গ্রামীণ ব্যাংকের ৩ কর্মকর্তার বিরুদ্ধে দুদকের মামলা : অর্থ আত্মসাৎ

আগের সংবাদ

মন্ত্রী-এমপির হস্তক্ষেপে লাগাম

পরের সংবাদ

সংবাদ সম্মেলনে সিআইডিপ্রধান : মাদক কারবারে বদির দুই ভাইয়ের সংশ্লিষ্টতা রয়েছে

প্রকাশিত: এপ্রিল ১৮, ২০২৪ , ১২:০০ পূর্বাহ্ণ
আপডেট: এপ্রিল ১৮, ২০২৪ , ১২:০০ পূর্বাহ্ণ

কাগজ প্রতিবেদক : মাদক মামলার মানিলন্ডারিং সংক্রান্ত বিষয়ে তদন্ত করতে গিয়ে টেকনাফের সাবেক এমপি আব্দুর রহমান বদির দুই ভাই- আমিনুর রহমান ও আব্দুর শুক্কুরের সংশ্লিষ্টতা পেয়েছে পুলিশের অপরাধ তদন্ত বিভাগ (সিআইডি)। বদির বিরুদ্ধে সাক্ষ্য-প্রমাণ পেলে তাকেও ছাড় দেয়া হবে না বলে জানানো হয়েছে।
‘সিআইডির জালে মাদকের গডফাদাররা : বিপুল পরিমাণ স্থাবর-অস্থাবর সম্পত্তি ক্রোক’ শীর্ষক সংবাদ সম্মেলনে এ কথা বলেন সিআইডিপ্রধান অতিরিক্ত আইজিপি মোহাম্মদ আলী মিয়া। গতকাল বুধবার দুপুরে রাজধানীর মালিবাগে সিআইডি প্রধান কার্যালয়ের মিডিয়া সেন্টারে এ সংবাদ সম্মেলন অনুষ্ঠিত হয়।
সিআইডিপ্রধান জানান, প্রাথমিকভাবে ৩৫টি মামলা তদন্ত করে মামলার হোতা বা গডফাদারদের মাদকব্যবসা থেকে অবৈধভাবে অর্জিত ব্যাংক অ্যাকাউন্টে জমাকৃত অর্থ, কেনা জমি, বাড়ি ও ফ্ল্যাটসহ বিভিন্ন স্থাবর ও অস্থাবর সম্পত্তির সন্ধান মিলেছে। এসব মামলায় অবৈধভাবে অর্জিত অর্থের পরিমাণ প্রায় ১৭৮ কোটি ৪৪ লাখ কোটি টাকা। সিআইডি এরই মধ্যে ৩৫ মামলার মধ্যে ৩টি মামলায় গডফাদারদের ৯ দশমিক ১৪ একর জমি ও ২টি বাড়ি ক্রোক যার মূল্য আনুমানিক ৮ কোটি ১১ লাখ টাকা এবং মাদকসংক্রান্ত মানিলন্ডারিংয়ের বিভিন্ন মামলায় ব্যাংকে গচ্ছিত ১ কোটি ১ লাখ ২৩ হাজার ৪২৫ টাকা ফ্রিজ করেছে। আরো ৩৫ দশমিক ১৭৩ একর জমি, ১২টি বাড়ি ও ১টি গাড়ি যার মূল্য অনুমানিক ৩৬ কোটি ৮২ লাখ টাকা ক্রোকের প্রক্রিয়া চলমান রয়েছে।
সিআইডি জানিয়েছে, ১০ মাদক গডফাদারের তালিকায় প্রথমে আছেন কক্সবাজারের নুরুল হক ওরফে ভুট্টো (৩২)। তবে তদন্তে শুধু সে-ই নয়, তার আরো ৪২ জন সহযোগীর তথ্য পেয়েছে সিআইডি। ভুট্টো কক্সবাজার জেলার টেকনাফ পৌরসভার অগ্রণী ব্যাংক, আল-আরাফা ইসলামী ব্যাংক, জনতা ব্যাংক, ইসলামী ব্যাংকের মাধ্যমে শুধু ইয়াবা ট্যাবলেট বিক্রি করে যা আয় করেছেন এর মধ্যে প্রায় ৩ কোটি টাকা তিনি মানিলন্ডারিং করেছেন। আর এ টাকায় করেছেন আড়াই কোটি টাকা মূল্যের বাড়ি। এছাড়াও তার ২ দশমিক ৪৫ একর জমির সন্ধান পেয়ে তা ক্রোক করা হয়েছে।
তালিকায় দ্বিতীয় অবস্থানে খুলনার শফিক আলম ওরফে শফিক ওরফে শফি। তার নামে খুলনায় ২০২১ সালে মানিলন্ডারিং আইনে মামলা হয়। সেই মামলা তদন্ত করতে গিয়ে দেখা যায়, তিনি চট্টগ্রাম জেলার খুলশী থানার ব্র্যাক ব্যাংকের সিডিএ অ্যাভিনিউ শাখা অফিসসহ টেকনাফ থানার ডেইল পাড়া এলাকার বিভিন্ন স্থান থেকে প্রায় ৪০ কোটি ১৪ লাখ টাকা পাচার করেছেন। তিনিও ইয়াবার ব্যবসা করেন। শফি ইয়াবা বিক্রি করে ৭০০ দশমিক ৯৬ শতাংশ জমি করেছেন, যার দলিল মূল্য ৫ কোটি ১১ লাখ টাকা।
তৃতীয়তে রয়েছেন খুলনার লবণচরার শাহজাহান হাওলাদার (৫৮)। তার নামে ২০২১ সালে মামলা হলে তদন্তে বেরিয়ে আসে তিনি চট্টগ্রাম জেলার খুলশী ব্রাক ব্যাংকের সিডিএ এভিনিউ শাখা অফিসসহ টেকনাফ থানার ডেইল পাড়া এলাকার বিভিন্ন স্থান থেকে মদ ও ইয়াবা বিক্রি করে প্রায় ২ কোটি ৫০ লাখ টাকা পাচার করেছেন। তার ক্রোককৃত সম্পদের পরিমাণ শূন্য দশমিক ৯৩৬ একর। তার জমিসহ বাড়ির মূল্য ৫০ লাখ টাকা।
চতুর্থতে থাকা মাদক গডফাদার শফিক আলম ওরফে শফিকের (৩৯) বিরুদ্ধে ২০২৩ সালের ২২ মার্চ টেকনাফ থানায় মানিলন্ডারিং মামলা হয়। সেই মামলায় তিনি ছাড়াও তার সহযোগী মনির আলম (৩০), মো. রফিক আলম (৩৭), আব্দুল গফুরের (৫৫) সংশ্লিষ্টতা পায় সিআইডি। তারা সবাই শফিকের পরিবারের সদস্য। ইয়াবা বিক্রি করে শফিক প্রায় ৪ কোটি টাকা মানিলন্ডারিং করেছে। এছাড়াও ১ কোটি ১০ লাখ টাকা মূল্যের ৩টি বাড়ি ও ২৯ দশমিক ৩৩ শতাংশ জমি কিনেন। তার মোট ৫টি ব্যাংক অ্যাকাউন্টে ২০ হাজার টাকা পাওয়ার পর তা ফ্রিজ করেছে সিআইডি।
মাদক গডফাদার শাহিন আলমের বিরুদ্ধে পাবনার আতাইকুলা থানায় ২০২৩ সালের ১৪ মার্চ মানিলন্ডারিং মামলা হয়। মামলার পর তদন্তে তার সহযোগীদেরও নাম ওঠে আসে। এছাড়াও তিনি গাঁজা ও ইয়াবা কারবার করে প্রায় ৬ কোটি ২০ লাখ টাকা লন্ডারিং করেছেন। তার একটি বাড়ি ও ১৯২ দশমিক ৬৭ শতাংশ জমি (মূল্য ৬ কোটি ২০ লাখ টাকা) ক্রোক করার জন্য আবেদন করেছে সংস্থাটি।
২০২০ সালের ২০ মার্চ কক্সবাজারের টেকনাফে মানিলন্ডারিং মামলায় অভিযুক্ত ইয়াবা গডফাদার নুরুল কবির। কবির ইয়াবার ব্যবসা করে ১১ কোটি ৫ লাখ টাকা পাচার করেছে। এছাড়াও তার অবৈধ টাকায় গড়ে তোলা এএনবি ব্রিকস নামে একটি ইটভাটা, একটি দ্বিতল ডুপ্লেক্স বাড়ি, পোল্ট্রি খামার, লবণ চাষের ব্যবসা এবং ৩৮টি দলিল মূলে মোট ১৫ দশমিক ৫৬৫৩ একর জমি (অনুমানিক মূল্য ৫ কোটি টাকা) ক্রোক করা হয়েছে।
২০২১ সালের ২০ অক্টোবর টেকনাফের আরেক মাদক গডফাদার সিদ্দিক আহমেদের (৫৩) বিরুদ্ধে মানিলন্ডারিংয়ের মামলা হয়। তদন্তে ওঠে আসে তার এই মাদক ব্যবসায় অন্যতম সহযোগী ছিল তার ছেলে ফরিদুল আলম ওরফে মেহেদী হাসান ওরফে ফরিদ (৩৮) ও রবিউল আলম (২৭), মো জসিম উদ্দীন (২৩), সৈয়দ আহমেদ ওরফে সৈয়দ হোছইন, আব্দুল মালেক ওরফে মালেক হোছাইন (৩২) এবং শফিকুল ইসলাম ওরফে সামসুল (২৫)। তাদের মাধ্যমে সিদ্দিক ইয়াবা কারবার করে দেড় কোটি টাকা পাচার করেন। তার ৪৮ দশমিক ৩৩ শতাংশ জমি ও ২০ লাখ টাকা মূল্যের ১টি বহুতল নির্মাণাধীন বাড়ি ক্রোকের প্রক্রিয়াধীন রয়েছে।
বিদায়ি ২০২৩ সালের ২২ মার্চ ঢাকার মাদক গডফাদার নুরুল ইসলামের বিরুদ্ধে আদাবর থানার মানিলন্ডারিং মামলা হয়। মামলার তদন্তে ওঠে আসে ইয়াবার কারবার করে নুরুল প্রায় ১৩ কোটি টাকা পাচার করেছেন। বিভিন্ন স্থানে তার ৪টি বাড়ি, ০ দশমিক ৮৮ একর জমি, ১টি গাড়ি ও স্বর্ণালংকার সনাক্ত করেছে সিআইডি। এসব সম্পদের পরিমাণ মোট ১৩ কোটি টাকা।
গাজীপুরের টঙ্গী পূর্ব থানায় মাদক ব্যবসায়ী পারুলের (৩৩) বিরুদ্ধে গত বছরের ৩০ অক্টোবর মানিলন্ডারিং মামলা হয়। তার মামলা তদন্ত করতে গিয়ে বেরিয়ে আসে ওই এলাকার খালেদা বেগম (৪০), রিতা (৩৫), জামাই লিটন (৫০), জালাল (৪০), ছোটন (৩৫), পলাশ (২৮), ফরহাদ (৩৫) ও শুক্কুর আলীসহ সহযোগীদের নাম। তারা সবাই প্রতিবেশী হলেও মাদক কারবারে নানাভাবে সহযোগিতা করতেন। পারুল ইয়াবা ও গাঁজা বিক্রি করে প্রায় ১ কোটি ৫৭ লাখ টাকা পাচার করেছেন। তার ১৮ দশমিক ৬৫ শতাংশ জমি এবং ১টি বাড়ি রয়েছে যার অনুমানিক মূল্য ১ কোটি ৫৭ লাখ টাকা।
টেকনাফ থানায় ২০২০ সালের ৩ সেপ্টেম্বর মাদক গডফাদার ফজর আলীর (৩৯) বিরুদ্ধে মানিলন্ডারিং মামলা হয়। সেই মামলার তদন্তে ওঠে আসে তার বোনজামাই গনু মিয়া (৬১) ও পার্টনার আব্দুর রহিম প্রকাশ রানা (৩৪) ছিলেন ফজর আলীর অন্যতম সহযোগী। ইয়াবা কারবারি ফজর আলী প্রায় ১ কোটি ৮০ লাখ টাকা পাচার করেছেন। তার ০ দশমিক ২০৬৭ একর জমির মূল্য অনুমানিক ৩৯ লাখ টাকা।
পুলিশ সদরদপ্তরের তথ্য-উপাত্তের বরাত দিয়ে জানানো হয়, দেশে প্রতিবছর গড়ে প্রায় ৮০ হাজার মাদক মামলা হয়। ২০২১ সালে সারাদেশে ৭৯ হাজার ৬৭৫টি, ২০২২ সালে ৮২ হাজার ৬৭২টি ও ২০২৩ সালে ৭৬ হাজার ৪০৩টি মাদক মামলা হয়েছে।
সিআইডি প্রধান মোহাম্মদ আলী বলেন, দেশের ৬৪ জেলায় যেসব মাদক মামলা হয় তাতে শুধু মাদক বহনকারীদের গ্রেপ্তার করা হয়, কিন্তু গডফাদাররা ধরা-ছোঁয়ার বাইরে থাকে। যেহেতু আমরা গডফাদারদের নিয়ে কাজ করছি দেখি কতগুলো ধরতে পারি। আরেক প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, মাদক মামলার মানিলন্ডারিং সংক্রান্ত বিষয়ে তদন্ত করতে গিয়ে টেকনাফের সাবেক এমপি আব্দুর রহমান বদির ২ ভাই- আমিনুর রহমান ও আব্দুর শুক্কুরের সংশ্লিষ্টতা পেয়েছি। বদির বিরুদ্ধেও যদি আমরা সাক্ষ্যপ্রমাণ পাই তাহলে ছাড় দেয়া হবে না। যার বিরুদ্ধেই তথ্যপ্রমাণ পাব ধরা হবে, ছাড় দেয়া হবে না।
তিনি আরো বলেন, কক্সবাজারে পর্যায়ক্রমে মাদকের সব গডফাদারদের আইনের আওতায় আনা হবে। মাদক ব্যবসায় যারা অবৈধভাবে সম্পদ ও অর্থ-বিত্তের মালিক হয়েছেন তাদের অবৈধ সম্পদ আইনি প্রক্রিয়ায় সরকারি কোষাগারে চলে যাবে। দেশপ্রেমিক নাগরিকদের প্রতি মাদক গডফাদারদের তথ্য সিআইডিকে দেয়ার জন্য তিনি অনুরোধ জানান।

মন্তব্য করুন

খবরের বিষয়বস্তুর সঙ্গে মিল আছে এবং আপত্তিজনক নয়- এমন মন্তব্যই প্রদর্শিত হবে। মন্তব্যগুলো পাঠকের নিজস্ব মতামত, ভোরের কাগজ লাইভ এর দায়ভার নেবে না।

জনপ্রিয়