শিগগিরই প্রয়োগ শুরু : আরো ৭ লাখ ৮১ হাজার টিকা এলো জাপান থেকে

আগের সংবাদ

বালুখালী রোহিঙ্গা ক্যাম্পে গুলিবিদ্ধ ২ : সশস্ত্র আরসা ও আরএসও আধিপত্যের দ্বন্দ্ব প্রকাশ্যে

পরের সংবাদ

খুনি

প্রকাশিত: আগস্ট ২, ২০২১ , ১২:০০ পূর্বাহ্ণ
আপডেট: আগস্ট ২, ২০২১ , ১২:০০ পূর্বাহ্ণ

আসলে এত দ্রুত দৃশ্যপট পাল্টে যাবে ভাবতে পারেনি জাফর। অতঃপর রাতের সকল নীরবতা ভেঙে ঘন কুয়াশার চাদরে মোড়ানো কনকনে শীতে বরফ জমানো শরীর এবং চোখে আধো আধো ঘুম নিয়ে হেলতে-দুলতে ট্রেন থেকে নামে জাফর।
রাত আনুমানিক কত হবে? সোডিয়াম আলোর নিচে দাঁড়িয়ে নিজের রং বদলে যাওয়া কিছুটা ধূসর কিছুটা বিবর্ণ হাতের দিকে তাকিয়ে নিজেকে না চিনতে পারার কৌতূহলী চোখে তাকায় জাফর। টাইটান ঘড়িটি আজ তার হাতে নেই। নেই। একদম কোথাও নেই। অথচ স্পষ্ট মনে আছে জাফরের, প্যান্টের চেইন লাগানোর সময় ঘড়িটি তার হাতেই ছিল। কিন্তু ঘড়িটি হঠাৎ করে কোথায় যে উধাও হলো এখন আর কিছুতেই খুঁজে পাওয়া যাচ্ছে না। বসুন্ধরা সিটি থেকে কিনে সিলভী তাকে এই ঘড়িটা গিফট করেছিল। সিলভীরা সপরিবারে অস্ট্রেলিয়া থাকে। রমজানের ঈদে বেড়াতে এসে ঘড়িটি জাফরকে দিয়েছিল। ছোটবেলায় একসঙ্গে পড়ত ওরা। কিন্তু এখন কোনোভাবেই জাফর মনে করতে পারছে না ঘড়িটাকে সে কি করেছে। নিজের ওপর নিজেরই প্রচণ্ড রাগ হয় জাফরের। গভীর মনোযোগে সে তার প্যান্টের দুই পকেটে খুঁজতে থাকে।
হতাশ জাফর আকাশের দিকে তাকায়। নগ্ন দুই হাত তার ছুঁয়ে যায় কোমল বাতাস। আকাশে আজ আলো কম। অদূরে আকাশের কোনো এক দিগন্ত রেখা রমনীর মাথার কালো বেণী হয়ে আছে। বৃষ্টি বৃষ্টি ভাব। যে কোনো সময়ে হুড়মুড়িয়ে নামতে পারে। শীতের সিজনে ঝড় বাদল হয় বলে জাফরের জানা নেই। সহসা এক হ্রাস কোমল বাতাস জাফরকে ছুঁয়ে যায়।
পাশে রাখা পুঁটলির মতো কালো ব্যাগটি কাঁধে নেয়ার চেষ্টা করে জাফর। কিন্তু কাপড়ে লেগে থাকা রক্তের দাগ বর্ষাকালের জলের ওপর বৈঠা ফালানোর মতো ফালা ফালা করে তার বুক পিঠ। লোহিত রক্তের ধারায় ভিজে জবজবে হয়ে যায় জাফরের শরীর। পিচঢালাহীন এবড়ো খেবড়ো পথে এলোমেলো হাঁটতে থাকে জাফর। প্রকৃত পক্ষে সে কোথায় যাবে কিংবা যেতে চায় মস্তিষ্ক যেন কোনো কিছুই নির্ধারণ করতে পারে না।
তবু ঝিরিঝিরি বাতাসে কুয়াশা ভেদ করে দিগন্তের নরম আলো যেমন পৃথিবীতে আঁছড়ে পড়ে তেমনি মৃদু আলো মৃদু অন্ধকারে জাফরের মনে পড়ে বছর কয়েক আগে বর্ষাকালের এক সন্ধ্যাঘন সময়ে সে এসেছিল। কয়েক দিন ছিলও। তখনই এখানকার রাস্তাঘাট তার পরিচিত হয়েছিল।
কিন্তু এই ক’বছরে প্রকৃতির চেহারা বেশ পাল্টালেও রাস্তাঘাটের যে ডিমোশনই হয়েছে, রাতের অন্ধকারেও জাফর বেশ ভালোভাবেই বুঝতে পারে। রাত তখন ৩টার কম না।
গুটি গুটি পা বাড়ায় জাফর। হাঁটতে হাঁটতেই পকেট থেকে পিস্তলটা বের করে। তারপর নিজের অজান্তেই হো হো করে হেসে ওঠে একবার। অতঃপর মুখ ভর্তি বিরক্ত নিয়ে অজানার মাকে উদ্দেশ্য করে একটা গালি দিয়ে হাতের পিস্তলটা ছুড়ে ফেলে পাশের ধানক্ষেতে। আরেকবার উচ্চ স্বরে গলা ফাটিয়ে চিৎকার করে ওঠে জাফর। নিজের মাথার চুল নিজেই টেনে ছেঁড়ার চেষ্টা করে। আচমকা পা দুটো যেন কিসের সাথে আটকে যায়। জাফর উহ করে ওঠে। মাথাটা কিসের সাথে যেন সহসা ধাক্কা খায়। পদ্ম পাতার জলের মতন টলমল করে কেঁপে ওঠে জাফরের সব পৃথিবী। আকাশ বাতাস গ্রহ নক্ষত্র এবং আজ সকালে মাথায় পিস্তল ঠেকিয়ে যাকে গুলি করে মেঝেতে ফেলে রেখেছে সেসব দৃশ্য এখন বারবার জাফরের চোখের সামনে ভেসে উঠছে। ছবিগুলো কিছুতেই যেন জাফর তার চোখের সামনে থেকে সরাতে পারছে না। মনে হচ্ছে কেউ তার চোখের সামনে জীবন্ত ছবিগুলো নাইলন সুতা দিয়ে বেঁধে ঝুলিয়ে দিয়েছে। তা আর কোনোভাবেই কোনোক্রমেই সরানো সম্ভব নয়। ছবিগুলো ক্রমেই স্থির আর দণ্ডায়মান হয়ে আছে।
একটু একটু করে খুনের দৃশ্যটা ভেসে উঠতে থাকে জাফরের চোখের সামনে। যেমন করে জলের বুকে ভেসে ওঠে জীবন্ত মেঘ ও মানুষের ছায়া। জাফর দুই হাত দিয়ে তার চোখ দুটিকে চেপে ধরে, যেন ওই ভয়ংকর দৃশ্যগুলো তার চোখের সামনে কিছুতেই আর না ভেসে ওঠে। কিন্তু হারামজাদা দৃশ্যগুলোকে কোনোভাবেই সরাতে পারে না। আয়ত্তে থাকা সব রকম চেষ্টা করে ব্যর্থ হয় জাফর। ইচ্ছে করে চোখ দুটোকে গলিয়ে ফেলতে। তাহলে যদি এই ভয়ংকর দুঃস্বপ্ন থেকে রেহাই পাওয়া যায়।
চোখ বন্ধ করলেই জাফর দেখতে পায় তার চোখের সামনে লাখো কোটি দর্শক বসে আছে একনজর জাফরকে দেখার অপেক্ষায়। একজন খুনিকে দেখার অপেক্ষায়। কীভাবে জাফর তার মাকে খুন করেছে। কীভাবে একজন মহিলাকে খুন করেছে। কীভাবে ধারালো অস্ত্রের আঘাতে ক্ষত-বিক্ষত করেছে একজন নারীর দেহ। জাফর আরো দেখতে পায়- উন্মাতাল একটি ছেলে কখনো ট্রেনে চেপে কখনো খোলা রাস্তা দিয়ে দৌড়াচ্ছে। তার চোখ মুখ দিয়ে প্রতিশোধের লালা গড়িয়ে পড়ছে। টকটকে লাল জিভ বের হয়ে আসছে। খালি গায়ে তার শরীরের লোমগুলোকে ভয়ংকর লাগছে। ছেলেটি দৌড়েই চলেছে। পৃথিবীর কেউ তার নাগাল পাচ্ছে না। ছেলেটি দৌড়াচ্ছে। যেমন করে দৌড়ায় ক্ষুধার্ত হায়েনারা।
জাফর আরো দেখতে পায়- একটি ছেলে, হ্যাঁ একটি ছেলে, মদ্যপ অবস্থায়, কিছুক্ষণ আগে, হ্যাঁ কিছুক্ষণ আগেই তো, গলির ভেতর, একটি অসহায়, সুন্দরী, কুমারী, হ্যাঁ কুমারীই তো, বিবাহিত নয়, কলেজ পড়–য়া মেয়েকে ধর্ষণ করে এসেছে। রক্তাক্ত করেছে। ক্ষত-বিক্ষত করেছে। ক্ষুধার্ত ব্যাঘ্র শাবকেরা যেমন করে ঝাঁপিয়ে পড়ে তার আহারের ওপর। তেমনি, ঠিক তেমনিভাবে হঠাৎ করে ঝাঁপিয়ে পড়েছে সে।
মেয়েটি চিৎকার করে। হাত-পা ছুড়ে মেঝেতে তড়পায়। কাঁদে। মুখ দিয়ে সমুদ্রের ঢেউয়ের মতো একহ্রাস সফেদ ফেনা বেরোয়। এক সময় নিথর নীরব নিঃশব্দ নিস্তব্ধ। একেবারে শব্দহীন।
অতঃপর বাড়িতে পুলিশ। জাফর টের পায় না। আঁচ করতে পারে না। বুঝতে পারে না যে তার অলক্ষ্যেই মা থানায় গিয়ে নিজের ছেলের নামে মামলাটি করে এসেছে। এমন মাও পৃথিবীতে হয় বলে জাফরের জানা নেই। যদি জানা থাকত তবে জাফর পালাতে পারত। অতএব জাফর পালায় না। মসজিদে-মন্দিরে, কালি ঘরের ঘুপচির ভেতর, নেতার বাড়ি-মন্ত্রীর বাড়ি; কোনো ঘরেই ঠাঁই নেয়ার চেষ্টা করে না জাফর। রাতের আঁধারে কাঁটাতারের সীমান্ত ক্রস করতে হয় না। বিএসএফের গুলি খেতে হয় না। ছদ্মনামে কিংবা মুখোশ পরে আশ্রয় নিতে হয় না অন্য কোনো লোকালয়ে। অন্য কোনো অপরিচিত জনপদে।
খেতে বসেছে জাফর। অতি যতেœ মা তাকে খাইয়ে দিচ্ছে। একান্ত আপন করে। পরম স্নিগ্ধতায়। পুলিশ ঘরে ঢোকে। হ্যান্ডস আপ। জাফর অবাক হয়। মুখের ভেতর ভাত নড়ে না। মাকে বিচলিত দেখায় না। জাফর একবার মায়ের দিকে একবার পুলিশের দিকে তাকায়। পুলিশ বাইরে গিয়ে দাঁড়ায়। জাফর খাওয়া শেষ করে। মা হাত-মুখ ধুইয়ে দেন। জাফর দেখে মায়ের মুখে কোনো হা-পিত্যেস নেই। চোখের কোণে জল নেই। কণ্ঠে অমøতা নেই। জাফর চলে যাচ্ছে। পুলিশ তাকে ধরে নিয়ে যাচ্ছে। রাস্তার ধারে অসংখ্য মানুষ জড়ো হতে থাকে। কিন্তু কোনো ব্যক্তি কিংবা কোনো প্রাণী একবারের জন্যও জাফরকে ছাড়িয়ে নিতে আসে না। একটু সহানুভূতি প্রকাশ করতে আসে না। শত মানুষের ভিড়ে জাফর শুধু একটি অশ্রæসজল মুখ খোঁজে। সেই মুখটিও দেখে না। জাফর বুঝতে পারে- তার জন্য কারো মায়া নেই। মমতা নেই। অপরাধীর জন্য, ধর্ষণকারীর জন্য কারো মায়া থাকতে পারে না। অবশ্যই পারে না। মানুষের চোখগুলো কেমন স্থির হয়ে আছে। জলহীন শক্ত আর থিতু।
জাফর চলে যায়। মানুষের মুখগুলো ক্রমাগত তার চোখের সামনে ফ্যাকাসে হতে থাকে। চারপাশের সব কিছু কেমন ঘোলা আর ঝাপসা হয়ে আসে। একটা সময় জাফর তার পশ্চাদদেশে সজোরে পুলিশের বুটের লাথি অনুভব করতে পারে এবং নিজেকে একা একটি লোহার বদ্ধ কক্ষে আবিষ্কার করে। পরদিন বাংলাদেশের সব দৈনিকে জাফরকে নিয়ে খবর বেরোয়।
দিন যায়। মাস যায়। এক জেল থেকে আরেক জেলে যায়। সমস্ত বাংলাদেশ ঘুরে বেড়ায় কিন্তু জাফরকে কেউ ছাড়িয়ে নিতে আসে না। তার খোঁজ নিতে কেউ আসে না। একটা মাত্র ধর্ষণে তার সুন্দর জীবনটা এভাবে এলোমেলো হয়ে যাবে কিছুতেই এটা মেনে নেয়া যায় না। সারা বিশ্বে প্রতি দিন প্রতি রাতে প্রতি সেকেন্ডে কত হাজার নারী ধর্ষিত হচ্ছে- কে তার খবর রাখে? ‘আমি তো মাত্র একজন নারীকে ধর্ষণ করেছি এজন্য আমার এত বড় শাস্তি হতে পারে না। এ সবের দেখার কি কেউ নেই?’ জাফর চিৎকার করে ওঠে। শরীর ফুসে উঠতে থাকে। নাক বেয়ে ঘাম ঝরতে থাকে।
সহসা একদিন জানতে পারে, জাফরের এই দুর্বিষহ জীবনের জন্য তার মা-ই দায়ী। তার সুন্দর সোনালি জীবনটা ধ্বংস করার জন্য তার মা-ই দায়ী। জাফর মাকে অভিসম্পাত দিতে থাকে। পৃথিবী থেকে চলে যেতে বলে। একদা জাফর নিজেই সেই কাজটি করে ফেলে।
নিজের হাতে মাকে খুন করে। তারপর তার আর কিছুই মনে পড়ে না।
জাফর যখন পিটপিট করে চোখ খুলে তখন দেখে তার সামনে একটি সুন্দরী মেয়ে বসে আছে। হাতপাখা দিয়ে বাতাস করছে। জাফর ঠিক মনে করতে পারে না এই মেয়েটিকে সে কোথায় দেখেছে। আসলেই কোথাও দেখেছে কি? সে কীভাবে এই মেয়েটির কাছে এলো। কেনই বা মেয়েটি তাকে এই নিষ্ঠুর সময়ে শরীরে বাতাস করে তার প্রতি আকর্ষণ সৃষ্টি করছে। মিথ্যে মায়া দিয়ে কেন-ই বা মেয়েটি তাকে নিজের করে নিতে চাইছে।
জাফর বুঝে উঠতে পারে না। পূর্বের মতোই তার কাছে সব কিছু এলোমেলো এবং ঘোলা ঘোলা লাগে। জাফর জানে এই পৃথিবীটা একটা অস্থির নিয়তির জায়গা। এখানে সব কিছু কেমন এলোমেলো। সবকিছু কেমন ব্যথাভরা যন্ত্রণার উচ্ছিষ্ট। কেন মেয়েটি তাকে নিয়ে কষ্ট করছে। কি তার স্বার্থ? কি তার পরিচয়? আমি আসলে কোথায়? কীভাবে এখানে এসেছি? জাফর নিজেকে প্রশ্ন করে এক পলকের জন্য মেয়েটির মুখের দিকে তাকায়। তারপর হঠাৎই চমকে
ওঠে সে।
:: পাফোস- ১০৬৪৫, মোহাম্মদপুর, ঢাকা

মন্তব্য করুন

খবরের বিষয়বস্তুর সঙ্গে মিল আছে এবং আপত্তিজনক নয়- এমন মন্তব্যই প্রদর্শিত হবে। মন্তব্যগুলো পাঠকের নিজস্ব মতামত, ভোরের কাগজ লাইভ এর দায়ভার নেবে না।

জনপ্রিয়