বিমানের পাইলটদের কর্মবিরতির হুমকি

আগের সংবাদ

ইভ্যালি হাওয়া, বিপাকে গ্রাহক

পরের সংবাদ

ধর্ষিতা তুমি, তোমারই অপরাধে?

প্রকাশিত: জুলাই ১৬, ২০২১ , ১২:০০ পূর্বাহ্ণ
আপডেট: জুলাই ১৬, ২০২১ , ১২:০০ পূর্বাহ্ণ

কখনো কখনো বন্দুকের নল শক্তির উৎস হয় বটে, তবে চিরকালই যা সত্য- বন্দুক বা তরবারি থেকেও কলমের শক্তি অনেক বেশি। সেই শক্তি কোথাও কোথাও জনমত তৈরি করে বিপ্লবের আগুন উসকে দেয়। গান, কবিতা, প্রবন্ধ কিংবা সংবাদ প্রতিবেদন- ধারালো লেখনীর এই শক্তিকে তাই উপেক্ষা করা কঠিন। আর কঠিন বলেই সেই বিরুদ্ধস্বরের কলমটিকে ভেঙে দিতে, গুঁড়িয়ে দিতে এমনকি কলমধারীকে হত্যা করতেও কারো কারো হাত কাঁপে না। বিরুদ্ধস্বরের সেই কলমটি যদি আবার কোনো নারীর হাতে ধরা থাকে, তাহলে অন্যান্য বাধার সঙ্গে সঙ্গে অহরহ তার চরিত্র হনন কিংবা দলবেঁধে তাকে ধর্ষণসহ নানা যৌনহিংসা চলে। দেখা গেছে, পুরুষের মতো নারী সাংবাদিকের কলমও যদি কোনো শক্তির সমালোচনা করে, কোনো রাজনৈতিক নেতা, ব্যবসায়ী অথবা প্রশাসনিক কর্তাদের নানা দুর্নীতি আর অবৈধ কাজের ওপর সত্য উদঘাটনের চেষ্টা করে, তবে কলমধারীর ওপর অধিক মাত্রায় লাঞ্ছনা-পীড়ন এবং ধিক্কার বাসা বাঁধে। নারীর এত সাহস!
সমস্যাটি আন্তর্জাতিক। বিভিন্ন দেশেই এর অস্তিত্ব আছে। তবে বাংলাদেশ, পাকিস্তান, সৌদি আরব, আফগানিস্তানসহ কিছু দেশে এর ব্যাপকতা একটু বেশি এই যা। তারপরও আমরা দেখতে পাই, রাজনীতিবিদ ও প্রভাবশালী ব্যবসায়ীদের হাতে ইউরোপীয় ইউনিয়নের ফান্ড নয়ছয় হওয়ার খবর করতে গিয়ে ৩০ বছরের বুলগেরিয়ান সাংবাদিক ভিক্টোরিয়া মারিনোভাকে ধর্ষণ ও নৃশংস হত্যার শিকার হতে হয়। আইরিশ সাংবাদিক ভেরোনিকা গেরিনকে ‘ড্রাগ লর্ড’-এর বিরুদ্ধে একাধিক খবর প্রকাশের দায়ে গুলিতে ঝাঁজরা করে দেয়া হয়। শাসকের সমালোচক হয়ে ওঠায় রাশিয়ার সাংবাদিক আনা পলিৎ কোভস্কায়া, মাল্টার ডাফনে কারুয়ানা গার্লজিয়া এবং ভারতের গৌরী লঙ্কেশের মতো অসংখ্য মহিলা সাংবাদিকের রক্তে দেশ-বিদেশের মাটি ভিজে যায়। তারপরও মহিলারা থেমে নেই। কিন্তু তাদের থামানোর নানা ধরনের অভিনব পদ্ধতি আবিষ্কার হয়ে যায় নানা দেশে। কোথাও সামাজিক ব্যবস্থার দোহাই, কোথাও ধর্মের ব্যবস্থার দোহাই- নারীদের পেছনে টেনে আনার চেষ্টার যেন কোনো কমতি নেই। এমন একটি লক্ষ্যে সম্প্রতি পৃথিবীর প্রগতিশীল মানুষের বিরক্তির নজর কেড়েছিলেন পাকিস্তানের প্রধানমন্ত্রী ইমরান খান। তিনি একটি বিদেশি চ্যানেলকে দেয়া সাক্ষাৎকারে পাকিস্তানে বৃদ্ধি পেতে থাকা ধর্ষণের ঘটনা সম্পর্কে প্রতিক্রিয়ায় বলেন- ‘পুরুষরা রোবট নন, নারীর স্বল্পবাসে মন চঞ্চল হতে পারে। একজন নারী যদি স্বল্প পোশাক পরেন, তাহলে তার প্রভাব পুরুষ জাতির ওপর পড়তে বাধ্য যদি তারা যন্ত্রমানব না হন।’ নারীদের স্বল্পবাসের কারণেই পাকিস্তানে ধর্ষণ বাড়ছে বলে মনে করেন পাক প্রধানমন্ত্রী। প্রাক্তন ক্রিকেট অধিনায়কের এ মন্তব্য আন্তর্জাতিক বিভিন্ন ক্ষেত্রে বিতর্কের ঝড় তুলেছে। ইমরানকে আরো বলতে শোনা যায়, কামনা বা বাসনা সংবরণ করার জন্যই পর্দাপ্রথার প্রচলন হয়েছে। তবে এই সংবরণের জন্য ইচ্ছাশক্তি দরকার, যা সবার নেই। কয়েক মাস আগেও পাকিস্তানে বাড়তে থাকা ধর্ষণের ঘটনার কারণ হিসেবে অশালীনতাকে দায়ী করেছিলেন ইমরান। ইমরান খানের মতো আরো অনেকেই মেয়েদের স্বল্প পোশাক পরা এবং ধর্ষণের মধ্যে সম্পর্ক খুঁজে পান।
পৃথিবীর আনাচে-কানাচে ঘটে যাওয়া কিছু ঘটনার সঙ্গে এ বিষয়ে সম্পর্ক খুঁজে পাওয়ার চেষ্টা করছি। শহরের মাঝে একটি ফোয়ারায় হঠাৎই নগ্ন হয়ে নেমে পড়েন এক তরুণী। জনবহুল রাস্তায় এক তরুণীকে এ রকম অবস্থায় দেখে পথচলা মানুষ হতভম্ভ হয়ে যায়। ঘটনাটি ঘটেছে ইতালির রাজধানী রোমে। পিয়াজা কলোনা নামের এ ফোয়ারাটি ইতালির পার্লামেন্টের একেবারে কাছেই। ওই তরুণী পুলিশের নজর এড়িয়ে পথচারীদের সামনেই পোশাক খুলে ফোয়ারার জলে নেমে কয়েক মিনিট সাঁতার কাটেন। নিরাপত্তা কর্মীরা ছুটে আসে এবং তরুণীকে ফোয়ারার জল থেকে বেরিয়ে আসতে বলে। তরুণী ওঠে এসে চট করে পোশাক পরে তাদের দিকে স্মিত হাসি দিয়ে সেখান থেকে চলে যান।
১৯৭২ সালে ভিয়েতনাম যুদ্ধে বাবা প্রাণে বাঁচতে দুই সন্তানকে নিয়ে পালিয়ে আশ্রয় নেন গভীর জঙ্গলে। সেই থেকে টানা ৪১ বছর জঙ্গল ছেড়ে বাইরে আসেনি হু ভ্যান ল্যাং। জ্ঞান হওয়ার পর থেকেই তিনি মানব সভ্যতা থেকে অনেক দূরে। তাই মানব জীবনের অনেক জৈবিক চাহিদার বোধই তৈরি হয়নি ল্যাংয়ের মধ্যে। তিনি না বুঝেন যৌনতা, না জানেন মহিলা কাদের বলে।
২০১৩ সালে উদ্ধার হন ল্যাং। ইন্দোনেশিয়ার অন্যতম প্রদেশ পাপুয়ার রাজধানী জয়পুরার ক্যামপাং এনগ্রোসের মাঝামাঝি স্থানে ৮ হেক্টর এলাকাজুড়ে ছড়িয়ে আছে ম্যানগ্রোভ অরণ্য। পাপুয়ার বাসিন্দাদের পছন্দের খাবার ঝিনুক এবং নানারকম ফলের জোগান দেয় এ অরণ্য। তবে এ অরণ্যে প্রবেশের অধিকার শুধু নারীদের। নারীদের অবশ্য জঙ্গলে প্রবেশের বেশ কিছু নিয়ম আছে। এখানে নারীরা সম্পূর্ণ উলঙ্গ হয়ে প্রবেশ করে। তারা জঙ্গল-জলাভূমিতে দলবেঁধে ঘোরে এবং সমুদ্র লাগুয়া জলাভূমিতে নেমে ঝিনুক সংগ্রহ করে। যেহেতু নারীদের এ জঙ্গলে নগ্ন হতে হয়, তাই এ জঙ্গলে পুরুষদের দূরে রাখার নিয়ম চালু আছে। ৪৫ বছরের আগস্টিনা জানিয়েছেন, এখানে তারা চিৎকার করে নিজেদের মনের কথা বলেন। দুঃখের কথা, বলতে না পারা যন্ত্রণার কথাও তারা এখানে বলেন নিশ্চিন্তে। পলিগ্যামি অর্থাৎ মহিলা ও একাধিক যৌন সম্পর্ক নিয়ে বিতর্কের শেষ নেই। কারো মতে, এটা খুবই স্বাভাবিক। কারো মতে, একাধিক যৌন সম্পর্কে লিপ্ত হওয়াটা ঘোর অন্যায়। তবে বিশ্বের বেশ কিছু জায়গায় যুগ যুগ ধরে এই পলিগ্যামি প্রথা চলে আসছে। সেটাকে সামাজিকভাবে স্বীকৃতিও দেয়া হয়েছে কোথাও কোথাও। সম্প্রতি এ নিয়ে তুমুল বিতর্কের সৃষ্টি হয়েছে দক্ষিণ আফ্রিকায়। সেদেশে পুরুষের বহুবিবাহ স্বীকৃত হলেও নারীদের বহুবিবাহ মানতে নারাজ এক শ্রেণির মানুষ। কিন্তু এরই মধ্যে বিভিন্ন ধর্মীয় এবং সামাজিক নেতা, মানবাধিকার কর্মীদের সঙ্গে আলোচনার পর নারীদের পলিগ্যামি বৈধ করার একটি আইন আনার জন্য চূড়ান্তভাবে ফাইল পৌঁছেছে দক্ষিণ আফ্রিকার সরকারি টেবিলে।
ভারতের কিছু উপজাতির মধ্যে এবং দক্ষিণ প্রশান্ত মহাসাগরের মারকুয়েস দ্বীপের বাসিন্দাদের মধ্যেও নারীদের বহুবিবাহ রীতি দেখা যায়। ইন্দো-তিব্বত সীমানার কাছে একটি জেলা হিমাচল প্রদেশের কিন্নর। সেখানে আজো দ্রৌপদী প্রথা চালু আছে। সেখানে এখনো একজন নারীকে একই পরিবারের সমস্ত ভাইকে বিয়ে করতে হয়। ভাইদের মধ্যে যাতে জমি ভাগ না হয়, সেই ভাবনা থেকেই সেখানে দ্রৌপদী প্রথার প্রচলন হয়েছিল, যা আজো চালু আছে।
ধর্ষণ প্রসঙ্গে মেয়েদের আচরণের প্রশ্ন তোলায় অনেকের মতো বাংলাদেশের নির্বাসিত লেখিকা তসলিমা নাসরিনও প্রশ্ন তুলেছেন। ক্রিকেট অধিনায়ক হিসেবে থাকা অবস্থায় ইমরানের শার্টপরা ছবি দিয়ে সেই ছবির ক্যাপশনে তিনি লিখেছেন- ‘পুরুষ স্বল্প পোশাক পরলে মেয়েদের মনও চঞ্চল হয়, যদি না তারা রোবট হয়।’
এসব বিতর্ক নিশ্চয়ই সুখের নয়। নারীদের ধর্ষণের কারণ হিসেবে পুরুষকে দায়ী না করে নারীদের আচার-আচরণ এবং পোশাককে যারা দায়ী করেন, তাদের দেশেই একের পর এক ধর্ষণ বেড়ে যাচ্ছে। অথচ ইতালির যে মেয়েটি রাস্তার মাঝখানে ফোয়ারায় নগ্ন হয়ে হঠাৎ করে নেমে পড়ল, তাকে কিন্তু ধর্ষিতা হতে হয়নি। ইন্দোনেশিয়ার যেসব মহিলা নগ্ন হয়ে ম্যানগ্রোভের জঙ্গলে যাচ্ছে, তাদের কিন্তু পুরুষরা ধর্ষণ করতে লাইন ধরে দাঁড়িয়ে যাচ্ছে না। বরং দক্ষিণ আফ্রিকায় পুরুষের পলিগ্যামির সঙ্গে সঙ্গে নারীদেরও পলিগ্যামি প্রথা চালু করার চেষ্টা করা হচ্ছে। নারীদের প্রতি অমর্যাদা এবং বিদ্বান আর চিন্তকদের মূল্যহীন করে রাখা সমাজব্যবস্থায় সামনের দিনে গণতন্ত্রের পক্ষে এক বিপজ্জনক সংকেত লক্ষ্য করার সুযোগ রয়েছে বৈকি! উদ্বেগের সঙ্গে আমরা কয়েক দশক ধরেই দেখছি, সত্যিকারের জ্ঞানচর্চা প্রায় সম্পূর্ণ পার্শ্বরেখায়িত হয়ে গিয়েছে। জ্ঞান সাধনার শতাব্দী প্রাচীন মূল্য আর যেন স্বীকৃত হতে পারছে না কোনো কোনো অঞ্চলে। রাষ্ট্রীয় জীবনে চিন্তকদের প্রায় কোনো পরিসর থাকছে না, ভূমিকা তো নয়-ই। আর তার ফলেই কোনো কোনো দেশের সর্বোচ্চ পর্যায়ের কর্তাব্যক্তি ধর্ষণের মতো গভীর অপরাধের সঙ্গে জড়িত পুরুষের দোষ না ধরে বরং মেয়েদের স্বল্প পোশাকের দিকে আঙ্গুল তুলে পুরুষের এ জঘন্য অপরাধকে এক ধরনের পাশ কাটিয়ে যাওয়ার প্রবণতা দেখাতে পারেন।
এমন এক সমাজব্যবস্থায় এক অশ্রদ্ধেয় মূল্যবিশৃঙ্খলার মধ্যে বেড়ে ওঠা নতুন প্রজন্মের পক্ষে যথেষ্ট জ্ঞানচর্চা ও শ্রদ্ধা অর্জন করার জায়গায় পৌঁছতে পারা সহজ না-ও হতে পারে। শিক্ষকরা অবশ্য এখনো বিশ্ববিদ্যালয়ের শ্রেণিকক্ষে প্রবেশ করে উদ্ভাসিত মুখগুলো দেখে ভবিষ্যতের এক স্বপ্নের কথা ভাবেন। কিন্তু সঙ্গে সঙ্গে তাদের মন আশঙ্কাতেও ভরে যায়- এদের মধ্যে যারা প্রকৃত অগ্রণী, পূর্ণ বিকাশের জন্য তাদের দেশ ছাড়তে হবে না তো? এমতাবস্থায় জ্ঞানী ব্যক্তিদের যে ভূমিকা থাকতে পারত, বাণিজ্যমুখী যুগে জ্ঞানচর্চা সম্পর্কে নিস্পৃহতার মধ্যে তারও কোনো সম্ভাবনা দেখছি না। কেননা বৃহত্তর রাষ্ট্রজীবনে তাদের নিয়ে নেতারা মাথা ঘামান না, হয়তো নামও শোনেন না। তাই বিশেষ করে তৃতীয় বিশ্বের দেশে দেশে গণতন্ত্রের ক্ষেত্রে একটা বিপদসংকেত জ¦লে উঠেছে। আজ আমরা তাকেই সংসদে পাঠাই, রাষ্ট্র পরিচালনায় তাকেই অংশ নিতে দেখি- যারা দেশের সম্পর্কে, সামাজিক সমস্যা সম্পর্কে প্রায় কিছুরই খবর রাখেন না, এমনকি গুছিয়ে কথাও বলতে পারেন না। তারা শুধু সমাজ বিষয়কে বিচার করেন তাদের রাজনৈতিক স্বার্থসংক্রান্ত দৃষ্টিকোণ থেকে। ‘অনেকেই খাবে’ এমন কথাকে তারা উগড়ে দেন অনায়াসে। কিন্তু এমনভাবে চলতে থাকলে রাজনীতির ভাষা হয়ে উঠবে আরো তিক্ত ও অশোভন। জড়ত্বের বেষ্টনে আমরা আরো আড়ষ্ট হয়ে যাব; অসহায় নারীরা আরো বেশি করে অপরাধীদের কুনজরে পড়বে; ধর্ষিতা হয়েও ঘরকুনো হয়ে নিজেদের কপাল চাপড়াতে থাকবে। অসহায় এ বোধকে রক্ষা করতে এগিয়ে কি আসবে কোনো কলমের শক্তি একদিন?

মেজর (অব.) সুধীর সাহা : কলাম লেখক।
[email protected]

মন্তব্য করুন

খবরের বিষয়বস্তুর সঙ্গে মিল আছে এবং আপত্তিজনক নয়- এমন মন্তব্যই প্রদর্শিত হবে। মন্তব্যগুলো পাঠকের নিজস্ব মতামত, ভোরের কাগজ লাইভ এর দায়ভার নেবে না।

জনপ্রিয়