মহামারিতে টালমাটাল পুরো বিশ্ব! বাংলাদেশেও কোনোভাবেই যেন ঠেকানো যাচ্ছে না সংক্রমণ ও মৃত্যুর হার। বাইরে থেমে থেমে শোনা যাচ্ছে আক্রান্ত ব্যক্তিদের বহনকারী অ্যাম্বুলেন্সের সাইরেনের শব্দ। চারদিকে শুধুই আতঙ্ক বিরাজ করছে! হাসপাতালে রোগী ও স্বজনদের গগনবিদারী আত্মচিৎকারে ভারি হয়ে উঠছে আশপাশের পরিবেশ। হাসপাতালে একটা বেড, একটা অক্সিজেন সিলিন্ডার, গুরুতর রোগীদের নিবিড় পর্যবেক্ষণ কেন্দ্রের (আইসিইউ) জন্য স্বজনদের ছোটাছুটি, হাহাকার চোখে পড়ছে। হাসপাতালের বারান্দা থেকে শুরু করে কোথাও যেন তিল ধারণের ঠাঁই নেই। দেশের সব হাসপাতালেই রোগীদের উপচে পড়া ভিড়। চিকিৎসাবিজ্ঞানের এত উন্নতি, ডাক্তার-নার্স সব কিছুই যেন আজ অসহায় ক্ষুদ্র ভাইরাসের কাছে! এত চিৎকার, আর্তনাদ, লাশের সারি, গণকবর পত্রপত্রিকা, টেলিভিশনে প্রতিনিয়ত দেখার পরও মানুষের বোধোদয় জাগ্রত হচ্ছে না। চলাফেরা করছে ‘ডোন্ট কেয়ার’ একটা ভাব নিয়ে।
আন্তর্জাতিক উদরাময় গবেষণা সংস্থার (আইসিডিডিআরবি) সম্প্রতি করা এক গবেষণায় দেখা গেছে, বাংলাদেশে শনাক্ত করোনা ভাইরাস আক্রান্ত রোগীর ৬৮ শতাংশ ভারতীয় ভ্যারিয়েন্ট। ভারতীয় ভ্যারিয়েন্টকে বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা ডেল্টা ভ্যারিয়েন্ট হিসেবে চিহ্নিত করে। যার বৈজ্ঞানিক নাম দেয়া হয়েছে বি.১.৬১৭। এর ভয়াবহতা সম্পর্কে ভারতীয় গবেষণা প্রতিষ্ঠান আইসিএমআর জানিয়েছে, ডেল্টা ভ্যারিয়েন্ট অর্থাৎ বি.১.৬১৭ কোনো বাধা না পেলে প্রতি রোগী ৪০৬ জন ব্যক্তিকে আক্রান্ত করতে পারে। এটি প্রতিনিয়তই তার মিউটেশন পরিবর্তন করতে সক্ষম। মিউটেশনটি দেহে রোগ-প্রতিরোধ ব্যবস্থায় তৈরি অ্যান্টিবডিকে পাশ কাটিয়ে যেতে ভাইরাসকে সাহায্য করতে পারে। ফলে ভ্যাকসিনের কার্যকারিতা হ্রাস পেতে পারে। যার ফলে ডাবল ভ্যাকসিন নেয়ার পরও আক্রান্ত হওয়ার খবর প্রায়ই শোনা যাচ্ছে।
ভারতীয় ডেল্টা ভ্যারিয়েন্টের রেস কাটতে না কাটতেই সম্প্রতি আবার নতুন প্রজাতির ডেল্টা প্লাস ভ্যারিয়েন্ট শনাক্ত হয়েছে, যা উদ্বেগের মাত্রা আরো বাড়িয়ে দিয়েছে। এখনই সচেতন না হলে এক ভয়াবহ মানবিক বিপর্যয়ের সম্ভাবনা রয়েছে। করোনা সংক্রমণের হার ও মানুষের সচেতনতা যেন ব্যস্তানুপাতিক হারে বাড়ছে। পরিস্থিতি যতটা অবনতি হচ্ছে মানুষের উদাসীনতা ততটাই লক্ষ করা যাচ্ছে। সংক্রমণ ও মৃত্যু বাড়ার পাশাপাশি গ্রামাঞ্চলে ঘরে ঘরে বাড়ছে করোনা উপসর্গ জ্বর-সর্দি-কাশি। তবে তার বেশিরভাগই প্রকাশ পাচ্ছে না। অনেকেই সামাজিক বয়কটের শিকার হওয়ার শঙ্কায়ই বিষয়টি চেপে যাচ্ছে। আবার কেউ এড়িয়ে যাচ্ছে ‘মৌসুমি জ্বর’ বলে। প্রথম সারির এক গণমাধ্যমে উঠে এসেছে, রাজশাহীর গোদাগাড়ীর মহিশালবাড়ী কবরস্থানে গত দেড় মাসে কবর হয়েছে ৪০টি। আর অন্যটিতে এক মাসেই হয়েছে ৩৮টি।
কবরস্থান কমিটির ভাষ্য অনুযায়ী, ৪০ জনের মধ্যে ২১ জন আর ৩৮ জনের মধ্যে ২৪ জনই করোনা বা করোনা উপসর্গ নিয়ে মারা গেছেন। বেশিরভাগ রোগীরই করোনা পরীক্ষা করা হয়নি বা ন্যূনতম চিকিৎসা সেবা পায়নি। গ্রামাঞ্চলের মানুষের অসচেতনতা ও অপ্রতুল চিকিৎসাসেবা- সব মিলিয়ে করোনার মহাবিস্ফোরণের আশঙ্কা করা হচ্ছে।
করোনা সংক্রমণ ঠেকানোর একমাত্র উপায় আক্রান্ত ব্যক্তিদের আলাদা করে ফেলা বা আইসোলেশনের ব্যবস্থা করা। আর এর জন্য নমুনা পরীক্ষা বাড়ানো প্রয়োজন। বিশেষ করে উচ্চ সংক্রমিত এলাকাগুলোতে অস্থায়ী বুথ স্থাপন করতে হবে। ফলে আক্রান্ত ব্যক্তিকে জেলা শহরে গিয়ে পরীক্ষার ঝামেলা ও সংক্রমণের ঝুঁকি অনেকটাই কমে যাবে। সন্দেহভাজন কারো শরীরে জ্বর, সর্দি, কাশি, গলাব্যথাসহ উপসর্গ দেখা দিলে সঙ্গে সঙ্গে পরীক্ষা করতে হবে। পজিটিভ হলে আইসোলেশনের ব্যবস্থা করতে হবে। এতে করে তিনি অন্যদের সংস্পর্শ থেকে দূরে থাকবেন এবং অন্যরাও সংক্রমিত হবে না। অন্যদিকে সংক্রমণ এড়াতে কঠোর স্বাস্থ্যবিধি মানার কোনো বিকল্প নেই। নিজের সুরক্ষা নিজের হাতে। ব্যক্তি নিজে থেকে সচেতন না হলে শুধু পুলিশ প্রশাসন দিয়ে কখনোই সচেতন করা যাবে না। তবে কঠোর লকডাউন বা মানুষের চলাচল সীমিত করতে প্রশাসনের ভূমিকা অনবদ্য।
মো. আব্দুল হাকিম জুবাইর
শিক্ষার্থী, ইসলামী বিশ্ববিদ্যালয়, কুষ্টিয়া।
[email protected]
মন্তব্য করুন
খবরের বিষয়বস্তুর সঙ্গে মিল আছে এবং আপত্তিজনক নয়- এমন মন্তব্যই প্রদর্শিত হবে। মন্তব্যগুলো পাঠকের নিজস্ব মতামত, ভোরের কাগজ লাইভ এর দায়ভার নেবে না।