নানা আয়োজনে প্রবারণা পূর্ণিমা উদযাপন

আগের সংবাদ

লো স্কোরিংয়ের রোমাঞ্চকর ম্যাচে অস্ট্রেলিয়ার জয়

পরের সংবাদ

অপশক্তির বিরুদ্ধে জেগে ওঠার আহ্বান

প্রকাশিত: অক্টোবর ২৩, ২০২১ , ১২:০০ পূর্বাহ্ণ
আপডেট: অক্টোবর ২৩, ২০২১ , ১২:০০ পূর্বাহ্ণ

দুর্গা পূজাকে কেন্দ্র করে সম্প্রতি দেশের বিভিন্ন স্থানে সাম্প্রদায়িক হামলার ঘটনা ঘটছে। সনাতনধর্মালম্বীদের বাড়ি, ব্যবসা প্রতিষ্ঠান এমনকি মন্দিরেও হামলা চালানো হয়েছে। পুড়িয়ে দেয়া হয়েছে বাড়িঘর। সাম্প্রদায়িক হামলা ও সহিংসতায় ক্ষোভ প্রকাশ করেছেন ঢাকার শোবিজের তারকারা। করছেন প্রতিবাদও। সহিংসতা প্রসঙ্গে কয়েকজন সাংস্কৃতিক ব্যক্তিত্বের মতামত তুলে ধরা হলো। গ্রন্থনা : রেজা শাহীন

সাংস্কৃতিক কর্মীদের সংঘবদ্ধ আন্দোলন
করতে হবে
মামুনুর রশীদ

উপমহাদেশের মধ্যে বাংলাদেশকে সবচেয়ে সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতির দেশ হিসেবে মনে করা হয়। সম্প্রীতিতে বাংলাদেশ ভারত-পাকিস্তানের চেয়েও এগিয়ে। রংপুরের পীরগঞ্জে এতগুলো ঘর-বাড়ি জ্বালিয়ে দেয়া হলো অথচ আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী তাদের নিরাপত্তা দিতে পারল না। শুধু রংপুর নয়, দেশের বিভিন্ন জায়গায় এমন ধ্বংসযজ্ঞ চলেছে যেখানে প্রশাসনের সহযোগিতা পাননি ভুক্তভোগীরা। এটি দুঃখজনক। এসব ঘটনা দেখে সত্যিই আমি আঘাত পেয়েছি মনের ভেতর। স্বাধীনতার ৫০ বছর পরেও সাম্প্রদায়িক শক্তির এমন উত্থান চিন্তার বিষয়। এই ধরনের সহিংসতা ঘটিয়ে সম্প্রীতি নষ্ট করার চেষ্টা করা হচ্ছে। একটা গোষ্ঠী দেশের মানুষকে উসকে দিচ্ছে। সত্যিকারের ধর্মপ্রাণ মানুষ সহিংসতা করে না, এসব সুবিধাভোগীর কাজ। এসব অপকর্ম দমন করার সামর্থ্য সরকারের যেমন আছে, তেমনি জনগণেরও। আমাদের দেশের প্রগতিশীল দলগুলোর উচিত মাঠে নেমে এর বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়ানো। শুধু বিবৃতি দিলেই এর সমাধান হবে না। শুধু আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী দিয়ে এসব দমন সম্ভব নয়। রাজপথে নেমে প্রতিবাদ করতে হবে। সাধারণ মানুষ ছাড়াও সাংস্কৃতিক কর্মীদের সংঘবদ্ধ আন্দোলন করতে হবে।
সংঘবদ্ধ আন্দোলনই পারে শান্তির বার্তা পৌঁছে দিতে। সব মানুষকে নিয়েই এই দেশ- এটা মনে রাখতে হবে আমাদের।

শুধু আইনের প্রয়োগ করে এ ধরনের ঘটনা বন্ধ করা যাবে না
ফেরদৌসী মজুমদার

এ ধরনের ঘটনা তো নতুন নয়, বারবার ঘটছে। এটি খুবই দুঃখজনক। দিন দিন এসব সহিংসতা বেড়েই চলছে। ভেবেছিলাম এবার কোনো অপ্রীতিকর ঘটনা ঘটবে না। কিন্তু আবারো পুরনো ঘটনার পুনরাবৃত্তি দেখলাম। আবারো মনে করিয়ে দিল দেশে এখনো ঘাপটি মেরে বসে আছে অপশক্তি। এসব ঘটনা দেখে এটাই মনে হয়, দিনে দিনে মানুষ পশু হয়ে যাচ্ছে। কারা এসব ঘটনার ইন্ধন দিচ্ছে, কারা ফায়দা লুটছেন সেসব শত্রæকে যদি চিহ্নিত করা না যায় তাহলে এর সমাধান হবে না। সম্প্রীতির দেশ হিসেবে সারা বিশ্বে বাংলাদেশের যে সুনাম ছিল সেটি নষ্ট করে দেয়া হয়েছে। বারবার এসব ঘটনা ঘটবার পর প্রতিবাদ হয়, মানববন্ধন হয়। কিন্তু কোনো ফল হয় না। তাই আমার মনে হয় বিষয়টি নিয়ে আমাদের অন্যভাবে ভাবা উচিত। শুধু আইনের প্রয়োগ করে এ ধরনের ঘটনা বন্ধ করা যাবে না। মানুষের মনুষত্ববোধ জাগ্রত করতে হবে। আমাদের বাসার পাশেই হিন্দু পরিবার ছিল। তাদের পূজা হতো। আমরা ওখানে যেতাম। বাবা কোনোদিন ওদের ওখানে যেতে নিষেধ করতেন না। ওরা হিন্দু- আমাদের মাথার ভেতরে ঢোকানো হয়নি। আসলে আমরা সম্প্রীতির বাংলাদেশ থেকে অনেকটা সরে গেছি। দেশের শান্তির জন্য, নিজেদের মধ্যে সম্প্রীতি অটুট রাখার জন্য আমাদের মানবিক হওয়ার চর্চা করতে হবে। সাধারণ জনগণের মধ্যে যে কোনো অন্যায়ের বিরুদ্ধে প্রতিবাদ করার মানসিকতা তৈরি করতে হবে।

এ রকম ঘটনা আমাদের জন্য ভীষণ লজ্জার
আবুল হায়াত

কুমিল্লার ঘটনাকে কেন্দ্র করে দেশের বিভিন্ন স্থানে যে পরিস্থিতির সৃষ্টি হয়েছে এটি অত্যন্ত দুঃখজনক। এ ধরনের ন্যক্কারজনক ঘটনার পেছনে কাদের ইন্ধন আছে তা স্পষ্ট নয়। সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতির দেশ হিসেবে বাংলাদেশের যে সুনাম ছিল সেটি আর রইল না। অভিনেতা হিসেবে নয়, একজন সাধারণ মানুষ হিসেবে মনে করি এ রকম ঘটনা আমাদের জন্য ভীষণ লজ্জার এবং হতাশার। সবচেয়ে বড় কথা হচ্ছে, এসব সমস্যা সমাধান করতে হলে সামাজিক আন্দোলন গড়ে তুলতে হবে। ধর্ম, বর্ণ, নির্বিশেষে সবাইকে অন্যায়ের বিরুদ্ধে প্রতিবাদ করতে হবে। জনসাধারণের কথা তো এখন কেউ মনে রাখতে চায় না। রাজনৈতিক দল ও সামাজিক আন্দোলনকারীদের জনসাধারণের সঙ্গে মিশতে হবে, সবাইকে বোঝাতে হবে। তাহলেই এসবের বিরুদ্ধে মানুষ সোচ্চার হবে। এসব সহিংসতা দমনের ক্ষেত্রে জনগণের চেয়ে সরকারের ভূমিকা গুরুত্বপূর্ণ। আশা করি সরকার বিষয়টিকে গুরুত্ব দিয়ে দেখবে। সরকারের পাশাপাশি রাজনৈতিক দলগুলোর দায়িত্বও আছে। রাজনৈতিক দলের উচিত সরকারের সঙ্গে কাঁধে কাঁধ মিলিয়ে সমস্যা সমাধানের জন্য কাজ করা। আমাদের দেশে আর এই ঘটনার পুনরাবৃত্তি চাই না। সেই সঙ্গে চাইব পৃথিবীর কোথাও এমন ঘটনা না ঘটুক।

এই বাংলাদেশ আমার সন্তানদের দিয়ে যেতে চাই না
মেহের আফরোজ শাওন

মুসলিম পরিবারে জন্ম আমার। ছোটবেলায় হুজুর রেখে সিপারা, আমপারা, কুরআন পড়িয়েছেন মা-বাবা। স্কুলে ‘ইসলাম শিক্ষা’ নামক একটি বিষয় ছিল। সনাতন ধর্মের শিক্ষার্থীদের সেই ক্লাস বাধ্যতামূলক না থাকলেও দু-একজন বন্ধু সেই ক্লাসও করত। কখনো তাকে আলাদা চোখে দেখতে শেখাননি আমাদের শিক্ষকরা। তাই ‘সাহা, চক্রবর্তী কিংবা সেন’ কে ‘আহমেদ, রহমান কিংবা হোসেন’-এর সঙ্গে পার্থক্য করিনি কখনো। নাচ শিখতাম শুক্লা সরকারের কাছে। আমি মুসলিম বলে আমার এই নৃত্যগুরু নিজ কন্যাদের চেয়ে এক বিন্দু আলাদা করে দেখেননি কোনোদিন। বরং কোনো কোনো ক্ষেত্রে প্রশ্রয়ই পেয়েছি। শিল্পী হিসেবে সেই শৈশব থেকেই নাচ-গান করেছি ঈদের অনুষ্ঠানের পাশাপাশি পূজার উৎসবেও। আমার সনাতন বন্ধুটিকে যেমন ঈদের সেমাই খেতে আমার বাড়িতে ডেকেছি তেমনি আমিও গিয়েছি নাড়– খেতে। বাক্স ভরে নিয়েও এসেছি তার মাকে বলে। কোনোদিন কোনো সাম্প্রদায়িক চিন্তা মাথায় তো আসেনি। সত্যি বলতে ‘সাম্প্রদায়িকতা’ শব্দটিই বোঝার দরকার হয়নি আমাদের কখনো। কিন্তু আজ এ কোন বাংলাদেশে আছি আমরা। কী শিখাচ্ছি আমাদের সন্তানদের। কোন বাংলাদেশ দিয়ে যাচ্ছি পরবর্তী প্রজন্মের হাতে।
যে বাংলাদেশে সামাজিক মাধ্যমে একজন সনাতন ধর্মাবলম্বী ‘ঈদ মুবারক’ লিখলে সবাই আলহামদুলিল্লাহ বলেন কিন্তু একজন মুসলিম ‘শুভ বিজয়া’ লিখলেই তার গোষ্ঠী উদ্ধার করতে ঝাঁপিয়ে পড়েন শত শত মানুষ, যে বাংলাদেশে অন্য ধর্মের অনুসারীদের নিজ ধর্মীয় উৎসব পালনের কোনো স্বাধীনতা নেই, যে বাংলাদেশে সনাতন ধর্মের সবচেয়ে বড় উৎসবে ভেঙে দেয়া হয় তাদের দেবীর মূর্তি- এই বাংলাদেশ আমার সন্তানদের দিয়ে যেতে চাই না।
রাতের আঁধারে পুড়িয়ে দেয়া হলো হিন্দুদের ঘর-বাড়ি, লুটতরাজ করা হলো তাদের দোকানপাট। স্বাধীনতার এত বছর পার করলাম আমরা। এখনো আমাদের দেশে এ রকম জঘন্য ঘটনা ঘটতে পারে, এটি মেনে নিতে কষ্ট হয়।
আমি সেই আগের বাংলাদেশ চাই। সেই সম্প্রীতির বাংলাদেশ চাই। এ ধরনের সহিংসতা যেন ভবিষ্যতে ঘটতে না পারে সেজন্য প্রতিবাদ গড়ে তুলতে হবে।

স্বাধীনতার সুবর্ণজয়ন্তী উদযাপনে যেন কালো একটা পর্দা পড়ে গেল
সুবর্ণা মুস্তাফা

গত কয়েকদিন ধরে এক বিশ্রী অনুভূতির মধ্যে বসবাস করছি। গøানি, দুঃখ, ক্ষোভ সব কিছু মিলেমিশে একাকার। স্বাধীনতার সুবর্ণজয়ন্তী উদযাপনে যেন কালো একটা পর্দা পড়ে গেল। ৩০ লাখ শহীদ আর ৩ লাখ নারীর সর্বোচ্চ ত্যাগকে অসম্মানিত হতে দেখলাম। বঙ্গবন্ধুর ধর্মনিরপেক্ষ সোনার বাংলাকে ধর্মের ধুয়াধারীরা কলুষিত করতে উদগ্রীব। কিন্তু আর না। নতুন করে যুদ্ধ শুরু করতে হবে। দেশকে এই কুচক্রীদের হাত থেকে মুক্ত করতে হবে। যারা ষড়যন্ত্র করে আমাদের সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতি নষ্ট করতে চাইছে, দেশকে অস্থিতিশীল করতে চাইছে, তাদের বলছি- ‘বারে বারে ঘুঘু তুমি খেয়ে যাও ধান, এবার ঘুঘু তোমার বধিব পরাণ’। জগন্নাথ হল যখন ভেঙে পড়ল, আমি বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ি। হাজার হাজার ছাত্রছাত্রী, সাধারণ মানুষ, ডাক্তার, নার্স সারাদিন-সারারাত সবাই একসঙ্গে উদ্ধারে কাজ করেছে। রক্ত দেয়া, ওষুধ আনার কাজ করে গেছি। মানুষ মানুষের পাশে দাঁড়িয়েছে। সেই বাংলাদেশ আমরা ফেরত চাই।
বাংলাদেশ এখন পুরোটাই ডিজিটাল। অপরাধীরা চিহ্নিত, তাদের আইনের আওতায় নিয়ে আসা হবে। আইনের শাসন দিয়েই তারা শাস্তি পাবে। সহনশীল হওয়ার দিন শেষ। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বলেছেন ‘কাউকে ছাড় দেয়া হবে না’। মানে কাউকেই ছাড় দেয়া হবে না। ধর্ম যার যার উৎসব সবার, সব ধর্মের প্রতি সমান সম্মান।
ঘটনা যা যা ঘটেছে সেটা ঠিকঠাক তদন্ত করে সবার সামনে তুলে ধরা উচিত
মোস্তফা সরয়ার ফারুকী

যাদের যাদের আমরা দেখি হিন্দু সম্প্রদায়ের মানুষ বা তাদের দেব-দেবী নিয়ে অশ্লীল গালিগালাজ করে, প্রতিমা ভাঙতে সেøাগান দেয়, এরা জানেও না সীমান্তের ওই পাড়ে যদি কোনো হিন্দু পরিবারে তাদের জন্ম হতো তাহলে তারা আসলে জয় শ্রীরাম বলে মুসলমানদের নবী-রাসুলদের গালিগালাজ করত, মসজিদ ভাঙত। পূজার শুভেচ্ছা জানালে গত কয় বছর হয় দেখি একদল লোক তেড়ে আসে। এরাই আবার জাস্টিন ট্রুডো ঈদ মুবারক জানালে গলে পড়ে, ভারতে সংখ্যালঘুর অধিকার নিয়ে জিকির তোলে। এই যে একটা বিশাল জনগোষ্ঠী ছড়িয়ে আছে জগৎজুড়ে, এসবকে কী করা যাবে, কবে এদের চিন্তার জগৎ বদলাবে- এসব ভাবলে গায়ে জ্বর চলে আসে। যা যা ঘটেছে সেটা ঠিকঠাক তদন্ত করে সবার সামনে তুলে ধরা উচিত। দ্রুততার সঙ্গে আগামীতে যেন এই রকম কিছু না ঘটে তার জন্য যা যা ব্যবস্থা নেয়ার সেটা নেয়া। আলেম সম্প্রদায়ের উচিত এ ঘটনার নিন্দা করে বয়ান দেয়া।
তবে সবচেয়ে বেশি দরকার যেটা সেটা হচ্ছে, প্রত্যেকেই যার যার জায়গা থেকে এ ঘটনার নিন্দা করা। হিন্দু বন্ধু এবং প্রতিবেশীকে জানানো, তুমি একা নও। এখন তাকে একা বোধ না করতে দেয়াই হচ্ছে সবচেয়ে বড় কাজ। এই সময় এক জগৎবিধ্বংসী ক্ষোভ-অভিমান চেপে বসে।
তার হাতটা চেপে ধরে বলি চলেন, ‘ইউ আর নট অ্যালোন’। আমরা প্রত্যেকেই কোনো না কোনোভাবে সংখ্যালঘু। কেউ রাজনৈতিক সংখ্যালঘু, কেউ সামাজিক সংখ্যালঘু, কেউ অর্থনৈতিক সংখ্যালঘু। ফলে দুর্বলের বেদনা, মজলুমের জ্বালা তো আমাদের না বোঝার কথা না। আল্লাহ যেন আমাদের সব প্রকার মজলুমের বেদনা উপলব্ধি করার তৌফিক দান করেন। অন্য দেশে সংখ্যালঘু মুসলমানকে অত্যাচার করলে আমাদের হৃদয় যেমন ব্যথিত হয়, নিজের দেশে সংখ্যালঘু হিন্দু বা অন্য কেউ অত্যাচারিত হলেও আমাদের হৃদয় যেন একইভাবে উপলব্ধি করতে পারে, আল্লাহ যেন আমাদের এই তৌফিক দান করেন।

মন্তব্য করুন

খবরের বিষয়বস্তুর সঙ্গে মিল আছে এবং আপত্তিজনক নয়- এমন মন্তব্যই প্রদর্শিত হবে। মন্তব্যগুলো পাঠকের নিজস্ব মতামত, ভোরের কাগজ লাইভ এর দায়ভার নেবে না।

জনপ্রিয়