জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয় : প্রক্টর ড. মোস্তফা কামালের মেয়াদ বাড়ল

আগের সংবাদ

গণভবন থেকে ভিডিও কনফারেন্সিংয়ে প্রধানমন্ত্রী : কেউ গৃহহীন থাকবে না

পরের সংবাদ

আমরা কোন পথে এগোচ্ছি

প্রকাশিত: আগস্ট ৩, ২০২১ , ১২:০০ পূর্বাহ্ণ
আপডেট: আগস্ট ৩, ২০২১ , ১২:০০ পূর্বাহ্ণ

আমাদের চারপাশের কাহিনীগুলো আমাদের জানা। কথা হলো, কেন এমনটা হলো। হওয়ার কথা তো ছিল অন্যরকম। একাত্তরে তো আমরা স্বপ্ন দেখেছিলাম একটি গণতান্ত্রিক রাষ্ট্র ও সমাজের, যেখানে মানুষে মানুষে বৈষম্য থাকবে না, থাকবে অধিকার ও সুযোগের সমতা; ক্ষমতা কোনো একটি কেন্দ্রে পুঞ্জিভূত হয়ে স্বৈরাচারী রূপ পরিগ্রহ করবে না, ক্ষমতার পরিপূর্ণ বিকেন্দ্রীকরণ ঘটবে; সব স্তরে নির্বাচিত জনপ্রতিনিধিদের কর্তৃত্ব থাকবে প্রতিষ্ঠিত; মানুষের নিরাপত্তার কোনো অভাব ঘটবে না, মৌলিক চাহিদাগুলোর পূরণ সম্ভব হবে। তেমনটা কেন ঘটল না? উত্তর হচ্ছে, ঘটার জন্য প্রয়োজন ছিল যে সামাজিক বিপ্লবের সেটি সম্ভব হয়নি; রাষ্ট্র ও সমাজের সব স্তরেই সম্পর্ক সেই আগের মতোই রয়ে গেছে : রাজা ও প্রজার, ক্ষমতাবান ও ক্ষমতাহীনের। মুক্তিযুদ্ধের যে চেতনার কথা আমরা বলি, এবং জিজ্ঞাসিত হলে সংজ্ঞা দিতে পারি না, সেটা তো আসলে সমাজ বিপ্লবের চেতনা ভিন্ন অন্য কিছু নয়।
তা সামাজিক বিপ্লবটা কেন ঘটল না? ঘটল না কারণ বিপ্লবী রাজনৈতিক শক্তি দেশে ছিল না। যুদ্ধের পরে ক্ষমতা চলে গেল জাতীয়তবাদীদের হাতে, তারা সবাই ছিলেন এবং এখনো রয়েছেন, পুঁজিবাদে বিশ্বাসী- জ্ঞাতে অথবা অজ্ঞাতে; কেউ অধিক কেউ কম। সমাজ বিপ্লবে নেতৃত্ব দেয়ার জন্য অঙ্গীকার করেছিলেন যে বামপন্থিরা, তারা ছত্রভঙ্গ হয়ে গেলেন। কেবল ছত্রভঙ্গ নয়, পরস্পরবিরোধীও হলেন। রুশপন্থিরা নতুন সরকারের সঙ্গে কীভাবে জোট বাঁধা যায় সে তৎপরতায় ব্যস্ত রইলেন; চীনপন্থিরা চলে গেলেন আত্মগোপনে এবং সমানে মার খেতে থাকলেন রক্ষীবাহিনী ও সরকারপন্থিদের হাতে।
যে তরুণদের চেতনায় সমাজ বিপ্লবের আকাক্সক্ষা টগবগ করছিল তারা পথ পেল না খুঁজে। বড় একটা অংশকে টেনে নিয়ে গেল জাতীয় সমাজতান্ত্রিক দল; যার নেতারা জানতেন না ঠিক কী চান এবং কোন পথে এগোবেন। হাজার হাজার তরুণকে তারা দাঁড় করিয়ে দিলেন রাষ্ট্রের মুখোমুখি। সুবিধা যা হওয়ার রাষ্ট্রেরই হলো। তরুণরা চিহ্নিত হয়ে গেল। রাষ্ট্র এদেরকে দমন করতে পারল। আবার এই তরুণরা যে বিপ্লবের কাজটাকে এগিয়ে নিয়ে যাবে সেটাও ঘটল না। সিরাজ সিকদারের সর্বহারা পার্টিও অসংখ্য তরুণকে বিপ্লবের জন্য উদ্বুদ্ধ করেছিল। ডেকে নিয়েছিল। কিন্তু পরে বোঝা গেল তাদের পথটা সঠিক ছিল না। বাংলাদেশের মতো জনাকীর্ণ একটি দেশে সশস্ত্র গোপন পথে বিপ্লব সংঘটিত করা সম্ভব নয়; প্রয়োজন ছিল গণ-অভ্যুত্থানের পথে এগুবার জন্য প্রকাশ্য রাজনীতির যেটুকু সুযোগ পাওয়া গিয়েছিল তার সম্পূর্ণ সদ্ব্যবহার করা। সর্বহারা পার্টি সেটি করেনি। ফলে পার্টির অগুনতি কর্মী প্রাণ দিয়েছে এবং বাকিরা হারিয়ে গেছে। বিপ্লবপন্থি তরুণদের এভাবে জ্বলে-ওঠা ও নিভে-যাওয়াতে শাসকশ্রেণি রাষ্ট্রকে নিজেদের মতো চালনা করার ব্যাপারে অতিরিক্ত সুবিধা পেয়ে গেল।
যুদ্ধ শেষ হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে দেখা গেল মুক্তির সমষ্টিগত স্বপ্নটি ভেঙে গেছে এবং ভাঙা টুকরোগুলো নির্মমভাবে পদদলিত হচ্ছে। অতিদ্রুত সমষ্টিগত সব স্বপ্ন ব্যক্তিগত হয়ে গেল। যুদ্ধের সময় প্রত্যেকে ভেবেছে দেশকে কী দেয়া যায়, যুদ্ধের পরে চিন্তাটা দাঁড়াল সম্পূর্ণ উল্টো, দেশের কাছ থেকে কতটা নেয়া যায়। আমি কী পেলাম, এই জিজ্ঞাসাটা সরবে ও নীরবে ধ্বনিত-প্রতিধ্বনিত হতে থাকল। আবার, পাশাপাশি, সঙ্গে সঙ্গে, ও কেন অতটা পেল, আমি কেন এত কম পেলাম, সেই ঈর্ষাও লকলক করতে থাকল।
পঁচাত্তরের ট্র্যাজেডির পরে রুশপন্থি ন্যাপের এক শীর্ষ নেতাকে বলতে শুনেছি কর্মীদেরকে ঠিক রাখা কঠিন হয়ে পড়েছে, সবাই জানতে চায় কী পাবে। অনুমান করি জিজ্ঞাসাটা খুব নতুন নয়। আগে কর্মীদের সন্তুষ্ট রাখা কোনো মতে সম্ভব হতো। পরিবর্তিত পরিস্থিতিতে সেটা দুরূহ হয়ে পড়েছে। নিজের তালে ব্যস্ত থাকলে সমাজ বিপ্লবটা এগুবে কী করে? স্বপ্ন ছিল রাষ্ট্র হবে গণতান্ত্রিক এবং উন্নয়নের ধারাটি পুঁজিবাদী হবে না, হবে সমাজতান্ত্রিক। এই দুই আশার প্রতিফলন সংবিধানের মূলনীতিতে জায়গাও করে নিয়েছিল ঠেলেঠুলে। কিন্তু উন্নয়নের ধারা সমাজতান্ত্রিক হয়নি এবং রাষ্ট্র গণতান্ত্রিক হওয়ার পরিবর্তে আগের চেয়েও অধিক মাত্রায় আমলাতান্ত্রিক হয়েছে। এসব কথা আমাদের বারবার বলতে হচ্ছে। এটাও না বলে উপায় থাকে না যে, উন্নয়নের চালিকা শক্তিটা হচ্ছে মুনাফা এবং সে মুনাফা ব্যক্তিগত। সভ্যতার ভদ্র আচ্ছাদনের অন্তরালে এই পাশবিক আত্মস্বার্থপরতা এখন বিশ্বব্যাপী বিদ্যমান; তবে বাংলাদেশের চিত্রটা বেশ উৎকট। বিশেষভাবে এই কারণে যে, উন্নতির এই দর্শনের বিরুদ্ধেই আমরা লড়েছি; দীর্ঘকাল ধরে এবং উল্লেখযোগ্যভাবে একাত্তর সালে।
রাষ্ট্রের তিন শাখার ভেতর দুর্দান্ত শক্তিতে অদম্য হয়ে উঠেছে নির্বাহী শাখা। সংসদ আছে কিন্তু তার কাছে নির্বাহী শাখার কোনো দায় নেই জবাবদিহিতার; সংসদ বসে এবং নির্বাহীকে প্রশংসা করার জন্য সুযোগের অপেক্ষায় থাকে। বিচার বিভাগের ওপর আস্থার ক্রমাবনিত অক্ষুণ্ন রয়েছে। ন্যায়বিচারের আশা প্রথম ধাক্কাটা খেল হানাদার পাকিস্তানি যুদ্ধাপরাধীরা সবাই যখন নির্বিঘেœ প্রস্থান করতে পারল, তখনই। স্থানীয় যুদ্ধাপরাধীদের কয়েকজনের বিচার হয়েছে শেষ পর্যন্ত কিন্তু অনেকেরই হয়নি। বঙ্গবন্ধু ও তার পরিবারের ঘাতকদের বিচার করা গেছে, কিন্তু রায় পুরোপুরি কার্যকর হয়নি। চার নেতার হত্যাকাণ্ডের বিচার এখনো অপেক্ষমাণই রয়েছে। মানুষ গুম হয়, অপহরণকারীদের বিচার হয় না। কপাল গুণে যদি কেউ ফিরে আসেন তবে তিনি সম্পূর্ণরূপে বোবা হয়ে পড়েন, এমনই আতঙ্ক। ক্রসফায়ারে মৃত্যুর জন্য তো অন্য কেউ দায়ী থাকে না, নিহত ব্যক্তিটি ছাড়া। সাগর-রুনি হত্যাকাণ্ডের তদন্ত-কাহিনী তো শেষ পর্যন্ত পুরনো কাসুন্দিতে পরিণত হবে বলে বিশ্বাস। প্রাণোচ্ছল কিশোরী মেয়েটি, সোহাগী; তার মৃত্যুর রহস্য উদ্ঘাটিত হবে এমন আশা তার পিতামাতাও ছেড়ে দিয়েছেন। তনু হত্যা মামলার তদন্ত চলল প্রায় ৬ বছর ধরে। মূল অভিযুক্ত উধাও হয়ে গেছে; মূল পরিকল্পনাকারীও অধরাই থাকত, যদি না তনুর পিতা পুলিশের সাবেক কর্মকর্তা হতেন এবং মেয়ের মৃত্যুর তদন্ত-দাবির পেছনে না লেগে থাকতেন। প্রশাসনের অভ্যন্তরে বিভিন্ন বিভাগের ভেতর দ্ব›দ্ব আছে। ঢাকার রাস্তায় এই সেদিন যে কর্তব্যে রওনা দেয়া একজন চিকিৎসকের সঙ্গে কর্তব্য-পালনরত পুলিশের মধ্যে বচসা হয়েছে এবং তা নিয়ে চিকিৎসক ও সাবেক পুলিশ কর্মকর্তাদের সমিতি পাল্টাপাল্টি যে বিবৃতি দিয়েছে, তেমন ঘটনাকে কেউ এখন আর অস্বাভাবিক বলবেন না। কক্সবাজারে পুলিশ বহিনীর কয়েকজন সদস্যের হাতে অবসরপ্রাপ্ত সেনা অফিসারের নিহত হওয়ার ঘটনাতে অবসরপ্রাপ্ত সেনা অফিসারদের সমিতি প্রকাশ্যে অবস্থান নেয়ার ঘটনাটিও তাৎপর্যবিহীন নয়। পুলিশের বদনাম সেই ব্রিটিশ যুগ থেকেই; যখন তাদের সৃষ্টি। অকারণে হেনস্তা করে, ঘুষ না-পেলে স্বাভাবিক থাকে না, এসব অভিযোগ ছিল। ওই বাহিনীতে যে ভালো লোক নেই তা নয়, অধিকাংশই সৎ, কিন্তু সৎ যারা তাদের পক্ষে টিকে থাকাটা মুশকিল হয়; অসৎদের দাপটে। স্বাধীন বাংলাদেশে পুলিশ সদস্যদের বিরুদ্ধে অন্য অভিযোগ তো রয়েছেই, ধর্ষণের অভিযোগও শোনা গেছে। ভারতে আটকে পড়া দুর্ভাগা এক তরুণী ফেরত এসেছে দেশে, অতিকষ্টে সীমান্ত পার হয়ে। তাকে কোয়ারেন্টাইনে পাঠানো হয়েছে খুলনার এক প্রাথমিক বিদ্যালয়ে। পাহারা দিচ্ছে পুলিশ। মেয়েটিকে একা পেয়ে তার ওপর হামলা করেছে কর্তব্য পালনরত একজন এএসআই। বাংলাদেশের অরক্ষিত মেয়েদের জন্য এখন তাহলে কোনটিকে বলা যাবে অধিক বিপজ্জনক? করোনা ভাইরাসের সংক্রমণ নাকি পুলিশের পাহারা? হায়রে, এ কোন বাংলাদেশ; পঞ্চাশ বছরে এ কোন অগ্রগতি? চাঁদা এবং মুক্তিপণ আদায়, এগুলো অবশ্য এখন আর খবর নয়। এটাকে কী খবর বলা যাবে? খবরটা এ রকমের : ‘রিকশাচালকের টাকা ছিনতাই। তিন পুলিশ সাময়িকভাবে বরখাস্ত।’ গরিব রিকশাওয়ালাটি রাতভর রিকশা চালিয়েছে, আয় করেছে ৮০০ টাকা, অতিপ্রত্যুষে টহলরত তিন পুলিশে মিলে হরণ করেছে মেহনতি মানুষটির সেই উপার্জন। খবরটা কেউ জানতেই পারত না, যদি না ফেসবুকে এক সহৃদয় ব্যক্তি এটি পুলিশের ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষের দৃষ্টি আকর্ষণ করতেন। এর আগে আরেকটি খবর পড়েছি, সংবাদপত্রেই। বিশেষ রকমের দক্ষ যে র‌্যাব বাহিনী তার ৪ জন সদস্য (ভুয়া নয়, খাঁটি) ধরা পড়েছে, দুজন পলাতক। এরা ভাড়া খাটছিল একজন মহিলার, যিনি তার এক ব্যবসায়ী সহযোগীর কাছ থেকে পাওনা টাকা উদ্ধারের জন্য র‌্যাব-সদস্যদের সঙ্গে যোগাযোগ করেন। র‌্যাবের সদস্যরা চিহ্নিত ব্যক্তিটিকে ধরে একটি মাইক্রোবাসে তোলে এবং তার আত্মীয়দের কাছে ২ কোটি টাকা মুক্তিপণ দাবি করে; অপারগতার কথা শুনে দাবি ১৫ লাখে নামিয়ে আনে, এবং শেষ পর্যন্ত রফা হয় ১২ লাখে। অপহৃত ব্যক্তির বোন মরিয়া হয়ে পুলিশকে জানায়, ফলে র‌্যাবের ৪ জন ধরা পড়ে, ২ জন পালিয়ে যায়। তা মাইক্রোবাস চালকের আর দোষ কী? ভাড়া ঘেটেছে! কিন্তু আমরা কী মাৎস্যন্যায়ের যুগের দিকে ধাবমান রয়েছি, নাকি সেই বন্যকালের?
সিরাজুল ইসলাম চৌধুরী : ইমেরিটাস অধ্যাপক, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়।

মন্তব্য করুন

খবরের বিষয়বস্তুর সঙ্গে মিল আছে এবং আপত্তিজনক নয়- এমন মন্তব্যই প্রদর্শিত হবে। মন্তব্যগুলো পাঠকের নিজস্ব মতামত, ভোরের কাগজ লাইভ এর দায়ভার নেবে না।

জনপ্রিয়