টাইগ্রেসদের উড়ন্ত সূচনা পাকিস্তানকে হারিয়ে

আগের সংবাদ

খুনোখুনি নিয়ে দুশ্চিন্তায় পুলিশ : অবৈধ অস্ত্রের পাশাপশি বেড়েছে বৈধ অস্ত্রের অবৈধ ব্যবহার > চলছে পুলিশের বিশেষ অভিযান

পরের সংবাদ

আওয়ামী লীগের কার্যনির্বাহী পরিষদের সভা : গুরুত্বপূর্ণ কিছু সিদ্ধান্ত

প্রকাশিত: নভেম্বর ২৩, ২০২১ , ১২:০০ পূর্বাহ্ণ
আপডেট: নভেম্বর ২৩, ২০২১ , ১২:৪৩ পূর্বাহ্ণ

গত ১৯ নভেম্বর বিকাল ৪টায় বাংলাদেশ আওয়ামী লীগের কেন্দ্রীয় কার্যনির্বাহী পরিষদের একটি সভা গণভবনে অনুষ্ঠিত হয়। আওয়ামী লীগের কার্যনির্বাহী পরিষদের সভা অধিকাংশ সময়ে বেশ নিয়মিতই অনুষ্ঠিত হয়। বাংলাদেশের যে কোনো ছোট বা বড় রাজনৈতিক দলের কার্যনির্বাহী পরিষদের সভা ততটা নিয়মিত হয় বলে শোনা যায় না। আওয়ামী লীগ অন্তত গঠনতন্ত্রের এই বিধানটি নিয়মিত অনুসরণ করে আসছে। যেহেতু এখন আওয়ামী লীগ দেশ পরিচালনায় সরকারের দায়িত্বে আছে তাই দলের কার্যনির্বাহী পরিষদের সভায় শুধু দলের রাজনীতিই নয়, দেশের অনেক গুরুত্বপূর্ণ বিষয়ও আলোচনা এবং সিদ্ধান্ত গ্রহণ করা হয়, যা দল এবং সরকারের জন্য গুরুত্ব বহন করে থাকে। দলের গুরুত্বপূর্ণ সিদ্ধান্ত কার্যকর করা এখন সরকারের পক্ষে খুব বেশি সমস্যা হয় না। তাছাড়া জনস্বার্থে অনেক সিদ্ধান্ত কার্যকর করাও বেশ সহজ হয়। সেদিক থেকে বিবেচনা করলে আওয়ামী লীগের কার্যনির্বাহী পরিষদের সভা অনুষ্ঠিত হওয়া এবং সিদ্ধান্ত গ্রহণের গুরুত্বকে বিশেষভাবে বিবেচনায় নেয়া যেতে পারে। গত শুক্রবার অনুষ্ঠিত সভাটি এই সময়ে বেশ আলোচনার সুযোগ করে দিয়েছে, একই সঙ্গে আওয়ামী লীগের দলীয় ভাবমূর্তি কোনো কোনো সিদ্ধান্তে উজ্জ্বল হওয়ার সম্ভাবনাও দেখা দিয়েছে। নানা সমালোচনা ও সীমাবদ্ধতার পরও আওয়ামী লীগ দলীয়ভাবে বেশ দৃঢ় অবস্থানের প্রকাশ ঘটাতে পারে সেটিও এই সভায় কিছু কিছু সিদ্ধান্ত থেকে বোঝা যাচ্ছে।
গত শুক্রবারের সভায় গৃহীত কয়েকটি সিদ্ধান্তের মধ্যে গাজীপুর সিটি করপোরেশনের মেয়র জাহাঙ্গীর আলমকে দল থেকে বহিষ্কার করা এবং মেয়র পদ থেকে আইনানুগ পদ্ধতিতে বহিষ্কারের ব্যাপারে দলের অবস্থান এখন দেশব্যাপী সবচেয়ে আলোচিত বিষয়। সরকার থেকেও তার বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেয়ার আইনগত দিকগুলো খতিয়ে দেখা হচ্ছে বলে স্থানীয় সরকার ও পল্লী উন্নয়নমন্ত্রী তাজুল ইসলাম সাংবাদিকদের জানিয়েছেন। এরই মধ্যে মেয়র জাহাঙ্গীর আলম গাজীপুরে নিজ বাসভবনে কান্নাজড়িত কণ্ঠে দলীয় সভাপতির কাছে ক্ষমা চেয়ে তার সদস্যপদটি রাখার অনুরোধ করেছেন। সেটি সম্ভব না হলে আওয়ামী লীগের সমর্থক হয়েও তিনি থাকতে চাচ্ছেন বলে গণমাধ্যমের সম্মুখে জানিয়েছেন। মেয়র জাহাঙ্গীর আলমের বিরুদ্ধে সর্বশেষ অভিযোগ, তিনি জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান এবং মুক্তিযুদ্ধ সম্পর্কে অডিও ক্লিপে বিতর্কিত মন্তব্য করেছেন। সেটি প্রমাণ হওয়ায় তার বিরুদ্ধে দল ও আদর্শ পরিপন্থি কাজ করায় সাংগঠনিক প্রক্রিয়ায় তাকে ওইদিনের অনুষ্ঠিত সভায় দল থেকে বহিষ্কারের চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত গ্রহণ করা হয়। মেয়র জাহাঙ্গীরের বিরুদ্ধে শৃঙ্খলাবিরোধী কর্মকাণ্ডে জড়িত থাকার অভিযোগ এটিই একমাত্র নয়। ২০১৩ সালে অনুষ্ঠিত গাজীপুর প্রথম সিটি নির্বাচনে তার বিরুদ্ধে যথেষ্ট অভিযোগ থাকার পরও তিনি ২০১৫ সালে গাজীপুর মহানগর আওয়ামী লীগের দলীয় সাধারণ সম্পাদক এবং ২০১৮ সালে সিটি করপোরেশন নির্বাচনে মেয়র পদে মনোনয়ন লাভ করেন। মেয়র পদে নির্বাচিত হওয়ার পর বাহ্যিকভাবে তিনি নিজেকে একজন সফল তরুণ মেয়র হিসেবে দেখানোর চেষ্টা করলেও ভেতরে ভেতরে তার কর্মকাণ্ডের মধ্যে স্বেচ্ছাচারিতা, হঠকারিতা এবং আইন ও শৃঙ্খলাবিরোধী কর্মকাণ্ডের অভিযোগের পাহাড় জমা হতে থাকে। তিনি হয়তো এসবকে পাত্তা না দিয়ে নিজের মতোই চলতে চেয়েছিলেন। তার হয়তো ধারণা ছিল দলের মধ্যে যাদের সমর্থনে তিনি এত কিছু পেয়ে গেছেন, তারাই তাকে রক্ষা করবেন। কিন্তু এভাবে যে রাজনীতিতে শেষ রক্ষা সবসময় হয় না সেটি তরুণ এই ‘রাজনীতিবিদ ও মেয়র’ বুঝতে চাননি। অনেকটাই ভারসাম্যহীনতা হারিয়ে তিনি তার মতো করে চলছিলেন। চলতে গিয়ে তিনি জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু এবং মুক্তিযুদ্ধ সম্পর্কেও কথা বলতে খেই হারিয়ে ফেলেছেন, বেসামালা হয়ে পড়েছেন। এটি তার রাজনৈতিক অভিজ্ঞতার অভাবই শুধু নয়, শিক্ষাদীক্ষা, আদর্শের প্রতি নিষ্ঠা, সততারও অভাবের পরিচয় বহন করে। তার এবং তার পরিবারের বিরুদ্ধে বিত্তবৈভবের অভিযোগ অনেকদিন থেকেই উচ্চারিত হয়ে আসছে। একদিকে ক্ষমতা অন্যদিকে অর্থবিত্ত, ক্যাডার বাহিনী এবং রাজনীতির অভিজ্ঞতার অভাব তাকে অনেক আগ থেকেই দলের শৃঙ্খলাবিরোধী কাজ করার পরিণতি সম্পর্কে বৃদ্ধাঙ্গুলি দেখানোর সুযোগ করে দিয়েছে। সে কারণেই তার পক্ষে অন্তত গত এক যুগ ধরে গাজীপুরে যেমন খুশি তেমনিভাবে চলার মনোভাব তৈরি করে দিয়েছে। তবে তার এই উত্থানের পেছনে দলের কারো না কারো নীরব সমর্থন থাকতে পারে। অন্তত ২০১৩ সালের নির্বাচনে তার নেতিবাচক ভূমিকা থাকার পর তার আর আওয়ামী রাজনীতিতে শনৈঃ শনৈঃ উত্থান ঘটার কথা ছিল না। কিন্তু তিনি তো শুধু উঠেনইনি, সবকিছু তার নিয়ন্ত্রণে নিতেও পেরেছেন। এটিই আওয়ামী লীগের মতো একটি দলে হওয়ার কথা নয়। এতে দলের ভাবমূর্তি যেমন ক্ষতিগ্রস্ত হয়, দলের ভেতরে সুবিধাবাদী, দুর্নীতিবাদ, শৃঙ্খলাবিরোধী নেতাকর্মীরাও বেপরোয়া হয়ে ওঠার দৃষ্টান্ত খুঁজে পায়। বিশেষত দল ক্ষমতায় আসার পর এই প্রবণতাটি আমাদের মতো দেশে রোধ করা খুবই কঠিন কাজ। আওয়ামী লীগের মধ্যে বিভিন্ন সময় স্থানীয় কোনো কোনো নেতার কর্মকাণ্ড নিয়ে গণমাধ্যমে এমনকি সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমেও বেশ কিছু লাইভ ভাইরাল হতে দেখা যায়। তাতেও কারো কারো নিয়ন্ত্রণহীন, বেপরোয়া ও বেসামাল উক্তির জন্য দল ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে। অথচ দলীয় সভাপতি বঙ্গবন্ধুকন্যা শেখ হাসিনা ৪০ বছর ধরে দলকে নেতৃত্ব দিয়ে এসেছেন। দেশ শাসনের সুযোগ পেয়ে তিনি বাংলাদেশের আর্থ-সামাজিক এবং আন্তর্জাতিকভাবে যে পর্যায়ে উন্নীত করেছেন তা অভাবনীয় ও ঈর্ষণীয়। জনগণের সচেতন অংশ তার সততা, দেশপ্রেম এবং রাষ্ট্র পরিচালনার দক্ষতা এক বাক্যে স্বীকার করে, তাকে দেশ পরিচালনায় অদ্বিতীয় হিসেবেই বিবেচনা করে থাকেন। কিন্তু আওয়ামী লীগের মধ্যে একদিকে যেমন ত্যাগী নেতাকর্মী রয়েছেন, অন্যদিকে জাহাঙ্গীর আলমের মতো নেতাকর্মীরও অভাব কম নেই। তারা স্থানীয়ভাবে আওয়ামী লীগের অর্জনকে মøান করে দিচ্ছে। বিষয়গুলো নিয়ে অনেকদিন থেকেই আলোচনা গণমাধ্যমে উঠে আসছে। করোনা সংক্রমণের আগে শেখ হাসিনা দল এবং দলের অঙ্গসংগঠনকে ওইসব দুর্নীতিপরায়ণ নেতাকর্মীদের হাত থেকে মুক্ত করার উদ্যোগ নিয়েছিলেন। সেটি অনেকদূর এগিয়েও গিয়েছিল। কিন্তু করোনার কারণে সেটি এতদিন চাপা পড়েছিল। কিন্তু জাহাঙ্গীর আলমের বিরুদ্ধে গৃহীত ব্যবস্থা দলীয় সভাপতির কঠোরতা আরো দৃঢ়ভাবে স্পষ্ট হয়ে উঠেছে। কেন্দ্রীয় কার্যনির্বাহী কমিটিও দলীয় প্রধানের সঙ্গে একাত্ম হয়েছে- এটি একটি অনুকরণীয় দৃষ্টান্ত হয়ে থাকবে। আশা করা যাচ্ছে দেশব্যাপী বার্তাটি সহজেই ছড়িয়ে পড়েছে। জনগণের কাছে এটি অত্যন্ত ইতিবাচক মনোভাব তৈরি করতে পারছে বলে মনে হচ্ছে। সামনের দিনগুলোতে দলের ভাবমূর্তি নষ্টকারীদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেয়া, নির্বাচনে মনোনয়ন না দেয়া, দল থেকে সরিয়ে দেয়া এবং প্রচলিত আইনে বিচারের সম্মুখীন করার দৃষ্টান্ত যত সৃষ্টি হবে, তত বেশি আওয়ামী লীগের সমর্থন ও ভাবমূর্তি বেড়ে যাওয়ার সম্ভাবনা থাকবে।
ইউপি নির্বাচন নিয়েও দল যে সিদ্ধান্ত নিয়েছে তাতে মনোনীত ও বিদ্রোহী প্রার্থিতা নিয়ে যে দ্ব›দ্ব-সংঘাত ও দলীয় উচ্ছৃঙ্খলা তৈরি হয়েছে সেটি গভীরভাবে অনুসন্ধানের মাধ্যমে তুলে আনা দরকার। ইউপি নির্বাচনে দলীয় প্রার্থী মনোনয়নে মন্ত্রী, এমপি বা স্থানীয় নেতা নয়, বরং দলের সাংগঠনিক তৃণমূল কমিটি থেকে উচ্চ পর্যায় পর্যন্ত প্রভাব ও দুর্নীতিমুক্তভাবে ত্যাগী, আদর্শ ও নিষ্ঠাবানদের মনোনীত করার প্রক্রিয়ায় যাদের দুর্বলতা থাকবে তাদের জবাবদিহি করার ব্যবস্থা থাকা দরকার, তাহলেই দ্ব›দ্ব-সংঘাত এবং হানাহানি এড়ানো সম্ভব হতে পারে।
বৈঠকে সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতি বিনষ্ট, বেগম খালেদা জিয়ার ইস্যু নিয়ে রাজনীতি, বিদেশে বসে একটি গোষ্ঠীর আওয়ামী লীগ ও দেশবিরোধী অপপ্রচার চালানো এবং দেশের অভ্যন্তরেও কেউ কেউ সরকারের বিরুদ্ধে অপপ্রচার ও ষড়যন্ত্র করার বিষয় নিয়েও আলোচনা হয়। এসব আলোচনার সঠিক জবাব দেয়ার জন্য দলীয় প্রধান শেখ হাসিনা দলের নেতাকর্মীদের আহ্বান জানান। দীর্ঘদিন ক্ষমতায় থাকার পরও আওয়ামী লীগ দলীয় প্রচার-প্রচারণায় জনমনস্তত্ত্বের দিকগুলোকে এখনো সঠিকভাবে মূল্যায়ন পূর্বক বক্তৃতা, বিবৃতি এবং গণমাধ্যমে পাওয়া সুযোগ দক্ষতার সঙ্গে কাজ লাগাতে সক্ষম হচ্ছে না যে সেটি নিয়ে সচেতন মহলে এখনো প্রশ্ন রয়েছে। বিষয়টি গুরুত্বের সঙ্গে এখনই নেয়া দরকার। দলের কার্যনির্বাহী পরিষদে তিনটি আসন ফাঁকা হওয়ায় মোফাজ্জল হোসেন চৌধুরী মায়া, কামরুল ইসলাম ও খায়রুজ্জামান লিটনকে অন্তর্ভুক্ত করা হয়েছে।
বেগম খালেদা জিয়ার চিকিৎসা বিদেশে নিতে বিএনপি উচ্চ আদালতে সরকারি-বেসরকারি মেডিকেল বোর্ডের সুপারিশ উপস্থাপনের মাধ্যমে জামিনের আবেদন না করে রাজপথে আন্দোলন সংগঠিত করে সরকারকে ‘গদিচ্যুত’ করার যে হুমকি দিয়েছে তাতে আওয়ামীবিরোধী সব শক্তিরই সমাবেশ ধীরে ধীরে ঘটার লক্ষণ দেখা যাচ্ছে। কার্যনির্বাহী পরিষদে গৃহীত সিদ্ধান্ত অনুযায়ী দেশের মানুষকে আইন, বিচার সরকার ও দলের অবস্থান যেমন স্পষ্ট করা দরকার, বিরোধী দলের রাজনৈতিক উদ্দেশ্যও তুলে ধরা প্রয়োজন। জনমনে আইন, বিচার এবং সরকারের ক্ষমতা নিয়ে অজ্ঞতা বিভ্রান্তি রয়েছে। সেটি নিরসন করা গেলে দলের কার্যনির্বাহী পরিষদে গৃহীত সিদ্ধান্ত বড় ধরনের ভূমিকা রাখতে পারে বলে মনে করা যায়।

মমতাজউদ্দীন পাটোয়ারী : অধ্যাপক (অবসরপ্রাপ্ত), ইতিহাসবিদ ও কলাম লেখক।
[email protected]

মন্তব্য করুন

খবরের বিষয়বস্তুর সঙ্গে মিল আছে এবং আপত্তিজনক নয়- এমন মন্তব্যই প্রদর্শিত হবে। মন্তব্যগুলো পাঠকের নিজস্ব মতামত, ভোরের কাগজ লাইভ এর দায়ভার নেবে না।

জনপ্রিয়