ঢাবির সাবেক অধ্যাপক শামসুল হক মোল্লা মারা গেছেন

আগের সংবাদ

বদলে যাচ্ছে মাদকবিরোধী যুদ্ধ

পরের সংবাদ

মেডিকেল টেকনোলজিস্ট সংকট : ১৩ বছর বন্ধ নিয়োগ > দুর্নীতির কারণে নিয়োগ প্রক্রিয়া বাতিল > আইনি জটিলতাও রয়েছে > নমুনা পরীক্ষার চাপ; সময়মতো মিলছে না রিপোর্ট

প্রকাশিত: ফেব্রুয়ারি ১৮, ২০২২ , ১২:০০ পূর্বাহ্ণ
আপডেট: ফেব্রুয়ারি ১৮, ২০২২ , ১২:০০ পূর্বাহ্ণ

সেবিকা দেবনাথ : বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার মানদণ্ড অনুযায়ী ১ জন চিকিৎসকের বিপরীতে থাকতে হবে ৫ জন মেডিকেল টেকনোলজিস্ট। সে হিসাবে দেশে এই পদে প্রয়োজন ১ লাখের বেশি টেকনোলজিস্টের। কিন্তু বাংলাদেশ মেডিকেল টেকনোলজিস্ট এসোসিয়েশনের তথ্য বলছে, বর্তমানে টেকনোলজিস্টের পদ আছে মাত্র ৭ হাজার ৯২০টি। সেখানে কর্মরত আছেন ৫ হাজার ১৬৫ জন। এর মধ্যে মেডিকেল টেকনোলজিস্ট (ল্যাবরেটরি) পদ ২ হাজার ১৮২টি। আর কাজ করছেন ১ হাজার ৪১৭ জন।
সংকট থাকলেও দীর্ঘ এক যুগেরও বেশি সময় ধরে গুরুত্বপূর্ণ এই পদে নিয়োগ প্রক্রিয়া স্থগিত রয়েছে। ২০০৮ সালের পর এই পদে আর কোনো নিয়োগ হয়নি। এ ক্ষেত্রে সবচেয়ে বড় বাধা ছিল কোর্টের স্থগিতাদেশ। করোনা মহামারি শুরু হলে নিয়োগ প্রক্রিয়ার স্থবিরতা কেটে গিয়ে দেখা দেয় আশার আলো। ৩ হাজার টেকনোলজিস্ট নিয়োগের নির্দেশ দেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। সেই নির্দেশনা অনুযায়ী ২০২০ সালের ২৯ জুন ২ হাজার ৬৮৯টি পদে (মেডিকেল টেকনোলজিস্ট ৮৮৯টি, মেডিকেল টেকনিশিয়ান ১ হাজার ৬৫০টি, ১৫০টি কার্ডিওগ্রাফার) নিয়োগের জন্য বিজ্ঞপ্তি দেয় স্বাস্থ্য অধিদপ্তর। এসব পদে লিখিত পরীক্ষা, মৌখিক পরীক্ষা অনুষ্ঠিত হয় ২০২১ সালের ২২ ফেব্রুয়ারি। কিন্তু বন্ধ হয়ে যায় নিয়োগ প্রক্রিয়া। এবার নিয়োগ পরীক্ষায় অনিয়ম ও ঘুষের অভিযোগের পরিপ্রেক্ষিতে ২০২১ সালের ২০ সেপ্টেম্বর সেই নিয়োগ বাতিল করে স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়। এরপর গত ২৮ সেপ্টেম্বর স্বাস্থ্য অধিদপ্তর নতুন এক অফিস নির্দেশনায় জানায়, ২০ সেপ্টেম্বরের নির্দেশনার আলোকে মেডিকেল টেকনোলজিস্ট, টেকনিশিয়ান ও কার্ডিওগ্রাফার পদে চলমান জনবল নিয়োগের কার্যক্রম বাতিল করা হলো। পুনরায় নতুন নিয়োগে স্বল্প সময়ের মধ্যে বিজ্ঞপ্তি দিয়ে দ্রুত নিয়োগের ব্যবস্থা করা হবে। ইতোপূর্বে যারা আবেদন করেছেন, তাদের নতুনভাবে আবেদনের প্রয়োজন নেই; তারা নতুন নিয়োগ পরীক্ষায় অংশ নিতে পারবেন। পরে সে নিয়োগ পরীক্ষা বাতিল চেয়ে আইনি নোটিস পাঠানো হয়।
একদিকে নমুনা পরীক্ষার চাপ অন্যদিকে জনবল সংকট। সেই সঙ্গে মেডিকেল টেকনোলজিস্টদের করোনায় সংক্রমিত হওয়ায় দেখা দিয়েছে চরম সংকট। পরীক্ষার জন্য ল্যাবে নমুনা দিয়েও সময় মতো মিলছে না রিপোর্ট। ফলে করোনা

আক্রান্ত হয়েও অনেকে ঘুরে বেড়াচ্ছেন। দেশে এখন পর্যন্ত সবচেয়ে বেশি নমুনা পরীক্ষা হয়েছে ন্যাশনাল ইনস্টিটিউট অব ল্যাবরেটরি মেডিসিন এন্ড রেফারেল সেন্টারে। নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক প্রতিষ্ঠানের এক মেডিকেল টেকনোলজিস্ট ভোরের কাগজকে বলেন, করোনাকালে ফ্রন্টলাইনারদের মধ্যেও ফ্রন্টলাইনার হচ্ছেন নার্স আর মেডিকেল টেকনোলজিস্টরা। কারণ, তারাই রোগীর সংস্পর্শে বেশি যান। তাই তাদের আক্রান্ত হওয়ার ঝুঁঁকিও বেশি। এই প্রতিষ্ঠানে নমুনা পরীক্ষার কাজটি যারা করেন তাদের পাশাপাশি কর্মকর্তা-কর্মচারীদের অনেকেই করোনায় আক্রান্ত। ল্যাবে কর্মকর্তা বেশ কয়েকজন টেকনোলজিস্ট সংক্রমিত হওয়ায় এবং নমুনার সংখ্যা বেড়ে যাওয়ায় সঠিক সময়ে রিপোর্ট দেয়া যাচ্ছে না।
মেডিকেল টেকনোলজিস্ট নিয়োগ-২০২০ বাস্তবায়ন কমিটির আহ্বায়ক মো. আলমগীর হোসেন বলেন, রোগ নির্ণয়ের মতো গুরুদায়িত্ব পালন এবং করোনা মোকাবিলায় জীবনের ঝুঁকি নিয়ে নমুনা সংগ্রহ, পরীক্ষা-নিরীক্ষা এবং ফলাফল দেয়ার মতো স্পর্শকাতর কাজে নিয়োজিত থাকার পরও স্বাস্থ্য বিভাগ সব সময়ই আমাদের সঙ্গে বিমাতাসুলভ আচরণ করে আসছে, যা অত্যন্ত হতাশার। আমরা মেডিকেল টেকনোলজিস্টরা দীর্ঘদিন ধরে আমাদের বিভিন্ন দাবি দাওয়া কর্তৃপক্ষের কাছে জানিয়ে আসছি। কিন্তু তাদের নির্লিপ্ততার জন্য আমরা স্তম্ভিত।
দীর্ঘ এক যুগেরও বেশি সময় টেকনোলজিস্টদের নিয়োগের ক্ষেত্রে প্রতিবন্ধকতা তৈরি করে ২০০৭ সালে দুটি শিক্ষাব্যবস্থা। ওই সময় শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের অধীনে কারিগরি শিক্ষা বোর্ড থেকে পাস করা মেডিকেল টেকনোলজিস্ট ও স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ের অনুমোদিত ইনস্টিটিউট অব হেলথ টেকনোলজি থেকে পাস করাদের নিয়োগ দেয়া নিয়ে শুরু হয় মামলা ও পাল্টা-মামলা পর্ব। এভাবেই চলতে থাকে। এর মধ্যে টেকনোলজিস্ট নিয়োগে প্রধানমন্ত্রীর নির্দেশে জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয়ের কমিটি একটি সুপারিশ করে, যা বাস্তবায়ন হয়নি। পরে সুপ্রিম কোর্ট আরেকটি আদেশে ‘অন আমব্রেলা কনসেপ্ট’-এর নির্দেশ দিলে সেটিও বাস্তবায়ন হয়নি। এই জট খুলে করোনাকালে ২০২০ সালে। ওই বছর প্রধানমন্ত্রীর নির্দেশে টেকনোলজিস্টদের নিয়োগের ব্যবস্থা হয়। কিন্তু অনিয়ম, ঘুষ ও দুর্নীতির অভিযোগ ওঠায় তা স্থগিত করা হয়। স্বাস্থ্য অধিদপ্তর দ্রুত সময়ের মধ্যে নিয়োগ বিজ্ঞপ্তি দেয়ার কথা বললেও তা করেনি। এর মধ্যে উন্নয়ন সহযোগী সংস্থা গেøাবাল ফান্ডের অর্থায়নে জাতীয় য²া নিয়ন্ত্রণ কর্মসূচির অধীনে একটি প্রকল্পে অস্থায়ী ভিত্তিতে ৩২০ জন মেডিকেল টেকনোলজিস্ট নিয়োগ দেয়া হয় চলতি বছর।
বেকার এন্ড প্রাইভেট সার্ভিসেস মেডিকেল টেকনোলজিস্ট এসোসিয়েশনের সভাপতি মোহাম্মদ শফিকুল ইসলাম ভোরের কাগজকে বলেন, দীর্ঘদিন ধরেই স্বাস্থ্য খাতে মেডিকেল টেকনোলজিস্টের সংকট রয়েছে। তবে করোনা মহামারির সময় এই সংকট ও প্রয়োজনীয়তার বিষয়টি সামনে আসে। ২০০৮ সালের পর এই পদে কোনো জনবল নিয়োগ হয়নি। তবে এই নিয়োগ চূড়ান্ত হয় ২০১১ সালে। এরপর ২০১৩ সালে নিয়োগ বিজ্ঞপ্তি প্রকাশ হয়েছিল। কিন্তু এ নিয়ে মামলা চলায় সেটি নিষ্পত্তি হয় ২০১৬ সালে। এরপর আমাদের আন্দোলনের কারণে এবং প্রধানমন্ত্রীর নির্দেশে ১২শ পদ তৈরি করা হয়। কিন্তু পরীক্ষাসহ সব কিছুর পর দুর্নীতির কারণে সেটি বন্ধ হয়ে যায়। স্বাস্থ্য বিভাগের পক্ষ থেকে বলা হচ্ছে শিগগিরই নিয়োগ বিজ্ঞপ্তি দেয়া হবে। কিন্তু সেটি এখনো হয়নি।
তবে এ ক্ষেত্রে আইনগত জটিলতাও রয়েছে বলেও স্বীকার করেন মোহাম্মদ শফিকুল ইসলাম। তিনি বলেন, নিয়োগ বাতিলের ঘোষণায় উত্তীর্ণদের পক্ষ থেকে আদালতে একটি রিট করা হয়। আদালতে বিষয়টি নিষ্পত্তি না হলে নিয়োগ বিজ্ঞপ্তি দেয়াও সম্ভব হচ্ছে না। এভাবে কালক্ষেপণে অনেক মেডিকেল টেকনোলজিস্টের চাকরির বয়স চলে যাচ্ছে।
উদাহরণ টেনে তিনি বলেন, সংকট কাটাতে ২০১৫ সালে সিনিয়র স্টাফ নার্স ও স্টাফ নার্সদের নিয়োগবিধি শিথিল করে সরকার। নার্সদের চাকরিতে প্রবেশের বয়সসীমা ৩০ থেকে বাড়িয়ে ৩৬ বছর করা হয়। মেডিকেল টেকনোলজিস্টদের ক্ষেত্রেও সরকার এই সিদ্ধান্ত নিতে পারে। একদিকে টেকনোলজিস্টের সংকট অন্যদিকে প্রায় ২৫ হাজার টেকনোলজিস্ট বেকার রয়েছেন। তাদের এডহক ভিত্তিতে নিয়োগ দেয়ারও সুপারিশ করেন তিনি।
বাংলাদেশ মেডিকেল টেকনোলোজিস্ট এসোসিয়েশনের সভাপতি আলমাছ আলী খান ভোরের কাগজকে বলেন, সরকার ডাক্তার, নার্স নিয়োগ দিচ্ছে। কিন্তু মেডিকেল টেকনোলজিস্ট নিয়োগ দিচ্ছে না। নিয়োগ প্রক্রিয়া সম্পন্ন করার পরও দুর্নীতির কথা বলে তা বাতিল করা হয়। এমনিতেই সংকট রয়েছে, সেই সঙ্গে প্রতিটি ল্যাবে একাধিক টেকনোলজিস্ট করোনায় আক্রান্ত হয়ে যখন আইসোলেশনে যান তখন সেই সংকটের তীব্রতা আরো বেশি হয়। জনবল কম হওয়ায় একেকজনকে দ্বিগুণ, কখনো এর চেয়েও বেশি কাজ করতে হচ্ছে। কিন্তু তাতেও দিনের কাজ দিনে শেষ করা যাচ্ছে না। সংকট কাটাতে সরকারকে শিগগিরই উদ্যোগ নিতে হবে। শুধু করোনাকালে নয়, সঠিক রোগ নির্ণয়ের ক্ষেত্রে একজন দক্ষ মেডিকেল টেকনোলজিস্টের গুরুত্ব অপরিসীম। সঠিকভাবে রোগ নির্ণয় করা না গেলে চিকিৎসা কীভাবে হবে?
সংকট কাটাতে স্বাস্থ্য বিভাগ আন্তরিক এবং শিগগিরই এই সমস্যার সমাধান হবে বলে জানান স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের পরিচালক (সংক্রামক রোগ নিয়ন্ত্রণ শাখা) ও মুখপাত্র অধ্যাপক ডা. নাজমুল ইসলাম। তিনি ভোরের কাগজকে বলেন, নিয়োগ পরীক্ষায় অনিয়ম ও ঘুষের অভিযোগের কারণে গত বছর মেডিকেল টেকনোলজিস্ট নিয়োগটি বাতিল করা হয়। এরপর গেøাবাল ফান্ডের অর্থায়নে জাতীয় য²া নিয়ন্ত্রণ কর্মসূচির অধীনে কিছু মেডিকেল টেকনোলজিস্ট নিয়োগ দেয়া হয়। নতুন নিয়োগ বিজ্ঞপ্তি দেয়ার আগে কিছু আইনি জটিলতা নিরসন করা প্রয়োজন। সেই প্রক্রিয়াটিই এখন চলছে। আশা করা যাচ্ছে শিগগিরই এসব জটিলতা নিরসন হবে এবং নতুন নিয়োগ বিজ্ঞপ্তিও হবে। জুন মাসের মধ্যেই এ বিষয়ে কোনো সুখবর পেতে পারি।

মন্তব্য করুন

খবরের বিষয়বস্তুর সঙ্গে মিল আছে এবং আপত্তিজনক নয়- এমন মন্তব্যই প্রদর্শিত হবে। মন্তব্যগুলো পাঠকের নিজস্ব মতামত, ভোরের কাগজ লাইভ এর দায়ভার নেবে না।

জনপ্রিয়