শিরীন আখতার কর্মহীন মানুষের খাদ্যের দায়িত্ব সরকারের

আগের সংবাদ

ফ্রান্সের নারী নির্মাতার হাতেই এবার ‘স্বর্ণপাম’

পরের সংবাদ

দক্ষিণাঞ্চলে পেয়ারা বাজার মন্দা

প্রকাশিত: জুলাই ১৮, ২০২১ , ১২:০০ পূর্বাহ্ণ
আপডেট: জুলাই ১৮, ২০২১ , ১২:০০ পূর্বাহ্ণ

এম কে রানা, বরিশাল থেকে : দক্ষিণাঞ্চলে বাংলার আপেলখ্যাত পেয়ারার ভরা মৌসুম শুরু হয়েছে। প্রায় ৩৩ হাজার একর জমির ওপর এ পেয়ারার রাজ্য। দামও গতবারের তুলনায় প্রায় অর্ধেক। গত বছর পেয়ারার মণ ছিল ৭-৮শ টাকা কিন্তু এবার মতো ৪-৫শ টাকা দরে বিক্রি হচ্ছে। তবে বৈশ্বিক মহামারি করোনার কারণে পেয়ারার বাজার এখন মন্দা। আগের বছরগুলোর মতো এবারে তেমন একটা পর্যটক বা পাইকারদের দেখা মিলছে না। ফলে লোকসানের আশঙ্কা করছেন পেয়ারা চাষিরা। তাছাড়া সংরক্ষণের অভাবে চাষিদের লোকসানের মুখে পড়তে হয় প্রতিবছরই। যুগ যুগ ধরে পেয়ারা চাষাবাদ করে এলেও উদ্যোক্তার অভাবে হিমাগারসহ প্রক্রিয়াজাতকরণ শিল্প গড়ে না ওঠায় দিন দিন চাষাবাদে আগ্রহ হারাচ্ছেন পেয়ারা চাষিরা।
দক্ষিণাঞ্চলের পিরোজপুরের স্বরূপকাঠি, বরিশালের বানারীপাড়ার ও ঝালকাঠির ৩৮টি গ্রামজুড়ে সবচেয়ে বড় পেয়ারা বাগান অবস্থিত। প্রায় ৩৩ হাজার একর জমির ওপর এ পেয়ারার রাজ্য। দক্ষিণাঞ্চলের হাট-বাজার আর বাগান এলাকাজুড়ে পাকা পেয়ারার ম-ম গন্ধ চারদিকে ছড়িয়ে পড়েছে।
পুষ্টিমানের দিক থেকে একটি পেয়ারা ৪টি আপেলের সমতুল্য বলে কৃষি বিশেষজ্ঞরা অভিমত দিয়েছেন। তাই পেয়ারাকে ভালোবেসে ‘বাংলার আপেল’ কেউবা ‘গরিবের আপেল’ হিসেবে গণ্য করে। প্রতি বছর পেয়ারার মৌসুমে এ বাগানগুলোতে বিপুল পরিমাণে সুস্বাদু পেয়ারা ফল উৎপাদন হয়ে থাকে। বাংলার আপেল নামে খ্যাত এ পেয়ারা এখানে প্রচুর উৎপাদন হলেও সংরক্ষণের অভাবে চাষিদের লোকসানের মুখে পড়তে হয় প্রতি বছরই। কারণ পেয়ারা দ্রুত পেকে যায়। তাই দ্রুত বিক্রি না করতে পারলে চাষিদেরও পড়তে হয় লোকসানের মুখে।
এদিকে চলতি বছর পেয়ারায় দেখা দিয়েছে ‘এনথ্রাকনোস’ নামক এক ধরনের ভাইরাস। যা স্থানীয়ভাবে ছিটপড়া রোগ বলে শনাক্ত করা হয়। এছাড়া বর্ষায়ও পেয়ারা সংগ্রহ ও বিক্রিতে সমস্যা দেখা দেয়ায় উৎপাদিত পেয়ারা বাগানেই নষ্ট হতে শুরু করেছে। পেয়ারা বাগান ঘুরে জানা যায়, পিরোজপুরের স্বরূপকাঠি উপজেলার আটঘর, কুড়িয়ানা, আদমকাঠি, ধলহার, কঠুরাকাঠি, আন্দাকুল, জিন্দাকাঠি, ব্রাহ্মণকাঠি, আতা, জামুয়া, মাদ্রা, ঝালকাঠি, শশীদ, পূর্ব জলাবাড়ি, আদাবাড়ি ও জৌসার গ্রাম এবং ঝালকাঠি ও বরিশালের বানারীপাড়ার মোট ৩৬টি গ্রামের প্রায় ৩৩ হাজার হেক্টর জমিতে পেয়ারার চাষাবাদ হয়। কয়েক হাজার পেয়ারা বাগানে হাজার হাজার চাষি এ পেয়ারা চাষাবাদ করে আসছেন। আর পেয়ারার চাষাবাদ ও বিপণন ব্যবস্থার সঙ্গে ওই সব এলাকার ৭ থেকে ৮ হাজার শ্রমজীবী মানুষ প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষভাবে জড়িত থেকে জীবন-জীবিকা নির্বাহ করে আসছে। সাধারণত আষাঢ়, শ্রাবণ ও ভাদ্র মাসের অর্ধেক এই আড়াই মাস জমে উঠে পেয়ারা বেচা-কেনা। পেয়ারা চাষ ও ব্যবসাকে কেন্দ্র করে এসব এলাকায় গড়ে উঠেছে একাধিক ছোট-বড় ব্যবসাকেন্দ্র। স্থানীয়ভাবে বলা হয় পেয়ারার মোকাম।
এ মোকামগুলোর মধ্যে উল্লেখযোগ্য হচ্ছে- আটঘর, কুড়িয়ানা, ভিমরুলী, ডুমুরিয়া, শতদশকাঠি, বাউকাঠি। প্রতিদিন সকালে এসব মোকামে চাষিরা ছোট ছোট ডিঙি নৌকায় সরাসরি বাগান থেকে পেয়ারা নিয়ে আসেন পাইকারদের কাছে। তা কিনে ট্রলারযোগে নৌপথে নিয়ে যাওয়া হচ্ছে রাজধানী ঢাকা, চট্টগ্রামসহ দেশের বিভিন্ন জেলায়।
করোনার প্রভাবে অর্থনৈতিক মন্দার কারণে পেয়ারা চাষিরা পর্যাপ্ত সার এবং মাটি দিতে পারেননি। কিন্তু তারপরেও এবার পেয়ারার ভালো ফলন হয়েছে। ঝালকাঠির কাঁচাবালিয়া গ্রামের পেয়ারা চাষি জাহিদ মিয়া বলেন, আমাদের ভাগ্য ভালো খরার কারণে ফলন ভালো না হওয়ার ভয় ছিল। উপরওয়ালা সহায় থাকায় পেয়ারার ফলন এবার ভালোই হয়েছে। তিনি জানান, এবার মৌসুমের শুরুতেই ১৫ থেকে ২০ টাকা কেজি দরে প্রতি মণ পেয়ারা ৮০০ টাকায় বিক্রি করা হয়েছে। কিন্তু বর্তমানে পেয়ারার দাম কমে গেছে। প্রতি মণ ২০০ থেকে ২৮০ টাকা দরে বিক্রি করতে হচ্ছে।
ঝালকাঠির জগদীশপুর গ্রামের পেয়ারা চাষি বিমল মিস্ত্রি জানান, প্রতি বছর হিমাগারের অভাবে এসব এলাকার কয়েক কোটি টাকার পেয়ারা নষ্ট হয়ে যায়। কারণ পেয়ারা পচনশীল ফল। তাই দ্রুত পেকে যাওয়ায় তা সংরক্ষণ করে রাখার কোনো ব্যবস্থা নেই। পাশাপাশি পিরোজপুর, ঝালকাঠি ও বরিশালের উৎপাদিত পেয়ারা সড়ক পথে নেয়ার কোনো সঠিক ব্যবস্থা আজ পর্যন্ত গড়ে ওঠেনি। কুড়িয়ানার পেয়ারা চাষি বিশ্বজিৎ জানান, সরকারি বা বেসরকারি উদ্যোগে বড় সাইজের পেয়ারা প্রসেসিং করে বিদেশে রপ্তানি করে প্রচুর বৈদেশিক মুদ্রা অর্জন করা সম্ভব। চাষিরা জানিয়েছেন, এ অঞ্চলের সঙ্গে সড়ক পথের যোগাযোগ ব্যবস্থা গড়ে উঠলে পেয়ারা দ্রুত বাজারজাত করা যেত। উন্নত যোগাযোগ ব্যবস্থা হলে পেয়ারা চাষিদের বাগান থেকে সরাসরি ট্রাকযোগে প্রতি বছর মৌসুমের শুরুতেই ঢাকা-চট্টগ্রামসহ দেশের বিভিন্ন স্থানে পেয়ারা পৌঁছে দেয়া এবং পচন রোধ করা সম্ভব হতো। স্থানীয় আড়তদার হালিম সরদার বলেন, ভিমরুলী দক্ষিণাঞ্চলের সবচেয়ে বড় পেয়ারার মোকাম। মৌসুমে প্রতিদিন প্রায় ১০ হাজার মণ পেয়ারা বিক্রি হয়। তবে বাউকাঠি থেকে ভিমরুলী হয়ে কীর্তিপাশা পর্যন্ত সড়ক পথ হলে দ্রুত প্রতিদিনের পেয়ারা প্রতিদিন বিভিন্ন জেলায় পৌঁছানো সম্ভব হতো। তিনি আরো জানান, ভিমরুলী মোকাম থেকে নৌপথে খুলনা, ফেনী, ঢাকা, সিলেট, পটুয়াখালী, ভোলা, মাদারীপুর, নাটোর, বরিশালে হাজার হাজার মণ পেয়ারা যাচ্ছে। কিন্তু সড়ক পথে তাৎক্ষণিকভাবে এসব জেলায় পেয়ারা নেয়ার ব্যবস্থা থাকলে চাষিরা সঠিক মূল্য পেতেন। স্বরূপকাঠি উপজেলা কৃষি কর্মকর্তা কৃষিবিদ রিফাত সিকদার জানান, সংরক্ষণসহ কৃষিভিত্তিক শিল্প-কারখানা গড়ে উঠলে এ অঞ্চলের চাষিরা আর্থিকভাবে লাভবান হতো। তাছাড়া চাষিরা সরকারি পৃষ্ঠপোষকতা পেলে অধিক ফলন এবং জীবনমান উন্নয়নে সহায়ক হবে বলে মনে করেন তিনি।

মন্তব্য করুন

খবরের বিষয়বস্তুর সঙ্গে মিল আছে এবং আপত্তিজনক নয়- এমন মন্তব্যই প্রদর্শিত হবে। মন্তব্যগুলো পাঠকের নিজস্ব মতামত, ভোরের কাগজ লাইভ এর দায়ভার নেবে না।

জনপ্রিয়