করোনার প্রাদুর্ভাব নিয়ন্ত্রণে বেইজিংয়ে ফের স্কুল বন্ধ

আগের সংবাদ

রাজধানীর আইনশৃঙ্খলা রক্ষায় ১৯ দফা নির্দেশনা : ঝুঁকি মোকাবিলায় নজরদারিতে চাকরিচ্যুত পুলিশরা

পরের সংবাদ

আমার হুমায়ূন

প্রকাশিত: মে ৬, ২০২২ , ১২:০০ পূর্বাহ্ণ
আপডেট: মে ৬, ২০২২ , ১২:০০ পূর্বাহ্ণ

বাংলা সাহিত্যে হুমায়ূন আহমেদ, এক অবিশ্বস্মরণীয় আশাজাগানিয়া জাদুকর। জীবনবোধ, চিন্তা ভাবনাকে বদলে দেবার অভূতপূর্ব রূপকার। আমার ক্ষুদ্র, স্যাঁতসেঁতে নিম্নমধ্যবিত্ত জীবনে পরশ পাথরের মতো, পথ দেখানো আলোকবর্তিকার নাম হুমায়ূন আহমেদ। এক পরাক্রমশালী গল্পকার যার শব্দের মায়াবী বুননে, ছোট অথচ অসম্ভব শক্তিশালী সহজ সংলাপে, ধরা পড়েছে সাধারণ পাঠকের হাসি, কান্না, আনন্দের জলছবি। প্রকৃত পক্ষে আমার একার নয়, আমার মতো অগণিত মানুষের দৃষ্টিভঙ্গি, মনোবিন্যাস পাল্টে দেবার শৈল্পিক কথাকার হুমায়ূন আহমেদ। ছোট বেলায় বাবার তফসিলী ব্যাংকে চাকরির সুবাদে বিভিন্ন জেলার মফস্বল/উপজেলায় বড় হয়েছি। সত্য বলছি ছেলেবেলায় বই বলতে ম্যাট্রিক পরীক্ষা দিয়ে শেষ না করা পর্যন্ত আমি পাঠ্য বইকে বুঝেছি। আমাদের উপজেলার বাসায় দৈনিক ইত্তেফাক পত্রিকা পৌঁছা তো একদিন পরে অর্থাৎ আজকের পত্রিকা কাল দুপুরে পেতাম। ইত্তেফাকের টারজান কার্টুন আর সিনেমার বিজ্ঞাপন দেখার মধ্যেই সীমাবদ্ধ ছিল আমার পাঠ্যবইয়ের বাইরে কোন কিছু পড়ার অভিজ্ঞতা। আম্মাকে মাঝে মাঝে শরৎচন্দ্র নিমাই ভট্টাচার্য পড়তে দেখতাম কিন্তু আব্বা চাকরি শেষে বাসায় এসে পত্রিকাতেই মনোনিবেশ করতেন। বাসায় ছোটদের পড়ার কোন বই ছিল না। ফলে শৈশবে আমি শিশুতোষ কোনো গল্প, কমিকস, ঠাকুরমার ঝুলি, ইশপের গল্প- এ জাতীয় বই চোখেই দেখি নাই। পাঠ্যবই বাধ্য হয়ে যতটুকু না পড়লে স্কুলে স্যারের হাতের মাইর থেকে রক্ষা পাওয়া যেত না, ততটুকুই পড়তাম। আমার মূল আগ্রহ ছিল ফুটবল খেলায় এবং খেলা শেষে মোহনগঞ্জ খালে সাঁতার কাটায়। ওই সময় আমার এক কাকা খালিয়াজুড়ীতে চাকরি করতে গিয়ে আমাদের বাসায় একটা সাইকেল রেখে গিয়েছিলেন। কিছুদিন পরে থাকার পর আমার এক বন্ধুর পরামর্শে বড় সাইকেল নিয়ে গেলাম পাশের মাঠে, উদ্দেশ্য সাইকেল চালানো শিখা। আমার গুরু আমার বন্ধু। সেই সময় ছোটদের যে আলাদা বেবি সাইকেল হয় তা আমার জানা ছিল না, কখনো চোখেও দেখি নাই। সেই বড় সাইকেলের তিন রডের ত্রিভুজের মাঝে বাম পা মাটিতে রেখে, ডান পা প্যাডেলে দিয়ে বাঁদুর ঝুলার মতো বাম হাতে হ্যান্ডেল, ডান হাতে বসার সিট আকড়ে ধরে পড়তে পড়তে পিঠ বাঁকিয়ে আশ্চর্য এক উপায়ে নিচ দিয়ে সাইকেল চালানো রপ্ত করে ফেললাম। কিছুদিন পরে নিচ দিয়ে চালানো শুরু করে গতিশীল অবস্থায় নিচ হতে মাথা উপরে তুলে পা রডের উপরে দিয়ে সিটে বসে পড়লাম এবং প্যাডেল পর্যন্ত পা না পৌঁছালেও এক পায়ে চাপ দিয়ে অন্য পা দিয়ে উল্টোদিকের প্যাডেলটি টেনে তুলে অদ্ভুত উপায়ে সাইকেল চালানো শিখে ফেল্লাম। এটাই আমার একমাত্র যান যা আমি নিজে চালাতে পারি। সাইকেল চালানো, ফুটবল খেলা, সাঁতার কাটা, শীতে ব্যাডমিন্টন খেলা এই নিয়েই ছিল আমার শৈশব, সেখানে পাঠ্যবইয়ের বাইরেও যে বই পড়া যায়, আনন্দ পাওয়া যায় আমার জানা ছিল না। আমার মাথায় ঢুকতো না পাঠ্যবই বাধ্য হয়ে, স্যারদের বেতে বাড়ি হতে বাঁচার জন্য পড়া যায়, তাই বলে শখ করে অন্য বই পড়া। ফলে তিন গোয়েন্দা, সেবা প্রকাশনীর মাসুদ রানা, কিশোর সাহিত্য ইত্যাদির স্বাদ না নিয়েই আমার বেড়ে উঠা। এরপর প্রাথমিক বিদ্যালয় শেষ করে ঢাকায় এসে ভর্তি হলাম মাদারটেক আব্দুল আজিজ হাই স্কুলে। ওই সময়কার মাদারটেকও মফস্বলের মতো। এখানেও পাড়ায় ফুটবল খেলি, ব্যাডমিন্টন খেলি শীতে। বর্ষায় এখন যেখানে বনশ্রী/দক্ষিণ বনশ্রী সেখানে বিশাল বিল। বর্ষায় অথৈই জল। নৌকা দৌড়াই, সাঁতার কাটি। ক্লাস নাইনে উঠে প্রথম এক টিকেটে দুই ছবি দেখি মধুমিতায়, বলাকায়, গুলিস্তানে। যারা এক টিকেটে দুই ছবি দেখেছেন তারা সকলেই জানেন কিসের আকর্ষণে কিশোরদল এসব দেখে বেড়াত। তখনো আমি কোনো গল্প উপন্যাস, কিশোর উপন্যাস, গোয়েন্দা কাহিনী পড়ি তো নাই-ই চোখেও দেখি নাই। নব্বই সালে এসএসসি পরীক্ষা দিয়ে বসে আসি। হাতে অলস সময়। তখন আমার ছোট বোন সেবা, সেও আমার সঙ্গে ৯০ সালেই ম্যাট্রিক পরীক্ষা দিয়েছে, দেখি কি একটা বই পড়ে। ওর পড়া শেষে আমি বইটা হাতে নিয়ে উল্টে পাল্টে দেখি, বলি কই পেয়েছিস। বলে শিমুর কাছ থেকে এনেছি। শিমুও আমাদের সঙ্গে একই স্কুল হতে ৯০ সালে ম্যাট্রিক দিয়েছে। বইটা হাতে নিয়ে দেখি লেখা ‘গৌরীপুর জংশন’ লেখক হুমায়ূন আহমেদ। বইটি নেড়েচেড়ে দেখতে দেখতে কখন পড়ায় ডুবে গেছি জানি না। এক বসায় বইটি পড়েছিলাম এবং পড়ে অভিভূত হয়ে থ মেরে গেলাম। আমার ভিতর ভিন্ন এক অভিজ্ঞতা হলো। এই প্রথম আমি বইয়ের প্রকৃত স্বাদ পেলাম। সময় কাটানো এত সুন্দর আয়োজন। আমার এতদিনের মনোজগৎ উল্টে গেল। যে আমি একটা কমিকসের ছোট বই পড়ি নাই সেই আমি এক বসায় আস্ত উপন্যাস শেষ করে ফেললাম কেবল মাত্র হুমায়ূন আহমেদের অপূর্ব মায়াজালে জড়িয়ে পড়ে। আমার নেশা ধরে গেল। পর দিন শিমুর কাছ থেকে হুমায়ূন আহমেদের আরেকটা বই প্রথম প্রহর এনে পড়লাম। আবারো বিস্ময়াভূত! তারপর ‘ফেরা’ ‘নন্দিত নরকে’, ‘তোমাদের জন্য ভালবাস’, ‘ফিহা সমীকরণ’, ‘নিষাদ, দ্বৈরথ’, ‘কুহক’, ‘ময়ূরাক্ষী’সহ শিমুর কাছে থাকা হুমায়ূনের সব বই পড়ে শেষ করলাম। এরপর জানলাম আমার বন্ধু উৎপলের দাদার সংগ্রহে অনেক বই আছে। উৎপলের বাসায় গিয়ে বই আনতে শুরু করলাম। উৎপলের দাদার সংগ্রহের সব হুমায়ূন শেষ করার পর নিজে প্রথম হুমায়ূন আহমেদের বই কিনি। আমার কেনা প্রথম হুমায়ূন স্যারের উপন্যাস ১৯৭১। এরপর হতে নতুন বই বের হলেই কিনে পড়া শুরু করি।এখনো পড়ি। হুমায়ূন আহমেদের পুরাতন বই গুলি খুঁজে খুঁজে বারবার পড়ি। আশ্চর্য প্রতি বারই নতুন পড়ছি বলে মনে হয় এবং একই রকম অভিভূত হই, আপ্লুত হই। হুমায়ূন আহমেদের বই পড়ে আমার ভাবনা চিন্তা বদলে গেল। সামান্য বইয়ে এত আনন্দ, এত উত্তেজনা, এত প্রাণশক্তি। এই প্রথম একজন সত্যিকারের কথার জাদুকরের দেখা পেলাম। হুমায়ূন আহমেদ আমার কাছে কেবল একজন লেখকই নন তিনি জীবনের বোধ, ভাবনা, পছন্দ অপছন্দ, বিশ্বাস অবিশ্বাস তৈরি করে দেবার মহান কারিগর। জীবন যে সাদা কালো, রাত দিনের মতো সুস্পষ্ট পৃথক সত্তা যা সহজেই আলাদা করা যায় এমন অনুভূতির সমাহার না বরং জীবনের বেশির ভাগ অংশই পড়েছে ধসূরের মাঝামাঝি- এই উপলব্ধি আমার হুমায়ূন আহমেদের উপন্যাস পাঠেই হয়েছে। একই জীবন সময়ের আর্বতে ভিন্ন ভিন্ন রূপে; নানা বিপরীতমুখী অচেনা ভাষায় অজানা আচরণে হাজির হয় তা হুমায়ূন আহমেদ পাঠেই জেনেছি। হুমায়ূন আহমেদ পড়েই আমার নিজেকে জানা বুঝতে চেষ্টা করা। আমরা যারা প্রেমবিহীন বিশেষত প্রেমিকার প্রেম হতে চিরবঞ্চিত হয়ে কলেজ, বিশ্ববিদ্যালয় কাটিয়েছি, অন্যরা কি বলবে জানি না আমার নিজের সকল বঞ্চনার আশ্রয় স্থল হিসেবে হুমায়ূন আহমেদের বই কে অবলম্বন করেছি। হুমায়ূন ভক্ত বলে নি¤œমানের পাঠক বিবেচনায় কেউ যখন আমার দিকে তাচ্ছিলের দৃষ্টিতে তাকায় সত্যি বলছে আমার তাতে কোন আক্ষেপ হয় না। আমি পাঠক হিসেবে হুমায়ূনের বৈচিত্র্যময় দিগন্তে হেঁটে বেড়াতেই স্বাচ্ছন্দ্যবোধ করি। হুমায়ূনের যুক্তির খেলা, আবেগের ভেলায় ভাসা, বিজ্ঞানের সহজ ব্যাখ্যা বা অতি প্রাকৃত জগতে খামখেয়ালি আচরণ, রহস্যপ্রিয়তা, সমান্তরাল জগতের এক টুকরো আলো, গ্রামীণ যুবকের মাঝে অবলীলায় আসা-যাওয়া, স্বার্থ ও স্বার্থহীনতার ছবি মুহূর্তে এঁকে ফেলা, এক বাক্যে কৌতূহল সৃষ্টি করা, নজর অন্যদিকে নিয়ে যাওয়ার -এই যে সৃষ্টিশীলতা, অপার রহস্যময়তা আবার একই সঙ্গে অপূর্ব সরলতার ছবি তা কেবল হুমায়ূন আহমেদের পক্ষেই সম্ভব। চরিত্রের মাঝে হঠাৎ আদিম ভয়ের তীব্র অনুভূতির প্রকাশ, অন্ধকার হতে আলোর বিচ্ছুরণ, শিশুর চোখে সমাজকে দেখা, নিভূত গ্রামে তারা, নক্ষত্রপ্রেমী যুবকের পদচারনা, ধার্মিক ও অবিশ্বাসীর পাশাপাশি জগৎ, সমসাময়িক ও ইতিহাসমুখিতা, বুদ্ধিদীপ্ত রসবোধ, গোছানো চিন্তা, সংক্ষিপ্ত কিন্তু প্রবল কামের প্রকাশ যৌনতামুক্ত শব্দের আবরণে। এ সবই হুমায়ূনের লেখার প্রাণ।
চির অনুসন্ধিৎসু মনে জানার ব্যাকুল আগ্রহ, চমকিত করার অসাধারণ কৌশল, সর্বোপরি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের ভাষায় বললে ‘সহজ কথা কইতে আমায় কহ যে, সহজ কথা যায় না লেখা সহজে’ এই সহজ কথা সহজ ভাষায় লেখার কঠিন কাজটাই অত্যন্ত সুনিপুণভাবে অবলীলায় করেছেন হুমায়ূন আহমেদ। তার চরিত্র যেন আমার মনের কথা বলে। আমার পরিবারের সদস্যদের মতো, বন্ধুবান্ধব, পাড়া-প্রতিবেশীর মতো ঘুরে বেড়ায় আশপাশে। ফলে হুমায়ূনের বই পড়া মানে নিজের পাড়ায় আরেকটা পাড়া তৈরি করে ভিন্ন স্বাদে জীবন কে উপভোগ করা। হুমায়ূন আহমেদ আমার মনের জানালায় উঁকি দেয়া ভোরের সূর্য, মধ্যাহ্নের ঝকঝকে নীল আকাশ, গোধূলীর রক্তিম আলো, রাতের আকাশের পূর্ণিমার চাঁদ, অন্ধকারের তারা।

মন্তব্য করুন

খবরের বিষয়বস্তুর সঙ্গে মিল আছে এবং আপত্তিজনক নয়- এমন মন্তব্যই প্রদর্শিত হবে। মন্তব্যগুলো পাঠকের নিজস্ব মতামত, ভোরের কাগজ লাইভ এর দায়ভার নেবে না।

জনপ্রিয়