ডিএসইর ডিজিটাল সাবমিশন প্ল্যাটফর্ম চালু

আগের সংবাদ

লোভের আগুনে কত স্বপ্ন পুড়বে?

পরের সংবাদ

সিডনি শনবার্গের ডেসপাচ রক্তাক্ত বাংলাদেশ

প্রকাশিত: জুলাই ১০, ২০২১ , ১২:০০ পূর্বাহ্ণ
আপডেট: জুলাই ১০, ২০২১ , ১২:০০ পূর্বাহ্ণ

১৯৭১-এর ২৫ মার্চ ঢাকায় থেকে যেসব বিদেশি সাংবাদিক পাকিস্তানি শাসক ও সেনাবাহিনীর নারকীয় হত্যাযজ্ঞ প্রত্যক্ষ করেছেন তাদের অন্যতম সিডনি শনবার্গ। ২৭ মার্চ যে ৩৫ জন বিদেশি সাংবাদিককে হোটেল ইন্টারকন্টিনেন্টাল থেকে উঠিয়ে নিয়ে দেহ ও লাগেজ তল্লাশি করে নোটবই ও ফিল্ম রেখে ঢাকা থেকে বলপূর্বক উড়োজাহাজে উঠিয়ে দেয়া হয় তখনকার ৩৭ বছর বয়সি সিডনি তাদের মধ্যে অন্যতম সক্রিয়। বাংলাদেশের জন্য তার আগ্রহ এতটুকু কমেনি। এপ্রিলের দ্বিতীয় সপ্তাহে টানা চার দিন ভারত ও ‘পূর্ব পাকিস্তান’ সীমান্তে অবস্থান করে বস্তুনিষ্ঠ খবর নিউইয়র্ক টাইমস পত্রিকায় পাঠিয়েছেন। ডিসেম্বরের ৭ তারিখেই যশোর শত্রæমুক্ত হয়ে যায়। তার পাঠানো যশোরের স্বাধীন মানুষের আনন্দ নৃত্যের খবর ১ ডিসেম্বর নিউইয়র্ক টাইমসে ছাপা হয়। কম্বোডিয়ার রণাঙ্গন কাহিনী তাকে এনে দেয় পুলিৎজার পুরস্কার। সিডনি এইচ শনবার্গের (জন্ম ৭ জানুয়ারি ১৯৩৪-মৃত্যু ৯ জুলাই ২০১৬) কম্বোডিয়ার কাহিনীর ওপর চলচ্চিত্র ‘দ্য কিলিং ফিল্ডস’ অস্কার পুরস্কার লাভ করে।

রক্ত ঝরছে, বাঙালিরা মন্ত্রিপরিষদও গঠন করেছে
নিউইয়র্ক টাইমসের জন্য বিশেষ প্রতিবেদন
আগরতলা, ভারত, এপ্রিল ১৩।
যদিও পূর্ব পাকিস্তানি বিচ্ছিন্নতাবাদী নেতাদের অনেকেই নিহত হয়েছেন বলে জানা গেছে এবং এখনো পাইকারি হত্যাযজ্ঞ চলছে সেখানে হাইকমান্ডের এখনো যারা বেঁচে আছেন তারা একটি মন্ত্রিপরিষদ গঠন করেছেন। তাদের মধ্যে আছেন শেখ মুজিবুর রহমানের সেকেন্ড ইন কমান্ড তাজউদ্দীন আহমদ। শেখ মুজিবুর রহমানের আওয়ামী লীগ স্বাধীনতার উদ্যোগ নিলে পশ্চিম পাকিস্তানি সামরিক বাহিনী তাদের ওপর ঝাঁপিয়ে পড়ে।
এই প্রতিনিধি পূর্ব পাকিস্তান সীমান্তের ছয়টি স্থান পরিদর্শন করেন এবং অন্তত ছয়জন বিচ্ছিন্নতাবাদী নেতার সঙ্গে তার সাক্ষাৎ হয়- যারা বাঙালিদের দেশ বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী ও প্রতিরক্ষামন্ত্রী তাজউদ্দীন আহমদের নাম তাকে শোনান। যদিও একান্তে তারা স্বীকার করেছেন তাদের নেতা শেখ মুজিবুর রহমান পশ্চিম পাকিস্তানের কারাগারে আছেন, তিনিই তাদের প্রেসিডেন্ট। কেন্দ্রীয় সরকারে পশ্চিম পাকিস্তানিদের প্রাধান্য, তারা অবিরাম ঘোষণা করে যাচ্ছে যে, পূর্ব পাকিস্তানে সবকিছুই শান্ত এবং দ্রুত স্বাভাবিক অবস্থায় ফিরে আসছে। কিন্তু বাস্তব চিত্র তা থেকে সম্পূর্ণ ভিন্ন।

প্রতিদিনের যুদ্ধ
বিভিন্ন সেক্টরের ৭ দিনের যুদ্ধের খবর বিশ্বস্ততার সঙ্গে লিপিবদ্ধ হলে আশ্রয় নিতে অথবা বিচ্ছিন্নতাবাদীদের সঙ্গে যোগ দিতে পূর্ব পাকিস্তানিরা দলে দলে ছুটেছে; সামান্য যা কিছু সম্বল হাতে কাঠবোডের বাক্স ও বস্তা নিয়ে সাময়িক আশ্রয়ের জন্য হাজার হাজার শরণার্থী পূর্ব পাকিস্তান সীমান্ত অতিক্রম করে ভারতে চলেছে। এই প্রতিবেদক দেখেছেন প্রতিরোধকারীদের লুকোবার আশ্রয়স্থল গ্রামের বাড়িঘরগুলো পাকিস্তানি সৈন্যদের দেয়া আগুনে জ¦লছে। আগুনের গ্রাসে খড় ও বাঁশের চালাঘরগুলো ভস্মীভূত হয়েছে; আগুন ও ধোঁয়ায় যখন কুমিল্লা শহরের বাইরের আকাশে দেখা গেছে তখন চক্কর দিয়ে নেমে এসেছে শকুন, বসেছে কৃষকের শরীরের একাংশের ওপর, যা ততক্ষণে কুকুর এবং কাক বিচ্ছিন্ন করে রেখেছে।
আমরা আসলে এখন পর্যন্ত জানি না পূর্ব পাকিস্তানের সাড়ে সাত কোটি মানুষের কতজন সেনাবাহিনীর হাতে নিহত হয়েছে। নির্ভরযোগ্য সূত্র বলছে অন্তত দশ হাজার মানুষকে হত্যা করা হয়েছে, কোনো প্রতিবেদনের দাবি আরো বেশি। কেন্দ্রীয় সরকার সব বিদেশি সাংবাদিকের পূর্ব পাকিস্তানে প্রবেশের ওপর আনুষ্ঠানিক নিষেধাজ্ঞা আরোপ করে রেখেছে। স্বাধীনতা আন্দোলন গুঁড়িয়ে দিতে তারা পূর্ব পাকিস্তানের অর্থনৈতিক ভিত্তিগুলো তছনছ করে ফেলেছে, বর্তমান নেতৃত্ব ও আগামির সম্ভাব্য নেতৃত্ব নিশ্চিহ্ন করে চলেছে- বিচ্ছিন্নতাবাদীদের দখলে থাকা গ্রামবাংলা থেকে এর প্রমাণ পাওয়া গেছে, যদি সেখানেও সেনাবাহিনী কখনো কখনো আক্রমণ চালাচ্ছে। সম্পূর্ণভাবে পশ্চিমা সৈন্য নিয়ে গঠিত পাকিস্তানি সেনাবাহিনী আদেশ পেয়ে এখানকার ছাত্র, বুদ্ধিজীবী, অধ্যাপক, ডাক্তার এবং নেতৃত্ব দেয়ার উপযুক্ত জাতীয়তাবাদী আন্দোলনের সঙ্গে সরাসরি যুক্ত তাদের হত্যা করছে।
সামরিক অভিযানে এবং হত্যাকাণ্ডে কেন্দ্রীয় সরকারের সেনাবাহিনী পূর্ব পাকিস্তানের সামরিক অফিসার ও সাধারণ সৈনিকদের নিশানা করেছে। ২৫ মার্চের নিধনযজ্ঞ শুরু হওয়ার পর যারা গ্যারিসন ছেড়ে বেরোতে পারেনি এবং গেরিলাদের সঙ্গে যোগ দিতে পারেনি তাদের অধিকাংশ সপরিবারে নিহত হয়েছে। মাত্র ক’জন পালিয়ে যেতে সক্ষম হয়েছে। আকাশ থেকে বোমাবর্ষণ এবং নৌবাহিনীর গোলাবর্ষণের মাধ্যমে সেনাবাহিনী খাদ্য সরবরাহ ব্যবস্থা, চা কারখানা, পাটকল এবং গ্যাসক্ষেত্র অচল করে দিয়েছে।
একজন স্কটিশ চা-বাগান ম্যানেজার যিনি উত্তর-পূর্বাঞ্চলের চা-বাগান থেকে পালিয়ে ভারতে চলে এসেছেন; বললেন, তারা এর মধ্যেই দেশটাকে ২৫ বছর পিছিয়ে দিয়েছে। সেনাবাহিনীকে ঠেকাতে মুক্তিফৌজ রেললাইন, সেতু ও সড়ক উড়িয়ে দিচ্ছে। যদি তারা স্বাধীনতা লাভ করেও, তাদের আবার একেবারে শূন্য থেকে শুরু করতে হবে। এই ম্যানেজার এবং তার সঙ্গে পালিয়ে আসা অপর দুজন তাদের নাম প্রকাশ না করার অনুরোধ করলেন, কারণ তাহলে এখনো পূর্ব পাকিস্তানে রয়ে যাওয়া তাদের পরিবার নির্যাতনের শিকার হবে।

খালি ট্রাকের ওপর আক্রমণ
পাকিস্তানি রেডিও থেকে দাবি করা হয়েছে, ৯টি ট্রাকের একটি বহর ভারতীয় অস্ত্রশস্ত্রসহ আসার সময় পাকিস্তানি বোমারু বিমান এগুলো ধ্বংস করে দিয়েছে। প্রকৃতপক্ষে এই তিনজন পালিয়ে আসা বিদেশি বললেন, এই ৯টি ট্রাকই তাদের চা-বাগানে খালি অবস্থায় এক জায়গায় পার্ক করা ছিল। নির্ভরযোগ্য সূত্র থেকে জানা যায়, রাজধানী ঢাকা, চট্টগ্রাম কিংবা কুমিল্লার মতো শহরে জনসংখ্যার মাত্র ২০-২৫ ভাগ রয়ে গেছে। এ ধরনের অন্যান্য কেন্দ্রও জনশূন্য হয়ে পড়েছে। ঢাকা শহরের লোকসংখ্যা ১৫ লাখ, চট্টগ্রামে ৪-৫ লাখ এবং কুমিল্লায় প্রায় এক লাখ। পূর্ব পাকিস্তানের পূর্বাঞ্চলে প্রায় প্রতিটি সেক্টরে গোলন্দাজ কামানের গোলার আওয়াজ প্রতিদিনই শোনা যায়। প্রতিটি গেরিলা আক্রমণের এবং সেনাবাহিনীর তুলনায় অতি অল্প সংখ্যক এবং অল্প অস্ত্রসজ্জিত গেরিলার উৎপাতের পর বিপুলসংখ্যক সশস্ত্র পাকিস্তানি বাহিনী বেসামরিক জনগণের ওপর প্রতিশোধমূলক নিপীড়ন চালায়। ইস্ট বেঙ্গল রেজিমেন্টের সবাইকে শেষ করে দেয়ার উদ্যোগের সময় পালিয়ে আসা তরুণ বাঙালি লেফটেন্যান্ট বললেন, ‘বড্ড কাপুরুষ! আমরা এগিয়ে যাই, আমরা সৈনিকের পোশাকে থাকি- আমাদের গুলি করুক, কিন্তু তারা গুলি চালায় বেসামরিক জনগণের ওপর।’
বিচ্ছিন্নতাবাদীদের সৈন্যবাহিনীতে প্রশিক্ষিত সৈন্য, অস্ত্র, গোলাবারুদ, যানবাহন এবং অন্যান্য অত্যাবশ্যকীয় রসদের ভীষণ অভাব। তাদের কাউকে কাউকে খালি পায়ে অপারেশনে যেতে হয়। তাদের কাছে সবচেয়ে ভারি যে অস্ত্র আছে তা হচ্ছে ৩ ইঞ্চি মর্টার, যদিও তারা এর মধ্যে পাকিস্তানি বাহিনীর ভারি কিছু অস্ত্র আটক করতে সমর্থ হয়েছে। পাকিস্তানি মিলিটারিরা ব্যবহার করছে জেট ফাইটার বোম্বার্স, ভারি কামান এবং গানবোট, যার অধিকাংশ যুক্তরাষ্ট্র, সোভিয়েত ইউনিয়ন এবং কমিউনিস্ট চীনে তৈরি। পাকিস্তানিদের অভিযোগ ভারত সরকার পূর্ব পাকিস্তানে তাদের সৈন্য ও হাতিয়ার পাঠাচ্ছে- এ রকম কিছু এই প্রতিবেদক এখনো পর্যবেক্ষণ করেননি। পূর্ব পাকিস্তান অংশে কোনো ভারতীয় সৈন্য দেখা যায়নি।
রাজনৈতিক সংকট তুঙ্গে উঠার আগে পূর্ব পাকিস্তানে প্রায় ২৫ হাজার পাকিস্তানি সেনা সদস্য ছিল। হাজার মাইলের ব্যবধান ডিঙিয়ে উড়োজাহাজে সৈন্য পরিবহন করে সংখ্যা বৃদ্ধি করা হয়। দুই প্রদেশের মাঝখানে পুরোটাই ভারত। এই হিসাবে এখন পূর্ব পাকিস্তানে পশ্চিম পাকিস্তানি সৈন্যের সংখ্যা ৬০-৮০ হাজার। তাদের অধিকাংশ আবার পাঞ্জাবি এবং পাঠান। যদিও পাঞ্জাবি এবং পূর্ব পাকিস্তানের বাঙালি উভয়েরই অধিকাংশ মুসলমান তারাই বাঙালিদের তুচ্ছতাচ্ছিল্য করে আসছে। যেখানে বাঙালিদের স্বাধীনতা আন্দোলনের অধিকাংশ নেতাই পাশ্চত্যের অনুসারী এবং ওয়াশিংটনের সমর্থন প্রত্যাশা করে সেখানে যুক্তরাষ্ট্র কোনো কঠোর ভূমিকা গ্রহণ না করাতে বাঙালিরা তাদের তিক্ত সমালোচক। তাদের বিরুদ্ধে যে আমেরিকান অস্ত্র ব্যবহার হচ্ছে, এতে তারা আরো বেশি ক্ষুব্ধ।

আমরা সাহায্য প্রত্যাশা করেছিলাম
একজন বাঙালি সৈন্য তীক্ষè স্বরে চোখ সঙ্কুচিত করে আমেরিকান প্রতিনিধিকে বলল, ‘আপনি কি জানেন আমাদের হত্যা করার জন্য তারা আপনাদের উড়োজাহাজ, আপনাদের রকেট, আপনাদের ট্যাঙ্ক ব্যবহার করছে? আমরা সাহায্য আশা করেছি, এটা নয়।’ অন্যরাও একই ধরনের মন্তব্য করেছে। সেনাবাহিনী যে চায়নিজ অস্ত্র ব্যবহার করছে এতে বাঙালিরা বিস্মিত নয়, কারণ তারা ধরেই নিয়েছে পিকিং পাকিস্তান সরকারকে সাহায্য করবে। কোনো কোনো বাঙালি অফিসার মনে করেন চীনাদের সঙ্গে নিয়ে পাকিস্তান সেনাবাহিনী আক্রমণের পরিকল্পনা করেছে। তারা জোর দিয়ে বলছেন, পিকিংয়ের পূর্ণ সমর্থনের আশ্বাস না পেলে পাকিস্তান এ ধরনের অপারেশনে নামত না।
বাঙালিদের কেউ কেউ বিস্মিত : এমনকি পাকিস্তানের অভিযান শুরুর আগে পশ্চিমের শক্তি ও অন্যরা বাঙালিদের দাবির প্রতি সমর্থন জানাল না কেন? তাদের এখন মোহভঙ্গ ঘটেছে। এক বাঙালি ছাত্র মন্তব্য করেন, যেখানে তারা গণহত্যা চালাচ্ছে সেখানে পৃথিবীর মানুষ দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে দেখছে। কেউ কথা বলছে না। পৃথিবীর কি কোনো বিবেক নেই? তাদের এই তিক্ততা অবশ্য ভারতের জন্য নয়। ভারত পাকিস্তানি সামরিক অভিযানের নিন্দা করেছে এবং ভারত অন্যান্য দেশের সরকারকে বোঝাতে চেষ্টা করছে তারা যেন হত্যাকাণ্ড বন্ধ করতে পাকিস্তানের ওপর চাপ দেয়। ভারতীয় বেসামরিক জনগণ এবং কর্মকর্তারা সীমান্ত এলাকায় শরণার্থী এবং অন্যদের সহায়তা করছেন, তবে এই সংবাদদাতা পাকিস্তান নয়াদিল্লির বিরুদ্ধে যে অভিযোগ করেছে তার প্রমাণ পাননি- সীমান্ত পথে অস্ত্র পরিবহনের কোনো ঘটনা দেখেননি। নয়াদিল্লি এ অভিযোগ বারবার প্রত্যাখ্যান করে আসছে।

উদ্ধারকৃত বিদেশিদের কথা
কলকাতা থেকে পাঠানো সিডনি শনবার্গের এই প্রতিবেদনটি ৭ এপ্রিল ১৯৭১ নিউইয়র্ক টাইমসে প্রকাশিত : পূর্ব পাকিস্তানের চট্টগ্রাম সমুদ্রবন্দর থেকে সমুদ্র পথে ৩৪ ঘণ্টা পাড়ি দিয়ে পূর্ব পাকিস্তান থেকে উদ্ধার করে আনা ১০০ জন বিদেশি এখানে এসে পৌঁছেছেন। পাকিস্তানি সেনাবাহিনী স্বাধীনতা আন্দোলন দাবিয়ে রাখতে কি করেছে এই বিদেশিরা তার প্রত্যক্ষদর্শী।
ডেনমার্কের শিক্ষার্থী জন মার্টিনুসেন বললেন, ‘এটা ভয়ংকর হত্যাকাণ্ড’। নিউইয়র্কে নিউ রচডেলের আমেরিকান চাকরিজীবী নীল ও’টুল বললেন, ‘আমি দেখেছি সেনাবাহিনী বেসামরিক জনগণের ওপর দিয়ে প্রতিশোধ নিচ্ছে, নেবে। তিনি তার সংস্থার নাম উল্লেখ না করতে অনুরোধ জানালেন। একটি ব্রিটিশ কার্গো জাহাজে ১১৯ জন বিদেশি আজ অপরাহ্নে কলকাতা ডকে এসে পৌঁছেছেন। কার্গো জাহাজটির চট্টগ্রাম বন্দরে মালামাল নামাবার কথা ছিল। কিন্তু যুদ্ধ চলতে থাকায় তা করতে পারেনি। ১৭টি দেশের ১১৯ জনকে তুলে নিয়ে কলকাতা চলে এসেছে। বিদেশিদের মধ্যে বড় দুটি দল ৩৭ জন আমেরিকান এবং ৩৩ জন ব্রিটিশ। তারা যখন ক্ল্যান ম্যাকনামাস নামের জাহাজ ও জেটির সংযোজক পাটাতন দিয়ে নেমে আসেন সেখানে কূটনৈতিক, ভারতীয় নাগরিক এবং অনেক বিদেশি সাংবাদিকরা জমায়েত হন।
যদিও প্রত্যাগতদের কেউ কেউ কথা বলতে অনাগ্রহী ছিলেন তাদেরই কেউ আবার পূর্ব পাকিস্তানের দ্বিতীয় বৃহত্তম শহর চট্টগ্রামের ভয়ংকর চিত্র তুলে ধরছিলেন। শহরের ৪ লাখ মানুষ কেমন করে (পাকিস্তানি সৈন্যদের) এ আক্রমণ মোকাবিলা করছেন সে সম্পর্কে সামান্যই জানা গেছে। বিদেশিরা বলেছেন, কয়েকদিনের লড়াইয়ের পর সেনাবাহিনী, যাদের সবাই পশ্চিম পাকিস্তানি, পূর্ব পাকিস্তানি প্রতিরোধ বাহিনীকে শহর থেকে হটিয়ে দিয়েছে। তবে তারা বলেছেন, সেনাবাহিনীর নিয়ন্ত্রণ শহরের বাইরে পাঁচ মাইল অর্থাৎ কর্ণফুলী নদীর সীমান্ত পর্যন্ত। নদীর দক্ষিণে সবকিছুই মুক্তিবাহিনীর নিয়ন্ত্রণে। এই বাহিনীতে রয়েছে বেসামরিক বাঙালি, পূর্ব পাকিস্তান পুলিশ পূর্ব পাকিস্তান রাইফেলসের সদস্য, ইস্ট বেঙ্গল রেজিমেন্টের সৈন্য- সবাই এসে তাদের স্বাধীনতা আন্দোলনে যোগ দিয়েছেন। বিদেশিরা বললেন, গতকাল সকালে তারা যখন কলকাতা যাত্রা করেন, শহরের বাইরের গোলাগুলির শব্দ তাদের কানে আসছিল। অধিকাংশ নগরবাসী তাদের শহর ছেড়ে পালিয়েছেন এবং গ্রামাঞ্চলে আশ্রয় নিয়েছেন বলে প্রত্যাগতরা জানান।

সেনাবাহিনী বস্তি জ¦ালিয়ে দিচ্ছে
২৬ মার্চ শুক্রবার সকালে শহরে যুদ্ধ বেঁধে যায়। বিদেশিরা জানান, পাকিস্তানি সেনাবাহিনী শহরের অনেক বস্তি জ¦ালিয়ে এবং গুঁড়িয়ে দিয়েছে; এখানকার দরিদ্র মানুষগুলো ছিল স্বাধীনতার কট্টর সমর্থক। বাঁশ দিয়ে তৈরি এসব ঘরবাড়ির ছাইয়ের ভেতর এখনো কোথাও কোথাও ধিকিধিকি জ¦লা আগুন বিদেশিদের চোখে পড়েছে। তখন সেনাবাহিনীর নিয়ন্ত্রণে থেকে তারা চট্টগ্রাম ছাড়ার জন্য ভোরবেলা শহর ছেড়ে ডকের দিকে আসছিলেন।
পাকিস্তান সরকারের মুখপত্র রেডিও পাকিস্তান বলেছে, পূর্ব পাকিস্তানে সব কিছু শান্ত এবং জীবনযাত্রা স্বাভাবিক অবস্থায় ফিরে আসছে। ‘কিছুই শান্ত নয় এবং কোনো কিছুই স্বাভাবিক অবস্থায় ফিরে আসেনি’ বললেন মার্টিনুসেন। ৭ মাস আগে তিনি স্ত্রী কারেনকে নিয়ে চট্টগ্রাম এসেছেন। তার কাছে ডেনমার্কের আরহুম বিশ্ববিদ্যালয়ের মাস্টার্স ডিগ্রি কর্মসূচিতে পাকিস্তানের রাজনীতি নিয়ে প্রত্যক্ষ জ্ঞান অর্জন করতে এ দেশে এসেছেন। তিনি বললেন, ‘তারা পদ্ধতিগতভাবে গরিব মানুষের জেলাগুলো পুড়ে ফেলছে, মনে হচ্ছে এক এক করে তল্লাশি করা সম্ভব নয় বলেই তারা আগুন লাগাচ্ছে। হত্যা করা এবং ধ্বংস করাটা তারা খুব উপভোগ করছে বলে মনে হচ্ছে।’
২৩ বছর বয়সি এই ছাত্র জানালেন, ‘বহুসংখ্যক বাঙালিকে হত্যা করা হয়েছে। চারদিন আগেও এই নদীর একাংশে আপনি ৪০০ ভাসমান মৃতদেহ গুনে পেতেন।’ মার্টিনুসেন অনেক বর্ণনা দিলেন, পূর্ব পাকিস্তানিদের তাদের দোকানে ও রাস্তায় গুলি করে মেরে ফেলা হচ্ছে। তবে তিনি ভবিষ্যদ্বাণী করেছেন শেষ পর্যন্ত সাড়ে ৭ কোটি পূর্ব পাকিস্তানির বিজয় হবেই। তারা বহু বছর ধরে পশ্চিম পাকিস্তানি শোষণের প্রতিবাদ করে আসছেন, এখান থেকে হাজার মাইল দূরত্বে ভারত পেরিয়ে তারপর পশ্চিম পাকিস্তান।

স্বাধীনতার জন্য আন্দোলন
সরুদেহী এই ছাত্র বললেন, ‘অনেক বাঙালি তাদের বাংলাদেশ চাচ্ছেন। আমি জানি তারা সফল হবেন।’ বাঙালি জাতির দেশের নাম বাংলাদেশ- এটা বাংলাদেশের স্বাধীনতা আন্দোলনের নাম- বাংলাদেশ। ২৬ বছর বয়সি নীল ও’টুলের কণ্ঠে ডেনমার্কের ছাত্রটির কথাই প্রতিধ্বনিত হলো। ‘চট্টগ্রাম সেনাবাহিনী নিয়ন্ত্রণ করছে। নির্মম ও সন্ত্রাসী বাহিনী শহরের নিয়ন্ত্রণে। আরো সৈন্য আসছে। তারা বেসামরিক জনগণকে গুলি করছে। আমরা মৃতদেহ দেখেছি। আমরা মৃতের গলিত দেহের দুর্গন্ধ পেয়েছি। অনেক মারধর করছে, ভীষণ ভোগাচ্ছে আর বহিরাগতরা নির্বিচারে বাড়িঘরে আগুন দিচ্ছে, লুটতরাজ করছে।

প্রতিহিংসার আগুন
বহিরাগত বলতে কাদের বুঝিয়েছেন নীল ও’টুল ব্যাখ্যা করেননি, তবে এটা বোঝা যাচ্ছে তিনি পূর্ব পাকিস্তানে অবস্থানরত পশ্চিম পাকিস্তানিদের কথা বলেছেন। অন্য শরণার্থীরা জানিয়েছেন, অবাঙালি ব্যবসায়ীদের হত্যা করে বাঙালিরা প্রতিশোধ নিচ্ছে। বিদেশিরা জানালেন, সন্ধ্যা ৭টা থেকে ভোর ৫টা পর্যন্ত চট্টগ্রামে কারফিউ বলবৎ থাকে। তিনদিন বিদ্যুৎ সংযোগ বিচ্ছিন্ন ছিল, শহরের কোনো কোনো জায়গায় বিদ্যুৎ ফিরে আসছে, কাজ করার মতো কোনো বাঙালি শ্রমিক না থাকার কারণে বন্দর কার্যত অচল হয়ে পড়ে আছে।
তীব্র যুদ্ধের সময় বিদেশিদের কেউ কেউ বাড়ি ছেড়ে হোটেল আগ্রাবাদে আশ্রয় নিয়েছিল। হোটেলটি লড়াইয়ের কেন্দ্রস্থল থেকে দূরে। তাদের অনুপস্থিতিতে সৈন্যরা তাদের বাড়িতে ঢুকেছে বলে তাদের কেউ কেউ জানান। নিউইয়র্ক মন্টরোজের এডওয়ার্ড জে ম্যাকনানাম নামের একজন আমেরিকান প্রকৌশলী ঠাট্টা করে বলেন, সৈন্যরা খুব বিনয়ী। সত্যি বলতে তারা আমার ঘরে ঢুকে সব হুইস্কি খেয়ে ফেলেছে, কিন্তু সব গøাস আমাকে দিয়ে গেছে।

ড. এম এ মোমেন : সাবেক সরকারি চাকুরে, নন-ফিকশন ও কলাম লেখক।

মন্তব্য করুন

খবরের বিষয়বস্তুর সঙ্গে মিল আছে এবং আপত্তিজনক নয়- এমন মন্তব্যই প্রদর্শিত হবে। মন্তব্যগুলো পাঠকের নিজস্ব মতামত, ভোরের কাগজ লাইভ এর দায়ভার নেবে না।

জনপ্রিয়