হেফাজতের সহিংসতা : এজাহারনামীয় এক আসামি গ্রেপ্তার

আগের সংবাদ

বোল্টের সিংহাসনে বসলেন জ্যাকবস

পরের সংবাদ

অতিবৃষ্টিতে বিপর্যস্ত জনজীবন : সাতক্ষীরায় শতাধিক কোটি টাকার ক্ষতি

প্রকাশিত: আগস্ট ১, ২০২১ , ১২:০০ পূর্বাহ্ণ
আপডেট: আগস্ট ১, ২০২১ , ১২:০০ পূর্বাহ্ণ

মসিউর রহমান ফিরোজ, সাতক্ষীরা থেকে : সাগরে লঘুচাপের প্রভাবে মুষলধারে বৃষ্টির সঙ্গে হালকা ঝড়ো বাতাস বয়ে যাওয়ায় সাতক্ষীরার জনজীবন বিপর্যস্ত হয়ে পড়েছে। গত মঙ্গলবার থেকে বৃহস্পতিবার সন্ধ্যা পর্যন্ত টানা বৃষ্টিতে সাতক্ষীরার নিম্নাঞ্চল প্লাবিত হয়েছে। তলিয়ে গেছে চিংড়ি ঘের, রোপা আমনক্ষেত ও বীজতলা। সাতক্ষীরা সদর উপজেলাসহ শ্যামনগর, আশাশুনি, কালীগঞ্জ, দেবহাটা ও তালা উপজেলার অধিকাংশ চিংড়ি ঘের বৃষ্টির পানিতে তলিয়ে গেছে। বৃষ্টিতে দুর্ভোগ বেড়েছে আশাশুনির শ্যামনগর উপজেলার বানভাসি মানুষের।
সাতক্ষীরায় দুদিনের ভারি বর্ষণে ভেসে গেছে রোপা আমন, বীজতলা, পুকুর ও মাছের ঘের। পানিতে একাকার সাত উপজেলার ৭৮টি ইউনিয়ন আর পৌরসভার নিম্নাঞ্চল। ভেসে গেছে ২০ হাজারের মতো ঘের। এতে ব্যাপক ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছেন চিংড়িচাষিরা। ইয়াসের ফলে সৃষ্ট জলোচ্ছ¡াসে ১৬ কোটি টাকার ক্ষতি হওয়ার পরে অতিবৃষ্টিতে শুধুমাত্র মাছের ক্ষতি হয়েছে ৫৩ কোটি টাকার।
এদিকে সাতক্ষীরা পৌরসভার সব নিচু এলাকাও এখন পানির নিচে। পানি নিষ্কাশন ব্যবস্থা না থাকায় এবং একই সঙ্গে অতিবৃষ্টি জলাবদ্ধতার কবলে থাকা এলাকাগুলোতে নতুন করে পানি বৃদ্ধি পেয়েছে। ফলে চরম দুর্ভোগের মধ্যে পড়েছেন এসব এলাকার মানুষ।
জানা গেছে, সাতক্ষীরা পৌরসভার অধিকাংশ নিচু এলাকা এখনো পানির নিচে। পানি নিষ্কাশনের ব্যবস্থা না থাকায় স্থায়ী জলাবদ্ধতার কবলে পড়েছেন সাতক্ষীরাবাসী। শহরের মধ্য দিয়ে বয়ে যাওয়া প্রাণসায়ের খালও পানি টানতে পারছেন না। সদ্য খননকৃত খালের দুই পাড়ের মাটি ধসে পড়তে শুরু করেছে।
পৌরসভার ইটাগাছা এলাকার বাসিন্দা আলীনুর খান বাবুল বলেন, সামান্য বৃষ্টিতে আমাদের এলাকা তলিয়ে যায়। আর বৃহস্পতিবারের যে ব্যাপক বর্ষা, তাতে চারিদিকে পানি থইথই করছে। চারিদিকে আটকানো। পানি বের হওয়ার সুযোগ নেই।
এদিকে গত ২৭ জুলাই বিকাল থেকে বৃহস্পতিবার বিকাল পর্যন্ত অতিবৃষ্টির ফলে সাতক্ষীরা সদর উপজেলার, বালুইগাছা, কোমরপুর, বড়দল, গোবিন্দপুর, দামারপোতা, মাছখোলা, শ্যালো, গদাইবিল, ছাগলা, বিনেরপোতা, রাজনগরসহ কমপক্ষে ১৩টি মাঠে পানি থইথই করছে। এসব মাঠে মৎস্যচাষিদের মাছের ঘের ভেসে একাকার হয়ে গেছে। বেতনা নদীর তীরবর্তী মাঠগুলোর পানি নদীতে নিষ্কাশিত হতে না পারায় লোকালয়ে চরম জলাবদ্ধতার সৃষ্টি হয়েছে। গ্রামাঞ্চলের সব পুকুর পানিতে তলিয়ে একাকার হয়ে গেছে। ভেসে গেছে লাখ লাখ টাকার মাছ। নেই গবাদিপশু, হাঁস-মুরগি রাখার মতো সুরক্ষিত কোনো জায়গা। নিজেদের খাবার রান্না হচ্ছে হাঁটু পানিতে দাঁড়িয়ে। অনেকের ঘরের ভেতরেও পানি লক্ষ্য করা গেছে। এছাড়া কাঁচা ঘরবাড়ি রয়েছে ঝুঁকির মধ্যে। হাঁস, মুরগি ও গবাদিপশু নিয়ে মানুষ চরম বিপদে পড়েছেন। পানিতে ডুবে গেছে অধিকাংশ সবজির ক্ষেত। মানুষ যাতায়াত করছেন হাঁটু ভেঙে। কিছু কিছু গ্রামে রাস্তার উপরে কোমর পর্যন্ত পানি দেখা গেছে। ভোগান্তি বেড়েছে খেটে খাওয়া মানুষের।
এদিকে বৃষ্টির পানিতে সয়লাব হয়ে গেছে উপকূলীয় উপজেলা শ্যামনগর, কালীগঞ্জ ও আশাশুনিসহ জেলার সাতটি উপজেলা। সেখানে প্রধান রাস্তার ওপর দিয়েও পানি প্রবাহিত হচ্ছে। এসব এলাকার মাছের ঘের তলিয়ে গেছে।
আশাশুনি উপজেলার প্রতাপনগর, আনুলিয়া, খাজরা, বড়দল, শ্রীউলা, আশাশুনি সদরসহ বিভিন্ন ইউনিয়নের নিম্নাঞ্চল পানিতে থইথই করছে।
শ্যামনগর উপজেলার গাবুরা, বুড়িগোয়ালিনী, কাশিমাড়ি, কৈখালী, রমজাননগরসহ বিভিন্ন ইউনিয়নের মাছের ঘের ও পুকুর পানিতে ভেসে একাকার হয়ে গেছে। বসতবাড়িতে উঠেছে পানি। পানি নিষ্কাশনের খালগুলো দখল করার কারণে এ দুর্দশার কবলে পড়েছেন এলাকাবাসী। হাঁস-মুরগি ও গবাদিপশু নিয়ে বিপাকে পড়েছেন প্লাবিত এলাকার মানুষ।
তালা উপজেলার ইসলামকাটি, মাগুরা, কুমিরা, খেশরা, তেঁতুলিয়া, ধানদিয়াসহ বিভিন্ন অঞ্চলের সবজিক্ষেত তলিয়ে গেছে। ভেসে গেছে পুকুর ও মাছের ঘের।
কালীগঞ্জের রতনপুর, কালিকাপুর, বিষ্ণুপুর, মথুরেশপুরসহ বিস্তীর্ণ এলাকার মাছের ঘের, পুকুর ও সবজিক্ষেত ডুবে ব্যাপক ক্ষতি হয়েছে। দেবহাটার কোমরপুর, পারুলিয়া, সখীপুর ও নওয়াপাড়া ইউনিয়নের বেশ কিছু এলাকায় পানিতে তলিয়ে গেছে পুকুর ও ঘের। অনেক ঘরের মধ্যে পানি ঢুকেছে।
সাতক্ষীরা আবহাওয়া অফিসের ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা জুলফিকার আলী রিপন জানান, নিম্নচাপের প্রভাবে বৃহস্পতিবার সকাল থেকে শুক্রবার সকাল পর্যন্ত ১৪৩ মি.মি. বৃষ্টিপাত রেকর্ড করা হয়েছে। আবহাওয়া অফিস সূত্রে জানা গেছে, গত ৫ বছরের মধ্যে এই অঞ্চলে এটাই সর্বোচ্চ বৃষ্টিপাতের রেকর্ড।
সাতক্ষীরা কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরেরর উপপরিচালক কৃষিবিদ নূরুল ইসলাম, ভারি বর্ষণে জেলার নিম্ন এলাকা প্লাবিত হয়েছে। এতে ১ হাজার ৭০০ হেক্টর জমির রোপা আমন বীজতলার ক্ষতি হয়েছে। ৮৬০ হেক্টর রোপা আমন ধানের ক্ষতি হয়েছে। এছাড়া ৫০০ হেক্টর জমির সবজির ক্ষতি হয়েছে। বৃষ্টি আর না হলে ক্ষতির পরিমাণ ধীরে ধীরে কমবে বলে জানান কৃষিবিদ নূরুল ইসলাম।
মৎস্য অধিদপ্তর সূত্রে জানা যায়, ঘূর্ণিঝড় আম্ফানে সাতক্ষীরায় মাছের ক্ষতি হয় ১৭৬ কোটি টাকা। ইয়াসের ফলে সৃষ্ট জলোচ্ছ¡াসে মাছের ক্ষতি হয় ১৬ কোটি টাকা। সর্বশেষ বৃহস্পতিবার ব্যাপক বর্ষণে ৫৩ কোটি টাকার ক্ষতি হয়েছে।
এ বিষয়ে আশাশুনির শ্রীউলা এলাকার ঘের ব্যবসায়ী আলাউল ইসলাম জানান, বছরে তিন থেকে চারবার আমাদের মাছের ঘের ভেসে যাচ্ছে। কিন্তু প্রতিরোধে কোনো ব্যবস্থা নেই। ৫০ বিঘার একটি ঘেরে আম্ফানে আমার ক্ষতি হয়েছিল ২০ লাখ টাকা। ইয়াসে ক্ষতি ছিল ৫ লাখ টাকা। আর বৃহস্পতিবার অতিবর্ষণে আমার ঘের ভেসে ক্ষতির পরিমাণ দাঁড়িয়েছে প্রায় ১০ লাখ টাকা। ঘের ব্যবসা আগামীতে বাদ দেবেন বলে জানিয়েছেন আলাউল ইসলাম।
সাতক্ষীরা জেলা মৎস্য কর্মকর্তা মশিউর রহমান জানান, জেলার ৭টি উপজেলার মধ্যে কলারোয়া উপজেলা ছাড়া অন্য সব উপজেলায় কমবেশি ক্ষতি হয়েছে আশাশুনি, শ্যামনগর ও কালীগঞ্জ উপজেলার ১৯ হাজার ৪৫৯টি মাছের ঘের ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। ঘেরের আয়তন ১২ হাজার ৬৫ হেক্টর। মাছের ক্ষতির পরিমাণ ৫৩ কোটি ৪৯ লাখ টাকা।
জেলা প্রশাসক মোহাম্মদ হুমায়ুন কবির জানান, ঘরবাড়িসহ অন্যান্য ক্ষয়ক্ষতি নিরূপণের কাজ চলছে। সংশ্লিষ্ট ইউএনওদের মাধ্যমে প্রাপ্ত ক্ষতির পরিমাণ আজকের মধ্যে পেয়ে যাব। তখন কোথায় কেমন বরাদ্দ করতে হবে, নিরূপণ করব। খাদ্য সহয়তা প্রয়োজনে ৩৩৩ ফোন দিলে খাদ্য পৌঁছে যাবে। তিনি আরো জানান, চলমান অতিবৃষ্টিতে সৃষ্ট জলাবদ্ধতা নিরসনে জেলাব্যাপী ঘেরের সব অবৈধ নেট-পাটা স্থাপনকারীকে নিজ উদ্যোগে মধ্যে নেট-পাটা অপসারণ করার জন্য নির্দেশ দেয়া হয়েছে। অন্যথায় নেট-পাটা স্থাপনকারীদের বিরুদ্ধে আইনানুগ ব্যবস্থা নেয়া হবে।

মন্তব্য করুন

খবরের বিষয়বস্তুর সঙ্গে মিল আছে এবং আপত্তিজনক নয়- এমন মন্তব্যই প্রদর্শিত হবে। মন্তব্যগুলো পাঠকের নিজস্ব মতামত, ভোরের কাগজ লাইভ এর দায়ভার নেবে না।

জনপ্রিয়