এস কে সুর চৌধুরী ও তার স্ত্রীর ব্যাংক হিসাব স্থগিত

আগের সংবাদ

রূপগঞ্জে হতাহত বেড়েছে চার কারণে : ভয়াবহ অগ্নিকাণ্ডে ৫২ জনের মৃতদেহ উদ্ধার, আহত শতাধিক, এখনো নিখোঁজ ৫১ জন

পরের সংবাদ

বিপন্ন আফগানিস্তান : সমাধান দূরঅস্ত

প্রকাশিত: জুলাই ৯, ২০২১ , ১২:০০ পূর্বাহ্ণ
আপডেট: জুলাই ৯, ২০২১ , ১২:০০ পূর্বাহ্ণ

আফগানিস্তানের বর্তমান দুর্দশার জন্য দায়ী কে- এ প্রশ্নের জবাব অতি সোজা ও স্পষ্ট। এক কথায় মূলত মার্কিন তথা ইঙ্গ-মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র ও তাদের মিত্র দেশগুলো। তারা আফগানিস্তানে সোভিয়েট প্রভাবিত নজিবুল্লাহর মার্কসবাদী শাসন উৎখাত ও নজিবুল্লাহর পতনের জন্য মরিয়া হয়ে উঠেছিল।
এ ব্যাপারে তাদের যৌথ শক্তি যথেষ্ট মনে না হওয়ায় পাকিস্তানভিত্তিক চরম প্রতিক্রিয়াশীল, মধ্যযুগীয় মূল্যবোধসম্পন্ন তালেবান সেনা সৃষ্টি করে এন্তার ডলার অস্ত্র সরবরাহ ও প্রশিক্ষণের নামে। পাকিস্তানও বুঝতে পারেনি যে, তাদের এক আত্মঘাতী সমরে নামানো হয়েছে তাদের নামেমাত্র আধুনিক চেতনাটুকুও নষ্ট করে দিতে। পাকিস্তান এখন প্রতিদিনের রক্ত ঝরার মাধ্যমে তার মাশুল গুনছে।
আকর্ষণীয় এ ধর্মীয় যুদ্ধে একাধিক ধর্মীয় মৌলবাদী সংগঠন মধুর লোভে কাবুলে এসে হাজির, এমনকি ভাড়াটে উজবেক সেনারাও। গুলবুদ্দিন হেকমতিয়ার থেকে শুরু করে সৌদি রাজ ঘরানার ওসামা বিন লাদেন পর্যন্ত। সবচেয়ে সর্বনাশা প্রতিক্রিয়াশীল ব্যক্তিত্ব ছিল স্থানীয় মৌলবাদী নেতা মোল্লা ওমর। আফগানিস্তানে তালেবানি ও রক্ষণশীল ধর্মীয় মৌলবাদী শাসন প্রতিষ্ঠার পর যার নির্দেশে বিশ্বের পয়লা নম্বর বৌদ্ধমূর্তি ধ্বংস করা হয়। এ নিয়ে আধুনিক বহুত তোলপাড়।
মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের এত বড় আয়োজন কি বৃথা যেতে পারে? বিশেষ করে বিশ্বের সর্বাধুনিক পরাক্রমশালী শ্বেতাঙ্গ বাহিনীর পাশাপাশি লড়ছে নানা বর্ণের প্রতিক্রিয়াশীল রাজনৈতিক শক্তি। বিশেষ করে ওসামা বিন লাদেনের মতো বিত্তবান ও বুদ্ধিমান কুশংসিল ব্যক্তি।
আফগানিস্তান তথা কাবুল তার গুরুত্বপূর্ণ সীমান্ত দেশীয় রেখার জন্য রাজনৈতিক তাৎপর্যের অধিকারী হয়েও অনেকটা বাফার স্টেটের চরিত্র অর্জন করে সীমান্তবর্তী রাষ্ট্রগুলোর সঙ্গে শান্তিপূর্ণ বা কারো সঙ্গে বন্ধুত্ব সম্পর্ক রক্ষার কারণে। ভারতের সঙ্গে ধর্মীয় ভিন্নতা সত্ত্বেও ছিল সুসম্পর্ক। এই বিরাট কুরুক্ষেত্র যুদ্ধের সঙ্গে সম্পর্ক ছিল রক্ষণশীল আফগান উপজাতির। স্বভাবতই যুদ্ধজয় কঠিন নয়, সহজ হয়ে ওঠে নজিবুল্লাহ শাসনের পতন এবং নজিবুল্লাহর নিষ্ঠুর হত্যার মাধ্যমে। মূলত সোভিয়েতবিরোধী নীতির কারণে লাল চীনও এ রণ-আয়োজনে সমর্থন জুগিয়েছে।
একদিকে সাম্রাজ্যবাদী শক্তি, অন্যদিকে ধর্মীয় মৌলবাদী শক্তির সমন্বিত প্রচেষ্টায় বিজয় সম্পন্ন হওয়ার পর মার্কিন ও ন্যাটো সেনারা যতই পাহারায় থাকুক শাসনক্ষমতায় ঠিকই তালেবানসহ মৌলবাদীদের হাতে পরিচালিত হতে থাকে। কট্টর ধর্মীয় অনুশাসনে আফগানিস্তানের সামরিক-সাংস্কৃতিক ও শিক্ষাগত চেহারা ও চরিত্রের আমূল পরিবর্তন ঘটে যেতে থাকে। পূর্বোক্ত বৌদ্ধমূর্তি ধ্বংস তার প্রমাণ। পরিবর্তন ঘটে আফগানিস্তানের অভ্যন্তরীণ নীতির মতোই তার বিদেশ নীতির। সেখানে সাম্রাজ্যবাদীদের, বিশেষ করে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের প্রাধান্য। এই যে শিক্ষা-সংস্কৃতিতে গভীর রক্ষণশীলতা ও প্রতিক্রিয়াশীলতার প্রাধান্য তাতে আধুনিক চেতনার ইঙ্গ-মার্কিন পরাশক্তির কোনো আপত্তি ছিল না। তাদের উদ্দেশ্য সিদ্ধ হলেই হলো। সোভিয়েত প্রভাব যে আফগানিস্তান থেকে দূর করা গেছে তাতেই সাম্রাজ্যবাদী শক্তির উদ্দেশ্য সিদ্ধি সম্পন্ন। আফগানিস্তান গৃহযুদ্ধে জ¦লুক, তাতে ক্ষতি নেই। চীনেরও একই নীতি।
দুই.
কিন্তু যেখানে বহু ধারার শক্তির সমন্বয়, সেখানে মতভেদ অনিবার্য। চরম প্রতিক্রিয়াশীল তালেবানদের সঙ্গে অন্য মৌলবাদী শক্তির মতভেদ, বিশেষ করে ওসামা বিন লাদের সাম্রাজ্যবাদবিরোধী ভূমিকা লক্ষ্য করার মতো। ওসামা বিশেষ করে ক্ষুব্ধ ফিলিস্তিনি আরবদের বিরুদ্ধে ইসরায়েলের সহিংস হামলা এবং তাতে ইঙ্গ-মার্কিন শ্বেতাঙ্গ শক্তির সমর্থন ওসামার ক্ষোভ ও মার্কিন-বিরোধিতার প্রধান কারণ। মিত্র এবার শত্রæতে পরিণত।
এ সময় পর্বের সবচেয়ে বড় ও তাৎপর্যপূর্ণ ঘটনা আমেরিকার ‘টুইন টাওয়ার’ ধ্বংস এবং বহু লোকের প্রাণনাশ। কারা এই ধ্বংসকাণ্ড চালিয়েছিল তা নিয়ে আজো বিতর্ক শেষ হয়নি। ঘটনাটিকে অভিনন্দন জানিয়ে ওসামা বিন লাদেন তার মৃত্যু নিশ্চিত করেন। আমার ধারণা এ কাজটি ওসামার নয়। কিন্তু মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে বড়সড় আঘাত হানার কৃতিত্বে খুশির চোটে আত্মহারা হয়ে হামলাকারীদের অভিনন্দন জানান ওসামা। আর তাতেই যত বিপত্তি। সিআইএ ধরে নিল এ ঘটনার ‘মাস্টারমাইন্ড’ ওসামা বিন লাদেন। তার বিত্ত, শক্তি ও কৌশল বিবেচনায় এমনটি ভাবার কথা। পাকিস্তান সামরিক বাহিনীর একটি অংশ আশ্রয়-প্রশ্রয় দিলেও এর অন্য একটি মার্কিনপন্থি অংশ তার অবস্থানের কথা সিআইএর কাছে ফাঁস করে দেয়। পরিণামে সিআইএর হাতে নিরস্ত্র ওসামা হত্যাকাণ্ড, যা নিয়ে সমালোচনা কম ছিল না। মৃত ওসামা অনেকের সহানুভূতি অর্জন করে বিচারের দাবিতে।
তিন.
আফগানিস্তানে বেশ দীর্ঘ সময় মার্কিন সেনা সমর্থনের পুতুল সরকার দেশ শাসন করলেও সেখানে আধুনিকতার পত্তন করতে পারেনি তালেবানদের দাপটে, বিশেষ করে রাজধানীর দূরবর্তী অঞ্চলে। তালেবানি সন্ত্রাস, আত্মঘাতী হামলা অব্যাহত থেকেছে। তালেবানদের লক্ষ্য পূর্বেকার মতো পুরো আফগানিস্তান শাসন করা- তাদের মৌলবাদী নীতি সমাজের সর্বত্র প্রতিষ্ঠা করা, আফগান নারীদের অশিক্ষা ও অনাধুনিকতার অন্ধকারে ঠেলে দেয়া। এক মালালা এদের প্রতাপ ও প্রভাবের বিরুদ্ধে উল্লেখযোগ্য শক্তি নয়।
কাজেই বিপন্ন আফগানিস্তান ন্যাটো-মার্কিন সেনার সমর্থনপুষ্ট শাসনব্যবস্থা সত্ত্বেও বিশেষ করে নারী সমাজ- এরা সবাই আধুনিকতার মুক্ত হাওয়া থেকে অনেক দূরে। কী করবে আফগানিস্তান, এখন সমাধান কোথায়। সাম্রাজ্যবাদবিরোধীদের দাবি, আফগানিস্তান থেকে ইঙ্গ-মার্কিন-ন্যাটো সেনাবাহিনী অপসারণ। যে যুক্তিতে আফগানিস্তানের বুকে নজিবুল্লাহ আমলে সোভিয়েত সেনা অপসারণের দাবি তোলা হয়, সেই একই দাবি এ ক্ষেত্রেও। কিন্তু তাতে কি সমাধান মিলবে? সম্প্রতি নব্য মার্কিন প্রেসিডেন্ট প্রতিশ্রæতি মাফিক আফগানিস্তান থেকে তাদের সৈন্য প্রত্যাহার শুরু করলে তালেবান বাহিনী স্থানীয় সরকারকে সশস্ত্র সংগ্রামে অনেক জেলা থেকে হটিয়ে দিয়ে তাদের ক্ষমতা প্রতিষ্ঠা করছে। রীতিমতো অশুভ লক্ষণ। মনে করা যায়, পুরো বিদেশি বাহিনী অপসারিত হলে তালেবানরা শাসনক্ষমতা দখল করে নিতে পারে- সেটা কি গ্রহণযোগ্য হতে পারে গণতন্ত্রী বা প্রগতিবাদীদের কাছে? না হলে এর বিকল্প কী বা কোথায়। বিকল্প একটাই- শক্তিশালী গণতান্ত্রিক প্রগতিবাদী শক্তি গড়ে তোলা। এতকাল মার্কিনিরা সেটা করেনি বা করতে দেয়নি। না দিয়ে যে সমস্যা সৃষ্টি করেছে সেই অন্ধবৃত্ত থেকে বেরিয়ে আসা প্রকৃত গণতন্ত্রীদের পক্ষে মোটেই সহজ নয়। আর ইঙ্গ-মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র চাইবে তালেবানদের বিপরীতে সাম্রাজ্যবাদী তোষক পুতুল সরকার, যা এতদিন তারা চালিয়েছে। ইরাক একটি উৎকৃষ্ট উদাহরণ। অবস্থাদৃষ্টে মনে হচ্ছে ইঙ্গ-মার্কিন-ন্যাটো সেনা অপসারণের পর আগের অপ্রিয় তালেবানি শাসন প্রতিষ্ঠিত হবে- ভয়ংকর রক্ষণশীল সে শাসন। তাই কারো ধারণা- মন্দের ভালো বিদেশি সেনা। তাহলে কী দোষ ছিল সোভিয়েত সেনা সমর্থিত সরকারের? তারা তো একটি প্রগতিশীল রাষ্ট্র গঠন করত। তবু কোনো বিদেশি সেনাই মুক্ত কোনো দেশের মাটিতে কাম্য নয়- না মার্কিনি, না সোভিয়েত সেনা। স্বদেশে স্বদেশি শাসনই সর্বদা কাম্য।
আফগানিস্তানে এখন দরকার সর্বমতের গণতন্ত্রী আধুনিক চেতনার ঐক্য, সংগঠিত ঐক্য, যা তালেবানবিরোধী সংগ্রামে সক্ষম। আফগানিস্তান এখন ‘ডড়ৎংঃ ড়ভ ঃযব ঃরসব’-এ দিনযাপন করছে। এ অবস্থা থেকে তার মুক্তিতে সব গণতন্ত্রী শক্তির সাহায্য দরকার।
আহমদ রফিক : লেখক, গবেষক ও ভাষাসংগ্রামী।

মন্তব্য করুন

খবরের বিষয়বস্তুর সঙ্গে মিল আছে এবং আপত্তিজনক নয়- এমন মন্তব্যই প্রদর্শিত হবে। মন্তব্যগুলো পাঠকের নিজস্ব মতামত, ভোরের কাগজ লাইভ এর দায়ভার নেবে না।

জনপ্রিয়