স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী : মাদক ঠেকাতে চুক্তি হয়েছে মিয়ানমার ও ভারতের সঙ্গে

আগের সংবাদ

আতঙ্কে মগবাজারের বাসিন্দারা

পরের সংবাদ

করোনা-আক্রান্ত সংস্কৃতি ভুবনের দিকে তাকানো দরকার

প্রকাশিত: জুন ২৮, ২০২১ , ১২:০০ পূর্বাহ্ণ
আপডেট: জুন ২৮, ২০২১ , ১২:০০ পূর্বাহ্ণ

এতদিন আমরা করোনা ভাইরাস আক্রমণে অর্থনৈতিক ক্ষয়ক্ষতি নিয়ে নানামাত্রিক আলোচনা চালিয়েছি, অন্যদিকে নজর ফেরানো হয়েছে সামান্যই। শিক্ষা প্রসঙ্গে কিছু বিচার-ব্যাখ্যা হলেও সংস্কৃতি, বিশেষত গণসংস্কৃতির প্রভাব ও প্রতিক্রিয়ার দিকটি আলোচনার বাইরে থেকে গেছে বলে মনে করা যেতে পারে।
করোনা ভাইরাসের আক্রমণ বাংলাদেশে ব্যাপক মহামারির রূপ ধারণ না করলেও এবং মূলত তা রাজধানী শহর ঢাকা ও বন্দরনগরী চট্টগ্রামসহ কয়েকটি অঞ্চলে সীমাবদ্ধ থাকলেও যখন একের পর এক সমাজের বিভিন্ন স্তরের অগ্রগণ্য বিশিষ্ট ব্যক্তিবর্গ করোনার নিষ্ঠুর আক্রমণে প্রাণ হারাতে থাকেন তখন আমরা গভীর আতঙ্কে ভেবেছি, করোনা কি তাহলে পাকিস্তানি সামরিক ভাইরাসের মতো বাংলাদেশকে মেধা ও প্রতিভাহীন করতে, তার আক্রমণের বিস্তার ঘটিয়েছে?
আপাত বিচারে এমন ভাবনা কারো কাছে অদ্ভুত মনে হলেও মৃত্যুর তালিকাটির দিকে নজর ফেরালে তেমন ভাবনা অস্বাভাবিক মনে হয় না। এরা সমাজ, শিক্ষা ও সংস্কৃতি অঙ্গনে আমাদের এত চেনা, এত প্রিয় মানুষ ছিলেন যে তাদের নাম উল্লেখ অপ্রয়োজনীয় মনে হয়- কিন্তু ঘটনার ট্রাজিক অভিঘাত ও তাৎপর্য অস্বীকার করা কঠিন। আর তাই এমন অস্বাভাবিক কথাও তখন অনেকের মুখে আলোচিত হতে শোনা গেছে, যা উল্লিখিত।
তবে বাংলাদেশি সমাজ অতীতে এমন একাধিক নেতিবাচক প্রভাব প্রতিহত করতে পেরেছে, দুঃখজনক ও ট্রাজিক ঘটনাগুলোতে সময়ের সহিষ্ণু ধারাবাহিকতায় অতিক্রম করে। ইতিহাস তার সবকিছু ভুলে যায়নি। তবে এবার করোনার আঘাতটি দুর্বোধ্য কারণে লক্ষ্যভেদে অনেকটাই সুস্পষ্ট ও সুনির্দিষ্ট। মনে হয় যেন এক নিঃশব্দ যুদ্ধের আয়োজন।

দুই.
এবার আলবদর, আলশামসকে পেরিয়ে ঘাতক করোনার আবির্ভাব ও দ্রুত লক্ষ্যভেদে নিপুণ তৎপরতা, যা বন্ধ হওয়ার কোনো লক্ষণ দেখা যাচ্ছে না। বরং তা ক্ষণ বিরতি নিয়ে বেড়েই চলেছে। শুরুতে দিনমজুর, পরিবহন শ্রমিক থেকে অনেক নিম্নবর্গীয়ের অর্থনৈতিক জীবন আক্রান্ত, মধ্যবিত্ত পেশাজীবী কিছুটা লড়াই করে, কিছুটা পিছটানে সামলে দিচ্ছে। শিক্ষায়তনগুলো এখনো বন্ধ, গেটের বাইরে অলস কুকুর হাই তুলে আর ঝিমিয়ে তা জানান দিচ্ছে। ছাত্রছাত্রীরা অপেক্ষমাণ- কবে তারা ফিরে পাবে কলবরমুখর প্রিয় ক্যাম্পাস প্রাঙ্গণ।
এর মধ্যে নীরবে সর্বাধিক ক্ষতি হয়ে গেছে সংস্কৃতি অঙ্গনের। বাংলাদেশে যে সংস্কৃতি চর্চা তথা সংস্কৃতি অঙ্গন গড়ে উঠেছে পঞ্চাশের দশকে রাষ্ট্রভাষা আন্দোলন ও একুশ দফার সেকুলার জাতীয়তাবাদী আন্দোলনে (যুক্তফ্রন্টের তাৎক্ষণিক বিজয়ে) যেখানে প্রগতিবাদী মতাদর্শের নীরব সরব উপস্থিতি ছিল আবেগাশ্রিত তাৎপর্যপূর্ণ- বিশেষত সাহিত্যে, সুস্পষ্টভাবে কাব্যের সৃজনশীলতায়। এই ধারাতেই রাজনৈতিক অঙ্গনে ষাটের দশকে একদিকে রাজনৈতিক মঞ্চে জাতীয়তাবাদের ব্যাপক বিচরণের পাশাপাশি প্রগতিবাদের বিভক্ত সঞ্চয়ন, যা কখনো বিস্ফোরণ চরিত্র অর্জন করেছে। অন্যদিকে এই প্রভাবে সাংস্কৃতিক অঙ্গনে পূর্বোক্ত দুই ধারার প্রসারের পাশে প্রগতিনাট্য এবং গণনাট্যের বিপুল তৎপরতা (ক্রান্তি, উদীচী ইত্যাদি) পরবর্তী দশকগুলোতে সমৃদ্ধ আয়োজনের উদাহরণ রেখেছে। তাই ষাটের দশক প্রগতি সংস্কৃতির দশক হিসেবে পরিচিত। এটা মূলত সংস্কৃতি অঙ্গনের জন্য সত্য, রাজনীতির জন্য নয়।
আর সত্তরের দশক রাজনৈতিক অঙ্গনে মুক্তির দশক হিসেবে সেøাগানে চিহ্নিত (প্রধানত পশ্চিমবঙ্গে), বাংলাদেশে তথা পূর্ববঙ্গে জাতীয়তাবাদী চেতনার দশক রূপে সোনালি রেখায় চিহ্নিত। একই ধারায় সংস্কৃতি অঙ্গনে পথযাত্রা মঞ্চ নাটক, পথ নাটক, গণনাট্যের সমৃদ্ধ। সংস্কৃতি অঙ্গনে এ দশকটি নাট্যচর্চার বলিষ্ঠকাল হিসেবেও পরিচিতি। এ সময় বিদেশি প্রগতিশীল নাটক (যেমন ব্রেখট) এবং ধ্রæপদী নাট্যচর্চার উদ্ভাস লক্ষ করা গেছে। এর সামাজিক প্রভাব নেহাত কম ছিল না।
লোকগীতির পাশাপাশি লোককাহিনীনির্ভর নাটক এবং গানের বিচিত্র পসরা নিয়ে সমৃদ্ধ সংগীত চর্চায় বাউল, মারফতি ও মরমি ও সহজিয়া ধারার সংগীতচর্চার ছিল যথেষ্ট সমাদর এবং সেটা উভয় দিক থেকে যেমন প্রকাশে তেমনি উপভোগ্য জনপ্রিয়তায়। সংস্কৃতি অঙ্গন তখন সমৃদ্ধির সোনালি রেখায় চিহ্নিত, যার আবেগধৃত প্রকাশ সত্তর পেরিয়ে কিছু সময়তক।

তিন.
রাজনীতি যেমনই হোক, সংস্কৃতি অঙ্গনের সম্ভার নিয়ে প্রশ্ন ছিল সামান্য, যা চরিত্রধর্মে আদর্শিক। সাংস্কৃতিক চর্চার সার্বিক যাত্রা ক্ষেত্রবিশেষে প্রশ্নবিদ্ধ হলেও তার ইতিবাচক দিকটিই ছিল প্রধান। এরই মধ্যে হঠাৎ করে করোনা প্রভুর অশুভ আগমন অন্যান্য খাতের মতো সংস্কৃতি খাতেও কালো ছায়া ফেলেছে মৃত্যু আর অর্থনৈতিক দুর্দশায়।
স্বাস্থ্য নীতির নানা বিধান মানতে গিয়ে সেখানে বিরাজ করছে হতদরিদ্র দশা- অর্থের সমাগম নেই, নতুন করে অর্থ ঢালার ব্যবস্থা নেই, পুঁজির দুর্বল বিচরণ করোনার কালো প্রভাবে। মাসের পর মাস তা নেতিবাচক প্রভাব রাখছে একাধিক মাত্রায়।
যেমন পেশাজীবী শিল্পীদের ক্ষেত্রে- যেদিকটাতে কেউ করোনাকালীন দুর্দশায় সহমর্মী নন, নজরদারি আছে বলে মনে হয় না। তাই যদিও বোঝা কঠিন, বাস্তব সত্য হলো পেশাদার শিল্পীরা আজ মহাঅর্থনৈতিক সংকটের সম্মুখীন, তবু মঞ্চের মুখোশটা বাস্তব জীবনেও ব্যবহার করে খুশি মনে চলতে হচ্ছে। তবে সবচেয়ে বেশি দুর্দশায় নাট্য খাতের কলাকুশলীরা- তাদের অন্য পথের উপার্জন নেই।
বাংলাদেশে চলচ্চিত্রের জায়গা দখল করা সমৃদ্ধ নাট্যচর্চার আজ মহাসংকটের সম্মুখীন মূলত করোনার নানামাত্রিক বিস্তারের কারণে। দিবা শ্রমিক থেকে নাট্যমঞ্চের কর্মচারীরা আজ রুটি-রুজিতে করোনার থাবা এবং এর ফলাফলে একটি জাতীয় সমস্যা হয়ে দাঁড়িয়েছে। শাসনযন্ত্র প্রথমটির দিকে যতটা নজর দিচ্ছেন দ্বিতীয় দিকেও অনুরূপ নজর দেয়া দরকার।
সংস্কৃতি ভুবনের নানা ধারার শিল্পীরা এই মুহূর্তে হয়তো সোনালি সময়ের সঞ্চয় ভেঙে দিনযাপন করছেন। কিন্তু তা ক’দিন? যখন দেখা যাচ্ছে করোনার যাত্রা ক্রমেই দীর্ঘ হচ্ছে, কমছে, আবার বাড়ছে অনেকটা চড়াই-উতরাই ভাঙার মতো। তাছাড়া অন্যরা? দ্বিতীয় তৃতীয় শ্রেণির কর্মীরা? যাদের কথা এইমাত্র উল্লেখ করা হলো, তাদের তো সঞ্চয় অতি অল্প বা নেই, তাদের অবস্থা তো দিশাহারা মানুষের মতো।
তাই দরকার করোনাবিরোধী পরিকল্পনার সঙ্গে সংস্কৃতি ভবনকে অন্তর্ভুক্ত করা, তাদের জন্য যথোচিত ব্যবস্থাপনা নিশ্চিত করা। তারা অন্যদের মতো রাস্তায় নেমে জোর গলায় সেøাগান তুলছে না বলে তা কর্তৃপক্ষের নজরে আসছে না। আর আসছে না বলে এই ব্যতিক্রমী রচনাটি পাঠক এবং সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষের জন্য। বিষয়টি একান্তই জরুরি। কারণ দুটি ঘটনা।
প্রথমত ইতোপূর্বে উল্লিখিত করোনা আক্রমণের অব্যাহত রূপ যা সংবাদ ভুবনের প্রতিবেদনে ও শিরোনামে প্রতিফলিত। যেমন ‘তীব্র হচ্ছে সংস্কৃতির সংকট’, ‘দ্রুত ছড়াচ্ছে ডেল্টা ভ্যারিয়েন্ট’। একই সঙ্গে লকডাউন কঠোরভাবে পালনের জন্য জনগণের প্রতি আহ্বান। আরো দরকার উল্লিখিত ভ্যারিয়েন্টের বিরুদ্ধে দ্রুত ব্যবস্থা গ্রহণ, ভারত থেকে আসা যাত্রীদের কোয়ারেন্টাইনে কঠোর নজরদারি।
যাই হোক, আমাদের এ রচনার মূল বক্তব্য সংস্কৃতি জগতে করোনার নেতিবাচক প্রভাব ঘুচাতে সরকারি প্রণোদনা ও যথাযথ সহায়তা যাতে এ খাতের শিল্পীদের পেশা বদলের পথে হাঁটতে না হয়। সেই সঙ্গে অন্যদের দুর্দশা লাঘব হয়।

আহমদ রফিক : লেখক, গবেষক ও ভাষাসংগ্রামী।

মন্তব্য করুন

খবরের বিষয়বস্তুর সঙ্গে মিল আছে এবং আপত্তিজনক নয়- এমন মন্তব্যই প্রদর্শিত হবে। মন্তব্যগুলো পাঠকের নিজস্ব মতামত, ভোরের কাগজ লাইভ এর দায়ভার নেবে না।

জনপ্রিয়