মাদকদ্রব্যের অপব্যবহার ও অবৈধ পাচারবিরোধী আন্তর্জাতিক দিবস : মাদকের আগ্রাসন থেকে যুবসমাজকে বাঁচাতে হবে

আগের সংবাদ

৮০-তে পা রাখলেন ফেরদৌসী রহমান

পরের সংবাদ

বেপরোয়া স্বভাবের কাছে জিম্মি মানুষ!

প্রকাশিত: জুন ২৭, ২০২১ , ১২:০০ পূর্বাহ্ণ
আপডেট: জুন ২৭, ২০২১ , ১২:০০ পূর্বাহ্ণ

আগামীকাল সোমবার থেকে সারাদেশে আবারো শুরু হচ্ছে কঠোর লকডাউন। এই কঠোর লকডাউনের পটভ‚মি সবারই জানা। করোনা আমাদের জীবনকে আবারো বিপর্যস্ত করে তুলছে। বিগত বছরের তুলনায় এবারকার করোনার সংক্রমণ ভিন্ন রকমের। এর আগে করোনা মোটামুটিভাবে দেশের কেন্দ্রভিত্তিক সংক্রমণে, অর্থাৎ রাজধানী ঢাকা ও আশপাশের অঞ্চলে সক্রিয় ছিল। কিন্তু বর্তমানে করোনা সমগ্র দেশের প্রায় চারপাশ ঘিরে তার সংক্রমণ ও আক্রমণ পরিকল্পনা নিয়ে তীব্র আঘাত হানছে। এখন আর আমাদের উদ্বেগাকুল মনোযোগ কেবল রাজধানী ঢাকা কেন্দ্রিক নিবদ্ধ নয়, দেশের প্রায় সমগ্র অঞ্চলেই বিস্তৃত রাখতে হয়। কারণ আঞ্চলিক সংক্রমণ হার এবং মৃত্যুর পরিসংখ্যানই এখন জাতীয় সংবাদ শিরোনাম হয়ে গণমাধ্যমগুলোকে ব্যস্ত রাখছে। আমাদের আতঙ্কও বিস্তৃত হচ্ছে নানা ডালপালায়! কিন্তু সাম্প্রতিক এই সংক্রমণ ও মৃত্যু বৃদ্ধির কারণ খুঁজতে গেলে বুঝব, মানুষের অসাবধানতা নয় বরং বেপরোয়া মনোভাবের কাছে পরাস্ত হয়েছে সরকারের যাবতীয় প্রজ্ঞাপন, পরাস্ত হয়েছে স্বাস্থ্য অধিদপ্তর এবং কোভিড-১৯ মোকাবিলায় জাতীয় পরামর্শক কমিটির সুপারিশকৃত স্বাস্থ্যবিধি। সর্বাত্মক লকডাউন, কঠোর লকডাউন এবং লকডাউন প্রভৃতি শব্দবন্ধগুলো মানুষের বেপরোয়া স্বভাবকে মোটেই দমিয়ে রাখতে পারেনি। মানুষ যেমন তার স্বাভাবিক চলাচলের স্বাধীনতাকে যেমন বিন্দুমাত্র ‘ছাড়’ দেয়নি তেমনি করোনাও তার অপ্রতিরুদ্ধ সংক্রমণ-স্বভাব থেকে চুল-পরিমাণ ‘ছাড়’ দিচ্ছে না! ফলে দেশের সর্বত্র যে সংকট সৃষ্টির পূর্বাভাস বিশেষজ্ঞরা দিয়েছিলেন তার নির্মম প্রতিফলন শুরু হয়েছে! সংক্রমণের দৈনিক সংখ্যা এখন ছয় হাজারের বেশি!
মানুষের খামখেয়ালিপূর্ণ স্বভাবের কাছে ‘জীবন ও জীবিকা’ এক ধরনের অজুহাতের নাম হিসেবেই চিহ্নিত হয়েছে। ‘জীবন ও জীবিকা’র কথা বলে এবং ‘অমুক অফিস খোলা, তমুক কারখানা খোলা সুতরাং আমার দোকানপাট খুলে দিতে হবে, আমার রেস্টুরেন্ট খুলে দিতে হবে, আমার গণপরিবহন খুলে দিতে হবেÑ ইত্যাকার অজুহাতে মানুষ তার বেপরোয়া স্বভাবকে নিয়ন্ত্রণের বদলে বরং উসকেই দিচ্ছে বেশি! নানা অজুহাত দেখিয়ে স্বাস্থ্যবিধি ও সরকারি প্রজ্ঞাপনে অবজ্ঞা প্রদর্শনে তৎপর রয়েছে অধিকাংশ মানুষ। সাধারণ মানুষ যে অবিমৃষ্যকারিতার পরিচয় দিয়েছে বলেই আমরা প্রত্যহ বিভিন্ন অঞ্চলকে গণমাধ্যমের খবরে পরিণত হতে দেখছি। ইতোমধ্যে দেশের ৪৪ জেলাকে সংক্রমণের উচ্চ ঝুঁকিপূর্ণ এলাকা ঘোষণা করা হয়েছে।
একাধিক লেখায় আমরা ইতোপূর্বে ডেল্টা ভ্যারিয়েন্টের সংক্রমণ বিস্তার নিয়ে আশঙ্কা করেছিলাম। আমাদের প্রায় চতুর্দিক বেষ্টিত ভারতের সীমান্ত থাকায় ডেল্টা ভ্যারিয়েন্টের আক্রমণ প্রতিহত করার শক্তি, সামর্থ্য এবং স্বাস্থ্য ব্যবস্থাপনা নিয়েও আশঙ্কা করেছিলাম। ইতোমধ্যে দেশের দক্ষিণ, পশ্চিম এবং উত্তরাঞ্চলে দৈনিক শনাক্ত ও মৃত্যুর হার বৃদ্ধি পাওয়ায় আশঙ্কাজনক পরিস্থিতির সৃষ্টি হয়েছে। আমরা জাতীয় সংবাদের চেয়ে ভীত-সন্ত্রস্ত মনে যশোর, কুষ্টিয়া, রাজশাহী, খুলনা ও রংপুর অঞ্চলের খবরের জন্য উদ্বিগ্ন থাকি! গত বছর করোনার ‘হট স্পট’ কেবল রাজধানী ও আশপাশের অঞ্চলেই ছিল। কিন্তু দ্বিতীয় ঢেউয়ে তা ছড়িয়ে পড়েছে রংপুর, রাজশাহী, কুষ্টিয়া, সাতক্ষীরা, যশোর ও খুলনাসহ সীমান্তবর্তী বিভিন্ন জেলা ও উপজেলায়। সংক্রমণ ও মৃত্যুর ঊর্ধ্বগতি নিত্যদিনের বুলেটিনেও স্থান করে নিয়েছে এসব অঞ্চল। বর্তমানে সমগ্র দেশেই বিস্তৃত হয়ে পড়েছে করোনাÑ বিস্তৃত হয়ে পড়েছে গ্রামে-গঞ্জেও। কোথাও কোথাও সংক্রমণের হার বিগত বছরের যে কোনো স্থানের রেকর্ডও ভঙ্গ করছে। সম্প্রতি একেকটি দিন পূর্ববর্তী দিনের সংক্রমণ-রেকর্ড ভঙ্গ করে ধারাবাহিকভাবে নতুন নতুন রেকর্ড সৃষ্টি করছে। করোনা সংক্রমণের এই গতি মানুষের স্বভাবের কারণেই প্রতিহত সম্ভব হচ্ছে না। স্বাস্থ্য নিয়ে ভাবিত এবং স্বাস্থ্য সংশ্লিষ্টরা দুশ্চিন্তায় নিমগ্ন হলেও সাধারণ মানুষের একটি বৃহৎ অংশ বেপরোয়া চলাচলে মোটেই নিয়ন্ত্রণ রাখছে না। উপরন্তু এরাই আবার স্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞদের পরামর্শ এবং স্বাস্থ্যসেবা সংশ্লিষ্ট সরকারের বিভিন্ন প্রজ্ঞাপনের বিরূপ সমালোচনায় প্রায়শ মুখরও থাকে!
অঞ্চলভেদে করোনার দাপুটে অবস্থার জন্য লকডাউনেও আনা হয়েছে আঞ্চলিক রূপান্তর। অর্থাৎ সংক্রমণ হার বিবেচনায় জেলা ও উপজেলাভিত্তিক স্থানীয় প্রশাসনকে লকডাউন কার্যকরের ঘোষণা দেয়ায় ক্ষমতাও প্রদান করা হয়েছে। ফলে বিগত প্রায় তিন সপ্তাহ ধরে আমরা দেশের বিভিন্ন অঞ্চলে বিভিন্ন সময়সূচি অনুযায়ী লকডাউনের খবরাখবর পাচ্ছি। কিন্তু লকডাউন না মানার সংস্কৃতির যে ভাইরাস তা রাজধানী থেকে দেশের প্রত্যন্ত অঞ্চলেও ছড়িয়ে পড়েছে অনেকটা যেন করোনা ভাইরাসের চেয়ে বহুগুণ বেশি শক্তিশালী রূপ নিয়ে। স্বাস্থ্যবিধি মেনে চলায় আমরা রাজধানীবাসীর মধ্যে যেমন উদাসীনতা দেখেছি, মফস্বলের বিভিন্ন অঞ্চলেও আমরা মানুষের মধ্যে একই রকমের উদাসীনতা এবং বেপরোয়া ভাব দেখছি। অর্থাৎ রাজধানী থেকে শুরু করে দেশের বিস্তৃত অঞ্চলের কোথাও মানুষ না মানছে লকডাউন না মানছে ন্যূনতম স্বাস্থ্যবিধি! এ ক্ষেত্রে প্রশাসনিক কর্মকর্তা-কর্মচারীসহ সব রাজনৈতিক দলের তৃণমূল পর্যায়ের নেতাকর্মীর দায়িত্বশীল অংশগ্রহণ জরুরি।
সাম্প্রতিক এই পরিস্থিতির স্রষ্টা আমরাই। আমরাই যে আমাদের সর্বনাশ ডেকে এনেছি তা আর বলার অপেক্ষা রাখে না। বরং ক্রমবর্ধমান সংক্রমণ এবং মৃত্যু আমাদের আত্মঘাতী আচরণের বহিঃপ্রকাশকেই স্পষ্ট করে। কিন্তু তবু আমরা বেপরোয়া, তবু আমরা সব ধরনের স্বাস্থ্যবিধি ভঙ্গের জন্য মাতোয়ারা, অজানা উচ্ছ¡াসে অনেকটাই পাগলপ্রায়! স্থির বুদ্ধিপ্রকাশক কোনো কর্মকাণ্ডই আমাদের চলাফেরা এবং আচার-আচরণের মধ্যে ফুটিয়ে তুলতে পারছি না। এই হঠকারিতার, এই অবিমৃষ্যকারিতার শেষ পরিণতি যে ভয়ংকর রূপ নিয়ে আমাদের অচিরেই আক্রমণ করবে মানুষের গোঁয়ার্তুমিনির্ভর চলাফেরার মধ্যে তারই লক্ষণ যেন বিভিন্নভাবে ফুটে উঠছে। আমাদের সেই বহুল আশঙ্কার ক্ষতি মেনে নেয়ার প্রস্তুতিও গ্রহণ করতে হবে!
গভীর হতাশাবোধ এবং আক্ষেপ থেকে নিয়তিবাদী এক রকমের সান্ত¡না আমাদের মনে মাঝেমধ্যে বাসা বাঁধে। তা হলোÑ আমাদের এই বেপরোয়া স্বভাব ও চাঞ্চল্যের স্থবিরতা হয়তো একদিন ঠিকই আসবে। কিন্তু ততদিনে আমরা আমাদেরই স্বভাবের কারণে অনেক স্বজনকেই হয়তো হারিয়ে ফেলব! বিগত কয়েকদিন ধরে সংক্রমণ প্রতিদিনই হাজারের অধিক ব্যবধান চিহ্নিত করেই ঊর্ধ্বমুখী আছে। সবাই জানি, সংক্রমণের হার বা সংখ্যা বৃদ্ধির সরল অর্থই হচ্ছে সপ্তাহান্তে মৃত্যুর হার ও সংখ্যা বৃদ্ধি! আমরা ফিলিপিন্সের প্রেসিডেন্ট দুতার্তেকে সম্প্রতি ঘোষণা করতে শুনেছিÑ ‘হয় টিকা নাও, নয়তো জেলে যাও’। আমাদের দেশে টিকার পর্যাপ্ত মজুত নেই। তাই স্বাস্থ্যবিধিই একমাত্র সুরক্ষার উপায়। তাও আমরা মানছি না। এর আগেও দুতার্তে লকডাউন ভঙ্গকারীদের গুলি করার কথা বলেছিলেন। বিশ্ব গণমাধ্যমে সেসব বার্তা চাউর হয়েছে। কিন্তু আমরা আমাদের দেশে ফিলিপিন্সের মতো কঠোরতা ও কড়াকড়ি চাই না। কিন্তু এই বার্তার পশ্চাতের ‘স্পিরিট’টি আমাদের অবশ্যই বুঝতে হবে। আমাদের সরকারের কাছে আমরা চাই, বারবার বিভিন্ন বিশেষণে বিশেষায়িত না করে লকডাউনকে বরং সত্যিসত্যি অর্থপূর্ণ করার জন্য প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নেয়া হোক। আর একইসঙ্গে সাধারণ মানুষের কাছেও আমাদের প্রত্যাশা, বেপরোয়া চলাচলে এখনই লাগাম টানুন। বিপদ আর বাড়াবেন না। আপনি নিশ্চিত করুন যে, আপনার মাধ্যমে কেউ সংক্রমিত হচ্ছে না! কাদম্বরীর মতো আমাদের যেন ‘মরিয়া প্রমাণ’ করতে না হয় যে, আমাদেরও করোনা হয়েছিল!
করোনায় আক্রান্ত আমেরিকা, ব্রাজিল, ইতালি কিংবা ভারতের মতো অভিজ্ঞতা কি আমরা অর্জন করতে চাইছি? একদিকে সংক্রমণ ও মৃত্যুর আতঙ্ক নিয়ে বসবাস, অন্যদিকে মৃতদেহ সৎকার করতে না পারার মর্মন্তুদ হাহাকারকেই কি আমাদের জীবনের সঙ্গে মেলাতে চাইছি? যে কোনো দুর্যোগ সৃষ্টি করা সহজ, কিন্তু দুর্যোগ থেকে সুরক্ষা ও পরিত্রাণ পাওয়া সহজ নয়। দুর্যোগ মোকাবিলা করাও অত্যন্ত কঠিন। বিগত ১৫ মাসে আমরা তা হাড়ে হাড়ে টের পেয়েছি! কিন্তু দুর্যোগ যত কঠিনই হোক না কেন তা থেকে পরিত্রাণ মানুষের পেতেই হবে, মানুষকেই জয়ী হতে হবে সব ধরনের দুর্যোগ থেকে। কিন্তু হতাশ হই যখন দেখি বিগত ১৫ মাস দুর্যোগের মধ্যে বসবাস করেও এখন পর্যন্ত আমরা সামান্য একটি মাস্ক ব্যবহারই যথাযথভাবে শিখতে পারলাম না তখন করোনার বিরুদ্ধে সংগ্রামে জয়ী হওয়া নিয়েও বিস্তর সন্দেহ, শঙ্কা ও আতঙ্ক আমাদের আরো গ্রাস করে, আরো আচ্ছন্ন করে, আরো হতাশ করে! ১৫টি মাসে এত করে দেখানো, শেখানো ও প্রচারের পরও সঠিক নিয়মে নাক ও মুখ ঢেকে মাস্ক পরতে কেন যে মানুষের অনীহা তাও আমাদের মনে হতাশা জাগায়!
দেশব্যাপী আঞ্চলিক লকডাউনেও যখন ডেল্টা ভ্যারিয়েন্ট ঠেকানো গেল না তখন সমগ্র দেশের করোনার পরিবর্তিত পরিস্থিতির আলোকে জাতীয় পরামর্শক কমিটি সারাদেশে দুই সপ্তাহের শাটডাউনের প্রস্তাব করে। সরকার তা কাটছাঁট করে সোমবার থেকে সাত দিনের ‘কঠোর লকডাউন’ ঘোষণা করেছে। কিন্তু ইতোপূর্বেকার লকডাউনের মতো যদি প্রস্তাবিত লকডাউন ঢিলেঢালা ও অর্থহীন শব্দগুচ্ছেই পরিণত হয় তবে সুফল বঞ্চিত হতে হবে সমগ্র জাতিকেই। আমরা অর্থহীন কোনো লকডাউন কিংবা শাটডাউন আর দেখতে চাই না। সরকার আসলে যা করতে চায় তা যেন স্পষ্ট করে আক্ষরিকভাবে প্রতিপালন করতে পারে। সেজন্য কঠোর নজরদারি প্রয়োজন হলেও তা থেকে বিচ্যুত হওয়া যাবে না। সুষ্ঠু পরিকল্পনার মাধ্যমে বেপরোয়া করোনা এবং বেপরোয়া মানুষকে নিয়ন্ত্রণে আনতে হবেÑ আনতেই হবে। ভ্যাকসিন নিশ্চিত হওয়ার পূর্ব পর্যন্ত মানুষের বেপরোয়া স্বভাবের জিম্মি দশা থেকে আমরা মুক্তি চাই।
আহমেদ আমিনুল ইসলাম : অধ্যাপক, জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়।
[email protected]

মন্তব্য করুন

খবরের বিষয়বস্তুর সঙ্গে মিল আছে এবং আপত্তিজনক নয়- এমন মন্তব্যই প্রদর্শিত হবে। মন্তব্যগুলো পাঠকের নিজস্ব মতামত, ভোরের কাগজ লাইভ এর দায়ভার নেবে না।

জনপ্রিয়