গলায় খাবার আটকে মৃত্যু প্রতিবন্ধীর

আগের সংবাদ

নতুন সিনেমায় অপি করিম

পরের সংবাদ

গাধা-গরুর সাতকাহন

প্রকাশিত: জুন ২৯, ২০২১ , ১২:০০ পূর্বাহ্ণ
আপডেট: জুন ২৯, ২০২১ , ১২:০২ পূর্বাহ্ণ

আমরা বিভিন্ন পশুর নামে একে অপরকে ব্যঙ্গ-বিদ্রƒপ, হাসি-তামাশা করে থাকি- বানর, ছাগল, উল্লুক, বেল্লিক, শূকর, ভেড়া, হাতি, গণ্ডার, গরু, গাধা ইত্যাদি। তবে সর্বাধিক যে পশু দুটির নামে একে অপরকে গালাগাল দিয়ে থাকি, সেটা গাধা ও গরু। অথচ পশু দুটি মানুষের অনুগত উপকারী যেমন, তেমনি জীবন-জীবিকার অপরিহার্য অনুষঙ্গও বটে। ওই পশু দুটির নাম যখন মানুষের উদ্দেশ্যে বলা হয় তখন সেটা গালিতে পরিণত হয়। অথচ গৃহপালিত অধিক উপকারী পশু দুটির উপকারিতা সম্পর্কে সামান্য সহানুভূতিও কখনো আমাদের মনে রেখাপাত করে না। বাংলায় প্রচলিত প্রবচন আছে, ‘উপকারীকে বাঘে খায়।’ কথাটি পুরোপুরি না হলেও অনেকাংশে যে সঠিক সেটা মানতেই হবে। মানুষকে অবলা নিরীহ পশুর নামানুসারে গরু-গাধা বলে তিরস্কার করা তো অস্বীকার করা যাবে না।
গরু গৃহপালিত প্রাণী। গরুর বাজার মূল্য এখন তীব্র থেকে তীব্রতর। গরুর উপকারিতা সম্পর্কে কারোই অজানা নেই। কেননা আমাদের শিক্ষার্থীদের মধ্যে একজনও পাওয়া যাবে না, যে গরুর রচনা লিখেনি কিংবা পড়েনি। তাই গরুর উপকারিতা সম্পর্কে বলা নিরর্থক। সাহিত্যিক সত্যেন সেন পশুর প্রতি কিশোরদের মমত্ববোধ সৃষ্টির অভিপ্রায়ে রচনা করেছিলেন ‘লাল গরুটা’ নামক রচনাটি। পাঠ্যসূচিতেও সেটি অন্তর্ভুক্ত ছিল। কিন্তু হেফাজতিদের দাবির মুখে নত হয়ে রচনাটি সরকারের আদেশে পাঠ্যসূচি থেকে প্রত্যাহার করা হয়েছে। গরুর প্রতি কিশোর মনে ভালোবাসা জাগানো সহ্য করেনি হেফাজতিরা।
উপকারী গরুর অপকারিতার একটিও দৃষ্টান্ত জানা যায় না। কৃষিপ্রধান আমাদের দেশে গরুর সর্বোচ্চ ব্যবহার কৃষিতে। গাভীর দুধ আমাদের খাদ্য সংস্কৃতির অবিচ্ছেদ্য অংশ। গরুর মাংস আমাদের প্রোটিন চাহিদা পূরণে সহজলভ্য ছিল। কিন্তু এখন অতি উচ্চমূল্য, সাধারণের নাগালের বাইরে। আমাদের পার্শ্ববর্তী বৃহৎ ভারতের মোট জনসংখ্যার প্রায় ৬০ ভাগ মানুষ নিরামিষভোজি। তারা মাছ, মাংস এমনকি ডিম পর্যন্ত খায় না, ধর্মীয় আচারিক মতানুসারে। বৌদ্ধ-জৈন ছাড়াও প্রচুর হিন্দু ধর্মাবলম্বী সেখানে নিরামিষভোজি। ভারতের পশ্চিম, উত্তর এবং দক্ষিণের রাজ্যগুলোতে নিরামিষভোজিদের সংখ্যা অধিক। সেখানকার সর্বাধিক খাবারের হোটেলগুলো ভেজিটেরিয়ান। নন-ভেজ হোটেল পাওয়া গেলেও, খুবই অল্প। গরুর মাংসভোজি মুসলিম, খ্রিস্টান ব্যতীত সংখ্যাগরিষ্ঠ হিন্দু-জৈন ধর্মাবলম্বীরা গরুর মাংস খাওয়াকে ধর্মহানি বলে মান্য করে। বৈদিক যুগে হিন্দুরা গরুর মাংস খেলেও দুটি বিশেষ কারণে পরবর্তীতে তারা সেটা ত্যাগ করেছে। নিম্নবর্গের (হরিজন) হিন্দুদের মধ্যে গরুর মাংস খাওয়ার রেওয়াজ রয়েছে। তবে অতীতের তুলনায় কমেছে, ব্রাহ্মণ্যবাদীদের নিষ্ঠুর হস্তক্ষেপে। অথচ হিন্দু ধর্মের কোনো শাস্ত্রে কিন্তু গরুর মাংস খাওয়া নিষিদ্ধ নয়। শ্রীকৃষ্ণকে মামাদের অভিসম্পাত থেকে রক্ষায় পরিবার বিচ্ছিন্ন করা হয়েছিল। শিশু শ্রীকৃষ্ণ গাভীর দুধ পান করেই জীবন রক্ষা করেছিল। শিবের সহচর নন্দী আকৃতিতে-আদলে ষাঁড়। ভারতের বিভিন্ন মন্দিরে বিশালাকার পাথরের ষাঁড়ের মূর্তি দেখেছি। সেগুলো শিবের সহচর নন্দীর মূর্তি। নন্দীর মূর্তিকে প্রণাম ও পূজা করতেও দেখেছি। আচারিক নিয়ম পালনেই হিন্দুরা গরুর মাংস খায় না।
তবে অবাক করার বিষয় কাশ্মিরের মুসলমানরাও কিন্তু গরুর মাংস খায় না। সিংহভাগ মুসলিম অধ্যুষিত কাশ্মিরের শ্রীনগরের মুসলিম খাবার হোটেলগুলোতে লেখা ‘নো-বিফ’। কারণ অনুসন্ধানে জেনেছি, শ্রীনগরে সুফি-সাধক নূরউদ্দিন ওয়ালির কথা, তার মাজারও সেখানে রয়েছে। এই নূরউদ্দিনের ধর্ম মা ছিলেন এক হিন্দু সন্ন্যাসিনী। তার নাম লালেশ্বরী। শৈশবে এই ধর্ম মা নূরউদ্দিনকে নিজ স্তনপান করেছিলেন। হিন্দুরা নূরউদ্দিন ওয়ালিকে নুন্দঋষি বলে। ধর্ম মাতা লালেশ্বরীকে মুসলমানরা ডাকে লাল্লাদেদ। মৃত্যুর পূর্বে নূরউদ্দিন তার ভক্তদের উদ্দেশে তার হিন্দু মাতার স্তনদানের ঋণ শোধের জন্য বলেছিলেন। সেই ঋণ শোধের জন্যই কাশ্মিরের সংখ্যাগরিষ্ঠ মুসলমানরা গরুর মাংস খায় না। গরু জবাই করে না।
আমাদের নিকটবর্তী কলকাতায় সবচেয়ে সস্তা খাবার ছিল গরুর মাংস। গরুর মাংসের দাম এখন কয়েকগুণ বেড়েছে। তবে আমাদের তুলনায় এখনো অনেক কম। গরুর মাংসের মূল্যবৃদ্ধির কারণ জানতে চেয়েছিলাম বিহারি মুসলমান এক হোটেল মালিকের কাছে। তিনি বলেছিলেন, এখানকার মুসলিম-খ্রিস্টানরাই কেবল গরুর মাংস খায় না, হিন্দুদের মধ্যেও বড় অংশ গরুর মাংস খায়। চাহিদা বৃদ্ধিতেই গরুর মাংসের মূল্যবৃদ্ধি ঘটেছে। ৩৪ বছরের বাম শাসনামলে পশ্চিম বাংলায় অসাম্প্রদায়িক-ধর্মনিরপেক্ষতা সংস্কৃতি বিকাশের বিষয়টি অনস্বীকার্য। হিন্দুত্ববাদী মোদির জোয়ারে সারা ভারত স্রোতে গা ভাসালেও পশ্চিম বাংলা অসাম্প্রদায়িক চেতনায় হিন্দুত্ববাদী স্রোত মুক্ত ছিল। কিন্তু গত লোকসভায় এবং সাম্প্রতিক বিধানসভার নির্বাচনে দৃশ্যপট ১৮০ ডিগ্রি ঘুরে গেছে। বিধানসভায় ৭৭টি আসন লাভ করলেও, তৃণমূল কংগ্রেস ভোট পেয়েছে ২ কোটি ৮৭ লাখ এবং বিজেপি পেয়েছে ২ কোটি ২৮ লাখ। এছাড়া বিজেপির ৯২ প্রার্থী হেরেছে গড়ে ১ হাজার ভোটের ব্যবধানে। বামদের হটাতে তৃণমূল বিজেপির জন্য পশ্চিম বাংলায় বিস্তারের সুযোগ করে দিয়ে এখন নিজের জন্যই সেটা বুমরাং হয়ে দাঁড়িয়েছে। পাশাপাশি অসাম্প্রদায়িক পশ্চিম বাংলা এখন সাম্প্রদায়িক প্রদেশে পরিণত হতে চলেছে।
সাংবিধানিক ধর্মনিরপেক্ষ-গণতান্ত্রিক ভারত তার ঐতিহ্য মোদির শাসনামলে একে একে হারাচ্ছে। গো-রক্ষার নামে হিন্দুত্ববাদীদের হাতে অহরহ ঘটছে নিরপরাধ মানুষ হত্যা। গো-রক্ষায় নানা কালা-কানুন আরোপ করা হয়েছে এবং হচ্ছেও। মোদির সহচর বজরং দল, শিবসেনা, আরএসএস প্রমুখ চরমপন্থি হিন্দুত্ববাদীদের আসল উদ্দেশ্য ভারতকে হিন্দু রাষ্ট্রে পরিণত করা। যেহেতু ভারতীয় জনগণের নিরঙ্কুশ সমর্থন পেয়েই তারা ক্ষমতায় এসেছে। তাই তাদের আত্মবিশ্বাস ভারতকে হিন্দুরাষ্ট্রে পরিণত করার ক্ষেত্রে সংখ্যাগরিষ্ঠ জনগণের নিরঙ্কুশ সমর্থন তারা পাবে। মোদির শাসনামলেই বাংলাদেশে গরুর মূল্য বহুগুণ বৃদ্ধি পেয়েছে। আমাদের দেশে গরু না পাঠানোর আনুষ্ঠানিক ঘোষণা পর্যন্ত দিয়েছে। ভারতে মুসলমানদের ওপর সাম্প্রদায়িক আঘাত এলে আমাদের মৌলবাদীরা সে সুযোগ হাতাতে তৎপর হয়ে উঠবে। এতে সর্বাধিক লাভবান হবেন হিন্দুত্ববাদী নরেন্দ্র মোদি। বাংলাদেশে হিন্দু সম্প্রদায় অনিরাপদ অভিযোগ তুলে ভারতের হিন্দুদের আস্থা অর্জন ও সমর্থন পাওয়া এবং অহিন্দু দমন-পীড়নের পথ সুগম হবে। তেমন মওকার সুযোগ হিন্দুত্ববাদীরা গ্রহণের অপেক্ষায় যে নেই, সেটাও বলি কীভাবে?
গরুকে কেন্দ্র করে উপমহাদেশের রাজনীতি নতুন নয়। স্বয়ং গান্ধী পর্যন্ত গো-রক্ষার আন্দোলনে মুখ্য ভূমিকা পালন করেছিলেন। খেলাফতের সঙ্গে রাজনৈতিক ঐক্য গড়ার প্রশ্নে গান্ধী বলেছিলেন, মুসলমানদের ছুরির হাত থেকে গো-মাতাকে রক্ষায় এই চুক্তি তিনি করেছেন। ১৮৫৭ সালে সিপাই বিদ্রোহে হিন্দু-মুসলমানের ঐক্য রক্ষায় সম্রাট বাহাদুর শাহ জাফর পর্যন্ত কুরবানি ঈদে গরু জবাই নিষিদ্ধ করেছিলেন। নিজে দুম্বা কুরবানি দিয়ে সব মুসলমানকে গরু জবাই থেকে নিবৃত্ত করেছিলেন। হিন্দুত্ববাদী মোদির শাসনামলে গো-রক্ষার অজুহাতে ভারতে মানুষ হত্যা চলছে।
অর্থনৈতিক এবং রাজনৈতিক উভয়ক্ষেত্রে অধিক মূল্যবান গরুকে নিয়ে আমরা তামাশা করি। মূর্খদের গরু বলে গাল দেই। গরু শব্দটি অত্যন্ত নেতিবাচক রূপে হর-হামেশা নানা ক্ষেত্রে ব্যবহার করে থাকি। কিন্তু গরু যে মানুষের জীবনের চেয়েও মূল্যবান; তার অকাট্য প্রমাণ তো প্রতিবেশী ভারতে দৃশ্যমান। তারপরও গরু নিয়ে উপহাস, তুচ্ছ-তাচ্ছিল্য করতে আমরা দ্বিধা করি না। অথচ উপকারী গরুর প্রতি আমাদের আগ্রহের কমতি নেই। আমাদের প্রান্তিক মানুষের জীবন-জীবিকায় গরু অপরিহার্য অনুষঙ্গ। কুরবানি ঈদ এলে গরু কুরবানি দিতে মরিয়া হয়ে ওঠে। গরু কুরবানি দেয়া সামাজিক মর্যাদা বৃদ্ধির অংশ হয়ে দাঁড়িয়েছে। কে কতটি এবং কত বড় গরু কুরবানি দিচ্ছে, এ নিয়ে বিত্তবানদের মধ্যে শীতল প্রতিযোগিতাও রয়েছে। গরু কুরবানি দেয়া-না দেয়ার ওপর নির্ভর করে সামাজিক মর্যাদা রক্ষা ও হারানো ভয়।
সামগ্রিক বিবেচনায় গাধা ও গরুর উপকারিতার কথা অনায়াসে ভুলে ওই প্রাণী দুটির নামে যথেচ্ছ ব্যঙ্গ-বিদ্রƒপ করে থাকি। অথচ পশু দুটির উপকারিতার কথা বেমালুম ভুলে যাই। পলাশীর প্রহসন যুদ্ধের পর কারো নাম ‘মীর জাফর’ রাখা হয়েছে, তেমন প্রমাণ পাওয়া যায় না। ‘মীর জাফর’ বিশ্বাসঘাতকতার প্রতীকে পরিণত। কেউ বিশ্বাস ভঙ্গ করলে তাকে ‘মীর জাফর’ বলে গালি দিয়ে থাকি। যেমন পাকিস্তানি হানাদারদের নৃশংসতায় তাদের ‘হায়না’ বলা হতো। সেটাও ছিল প্রাসঙ্গিক। কিন্তু নিরীহ উপকারী প্রাণী গাধা-গরুকে নিয়ে উপহাস করা কতটা প্রাসঙ্গিক! অর্থনৈতিকভাবে প্রাণী দুটির ভূমিকা-মূল্য থাকলেও সামাজিক জীবনে প্রাণী দুটির প্রতি আমরা অকৃতজ্ঞতার পরিচয় দিয়ে আসছি। চূড়ান্ত বিচারের ভার পাঠকদের ওপর ন্যস্ত করে ব্যক্তিগত অনুভূতিই ব্যক্ত করলাম।

মযহারুল ইসলাম বাবলা : নির্বাহী সম্পাদক
নতুন দিগন্ত।
[email protected]

মন্তব্য করুন

খবরের বিষয়বস্তুর সঙ্গে মিল আছে এবং আপত্তিজনক নয়- এমন মন্তব্যই প্রদর্শিত হবে। মন্তব্যগুলো পাঠকের নিজস্ব মতামত, ভোরের কাগজ লাইভ এর দায়ভার নেবে না।

জনপ্রিয়