চাঁদাবাজির মামলা ৪ দিনের রিমান্ডে দর্জি মনির

আগের সংবাদ

বন্যার পদধ্বনি : পদক্ষেপ এখনই নিতে হবে

পরের সংবাদ

রপ্তানিতে নতুন সম্ভাবনা ও পাটের ন্যায্যমূল্য

প্রকাশিত: আগস্ট ৬, ২০২১ , ১২:০০ পূর্বাহ্ণ
আপডেট: আগস্ট ৬, ২০২১ , ১২:০০ পূর্বাহ্ণ

করোনা ভাইরাস মহামারির মধ্যে পরিবেশ দূষণের বিষয়টি সারা বিশ্বে জোরালোভাবে আলোচিত হচ্ছে। এরই মধ্যে সদ্যসমাপ্ত ২০২০-২১ অর্থবছরে চামড়াকে পেছনে ফেলে পাট ও পাটজাত পণ্য হয়ে উঠেছে দেশের দ্বিতীয় রপ্তানি খাত। রপ্তানি বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে কৃষকও ভালো দাম পাচ্ছেন পাটের। পাটের ফলন বৃদ্ধি ও গুণগতমানের আঁশ উৎপাদনে কৃষকের মধ্যেও আগ্রহ লক্ষ করা যাচ্ছে বেশ।
পাট বাংলাদেশের অন্যতম অর্থকরী ফসল। জমির উর্বরতা বৃদ্ধি, পরিবেশের ভারসাম্য রক্ষা, কর্মসংস্থান ও বৈদেশিক মুদ্রা অর্জনে পাটের ভূমিকা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। এছাড়া পাট আমাদের ইতিহাস ঐতিহ্যের সঙ্গে ওতপ্রোতভাবে জড়িত। ১৯৫৪ সালের যুক্তফ্রন্টের নির্বাচনের ২১ দফা ও ১৯৬৬ সালের ঐতিহাসিক ৬ দফায় পাট চাষিদের অধিকারের কথা উল্লেখ আছে। আমার জীবনেই দেখেছি। কৃষক শ্রাবণ-ভাদ্র মাসে বাজারে নতুন পাট বিক্রি করে নতুন শাড়ি ও রুপালি ইলিশ কিনে বাড়ি ফিরতেন। ভাজা ইলিশের গন্ধে মুখরিত হয়ে উঠত গ্রাম। সরকারি হিসাবে দেশে পাট চাষির সংখ্যা ৪০ লাখ হলেও দেশের মোট জনসংখ্যার প্রায় ২০ শতাংশ পাট চাষ এবং চাষ-পরবর্তী বিভিন্ন কর্মকাণ্ড, যেমন প্রক্রিয়াজাতকরণ, ঘাটবাঁধা, গুদামজাতকরণ, পরিবহন ও বিপণনের মতো নানা কাজে যুক্ত। জিডিপিতে পাটের অবদান ০.২৬ হলেও কৃষি সেক্টরে এর একক অবদান ১.১৪ শতাংশ।
চলতি মৌসুমে দেশে সাড়ে ৭ লাখ হেক্টর জমি থেকে ৮৬ লাখ ১০ হাজার বেল পাট উৎপাদনের লক্ষ্য স্থির করা হলেও আবাদ হয়েছে ৭ লাখ ২৫ হাজার হেক্টর জমিতে। কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের মতে, আবাদ লক্ষ্যমাত্রা শতভাগ পূরণ না হলেও বড় ধরনের কোনো প্রাকৃতিক দুর্যোগ না হলে এই পরিমাণ জমি থেকেই লক্ষ্যমাত্রা মোতাবেক পাট উৎপাদন ও দেশের চাহিদা পূরণ সম্ভব হবে। বেশি দিনের কথা নয়, নব্বইয়ের দশকেও দেশে ১২ লাখ হেক্টর জমিতে পাটের চাষ হতো। স্বাধীনতার পর পাটই ছিল বাংলাদেশের প্রধান রপ্তানি পণ্য। রপ্তানি আয়ের শতকরা ৮০ ভাগ আসত পাট থেকে। তাই পাটকে বলা হতো সোনালি আঁশ। দেশের সব জেলাতে কমবেশি পাট চাষ হয়। তবে সবচেয়ে বেশি পাটের আবাদ হয় ফরিদপুর জেলায়। এ বছর ফরিদপুর জেলায় ৮৫ হাজার ৭৭ হেক্টর জমিতে পাটের আবাদ হয়েছে। গত বছর আবাদ হয়েছিল ৮৪ হাজার ৪২৭ হেক্টর জমিতে। তার আগের মৌসুমে আবাদ হয়েছিল ৮০ হাজার হেক্টর জমিতে। গত মৌসুমে পাটের ভালো দাম পাওয়ায় এবার কৃষক বেশি জমিতে পাটের চাষ করেছেন। এই মৌসুমে ফরিদপুর জেলায় ১ লাখ ৮৮ হাজার টন পাট উৎপাদনের লক্ষ্যমাত্রা ধরা হয়েছে।
আবহাওয়া অনুকূলে থাকায় এবার সারাদেশেই পাটের ভালো ফলন হয়েছে। জামালপুর জেলার দেওয়ানগঞ্জ উপজেলার এক পাট চাষি জানান, গত বছর বিঘাপ্রতি তার পাট উৎপাদন হয়েছিল ৭ থেকে ৮ মণ। এবার হবে ৮ থেকে ১০ মণ। প্রতি বিঘা জমিতে পাট চাষে তার খরচ হয়েছে ১২ হাজার টাকা। বাজারে বর্তমানে নতুন পাট বিক্রি হচ্ছে ২ হাজার ২০০ থেকে ২ হাজার ৫০০ টাকা মণ দরে। যদি পাটের দাম এ রকমই থাকে, তা হলে প্রতি বিঘা জমির পাট বিক্রি করে তার লাভ হবে ৫ হাজার ৬০০ টাকা। তার মতে, প্রতি মণ পাটের দাম হওয়া উচিত কমপক্ষে ৩ হাজার টাকা।
কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের তথ্য অনুযায়ী, দেশে উৎপাদিত পাটের শতকরা ৫১ ভাগ স্থানীয় পাটকলে ব্যবহৃত হয়। শতকরা ৪৪ ভাগ কাঁচাপাট বিদেশে রপ্তানি হয়। ৫ শতাংশের মতো পাট ব্যবহৃত হয় গৃহস্থালি ও কুটির শিল্পের কাজে। গুণগতমানের পাট বীজের অভাব বাংলাদেশে পাট উৎপাদনে একটি মৌলিক সমস্যা। দেশে ব্যবহৃত পাট বীজের শতকরা ৮০-৮৫ ভাগ আসে ভারত থেকে। এই সমস্যা সমাধানে মানসম্মত পাটের উৎপাদন বৃদ্ধি ও পাট বীজে স্বয়ংসম্পূর্ণতা অর্জনের লক্ষ্যে পাট অধিদপ্তরের আওতায় ‘উন্নত প্রযুক্তিনির্ভর পাট ও পাট বীজ উৎপাদন এবং সম্প্রসারণ’ শীর্ষক একটি প্রকল্প চলমান রয়েছে। প্রকল্পটি দেশের ৪৬টি জেলার ২৩০টি উপজেলায় বাস্তবায়িত হচ্ছে। প্রকল্পটির মাধ্যমে পাট চাষের উন্নত কলাকৌশল সম্পর্কে চাষিদের প্রশিক্ষিত করা এবং সার্বিকভাবে গুণগতমানসম্মত পাট ও পাটবীজ উৎপাদন বৃদ্ধির জন্য কৃষকদের মধ্যে বিনামূল্যে ৩৯০ টন পাট বীজ বিতরণ করাসহ সব ধরনের সহায়তা করছে সরকার। আশা করা যায়, এতে দেশে গুণগতমানের পাট বীজের অভাব অনেকটা পূরণ হবে। বাড়বে ফলন ও আঁশের গুণগতমান।
ইউরোপ-আমেরিকাসহ প্রধান বাজারগুলোতে করোনা ভাইরাস মহামারির প্রকোপ কমে স্বাভাবিক অবস্থায় ফিরে আসতে শুরু করেছে। তাই রপ্তানিকারকরাও এই খাতটি থেকে গত অর্থবছরের চেয়ে বেশি বিদেশি মুদ্রা দেশে অর্জনে নতুন পরিকল্পনা তৈরি করছেন। গত ২০১৯-২০ অর্থবছরে চামড়া ও চামড়াজাত পণ্য রপ্তানি করে ৭৯ কোটি ৭৬ লাখ ডলার আয় করেছিল বাংলাদেশ। আর পাট ও পাটজাত পণ্য রপ্তানি করে আয় করেছিল ৮৮ কোটি ২০ লাখ ডলার। গত ২০২০-২১ অর্থবছরে চামড়া খাত থেকে রপ্তানি আয় হয় ৯৪ কোটি ১৭ লাখ ডলার। আর পাট খাত থেকে রপ্তানি আয় হয় ১১৬ কোটি ১৪ লাখ ডলার। গত অর্থবছরের ধারাবাহিকতা বজায় রেখে নতুন অর্থবছরে পাট ও পাটজাত পণ্য থেকে আরো বেশি রপ্তানি আয়ের আশা করছে বাংলাদেশ। গত ৬ জুলাই, বাণিজ্য মন্ত্রণালয় ২০২১-২২ অর্থবছরের পণ্য রপ্তানি থেকে ৪৩.৫০ বিলিয়ন ডলার আয়ের যে লক্ষ্যমাত্রা ঘোষণা করে, তাতে ২৩.১২ শতাংশ প্রবৃদ্ধি ধরে পাট ও পাটজাতপণ্য থেকে ১৪৩ কোটি ডলার আয়ের লক্ষ্যমাত্রা ধরা হয়েছে। এ লক্ষ্যমাত্রা অর্জন করতে হলে পাটের সর্বোচ্চ ব্যবহার নিশ্চিত করতে হবে।
বাংলাদেশের মতো উৎকৃষ্টমানের পাট পৃথিবীর কোনো দেশেই উৎপন্ন হয় না। পাট বাংলাদেশের একটি গুরুত্বপূর্ণ খাত। এ খাতের উন্নয়নে বন্ধ ঘোষিত পাটকলগুলো দ্রুততম সময়ে বেসরকারি ব্যবস্থাপনায় ভাড়া বা ইজারায় চালু করা হবে বলে জানায় বস্ত্র ও পাট মন্ত্রণালয়। বেসরকারি ব্যবস্থাপনায় পাটকল চালু হলে বন্ধের সময় যেসব শ্রমিক ছিলেন তারা অগ্রাধিকার ভিত্তিতে কাজের সুযোগ পাবেন। পর্যায়ক্রমে সব শ্রমিককে পুনর্বাসিত করা হবে।
রপ্তানিকারকদের কথা- এখন পৃথিবীতে পাট ও পাটজাত পণ্য রপ্তানিতে সুসময় চলছে। কোভিড-১৯ মহামারি পরিবেশের ক্ষেত্রে নতুন ভাবনার জন্ম দেয়ায় এ খাতের সম্ভাবনা দেখা দিয়েছে নতুন করে। পরিবেশের ক্ষতি বিবেচনায় এমনিতেই পলিথিনের ব্যবহার কমে আসছিল বেশিরভাগ দেশে। পরিবেশের বিষয়টি ভবিষ্যতে আরো জোরালোভাবে সামনে আসবে। আর তাতে পাট ও পাটপণ্যের চাহিদা বাড়বে।
গত অর্থবছরে পাট সুতা রপ্তানি হয়েছে ৮০ লাখ ডলারের, প্রবৃদ্ধি হয়েছে ৪১.৬১ শতাংশ। কাঁচাপাট রপ্তানি হয়েছে ১৩ কোটি ৮১ লাখ ৫০ হাজার ডলার, আয় বেড়েছে ৬.৩৬ শতাংশ। পাটের তৈরি বস্তা, চট ও থলে রপ্তানি হয়েছে প্রায় ১৪ কোটি ডলারের। আয় বেড়েছে ৩০.১৫ শতাংশ। পাট ও পাট সুতা দিয়ে হাতে তৈরি বিভিন্ন পণ্য রপ্তানি করে আয় হয়েছে ১২ কোটি ডলার, প্রবৃদ্ধি ১০ শতাংশ। এছাড়া পাটের তৈরি অন্যান্য পণ্য রপ্তানি হয়েছে ৮ কোটি ৫৬ লাখ ৩০ হাজার ডলারের।
পাট খাতে উন্নয়নে শুধু বিদেশে রপ্তানির ওপর নির্ভর করলে চলবে না। দেশেও পাটের ব্যবহার বাড়াতে হবে। বস্ত্র ও পাট মন্ত্রণালয় সূত্রে জানা গেছে, পাটের অভ্যন্তরীণ ব্যবহার এবং পরিবেশ সুরক্ষায় সরকার ১৯টি পণ্যে পাটের মোড়ক ব্যবহার বাধ্যতামূলক করে আইন প্রণয়ন করেছে। এই ১৯টি পণ্য হচ্ছে- ধান, চাল, গম, ভুট্টা, চিনি, সার, মরিচ, হলুদ, পেঁয়াজ, আদা, রসুন, ডাল, ধনিয়া, আলু, আটা, ময়দা, তুষ-খুদ-কুঁড়া, পোল্ট্রি ফিড ও ফিশ ফিড। কিন্তু দুর্ভাগ্যের বিষয়, শুধু ধান, চাল ও গমে পাটের ব্যবহার হচ্ছে। সেটাও সামান্য পরিমাণে শুধু রাজধানী ঢাকায়। বাইরের জেলা-উপজেলাগুলোতে কেউ মানছে না এই আইন। আইনটি বাস্তবায়ন করা গেলে প্রতি বছর ১০০ কোটি পাটের বস্তার চাহিদা তৈরি হবে। স্থানীয় বাজারে পাট ও পাটজাত পণ্যের চাহিদা বৃদ্ধি পাবে, চাষিরা পাটের ন্যায্যমূল্য পাবেন এবং দেশে সৃষ্টি হবে সোনালি আঁশের নতুন সম্ভাবনা।
নিতাই চন্দ্র রায় : কৃষিবিদ ও কলাম লেখক।
[email protected]

মন্তব্য করুন

খবরের বিষয়বস্তুর সঙ্গে মিল আছে এবং আপত্তিজনক নয়- এমন মন্তব্যই প্রদর্শিত হবে। মন্তব্যগুলো পাঠকের নিজস্ব মতামত, ভোরের কাগজ লাইভ এর দায়ভার নেবে না।

জনপ্রিয়