চোপড় ও অন্যান্য সামগ্রী রাখা এবং বিভিন্ন সময়ে বেশি কাজের অর্ডার পেলে বাড়তি লোকজন দিয়ে দ্রুত তা সারার জন্য দুটি রুমই কাজে লাগানো যাবে- তেমন চিন্তা-ভাবনা করেই তিন তলায় দুই রুমের একটি ফ্ল্যাট ভাড়া নেয় সে।
ব্যবসার কাজের জন্য সামিনাকে প্রায় দিনই অনেকটা সময় জায়েদের ভাড়া করা ফ্ল্যাটে কাটাতে হয়। কারিগর, মেয়ে শ্রমিক-কর্মীদের পাশে থেকে ঠিকঠাক মতো কাজ বুঝিয়ে না দিলে অনেক সময় উল্টোপাল্টা করে ফেলে তারা। যে কারণে তাদের সঙ্গে পাশে থেকে দেখিয়ে দিতে হয় কাজ। ব্যাপারটাকে সহজ স্বাভাবিকভাবে নিয়েছে সামিনার স্বামী আরিফ এবং মেয়ে দোলা। কারণ, তাদের বাসায় নিয়মিত আসা-যাওয়া করতে করতে ততদিনে এ পরিবারের একজন হয়ে উঠেছে জায়েদ। তাকে খুব কাছের একজন মানুষ ভাবতে এবং তাকে বিশ্বাস করতে শুরু করেছে তারা তিনজনই। সামিনাকে এর আগেও এ কাজে বিভিন্ন কারিগর, মেয়ে শ্রমিকের বাসায়, ছোট ছোট কারখানায় ছোটাছুটি করতে হয়েছে অনেক। এটা নতুন কোনো ব্যাপার নয় তার জন্য।
জায়েদের ফ্ল্যাটে সামিনার যাওয়া-আসা কিংবা সামিনাদের বাসায় জায়েদের যাতায়াতের ব্যাপারটি নিয়ে এমনিতে কেউ অন্য কিছু না ভাবলেও একদিন হঠাৎ অপ্রত্যাশিত একটি ঘটনা ঘটে যায়।
একসঙ্গে বেশ কয়েকটি ফ্যাশন হাউস আর বুটিক শপের অনেক কাজের ফরমায়েশ আসায় জায়েদের ফ্ল্যাটে কয়েকজন কারিগর এবং মেয়ে শ্রমিক এনে পরপর কয়েকদিন একটানা কাজ চলছিল। স্বাভাবিকভাবে তখন সামিনাকে সেখানে অনেকটা সময় দেয়া লাগছিল। জায়েদ সারাদিন বিভিন্ন বুটিক শপ আর ফ্যাশন হাউস ঘুরে পাওনা টাকা কালেকশনসহ নতুন কাজের অর্ডার আনতে বাসার বাইরে ব্যস্ত থাকলেও সামিনা সেখানে থেকে সব কাজ সামলে নিচ্ছিল।
হঠাৎ একদিন বিকালে ঝড়-বৃষ্টি শুরু হওয়ায় কাজ কিছুটা বাকি থাকতেই কর্মরত কারিগর আর মেয়ে শ্রমিকগুলো যে যার মতো বাড়িঘরে চলে গিয়েছিল। সামিনা তার নিজের বাসায় ফেরার প্রস্তুতি নিলেও জায়েদ না ফেরার কারণে বেরোতে পারছিল না। দামি কাপড়-চোপড় এবং অন্যান্য জিনিসপত্র রয়েছে বাসায়। শুধুমাত্র দরজায় তালা দিয়ে রেখে যাওয়াটা মোটেও নিরাপদ নয়। ঘরে কেউ না থাকলে চুরির সম্ভাবনা রয়েছে। বাইরে ঝড়-বৃষ্টির কারণে নিজের বাসায় ফেরাটাও অনিরাপদ হয়ে গেছে। ঘরের মধ্যে বসে অস্থির হয়ে ভাবছিল, কী করা যায়। যদিও সামিনা তার মেয়ে দোলাকে মোবাইলে ফোন করে বলেছে, হঠাৎ ঝড়-বাদলে আটকে গেছে সে। ঝড়-বৃষ্টি কমলেই রাস্তায় বেরোবে।
সন্ধ্যা গড়িয়ে রাত নেমে গেছে ততক্ষণে। একসময়ে ঝড়-বৃষ্টি মাথায় নিয়ে বাসায় ফিরে জায়েদ।
তখনো সামিনা বাসায় বসে অপেক্ষা করছিল তার ফিরে আসার জন্য।
তাকে দেখে আক্ষেপ করে সে। ‘আরে আপা, আপনি কেন একা একা বসে পাহারা দিচ্ছেন। আপনি দরজায় তালা লাগিয়ে চলে যেতে পারতেন। আমার কাছেও তো দরজার চাবি ছিল। বাসায় ঢুকতে সমস্যা হতো না।’
‘ঘরে অর্ডারের দামি জামা-কাপড়, পুঁতি এবং অন্যান্য জিনিসপত্র রয়েছে। ঢাকা শহরে ফ্ল্যাটে ফ্ল্যাটে চোরের উপদ্রব সব সময় লেগেই আছে। কখন কী ঘটে যায়, বলা তো যায় না। আমাদের ছোটখাটো ব্যবসা। যদি কিছু ক্ষতি হয়ে যায়, সামাল দিতে পারবো না। আমি এবং আপনি দুজনই শেষ হয়ে যাবো। তাই সাবধান থাকা ভালো। আমার বা আপনার কষ্ট হলেও এই সাবধানতা অবলম্বন করতেই হবে।’ সামিনা বলে।
ঝড়-বৃষ্টি কমে আসতেই নিজের বাসায় ফেরার জন্য প্রস্তুতি নেয় সামিনা। কাছেই তার বাসা। কয়েকটি গলি পেরোলেই হেঁটে যাওয়া যায়।
জায়েদের ফ্ল্যাট থেকে বেরোতে দরজার দিকে এগিয়ে যেতেই তার মাথাটা হঠাৎ চক্কর দিয়ে ওঠে। দুচোখে কেমন ঝাপসা হয়ে আসতে চায়। সারা শরীর ঝিমঝিম করতে থাকে। সে দাঁড়িয়ে থাকতে পারে না। কোনোভাবে নিজেকে সামলে ঘরের মধ্যে ফিরে বিছানায় বসে পড়ে।
গত কিছুদিন থেকে হঠাৎ হঠাৎ শরীরটা এমন খারাপ লাগছে। আজকাল নিজের ব্যবসা শুরুর পর থেকে কাজের চাপ আগের চেয়ে অনেক গুণ বেড়ে গেছে। পরিশ্রম করতে হচ্ছে অনেক বেশি। শরীরের ওপর ধকল যাচ্ছে ভীষণ। বয়সও তো বাড়ছে। চল্লিশের কাছাকাছি পৌঁছে গেছে সে। আগের মতো পরিশ্রম করার মতো শক্তি পায় না যেন সে ভেতর থেকে। এতো তাড়াতাড়ি বুড়িয়ে যেতে শুরু করেছে সে… ভাবতেই মনটা দুর্বল হয়ে আসতে চায়। সামিনা চায় সব বাধা পেরিয়ে এগিয়ে যেতে। নিজের শক্তি-সামর্থ্যকে কাজে লাগিয়ে সংসারটাকে সচ্ছল এবং সমৃদ্ধ রাখতে।
সামিনার প্রস্তুতি নিয়ে বাসায় রওনা দেয়া আবার পরক্ষণেই ফিরে আবার বিছানায় বসে পড়া এবং তার চোখ-মুখের ফ্যাকাশে মøান ভাব দেখে জায়েদ কিছুটা বিচলিত হয়ে পড়ে।
‘কী ব্যাপার, আপনার শরীর খারাপ লাগছে?’ জানতে চায় সে।
‘হুম, হঠাৎ মাথাটা চক্কর দিচ্ছে। দাঁড়াতে পারছি না। প্রেসারটা কমেছে মনে হয়। লো প্রেসারের কারণে শরীরটা বেশ দুর্বল লাগছে। কিছুক্ষণ বসি আমি। তারপর ঠিক হয়ে যাবে।’
নিজের সম্পর্কে বলে সামিনা। এরপর সে শরীরটা এলিয়ে দিয়ে শুয়ে পড়ে বিছানায়। ভীষণ ক্লান্ত লাগছে কেন জানি। ঘুম পাচ্ছে ভীষণ। নিজের অজান্তেই কখন যে বিছানায় ঘুমে তলিয়ে যায় টেরই পায় না।
দুর্বল আচ্ছন্ন ভাবটা কাটিয়ে হঠাৎ জেগে উঠতেই ভীষণভাবে চমকে উঠে সামিনা।
তার নিজের শরীরের ওপর কেমন চাপ অনুভব করে। একটু ধাতস্থ হতেই সামিনা তার শরীরে ঘনিষ্ঠভাবে চেপে থাকা জায়েদকে আবিষ্কার করে। ভীষণ উত্তেজনায় যেন টগবগ করছে সে। তার ঘন ঘন গরম নিশ্বাসের আঁচ অনুভব করে সামিনা। তেমন পরিস্থিতির জন্য কোনোভাবেই প্রস্তুত ছিল না সে।
হঠাৎ তাকে একা পেয়ে দুর্বল মুহূর্তের সুযোগ নেবে মানুষটা, ভাবেনি কোনো সময়ে।
গত বেশ কিছুদিনের যাওয়া-আসায় চেনাজানা ঘনিষ্ঠতায় সামিনা জায়েদকে অনেক বিশ্বাস করেছিল। তাকে বিশ্বাস করে একসঙ্গে পার্টনারশিপে ব্যবসা শুরু করেছে। এর মধ্যে কোনোদিন তার মাথায় আসেনি মানুষটা তেমন কাণ্ড ঘটাতে পারে। দ্রুত এতোসব কথা ভাবতে ভাবতে সামিনার ভেতরে ভীষণ তোলপাড় বয়ে যায়। সে জায়েদকে দুহাতে সরিয়ে দিতে চায়। নানাভাবে চেষ্টা করে। একবার চিৎকার দিতে গিয়ে থেমে যায় নিজের মান-সম্মানের কথা ভেবে। তার চিৎকার শুনে বিল্ডিংয়ের আশপাশের ফ্ল্যাটের মানুষজন যদি ছুটে আসে, সবাই এসে যদি ব্যাপারটা জানে তখন সেটা তার জন্য অনেক বেশি অসম্মানের ব্যাপার হবে। এলাকায় জানাজানি হবে। নানা কথা রটবে। বাসায় স্বামী আরিফ এবং কন্যা দোলার সামনে কীভাবে, কোন মুখ নিয়ে দাঁড়াবে সে? আত্মীয়স্বজন চেনাজানা সবাই তখন তার চরিত্র নিয়ে কাল্পনিক মিথ্যা মনগড়া গল্প ছড়াবে। যা হয়নি, তেমন কথা রটিয়ে বিশেষ আনন্দ পাবে কেউ কেউ।
জায়েদকে নিবৃত্ত করতে চিৎকার না করে অনেকভাবে চেষ্টা করে সামিনা। কিন্তু নিজের দুর্বল শরীর নিয়ে শক্ত-সামর্থ্য একজন টগবগে উত্তেজিত যুবককে কোনোভাবেই বাধা দিয়ে টিকতে পারে না। একসময় সামিনা অনেকটা বাধ্য হয়েই আত্মসমর্পণ করে। জায়েদ একে একে তার শরীরের সব কাপড়-চোপড় সরিয়ে নিরাবরণ করে ফেলে তাকে। সামিনা কাঠের পুতুলের মতো হয়ে যায়। তার বস্ত্রহরণের ব্যাপারটা উপলব্ধি করলেও মোটেও বাধা দেয় না সে। জায়েদের সান্নিধ্য তাকে কেমন আবিষ্ট করে তোলে। তার বন্য আচরণে নিজেও সাড়া দিতে থাকে অল্প অল্প করে। একসময় এক জোড়া নরনারী তাদের সামাজিক পরিচয়, পারিবারিক অবস্থান, বয়স, বিবেক-বুদ্ধি, নৈতিকতা, সামাজিক, ধর্মীয় অনুশাসন ইত্যাদি ভুলে নিষিদ্ধ এক ভুবনে হারিয়ে যায়।
একসময় দুজনেই ক্লান্ত, পরিশ্রান্ত হয়ে যখন সম্বিত ফিরে পায় তখন সময় আরো কিছুটা গড়িয়ে গেছে।
নিজেকে অবিন্যস্ত, বিধ্বস্ত অবস্থায় আবিষ্কার করে সামিনা ভীষণভাবে অবাক হয়। নিজেকে নিজের কাছেই কেমন অচেনা মনে হয়। এ ঘরে কিছুক্ষণ আগে ঘটে যাওয়া ঘটনাগুলো মনে পড়ে যায় দ্রুত। নিজের দিকে তাকাতেই গুটিয়ে যায় সে।
দ্রুত ঘরের মধ্যে ছড়িয়ে থাকা নিজের কাপড়-চোপড়গুলো পরে নেয়। ঘটে যাওয়া ঘটনাগুলো মনে পড়তেই নিজেকে ভীষণ ছোট মনে হতে থাকে। নিঃস্ব, রিক্ত, অসহায় একজন মেয়েমানুষ মনে হয় নিজেকে। তার অকৃতকর্মের জন্য অনুশোচনা হতে থাকে। স্বামী ও সন্তানের কথা ভেবে ভীষণ কান্না পায় সামিনার। তার একটি চমৎকার সুখের সংসার রয়েছে। স্বামীর সঙ্গে ভালো বোঝাপড়ার সম্পর্ক তার। তাকে অনেক ভালোবাসে এবং বিশ্বাস করে আরিফ। যে কারণে একজন পরপুরুষের সঙ্গে পার্টনারশিপে ব্যবসা করার সুযোগ দিয়েছিল সে তার বউকে। মেয়ে দোলা কলেজপড়–য়া। অনেক কিছু বোঝার মতো বয়স হয়েছে তার। সেও তার মাকে অনেক ভালোবাসে, বিশ্বাস করে। জায়েদের সঙ্গে মিলে বুটিকের ব্যবসা করার ব্যাপারটিকে তারা কেউ খারাপ চোখে দেখেনি, এ নিয়ে ভিন্ন কিছু চিন্তা-ভাবনা করেনি। এর মধ্যে অপ্রত্যাশিত, অনাকাক্সিক্ষত কোনো বিষয় কিংবা ব্যাপার থাকতে পারে- তারা ভাবেনি। অথচ সে তাদের সঙ্গে প্রতারণা করেছে, বিশ্বাসঘাতকতা করেছে। একজন পরপুরুষ জায়েদের জৈবিক ইচ্ছায় সাড়া দিয়ে ভেসে গেছে বুনো উদ্দামতায়। ভয়ানক পাপ করেছে সে। তখন জায়েদের ইচ্ছার বিরুদ্ধে চাইলে রুখে দাঁড়াতে পারতো। একটু বেশি চেষ্টা করলে তার কবল থেকে নিজেকে মুক্ত করে এ বাসা থেকে বেরিয়ে যেতে পারতো। কিন্তু শেষ পর্যন্ত মানুষটিকে বাধা না দিয়ে নিজেই আত্মসমর্পণ করেছে, নিজেই বাঁধভাঙা জোয়ারে ভেসে গেছে।

সামিনার চাপা কান্না জায়েদকে কিছুটা চঞ্চল করে। কিছুটা অপরাধীর ভঙ্গিতে মাথা নিচু করে তার সামনে দাঁড়িয়ে বলে, ‘প্লিজ কাঁদবেন না। যা ঘটেছে তার জন্য আমি অনেক দুঃখিত। এ রকম ঘটনার জন্য আমরা কেউই প্রস্তুত ছিলাম না। হঠাৎ কীভাবে, কী হয়ে গেল। আমি মাফ চাইছি আপনার কাছে। আপনি আমাকে শাস্তি দেন, আপনার যে কোনো শাস্তি আমি মাথা পেতে নেবো। আপনার পা ধরে বলছি, আর কোনো সময়ে আমি তেমন অপরাধ করবো না, আপনি আমার বড় বোনের মতো, ছোট ভাই হিসেবে আমাকে মাফ করে দেন এবারের মতো। তবে আমার রিকোয়েস্ট, ব্যাপারটা কাউকে বলতে যাবেন না। আপনার বাসার কেউ যেন না জানে। তারা জানতে পারলে আপনার যেমন ক্ষতি হয়ে যাবে, আমারও চরম সর্বনাশ হবে। থানা পুলিশ পর্যন্ত গড়াতে পারে। তখন হয়রানির শিকার হতে হবে আমাদের দুজনকেই। যা আমাদের দুজনেরই জীবনে অনেক বড় ক্ষতি ডেকে আনবে।’
জায়েদের কথাগুলো শোনার পর বাস্তব অবস্থাটা উপলব্ধি করে সামিনা। নিজের অসহায়ত্ব টের পায়। এতো বড় একটা ঘটনা ঘটে যাবার পরও বিহিত করার কোনো ক্ষমতা নেই। লোকটা তাকে একাকী দুর্বল অবস্থায় পেয়ে সুযোগ নিয়ে যে জঘন্য কাজটি করেছে তার শাস্তির ব্যবস্থা করা দরকার। অথচ সামিনা কিছুই করতে পারছে না। নিজের অক্ষমতা, সীমাবদ্ধতায় এক ধরনের গøানিবোধ চেপে বসে বুকের মধ্যে। এ ঘটনার কথা জানাজানি হলে সামিনা নিজে কোথায় গিয়ে পৌঁছবে। তার স্বামী, সন্তান কোনোভাবেই মেনে নিতে চাইবে না, সহজভাবে গ্রহণ করবে না। তাকেই দোষারোপ করবে। কেউ সহানুভূতিশীল হবে না। সমাজের সবাই অন্য দৃষ্টিতে দেখবে তাকে। তার চেয়ে যা ঘটেছে, তা নিছক অনিচ্ছাকৃত দুর্ঘটনা হিসেবে মেনে নিয়ে চেপে যাওয়াটাই বুদ্ধিমানের কাজ বলে মনে করতে চায় সে।
সেই ঘটনার পর জায়েদের সঙ্গে পার্টনারশিপে চালু করা ব্যবসা ছেড়ে সরে আসার চিন্তাভাবনা করেছে সামিনা। যে মানুষটা হঠাৎ একটা সুযোগ পেয়ে তার এতোবড় সর্বনাশ করতে পেরেছে, তার দুর্বলতা অসহায়ত্বের সুযোগ নিতে বিন্দুমাত্র দেরি করেনি তাকে আর কোনোভাবেই বিশ্বাস করা যায় না।
সামিনা অনেকবার নানাভাবে চেষ্টা করেছে জায়েদের খাটানো টাকা-পয়সা তাকে ফেরত দিয়ে ব্যবসাটা এককভাবে নিজের করে নিতে। কিন্তু এতো টাকা একসঙ্গে নগদ জোগাড় করা কোনোভাবেই সম্ভব হয়নি তার। স্বামী আরিফকে কয়েকবার বলেছে জায়েদকে বাদ দিয়ে এককভাবে নিজেই চালাতে চায় সে ব্যবসাটা। আরিফ বউয়ের কথা শুনে তেমন পাত্তা দেয়নি ব্যাপারটা। হেসেই উড়িয়ে দিয়েছে।
‘আরে, জায়েদের মতো একটা ছেলেকে পার্টনার হিসেবে পাশে পেয়েছো এটা তোমার সৌভাগ্য! আমি তো চাকরির পেছনে ছুটতে ছুটতে বেহাল, তোমার ব্যবসার কাজে সময় দেয়ার সুযোগ নেই। বড় পোস্টে অফিসে চাকরি করলে না হয় একটা ব্যাপার ছিল। আমাদের মতো কেরানি গোছের চাকরিজীবীদের চাকরির বাইরে অন্য কোথাও সময় দেয়ার সুযোগ কোথায়? সারাক্ষণ বড় কর্তাদের হুকুম তামিল করতে করতে দিন চলে যায়। জায়েদ ছেলেটা চটপটে, স্মার্ট। ওর সঙ্গে পার্টনারশিপে ব্যবসা করে অল্পদিনেই বেশ এগিয়ে গেছ তুমি। তোমার কাজকর্ম কতো বেড়েছে। আয়-রোজগারও কয়েকগুণ বেশি হচ্ছে। এ অবস্থায় তার কাছ থেকে সরে এলে কিংবা তাকে বাদ দিয়ে একাকী কিছু করতে গেলে তুমি সবদিক সামাল দিতে পারবা না। সব কিছু লাটে উঠবে। গত কিছুদিনে যতদূর এগিয়েছ, তা হারিয়ে অনেক পিছিয়ে পড়বে। এখন তুমি নিশ্চয়ই এখান থেকে পিছিয়ে আগের চেয়ে খারাপ অবস্থায় ফিরে যেতে চাইবে না।’
আরিফের কথার বিপক্ষে পাল্টা যুক্তি দেখিয়ে কিছুই বলতে পারেনি সামিনা। কেন সে জায়েদের কাছ থেকে সরে এককভাবে আলাদা ব্যবসা দাঁড় করাতে চাইছে, তার আসল কারণটা খুলে বলতে পারেনি। অনেকটা বাধ্য হয়ে একান্ত অনিচ্ছায় জায়েদের সঙ্গে বুটিকের ব্যবসাটা চালিয়ে যেতে হয়েছে তাকে।
ঝড়-বৃষ্টিমুখর এক সন্ধ্যায় নিজের ফ্ল্যাটে একাকী অসুস্থ দুর্বল অবস্থায় সামিনাকে পেয়ে সেই সুযোগটি নিয়েছিল জায়েদ। যদিও সে তার কৃতকর্মের জন্য সামিনার হাতে-পায়ে ধরে ক্ষমা চেয়েছে। আর কখনো তেমন কাজ করবে না বলেছে। কিন্তু একবার লোভনীয় মাংসের স্বাদ পাওয়া নেকড়ে কোনোভাবেই নিজেকে নিবৃত্ত রাখতে পারে না, যে কোনোভাবে সুযোগ পেলে কিংবা সুযোগ সৃষ্টি করে তার উদ্দেশ্য পূরণে সচেষ্ট হয় যেমনভাবে। জায়েদও নানা কৌশলে বিভিন্নভাবে ফাঁদ পেতে তার ফ্ল্যাটে সামিনাকে নিয়ে তার একান্ত চাহিদা পূরণ করে।
নিজে বারবার একজন পরপুরুষের লালসার শিকার হলেও এক্ষেত্রে যেন তার কিছু করার নেই- এটাই যেন তার নিয়তি। কেন জানি মনে হয় মধ্যবয়সী এই নারীর। প্রথম দিকে ব্যাপারটা সামিনার বেশ ঘৃণার মনে হতো। তখন নিজেকে মনে মনে বেশ ধিক্কার দিত সে। কিন্তু এখন জায়েদের সঙ্গে সবার অগোচরে তার ফ্ল্যাটে নিয়মিতভাবে অবাধ প্রেমলীলায় মেতে উঠতে গিয়ে খারাপ লাগে না, মনের মধ্যে তেমন কোনো অস্বস্তিভাব জাগে না। তার চেয়ে গতানুগতিক দাম্পত্য জীবনের সমান্তরাল আরেকটি গোপন শরীরিক সম্পর্কে জড়িয়ে অন্যরকম আনন্দ উত্তেজনা শিহরণ অনুভব করে। এভাবেই বিজনেস পার্টনার অল্পবয়সী যুবক জায়েদের সঙ্গে পরকীয়ায় মেতে ওঠে মধ্যবয়সী সাধারণ এক গৃহবধূ সামিনা।
তাদের দুজনের মধ্যকার গভীর গোপন প্রণয়ের সম্পর্কের ব্যাপারটা বাইরে থেকে কেউ টের পায় না। খুব কাছের মানুষেরাও বুঝতে পারে না ব্যাপারটা। বাসায় স্বামী ও কন্যার চোখেও ধরা পড়ে না ব্যাপারটা। জায়েদও আগের মতো সহজ স্বাভাবিকভাবে সামিনাদের বাসায় যাতায়াত করতে থাকে। আরিফ এবং দোলা তাকে নিয়ে কোনোরকম সন্দেহ প্রকাশ করে না। ওদিকে ব্যবসায়িক কাজ দেখাশোনা এবং তত্ত্বাবধান করতে জায়েদের ফ্ল্যাটে সামিনার নিয়মিত যাওয়া-আসাটাকে সাধারণভাবে মেনে নেয় সবাই আগের মতো।
জায়েদের সঙ্গে গড়ে ওঠা গোপন সম্পর্কটাকে অস্বস্তিকর মনে না হলেও এটার শেষ পরিণতি কোথায়, শেষ পর্যন্ত কোন দিকে গড়াবে, কোথায় গিয়ে দাঁড় করাবে তাদের দুজনকে- এসব বিষয় নিয়ে মাঝে মাঝে চিন্তা-ভাবনার উদ্রেক হয় সামিনার। এ বিষয়ে বেশ কয়েকবার জানতে চেয়েছে প্রেমিক কাম বিজনেস পার্টনার জায়েদের কাছে। সে হাসতে হাসতে বলেছে, ‘তুমি কী করতে চাও? তুমি কী তোমার ঘর-সংসার, স্বামী, সন্তান ছেড়ে আসতে পারবা একেবারে, এটা কী সম্ভব তোমার পক্ষে?’
জায়েদের তেমন প্রশ্নে সামিনার মনে এক ধরনের অস্থিরতা সৃষ্টি হয়েছে। গোপনে একজন পরপুরুষের সঙ্গে নিষিদ্ধ সম্পর্কে জড়িয়ে পড়লেও সে কোনোভাবেই স্বামী, সন্তান এবং সংসার ছাড়ার কথা ভাবতে পারে না। এখনো তাদেরকে অনেক বেশি ভালোবাসে এবং নিজের জীবনের একটি অংশ ও বেঁচে থাকার অবলম্বন বলে মনে করে।

সামিনা জায়েদের প্রশ্নের জবাবে কিছু বলতে পারে না। গন্তব্যহীন পথ ধরে চলতে থাকে তাদের গোপন প্রণয়।

এভাবেই কেটে যাচ্ছিল দিন। কিন্তু হঠাৎ করে জায়েদের কিছু ব্যাপার সামিনাকে বেশ চিন্তিত এবং অস্থির করে তোলে। তাদের বাসায় নিয়মিত যাওয়া-আসায় সবার সঙ্গে জায়েদের সহজ খোলামেলা সম্পর্ক গড়ে উঠেছে। আরিফ এবং দোলার সঙ্গে প্রায়ই সময় সুযোগ হলে বসে আড্ডা দেয়, টিভিতে হিন্দি-বাংলা সিনেমা, সিরিয়াল দেখে। সেখানে অনেক সময় সামিনাও যোগ দেয়, আবার অনেক সময় সে থাকতে পারে না সাংসারিক ব্যবসায়িক কাজের ব্যস্ততার চাপে।
আজকাল দোলার সঙ্গে জায়েদের মাখামাখিটা বেশ চোখে পড়ছে। একসঙ্গে টিভি দেখতে বসে বেশ অন্তরঙ্গ হয়ে হাসিঠাট্টার পাশাপাশি তারা দুজন চোখের ইশারায় নানা কথা বলছে। মা হিসেবে কন্যার তেমন আচরণ মোটেও ভালো লাগেনি সামিনার। দোলা জায়েদকে ‘মামা’ ডাকলেও ভেতরে ভেতরে তাদের দুজনের মধ্যে অন্যরকম কোনো ব্যাপার ঘটে চলেছে, মেয়েটা একজন লম্পট, চরিত্রহীন মানুষের খপ্পরে পড়ে গেছে- স্পষ্ট টের পায় সে। তেমন অবস্থায় মা হয়ে চুপচাপ, নির্বিকারভাবে বসে থাকতে পারে না সামিনা। জায়েদকে নরকের কীট মনে হয় তার কাছে। মানুষটা একসময়ে দুর্বলতার সুযোগ নিয়ে সম্পর্ক গড়েছে যে নারীর সঙ্গে, পরবর্তী সময়ে আবার সুযোগ পেয়ে তারই কন্যার সঙ্গে প্রণয়লীলা শুরু করতে বেপরোয়া হয়েছে।
এ নিয়ে দোলাকে কিছু না বললেও সামিনা জায়েদের সঙ্গে তার ফ্ল্যাটে একান্ত সময় কাটানোর সময় তাকে হঠাৎ করে প্রশ্ন করে, ‘আচ্ছা, দোলার সঙ্গে তোমার এতো মাখামাখি চলছে দেখছি বেশ কিছুদিন ধরে। তোমার মতলব আমি বুঝে ফেলেছি। আমার চরম সর্বনাশ করে এবার তুমি কোন সাহসে আমার মেয়ের দিকে হাত বাড়িয়েছো, তার সর্বনাশ করতে চাইছো। আচ্ছা তুমি কী মানুষ? নাকি দুই পায়ে হাঁটা কোনো জন্তু জানোয়ার? ছিঃ, ছিঃ, তোমার মতো একজন জঘন্য চরিত্রের মানুষের সঙ্গে আমার কোন কুক্ষণে যে পরিচয় হয়েছিল। তোমার সঙ্গে আবার ঘনিষ্ঠ হয়েছি মেলামেশা করেছি, নিজেকে তুলে দিয়েছি সবার অগোচরে, গোপনে, লুকিয়ে লুকিয়ে যাচ্ছে তাই করে যাচ্ছি। এখন আমার নিজের ওপর ভীষণ ঘেন্না হচ্ছে।’
সামিনার কথাগুলো শুনে কিছুক্ষণ চুপচাপ থাকে জায়েদ। এরপর ঠাণ্ডা গলায় উত্তেজনাহীন ভঙ্গিতে বলে, ‘আমার কোনো দোষ নেই, সত্যি বলছি। বিশ্বাস করো, দোলাকে আমি কোনো জাদুটোনা করিনি। সেই আমার প্রতি দুর্বল হয়েছে নিজে থেকে। তার সঙ্গে ঘনিষ্ঠ হতে নানাভাবে প্রলুব্ধ করেছে। আমি অনেকবার তাকে বলতে চেয়েছি, আমি তোমার মামা। আমার সঙ্গে তোমার প্রেম-ভালোবাসার সম্পর্ক হতে পারে না। কিন্তু দোলা বলেছে, তুমি তো আমার আপন মামা নও। জাস্ট মামার মতো একজন। তোমাকে আমার ভালো লেগেছে। আর কিছুর প্রয়োজন নেই এর মধ্যে।’
জায়েদের কথাগুলো সামিনার শরীর আগুন ধরিয়ে দিয়েছে তখনই। মাথায় রক্ত চড়ে গেছে। আপন কন্যার চরম সর্বনাশ উপলব্ধি হতেই একজন মা হিসেবে এর একটা বিহিত করার তাগিদ অনুভব করেছে। কিন্তু এটা কীভাবে সম্ভব করবে সে?
অল্পক্ষণ পরেই জাহিদ তার মোবাইল ফোনে দোলার সঙ্গে একান্ত ঘনিষ্ঠ মুহূর্ত কাটানোর বেশ কিছু ভিডিও ছবি দেখায় সামিনাকে। যেখানে আপন কন্যার নিলর্জ্জতার প্রকাশ রয়েছে। যে পুরুষ মানুষটি সুযোগ পেয়ে তাকে বারবার, অনেকবার শয্যা সঙ্গিনী করেছে, তাকে ইচ্ছামতো ব্যবহার করেছে। সে নিজেও অকাতরে সমর্পণ করেছে তার কাছে নিজেকে। সেই একই পুরুষের কাছে তার নিজস্ব ফ্ল্যাটে একই বিছানায় দোলাকে একইভাবে সমর্পিত হতে দেখে মাথাটা ঘুরে ওঠে সামিনার। ভূমিকম্প শুরু হয়ে যায়। তার কাছে মনে হয় এই মুহূর্তে মহাপ্রলয় নেমে আসুক পৃথিবীতে। সবকিছু ধ্বংস হয়ে যাক।
একজন মা হয়ে সে যে পাপ করেছে তার প্রায়শ্চিত্ত এভাবে করতে হবে তাকে, মনে হতেই চরম গøানি অনুশোচনায় ভরে যায় মন। এই পৃথিবীতে বেঁচে থাকতে আর মন চায় না। কিন্তু এভাবে অনুশোচনা আর অপমানের জ্বালা জুড়োতে এক বুক গøানি, দুঃখ, বেদনা নিয়ে আত্মঘাতী হলে তো সেটা হবে তার এক ধরনের পরাজয়। এ জন্য দায়ী মানুষটির কিছুই হবে না। আপন কন্যাটি তার ভোগ লালসার লম্পট্যের শিকার হতে থাকবে আরো কিছুদিন। এর পর হয়তো দোলাকে ছেড়ে অন্য কোনো নারীর দিকে হাত বাড়াবে জায়েদ। তার লাম্পট্যের শিকার হতে থাকবে একের পর একজন মেয়ে। এটা হতে দেয়া যায় না কোনোভাবেই। এর একটা প্রতিকার প্রয়োজন।
অনেকটা মরিয়া হয়ে সামিনা ক্ষুব্ধ গলায় প্রশ্ন করে, ‘আচ্ছা, তুমি কী মানুষ, নাকি জানোয়ার?’
তার প্রশ্নের জবাবে জায়েদ সহজ স্বাভাবিক ভঙ্গিতে বলে, ‘কেন কী হয়েছে? আমার দোষ কোথায়, তোমার মেয়েই তো আমার সঙ্গে-’।
তাকে আর কথা বলতে দেয় না সামিনা।
‘চুপ করো শয়তান, আর কোনো কথা শুনতে চাই না, তুমি তোমার মোবাইল ফোন থেকে দোলার সঙ্গে তোমার সব ছবি, ভিডিও এক্ষুনি ডিলিট করো। এগুলো যেন কেউ না জানতে পারে অথবা দেখতে পারে। রাগী গলায় কথাগুলো বলে সামিনা। উত্তেজনা, রাগে, অপমানে, লজ্জায় তার শরীর জ্বলছে। যেন দাউ দাউ করে আগুন জ্বলছে শরীর জুড়ে। তার সারা শরীর থর থর করে কাঁপছে। সামিনার অগ্নিমূর্তি দেখে প্রথমে কিছুটা চমকে গেলেও পরক্ষণে আবার সহজ স্বাভাবিক হয়ে যায় জায়েদ।
‘তোমার কথা মতো দোলার সঙ্গে আমার সব ছবি, ভিডিও ডিলিট করে দিলাম আমার মোবাইল থেকে। কিন্তু ঐ ছবি আর ভিডিওগুলো কী করবো, সেটাতো বলছো না।’
জায়েদ রহস্য জড়ানো কণ্ঠে কথাগুলো বলে। তার কথায় হঠাৎ কেমন যেন ধাক্কা খায় সামিনা ভেতরে ভেতরে।
‘ঐ ছবি আর ভিডিও মানে ?’ অবাক হয়ে জানতে চায় সে।
তার প্রশ্নের জবাবে কিছু না বলে জায়েদ তার অ্যান্ড্রয়েড মোবাইল ফোনে থাকা কিছু ভিডিও দেখাতে থাকে সামিনাকে।
এক জোড়া নর-নারীর অশ্লীল খোলামেলা প্রণয়ের সচিত্র বিবরণ ভিডিওগুলোতে রয়েছে। কিছুটা দূর থেকে দেখায় নর-নারীকে হঠাৎ চিনতে পারে না সামিনা। মোবাইল ফোনটি ছো মেরে জায়েদের কাছ থেকে দ্রুতই হাতে তুলে নেয় সে। কাছে এনে বেশ মনোযোগ দিয়ে দেখতে গিয়ে অবাক বিস্ময়ে পাথর হয়ে যায়। তার মুখ দিয়ে কোনো কথা বেরোতে চায় না। নির্বাক পাথরের মূর্তি যেন হয়ে যায় সামিনা। কী দেখছে সে জায়েদের মোবাইল ফোনের ক্যামেরায় তোলা ভিডিওগুলোতে?
গত বেশ কিছুদিন ধরে চলা জায়েদের সঙ্গে গভীর গোপন প্রণয় আর উদ্দাম মেলামেশার অনেক কিছুই তার অগোচরে তার চোখকে ফাঁকি দিয়ে নিজের মোবাইল ফোনে তুলে রেখেছে সে। যেখানে নিজের নির্লজ্জতা বেহায়াপনা আর বিশ্বাসঘাতকতার নগ্নচিত্র ফুটে উঠেছে। আরিফ কিংবা দোলা যদি কোনোভাবে এই ভিডিওগুলো দেখে ফেলে তখন কী হবে- ভাবতে গিয়ে সারাটা পৃথিবী যেন আরেকবার দুলে ওঠে তার সামনে। ভয়ে, আতঙ্কে তার সারা শরীর ঘামতে শুরু করে।
সামিনার মনের অবস্থা টের পায় জায়েদ। তার অসহায়ত্ব উপলব্ধি করে সেই সুযোগটা নিতে চায়।
‘আমি তোমার মনের অবস্থা বুঝতে পারছি। অনেক বড় একটা খারাপ পরিস্থিতিতে পড়ছো তুমি। তুমি তোমার এই পরিস্থিতির কথা কাউকে বলতে পারবা না। আমার নামে পুলিশ, থানা, র‌্যাব, ট্রিপল নাইন কোথাও কমপ্লেইন করতেও পারবা না। যদি করো, তা হইলে তোমার সব কিছু শেষ হইয়া যাইবো। ধ্বংস হইয়া যাইবো মান-সম্মান, ব্যবসা-বাণিজ্য, ঘর-সংসার। স্বামী, সন্তান সবাই লাঞ্ছিত-অপমানিত হইবো তোমার সঙ্গে সঙ্গে। এই জন্য আমি অনেকটা দায়ী। তবে এইখানে তোমারও তো অনেক দোষ আছে। তুমি ঘরে স্বামী, সন্তান থাকতে একজন পরপুরুষের সঙ্গে গোপন সম্পর্কে জড়াইছো নিজেকে। পাপের সাগরে ভাসছো কিছু সময়ের আনন্দ পাওয়ার লোভে। সেই সব পাপের প্রায়শ্চিত্ত তোমাকেই করতে হবে।’
একটানা নাটকীয় ভঙ্গিতে নাটক-সিনেমার ভিলেনদের মতো শোনায় তার কথাগুলো।
বিধ্বস্ত, ঘর্মাক্ত, ক্লান্ত, বিষণ্ন চেহারা নিয়ে ফ্যাল ফ্যাল করে তাকিয়ে অনেক কিছু ভাবতে থাকে সামিনা। তেমন ভয়ংকর বিপদ থেকে কীভাবে সে উদ্ধার পাবে? কে তাকে বাঁচাবে? কার কাছে সাহায্য চাইবে সে তেমন অবস্থা থেকে রক্ষা করার জন্য?
‘শোনো, আমি সব কিছু ভুলে যেতে চাই। আমার মন থেকে তোমার এবং তোমার মেয়ে দোলার কথা মুছে ফেলতে চাই। আমার মোবাইল ফোনে থাকা তোমরা মা-বেটির কাণ্ডকীর্তির সব ছবি, ভিডিও ডিলিট করে দেবো। আমি ভাবছি, এই ঢাকা শহরে আর থাকবো না। আমি আমার গ্রামের বাড়িতে ফিরে নতুন আরেকটা জীবন শুরু করতে চাই। একটা বিয়া-শাদি করে ঘর-সংসার শুরু করবো চিন্তা করেছি। গ্রামে কৃষি কাজ করে বাকি জীবনটা কাটাতে চাই। এজন্য আমি মুক্তি চাই তোমার কাছ থেকে। তোমার আমার এই বিজনেসের সবটাই আমাকে যদি তুমি লিখে দাও, তাহলেই আমি খুশি মনে তোমাদের ছেড়ে চলে যাবো, কোনো ডিস্টার্ব কিংবা ঝামেলা হবে না। নীরবে নিঃশব্দে সরে যাবো তোমাদের জীবন থেকে। তোমার স্বামী কিংবা মেয়ে কেউ কিছু জানতে পারবে না। তোমার সংসার জীবন আগের মতো ঠিকঠাক, সুন্দর, ছিমছাম থাকবে। তুমি নিশ্চয়ই এটাই চাও?’ জায়েদ বলে।
‘তাহলে আমাকে কী করতে হবে?’ অনেকটা বেপরোয়া হয়ে জানতে চায় সামিনা।
সে উপলদ্ধি করে ভয়ানক এক ফাঁদে আটকে গেছে সে। এখান থেকে উদ্ধার পেতে যে কোনো ধরনের ত্যাগ স্বীকারে প্রস্তুত হতে হবে।
‘আমাদের দুজনের বিজনেসের সব কিছু আমার নামে লিখে দিতে হবে তোমাকে। তুমি তোমার অংশের পুরোটাই আমার নামে লিখে দিতে যদি রাজি হও, তাহলে এই বিপদ থেকে বেঁচে যাবে। তা না হলে পরিস্থিতি কোনদিকে যেতে পারে- সেটা তো তুমি বুঝতে পারো আমার চেয়েও অনেক বেশি। তুমি যদি রাজি হও বলো। এ নিয়ে অযথা সময় নষ্ট করে কোনো কাজ হবে না। আমার আর কিছু চাওয়া-পাওয়া নেই। তোমরা মা-মেয়ে আমার অনেক সাধ পূরণ করছো। অনেক সুখ দিছো। যা আমি অন্য কোথাও পাবো কিনা জানি না। আমি তোমাদের কাছে আর কিছু চাই না। আমি এখন তোমাদের মুক্তি দিয়ে গ্রামে ফিরে যেতে চাই’ জায়েদ বলে।
জায়েদকে এই মুহূর্তে একজন মানুষ বলে মনে হয় না সামিনার কাছে। নিজের কৃতকর্মের জন্য কোনোরকম অনুশোচনা কিংবা অপরাধবোধ নেই তার মধ্যে। বরং সামিনা এবং তার মেয়ে দোলার সঙ্গে তার অবৈধ সম্পর্কের বিষয়টি নিয়ে অবলীলায় কথা বলছে। অশালীনতার মাত্রা অতিক্রম করছে সে তার মুখের কথায়। তাকে দুই পায়ে ভর দিয়ে হাঁটা বুনো হিংস্র কোনো প্রাণী মনে হয়। যার মধ্যে লজ্জাবোধ কিংবা বিবেক, মানুষ্যত্ববোধ, নৈতিকতা, ধর্ম ভয় ইত্যাদির কিছু লেশমাত্র নেই।
জায়েদের প্রস্তাবে রাজি হওয়া মানে এতদিন তিল তিল করে গড়ে তোলা ব্যবসাটা নিজের অংশ ছেড়ে তার হাতে পুরোপুরিভাবে তুলে দেয়া। কত কষ্ট করে, নানাভাবে ত্যাগ স্বীকার করে, সংসারের সুখ-স্বাচ্ছন্দ্য, বিলাসিতা বিসর্জন দিয়ে জমানো পুঁজি দিয়ে গড়ে তুলেছিল সে ব্যবসাটা। যা সামিনার জীবনে নতুন দিশা এনে দিয়েছিল। এক সাধারণ আটপৌরে গৃহবধূ থেকে একজন ভালো ব্যবসায়ী-উদ্যোক্তা হিসেবে চূড়ান্ত লক্ষ্যের দিকে এগিয়ে যাচ্ছিল সে। তার সব স্বপ্ন, সব আকাক্সক্ষা এভাবে হঠাৎ করে অশান্ত ঝড়ে তছনছ হয়ে যাবে, মহাপ্রলয় নেমে আসবে তার জীবনে- ভাবতে পারেনি সামিনা।

জায়েদ পুরো ব্যবসা তার নিজের নামে করে নিতে উকিলের মাধ্যমে সব দলিল, কাগজপত্র তৈরি করতে দ্রুত ব্যবস্থা নেয়। কয়েকদিনের দৌড়ঝাঁপে কাজটা শেষ করে ফেলে। যৌথ ব্যবসার নিজের অংশের পুরোটাই নগদ টাকার বিনিময়ে জায়েদের নামে লিখে দিচ্ছে সামিনা- তেমন দলিল, কাগজপত্র তৈরি করে সেখানে সই-স্বাক্ষর দেয়ার জন্য তার ফ্ল্যাটে যাওয়ার আমন্ত্রণ জানায় জায়েদ। হয়তো তেমন মোক্ষম সুযোগের অপেক্ষায় ছিল সে। সুযোগ হাতে চলে আসতেই কাজে লাগাতে ভীষণ তৎপর হয়ে উঠেছে।

হঠাৎ করে সামিনার বিষণ্নভাব আরিফকে যেমন অবাক করে, তেমনিভাবে দোলাও ভেতরে ভেতরে অস্বস্তি অনুভব করে।
দোলা ভাবে, জায়েদকে নিয়ে যে স্বপ্ন দেখছে সে, তা কি মা জেনে গেছে? জায়েদের সঙ্গে গোপনে গড়ে ওঠা সম্পর্কের ব্যাপারটা কি ধরে ফেলেছে মা? এজন্যই হয়তো তার মধ্যে বিষণ্নতা ভর করেছে। বাসায় মনমরা হয়ে সব সময় বসে থাকছে। কারো সঙ্গে মন খুলে তেমন কথাবার্তা বলছে না।

সামিনা জায়েদকে প্রতিশ্রæতি দিয়েছে তার কথামতো কাজ করবে। দলিল, কাগজপত্র রেডি করে আনলে তাতে সই-স্বাক্ষর দিয়ে দেবে। দুজনের যৌথ ব্যবসার পুরোটাই জায়েদের নামে লিখে দেবে, নিজের অংশটা তাকে লিখে দেবে।
সবকিছু লিখে দেয়ার পরও কি শেষ রক্ষা হবে, পুরো ব্যবসা নিজের নামে করে নেয়ার পরও কি জায়েদ তার পশুবৃত্তি ছেড়ে মানবিক হবে? সামিনার দুর্বলতা আর অসহায়ত্বের সুযোগ নিয়ে আবার নতুন কোনো খেলা শুরু করবে কিনা, তার তো কোনো নিশ্চয়তা নেই। তার মধ্যে নীতিবোধ, সততা, বিশ্বস্ততা, সহানুভূতি, মানবতাবোধ কোনো কিছুরই লেশমাত্র নেই। একজন মানুষ কতোটা জঘন্য এবং ভয়ংকর স্বভাবের হতে পারে- জায়েদের স্বভাব-চরিত্র এবং গত বেশ কিছুদিনের আচরণে হাড়ে হাড়ে টের পাচ্ছে সামিনা। তেমন একজন মানুষকে কোন ভরসায় বিশ্বাস করা যায়? ব্যবসার নিজের অংশ তার নামে লিখে দেয়ার পরও যদি বিষাক্ত সাপের মতো আবার ছোবল দিতে উদ্যত হয় জায়েদ, নতুন কোনো ফন্দি আঁটে, আবারো তাকে তার পাপের প্রায়শ্চিত্ত করার জন্য নতুন কোনো বায়না নিয়ে উপস্থিত হয় তখন কী হবে- ভাবতে ভাবতে নতুন করে দুশ্চিন্তার অতলে ডুবে যেতে থাকে সে।
এরপর কী ঘটবে, জানে না সামিনা।

মন্তব্য করুন

খবরের বিষয়বস্তুর সঙ্গে মিল আছে এবং আপত্তিজনক নয়- এমন মন্তব্যই প্রদর্শিত হবে। মন্তব্যগুলো পাঠকের নিজস্ব মতামত, ভোরের কাগজ লাইভ এর দায়ভার নেবে না।

জনপ্রিয়