স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী : মাদক ঠেকাতে চুক্তি হয়েছে মিয়ানমার ও ভারতের সঙ্গে

আগের সংবাদ

আতঙ্কে মগবাজারের বাসিন্দারা

পরের সংবাদ

মুক্তিযুদ্ধের সংগঠকদের স্বীকৃতি ও বিতর্ক

প্রকাশিত: জুন ২৮, ২০২১ , ১২:০০ পূর্বাহ্ণ
আপডেট: জুন ২৮, ২০২১ , ১২:০০ পূর্বাহ্ণ

পঁচিশ মার্চের কালরাতের বিভীষিকাময় চিত্র ফোটে উঠে ব্রিটেনের বিভিন্ন কাগজে। হেরাল্ড ট্রিবিউন পত্রিকায় প্রকাশিত হয় পাকিস্তানি শাসকদের হত্যার চিত্র। প্রবাসীরা জানতে পারে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের স্বাধীনতার ঘোষণার কথা। ব্রিটেন প্রবাসীদের মাঝে সাড়া পড়ে। লন্ডনে গঠিত হয় ‘কাউন্সিল ফর দ্য পিপলস রিপাবলিক অব বাংলাদেশ’ নামের একটি সংগ্রাম পরিষদ। ২৭ মার্চ এ কমিটি গঠনের পরদিন ঐতিহাসিক ট্রাফলগার স্কোয়ারে আয়োজিত হয় প্রতিবাদ সভা। একের পর এক গঠিত হতে থাকে অ্যাকশন কমিটি। লন্ডন থেকে শুরু করে বার্মিংহাম, কভেন্ট্রি, ম্যানচেস্টার, ওল্ডহ্যাম ব্রাডয়োর্ড, সেফিল্ড, লুটন, সেন্টআলবন্স, বেডফোর্ড, অক্সফোর্ড, ব্রাইটন, হেজলিংটন, রচডেল, হাইড, কার্ডিফ কিংবা স্কটল্যান্ড অর্থাৎ যেখানে বাঙালি, সেখানেই গঠিত হয়েছে অ্যাকশন কমিটি। আর ওইসব আঞ্চলিক কমিটির সমন্বয়েই গঠিত হয় ‘অ্যাকশন কমিটি ফর পিপলস রিপাবলিক অব বাংলাদেশ ইন ইউকে’ নামের একটি শক্তিশালী কমিটি। এছাড়া গঠিত হয়েছিল ছাত্র সংগ্রাম পরিষদ। ছিল বামপন্থিদের নিজস্ব সংগঠন, ছিল যুবকদের ভিন্ন সংগঠন। প্রবাসের বাঙালি নারীরা লন্ডন নগরীতে মিছিল করেছে, ডাউনিং স্ট্রিটে স্মারকলিপি দিয়েছে। প্রতিবাদে প্রজ¦লিত ছিল আমাদের নারী সমাজও। ব্রিটেনে হাজার হাজার মানুষের সমাবেশ হয়েছে হাইড পার্কে। ব্রিটেনের বিভিন্ন শহর থেকে কোচভর্তি হয়ে বীর বাঙালিরা জমায়েত হয়েছে ওইসব সমাবেশে। পাশাপাশি শুরু হয় কূটনৈতিক যোগাযোগ।
লন্ডনের বাঙালিদের পাশাপাশি বাইরের শহরগুলোর বাঙালিরা যার যার অবস্থান থেকে এ যোগাযোগ রাখার চেষ্টা চালান। ১৩ মে কার্ডিফ অ্যাকশন কমিটির ৫ সদস্য বাংলাদেশের হত্যাযজ্ঞ নিয়ে ব্রিটিশ পার্লামেন্টে আলোচনা উত্থাপন ও বাংলাদেশকে স্বীকৃতিদানের জন্য অনশন শুরু করেন। কারণ পরদিন ছিল পার্লামেন্টে বাংলাদেশবিষয়ক আলোচনা। এ আলোচনা ছিল টানা ২৬ ঘণ্টার। এভাবে যুক্তরাজ্যের সব প্রান্তে ছড়িয়ে পড়া বাঙালিরা স্ব-স্ব ক্ষেত্র থেকে চেষ্টা করেছেন বাংলাদেশের দুর্যোগময় পরিস্থিতিতে আন্তর্জাতিক সহানুভূতি আদায়ের। ব্রিটেনের তৎকালীন লেবার দলীয় এমপি ডগলাসম্যানের বাংলাদেশ নিয়ে উত্থাপিত প্রস্থাবে ৩০০ এমপি স্বাক্ষর করেন। বাংলাদেশের এই ভয়াবহ পরিস্থিতিতে ব্রিটিশ সরকার নীরব না থাকার জন্য তাদের প্রস্থাবে সরকারের প্রতি আহ্বান জানান। ওইদিন অর্থাৎ ১৪ মে ফরেন সেক্রেটারি রিচার্ড উড বাঙালিদের জনপ্রিয় এমপি পিটার শোর স্যার ফেডারিক বেনেটসহ ২০ পার্লামেন্ট সদস্য বাংলাদেশবিষয়ক আলোচনায় অংশ নেন। এই বিতর্ক কিংবা আলোচনা পরদিন অর্থাৎ ১৫ মে ব্রিটেনের মূলধারার গণমাধ্যমে গুরুত্বের সঙ্গে প্রচারিত হয়, যা ব্রিটেনসহ বিশ্ববাসীর দৃষ্টি বাংলাদেশমুখী করতে সহায়তা করে। দাতা দেশগুলোতে লন্ডন অ্যাকশন কমিটি ধরনা দিয়েছে পাকিস্তানকে সহযোগিতা না করার জন্য।
আন্তর্জাতিক যোগাযোগের পাশাপাশি যে দায়িত্বটা সেই কঠিন সময়ে পালন করেছিল, তা হলো উদার হাতে চাঁদা প্রদান। কতিপয় পাকিস্তান প্রেমিক ছাড়া ব্রিটেনের এমন কোনো বাঙালি নেই, যিনি মুক্তিযুদ্ধের প্রয়োজনে পাউন্ড দিতে কার্পণ্য করেছেন। ব্যবসায়ী, শ্রমিক, পেশাজীবী নিজ নিজ অবস্থান থেকে চাঁদা দিয়েছেন। দেখা গেছে, প্রত্যেক বাঙালি বিশেষত শ্রমিক যারা সপ্তাহান্তে বেতন পেতেন, তারা এই বেতনের একটা উল্লেখযোগ্য অংশ দিয়ে দিতেন মুক্তিযুদ্ধের ফান্ডে। তাই তো দেখা যায়, বর্তমান সময়ের তুলনায় অল্প উপার্জনকারী দেশপ্রেমিক বাঙালিরা প্রায় সাড়ে ৩ লাখ পাউন্ডের চাঁদা তুলেছে সে সময়। এবং স্বাধীনতার পর এই অর্থই নাকি বাংলাদেশের প্রথম বৈদেশিক মুদ্রা হিসেবে পরিগণিত হয়।
পাকিস্তানের ক্রিকেট টিম এপ্রিলের কোনো এক সময়ে খেলতে আসে ব্রিটেনে। সেখানে ছিল না কোনো বাঙালি খেলোয়াড়, ব্রিটেনের বাঙালিরা এতে ক্ষুব্ধ হয়, বিক্ষোভ করে শত শত বাঙালি। ২৬ বাঙালি ওইদিন গ্রেপ্তার হন।
এছাড়া একাত্তরের কোনো এক সময় পাকিস্তান হাইকমিশনে বিক্ষোভ করতে গিয়ে আহত হয়েছে মানুষ। গ্রেপ্তারও বরণ করতে হয়েছে ১১ জনকে। এর মধ্যে ইব্রাহিম আলী নামে একজনকে ৬ সপ্তাহের জন্য কারাগারেও যেতে হয়। এই প্রবাসে ক্রমেই জন্ম নিতে থাকে পাকিস্তানিদের প্রতি ঘৃণা। অবিশ্বাস আর ঘৃণার মধ্য দিয়ে পাকিস্তানি আর বাঙালিদের মাঝে বাড়তে থাকে বিদ্বেষ। দাঙ্গা-কলহ হয়ে উঠে এক নৈমিত্তিক ব্যাপার। আর এরই নির্মম শিকার হন আব্দুন নূর নামের একজন। বৃহত্তর সিলেটের ওই নূরই সম্ভবত প্রথম কোনো মানুষ, যিনি স্বাধীনতার নাম নিয়ে নিহত হন কোনো এক পাকিস্তানির হাতে প্রবাসে। একে সাধারণ হত্যা বলে চালিয়ে দিতে চাইলেও এটা কি আসলেও তাই। কারণ এটা ছিল পাকিস্তানি আর বাঙালি দ্ব›দ্ব এবং জাতিগত এই দ্ব›েদ্বরই নির্মম পরিণতিতে স্বাধীনতার বলি হলেন আব্দুন নূর। আর এ অর্থে তিনি একাত্তরের শহীদ।
ব্রিটেন প্রবাসী অগণিত বাঙালির মুক্তিযুদ্ধে অসাধারণ ত্যাগের ছোট্ট একটা অংশ মাত্র ওপরের এই বর্ণনা। কিন্তু তবুও উঠে এসেছে একটা চিত্র। রাজাকারদের দোসর আবুল হায়াত, হাজি রুপা মিয়া কিংবা সাজিদ আলীদের মতো কিছু নগণ্যসংখ্যক দেশ দ্রোহী ছাড়া সব বাঙালিই একটা নতুন স্বাধীন বাংলাদেশের অভ্যুদয়ের জন্য কাজ করেছেন। ব্রিটেন প্রবাসী সেই সময়ের অনেকেই এখন আর বেঁচে নেই। সে সময়ের তরুণ কেউ কেউ এখন বয়সের ভারে ন্যুব্জ কিংবা অবসর জীবন কাটাচ্ছেন।
সে রকমই একজন বাস করেন নর্থ ইংল্যান্ডের রসেনডেলে। তিনি রসেনডেল বাংলাদেশ এসোসিয়েশনের প্রতিষ্ঠাতা সভাপতি। ব্রিটেনে বাংলাদেশিদের অবস্থান আর ইতিহাস নিয়ে ইতোমধ্যে যার বইও বেরিয়েছে দুই-তিনটি। যিনি ১৯৬৩ সালে এসেছিলেন ব্রিটেনে। তারপর বহু ইতিহাসের সাক্ষী। তিনি তার তারুণ্যে প্রত্যক্ষ করেছেন ব্রিটেনে মুক্তিযুদ্ধের সাংগঠনিক প্রক্রিয়া। যোগ দিয়েছেন মিছিল-সমাবেশে। তিনি হলেন এম এ মিয়া, যাকে লাল মিয়া নামে সবাই চিনে, ওই মানুষটি বলেছেন, কীভাবে তারা বরফ ভেঙেছেন, হাইড পার্কে গেছেন কোচভর্তি মানুষ নিয়ে। কীভাবে মানুষের বাসায় বাসায় গিয়ে মানুষের কাছ থেকে চাঁদা সংগ্রহ করেছেন। তিনিই জানালেন নর্থ ইংল্যান্ডের হাইড শহরের সে সময়ের এক তরুণ বাঙালির কথা, যিনি এখন অসুস্থ, তাকে আমিও জানি, যিনি ম্যানচেস্টারে পাকিস্তানি হাইকমিশনারকে চেয়ার ছুড়ে মেরেছিলেন, বিক্ষোভ দেখাতে গিয়ে।
এম এ মিয়া দুঃখ করে বললেন, আজ যাদের নাম দেখলাম, তাদের একজনের নাম আমি জানি, তাও শুনেছি মাত্র ক’বছর থেকে, তিনি রাজনৈতিক নেতা হওয়ার পর। অন্য ১১ জন হয়তো অবশ্যই মুক্তিযুদ্ধ সংঘটিত করতে কাজ করেছেন, তবে নেতৃত্বে তাদের দেখিনি- তিনি আফসোস করে বললেন। তিনি নর্থ ইংল্যান্ডের কয়েকজন মানুষের নাম উচ্চারণ করে বললেন এদের রাত-দিন খেটে যাওয়ার কথা। নর্থ ওয়েস্ট ইংল্যান্ডের ক’জন ব্যবসায়ীর অর্থনৈতিক সহযোগিতার কথা তিনি তোলে ধরে বললেন, এদের রেস্টুরেন্ট ছিল যেন মুক্তিযুদ্ধকালীন বাংলাদেশি একেকটা কার্যালয়। তিনি ক্ষোভের সঙ্গে উচ্চারণ করলেন, এদের নাম তো আসতে পারত। লন্ডনে যারা কাজ করেছেন, এক বাক্যে তাদের অনেকের নাম নিলেন তিনি, যাদের নাম সর্বাগ্রে আসা উচিত ছিল বলে মন্তব্য করেন এম এ মিয়া।
ব্রিটেনের মাত্র ১২ জনকে বাংলাদেশের মুক্তিযোদ্ধা মন্ত্রণালয় স্বীকৃতি দিয়েছে ’৭১-এ মুক্তিযুদ্ধে অবদানের জন্য। ব্রিটেনে এ নিয়ে শুরু হয়েছে তুমুল বিতর্ক। সমাজকর্মী, লেখক-সাংবাদিক এমনকি ক্ষমতাসীন দলের রাজনৈতিক নেতাকর্মীরা এ নিয়ে সোচ্চার। সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে এ নিয়ে চলছে ব্যাপক সমালোচনা। এমনকি বাংলাদেশ হাইকমিশন এ নিয়ে বিবৃতি দিতেও বাধ্য হয়েছে। আওয়ামী লীগের একজন পরিচিত নেতা তার ফেসবুক স্ট্যাটাসে বাংলাদেশের মুক্তিযোদ্ধা মন্ত্রণালয়ের সাম্প্রতিক স্বীকৃতিপ্রাপ্ত একজনের নাম না উল্লেখ করে লিখেছেন, “নেতাকে ১৯৭৫-এ বঙ্গবন্ধু হত্যার পর হিথরো এয়ার পোর্টে জিজ্ঞাসা করা হয়েছিল বঙ্গবন্ধুবিহীন বাংলাদেশ কেমন চলছে, নেতা প্রতিউত্তরে বলেছিলেন, ‘মুশতাক ভাই ভালোই চালাচ্ছেন’। আর এখন মুক্তিযোদ্ধা, বেহায়া!”
যাকে তিনি বেহায়া বলেছেন, তার এ ঘটনা অনেকেই জানেন, কিন্তু আওয়ামী লীগের এ নেতা বিষয়টি আবারো তোলে ধরলেন। এ সময়ে এ রকম সাহসী কথাগুলো উচ্চারিত হওয়া প্রয়োজন।
এ রকম ‘বেহায়া’সহ যাদের নাম এসেছে, তারা যে মুক্তিযুদ্ধের সময় ব্রিটেনে ছিলেন না, তা কেউ অস্বীকার করছে না। কিন্তু তার আদৌ কোথায় কী করেছেন, তাদের খুব একটা হাদিস মিলছে না, হয়তো নীরবে কাজ করেছেন? হাজার হাজার মানুষের সঙ্গে কয়েকজন মহিলা জোরেশোরে রাজপথ প্রকম্পিত করে সে সময় বিদেশিদের চোখ কেড়েছিলেন, কিন্তু পরিচিত এবং বহু উচ্চারিত শত শত মানুষের একজনের নামও এই ১২ জনের মাঝে আসেনি।
সবচেয়ে বিস্ময়ের ব্যাপার হলো মন্ত্রণালয়ের সচিব বলেছেন, এরপর থেকে আর কোনো আবেদন গ্রহণ করা হবে না। তার এ কথাটা নিঃসন্দেহে আপত্তিকর। আপত্তিকর এজন্য যে, তার কথায় মনে হচ্ছে এই ১২ জন কিংবা তাদের পক্ষের উকিলরা কাকুতি-মিনতি করে হাত কচলিয়ে তাদের রিকগনিশনটা আদায় করেছেন এবং মন্ত্রণালয়ও বিরক্ত হয়েই এই স্বীকৃতিটা দিয়েছে। তা না হলে কোন স্পর্ধায় তিনি বলতে পারেন আর কোনো আবেদন গ্রহণ করা হবে না। যারা সে সময় অল্প উপার্জনের দিন-সপ্তাহ-মাসের অর্থ তোলে দিয়েছে, তাদের সামনে ছিল শুধুই দেশ এবং তাদের দেশের স্বাধীনতা। আজ সেই মানুষগুলো অর্থে-বিত্তে টইটুম্বুর। এদের পরবর্তী অর্থাৎ বর্তমান প্রজন্মের অধিকাংশই চোখ ধাঁধানো ক্যারিয়ার নিয়ে ব্রিটেনে অবস্থান করছে। এই মানুষগুলো বাংলাদেশ সরকারের মুক্তিযোদ্ধাদের প্রাপ্য সব সুবিধায় ভাগ বসাতে আবেদন করেনি আগে। হয়তো এই সনদের জন্য তারা আবেদনও করত না। কিন্তু হঠাৎ করে ব্রিটেনে মুক্তিযুদ্ধ সংঘটিত করতে অচেনাদের এই সম্মাননার সনদ দিয়ে বরং ব্রিটেনের মুক্তিযুদ্ধের প্রকৃত সংগঠকদের অপমান করা হয়েছে। আর সেজন্যই এই মানুষগুলোর অবদানের মূল্যায়নের জন্য মুক্তিযোদ্ধা মন্ত্রণালয়ের সিদ্ধান্ত নিয়ে বিতর্ক উঠেছে।
ফারুক যোশী : কলাম লেখক।
[email protected]

মন্তব্য করুন

খবরের বিষয়বস্তুর সঙ্গে মিল আছে এবং আপত্তিজনক নয়- এমন মন্তব্যই প্রদর্শিত হবে। মন্তব্যগুলো পাঠকের নিজস্ব মতামত, ভোরের কাগজ লাইভ এর দায়ভার নেবে না।

জনপ্রিয়