বিষাক্ত কেমিক্যালে নামি ব্র্যান্ডের নকল পানীয় তৈরি : রাজধানীতে গ্রেপ্তার ২

আগের সংবাদ

সংক্রমণ বাড়ার পথ খুলল!

পরের সংবাদ

বাংলাদেশে প্লাস্টিক রিসাইক্লিংয়ের সম্ভাবনা!

প্রকাশিত: জুলাই ১৫, ২০২১ , ১২:০০ পূর্বাহ্ণ
আপডেট: জুলাই ১৫, ২০২১ , ১২:০০ পূর্বাহ্ণ

দুই দশক ধরে বাংলাদেশের শিল্প খাতের অতি গুরুত্বপূর্ণ একটি অংশ হচ্ছে প্লাস্টিক ইন্ডাস্ট্রিজ। বাসাবাড়ির নিত্যপ্রয়োজনীয় দ্রব্যাদি থেকে শুরু করে দৃষ্টিনন্দন ঘর সাজানোর ফার্নিচার এমনকি আমাদের ব্যবহৃত দামি পোশাকও তৈরি হচ্ছে প্লাস্টিক থেকে। প্লাস্টিক হচ্ছে জৈব পলিমার থেকে তৈরি এমন একটি সিন্থেটিক অথবা সেমি সিন্থেটিক বস্তু- যাকে গলিত অবস্থায় যে আকার দেয়া হয় নিজস্ব ইলাস্টিক ধর্ম বজায় রেখে সে আকারের কঠিন বস্তুতে পরিণত হয়। জৈব পলিমারের রাসায়নিক বন্ধনের মাধ্যমে উৎপত্তি হওয়ায় এসব প্লাস্টিক সহজে পরিবেশ বিশ্লেষিত হয় না বা পচে না- যা অবশ্যই পরিবেশের ভারসাম্য রক্ষায় হুমকির সমতুল্য।
বাংলাদেশ প্লাস্টিক পণ্য উৎপাদন ও রপ্তানি এসোসিয়েশনের তথ্য মতে, বর্তমানে দেশীয় ৩০০টি উৎপাদন প্রতিষ্ঠান বাংলাদেশি টাকায় বার্ষিক প্রায় ৩০ বিলিয়ন প্লাস্টিক পণ্য রপ্তানি করে থাকে। এবং প্লাস্টিক পণ্যের দেশীয় বাজার মূল্য বাংলাদেশি টাকায় প্রায় ২০০ বিলিয়ন। প্লাস্টিক যেহেতু এক বিশেষ ধরনের রাসায়নিক পলিমারজাত; তাই এটি পরিবেশের সঙ্গে মিশে যেতে অনেক বেশি সময় প্রয়োজন হয়, যা কিনা বর্তমানে পরিবেশের দীর্ঘস্থায়ী ক্ষতির কারণ। অপচনশীল প্লাস্টিক বর্জ্যরে কারণে পরিবেশের উদ্ভিদকুল, প্রাণিকুল এমনকি জলজ প্রাণীদের অস্তিত্ব হুমকির সম্মুখীন। মাটিতে মিশে থাকা ক্ষুদ্র প্লাস্টিক কণা (মাইক্রোপ্লাস্টিক) জমির উর্বরতা তথা ফলসের উৎপাদন হ্রাস করে দিচ্ছে। তেমনি বাতাসে মিশে যাওয়া মাইক্রোপ্লাস্টিক প্রাণিকুলের, বিশেষত মানুষের নিশ্বাসের সঙ্গে দেহে প্রবেশ করে শ্বাসক্রিয়ার অবনতি ঘটাচ্ছে এবং হাঁপানি রোগীর সংখ্যাও বেড়ে যাচ্ছে। অন্যদিকে পানির সঙ্গে মিশে যাওয়া প্লাস্টিক কণা ক্যান্সার, হরমোনজনিত সমস্যা এমনকি বন্ধ্যত্ব রোগের সৃষ্টি করে। এছাড়াও খাদ্য শৃঙ্খলের মাধ্যমে এই ক্ষতিকর বর্জ্য মানবদেহে প্রবেশ করে থাকে। আর সবচেয়ে বেশি প্লাস্টিক দূষণের শিকার হয়ে থাকে গর্ভবতী নারী ও ছোট ছোট শিশুরা। এবং আরো উল্লেখযোগ্য যে, ২০১৫ সালে বিশ্বব্যাংক কর্তৃক প্রকাশিত এক রিপোর্টে বলা হয় বাংলাদেশে প্রতি বছর প্রায় ২৮ শতাংশ মানুষের মৃত্যুর কারণ হচ্ছে- প্লাস্টিক দূষণ। উন্নয়নের চাকা সচল রাখতে তাই প্লাস্টিক পণ্য উৎপাদনের পাশাপাশি এই বর্জ্যরে যথাযথ ব্যবস্থাপনা প্রয়োজন।
বাংলাদেশের অর্থনীতি সঞ্চালনকারী প্রযুক্তি ও পণ্য উৎপাদনের ক্ষেত্রে প্লাস্টিক ইন্ডাস্ট্রিজ-প্যাকেজিং, টেক্সটাইল, চিকিৎসা সামগ্রী, স্থাপনা, ইলেকট্রনিক্স, অটোমোবাইল, শক্তি উপাদনে ও গুরুত্বপূর্ণ সহায়ক ভূমিকা রাখে। প্রতি বছর গড়ে শতকরা ২০ শতাংশ হারে প্লাস্টিকের উৎপাদন বেড়ে চলেছে। তাছাড়া প্রতি বছর বাংলাদেশে প্রায় ২৫৩০ ধরনের প্লাস্টিক পণ্য উৎপাদিত হয়ে থাকে এবং উল্লেখযোগ্যভাবে দেশে ব্যবহৃত প্যাকেজিং। নিত্য ব্যবহার্য প্লাস্টিক পণ্যের বেশিরভাগই দেশীয়ভাবে উৎপাদিত ও প্রস্তুতকৃত। কিন্তু দুঃখের বিষয়, এসব প্লাস্টিক পণ্য উৎপাদনে ব্যবহৃত কাঁচামালের জন্য আমাদের আজো আমদানিনির্ভর হয়েই চলতে হচ্ছে। যদিও উৎপাদিত প্লাস্টিক পণ্যের কাঁচামাল জোগান দিতে আমাদের দেশ এখনো স্বনির্ভর নয়, কিন্তু বিকল্প পদ্ধতিতে কিছুটা হলেও আমরা আমাদের এই প্রতিবন্ধকতা অবশ্যই কাটিয়ে উঠতে সক্ষম। আর এই বিকল্প পদ্ধতি হচ্ছে প্লাস্টিক রিসাইক্লিং। প্লাস্টিক রিসাইক্লিংয়ের মাধ্যমে প্লাস্টিক পণ্যের কাঁচামাল কিছু অংশে হলেও পুনরুদ্ধার করা যায় এবং পুনরায় তা দ্বারা নতুনভাবে প্লাস্টিক দ্রব্যাদিও উৎপাদন করা যায়।
বাংলাদেশের জন্য দুঃখের হলেও সত্য যে এদেশে গত দুই দশকে প্লাস্টিক ইন্ডাস্ট্রিজের ব্যাপ্তি ঘটলেও প্লাস্টিক রিসাইক্লিংয়ে অত্যাধুনিক তেমন প্রসার ঘটেনি। এর পাশাপাশি প্লাস্টিক বর্জ্য ব্যবস্থাপনার ক্ষেত্রেও আমাদের উন্নত প্রকৌশলী ব্যবস্থাপনা মডেল ও বৈজ্ঞানিক চিন্তাধারার ঘাটতি রয়ে গেছে। ফলে প্লাস্টিক সামগ্রী ম্যানুফেকচার দ্বারা অর্থনৈতিক সমৃদ্ধ এলেও রিসাইক্লিং বাণিজ্যে তেমন সুফল আসেনি; যা বর্তমানে মূলত কেবল মেকানিক্যাল রিসাইক্লিং পর্যন্তই সীমাবদ্ধ। এর পর্যায়ক্রমিক ধাপগুলো হলো : বর্জ্য সংগ্রহ-বাছাইকরণ-কেটে টুকরোকরণ-ধৌতকরণ/বিশুদ্ধকরণ-শুকানো-ঠাণ্ডা পানিতে শীতলীকরণ-ক্ষুদ্রাতিক্ষুদ্র প্লাস্টিক কণায় কেটে ফেলা এবং সর্বশেষ উৎপাদন হচ্ছে প্লাস্টিক ফ্লেক্স, যা পরবর্তীতে পুনরায় ব্যবহারের জন্য প্লাস্টিক পণ্য উৎপাদন কারখানায় পাঠানো হয়। অন্যদিকের চিত্র হলো প্লাস্টিক রিসাইক্লিং বাণিজ্যে উন্নত দেশগুলো কিছু অর্থ বিনিয়োগের দ্বারা পাইরোলাইসিস প্রক্রিয়ায় ফিডস্টক রিসাইক্লিংয়েও তাদের সক্ষমতা প্রমাণ করছে এবং প্লাস্টিক তৈরির কাঁচামাল পুনরুদ্ধার করে রপ্তানি বাণিজ্যকে আরো শক্তিশালী করে তুলছে। যার কারণ হলো পাইরোলাইসিস প্রক্রিয়ায় প্লাস্টিক বর্জ্য থেকে ভালো পরিমাণ বায়ো-চার, বায়ো-ফুয়েল (ডিজেল) ও সিন-গ্যাস নামক জ¦ালানি উৎপাদন সম্ভব। এদিক বিবেচনায় উন্নত প্লাস্টিক রিসাইক্লিং যে কোনো দেশের জন্যই একটি অর্থনৈতিক ও বাণিজ্যিক সমৃদ্ধির উৎস; বিশেষত বাংলাদেশের মতো উন্নয়নশীল দেশের জন্য।
আমাদের দেশে যে প্রক্রিয়ায় প্লাস্টিক বর্জ্য সংগ্রহ করা হয় সেটি মোটেও স্বাস্থ্যসম্মত নয় এবং এতে স্বাস্থ্যঝুঁকিও আছে। প্লাস্টিক বর্জ্যরে সঠিক অপসারণ সম্পর্কে আমরা এখনো সচেতন নই। প্রতিনিয়তই অন্য সব বর্জ্যরে সঙ্গে প্লাস্টিক বর্জ্যকে মিলিয়ে ফেলা হচ্ছে এবং রাস্তাঘাট, নদীনালা তথাপি যেখানে সেখানে ফেলা হচ্ছে; যা পরিবেশের পাশাপাশি প্রাণিজগৎ কেউ বিষময় করে তুলেছে। তা ছাড়া ক্ষতিকর জানা সত্ত্বেও একবার ব্যবহার উপযোগ্য প্লাস্টিক পণ্য যেমন- পিইটি বোতল, পলিব্যাগের ব্যবহার কমানো যায়নি বরং দিন দিন এর চাহিদা বেড়ে চলেছে, যা উৎপাদিত প্লাস্টিক বর্জ্যরে আকারকে আরো ভয়াবহ রূপ দিচ্ছে। বিশেষজ্ঞরা বলছেন, ‘বাংলাদেশে এমন সময় আসতে বেশি দেরি নেই যখন এদেশের নদীগুলোতে মাছের পরিবর্তে প্লাস্টিক বর্জ্যই বেশি পাওয়া যাবে।’
এখন থেকেই প্লাস্টিক বর্জ্যরে স্থায়ী, উন্নত ও বিজ্ঞানসম্মত ব্যবস্থাপনা না করা গেলে অদূর ভবিষ্যতে এটি ভয়াবহ রূপ ধারণ করবে। সরকারের এখন থেকেই প্লাস্টিক বর্জ্য ব্যবস্থাপনায় বিশেষ গুরুত্ব দেয়া প্রয়োজন। প্লাস্টিক সামগ্রী উৎপাদনের মাধ্যমে কেবল চাহিদা পূরণ নয় রিসাইক্লিং বাণিজ্য দ্বারা বর্জ্য ব্যবস্থাপনার পাশাপাশি আর্থিক সঞ্চয়ের দিকটি বিবেচনায় আনার সময় এসেছে। রিসাইক্লিং বাণিজ্য প্রসার ঘটলে দেশের বেকার জনগণের একটি বড় অংশের জন্য কর্মক্ষেত্র তৈরি হবে। এর জন্য এখন সবচেয়ে বেশি প্রয়োজন প্লাস্টিক রিসাইক্লিং সম্পর্কে সঠিক ও উন্নত প্রকৌশলী ধারণা, সরকারের সার্বিক সহযোগিতা ও পর্যাপ্ত আর্থিক বিনিয়োগ এবং সর্বোপরি প্লাস্টিক বর্জ্য ব্যবস্থাপনার মাধ্যমে হুমকিকে আর্থিক সম্পদে রূপান্তরিত করার দৃঢ় মনোবল ও প্রচেষ্টা।

সাইদা ইসলাম সেঁজুতি : শিক্ষার্থী, জাতীয় কবি কাজী নজরুল ইসলাম বিশ্ববিদ্যালয়, ত্রিশাল, ময়মনসিংহ।
[email protected]

মন্তব্য করুন

খবরের বিষয়বস্তুর সঙ্গে মিল আছে এবং আপত্তিজনক নয়- এমন মন্তব্যই প্রদর্শিত হবে। মন্তব্যগুলো পাঠকের নিজস্ব মতামত, ভোরের কাগজ লাইভ এর দায়ভার নেবে না।

জনপ্রিয়