সাবের হোসেন চৌধুরী : বনের জমি দখলে সরকারি প্রতিষ্ঠানকেও ছাড় নয়, বন কর্মকর্তার খুনিদের কঠোর শাস্তি নিশ্চিত করা হবে

আগের সংবাদ

সর্বাত্মক অভিযানে যৌথবাহিনী

পরের সংবাদ

সাহিত্যে লেখালেখির শিল্প কৌশল

প্রকাশিত: এপ্রিল ৫, ২০২৪ , ১২:০০ পূর্বাহ্ণ
আপডেট: এপ্রিল ৫, ২০২৪ , ১২:০০ পূর্বাহ্ণ

গ্রিসের প্রখ্যাত সাহিত্য সমালোচক লঙ্গিনাস তার চবৎর যুঢ়ংড়ং (ঙহ ঃযব ঝঁনষরসব) গ্রন্থে (গ্রস্থটি সম্ভবত খ্রিস্টিয় প্রথম শতকে রচিত) বলেন, অধিক শিক্ষা গ্রহণকারী উদ্ভাবনী শক্তিসম্পন্ন লেখকই সার্থক লেখক। তিনি লেখালেখির শর্ত হিসেবে অধিক শিক্ষাগ্রহণ ও উদ্ভাবনী শক্তির উপর যে গুরুত্বারোপ করেছেন তা বলার অপেক্ষা রাখে না। আসলে লিখতে হলে পড়তে হয়, পড়া হৃদয়ঙ্গম করতে হয়। পড়া জ্ঞানের ভাণ্ডার সমৃদ্ধ করে, উদ্ভাবনী প্রতিভা চাঙ্গা করে। তবে অনেকেই বলে থাকেন, প্রতিভা মানুষের সহজাত প্রবণতা। এটা এ রকম নয় যে, চর্চার মাধ্যমে তা আয়ত্ত করা যায়। কথাটা সত্যি। কিন্তু এটাও ঠিক যে, সাহিত্যে লেখালেখির শিল্পকৌশলে জানার মতো বিষয়ও আছে, যাকে অবজ্ঞা করার সুযোগ নেই। সাহিত্যে লেখক প্রতিনিয়ত নতুনত্বের অন্বেষণ করেন। অন্বেষণ না থাকলে শিল্পস্রোত মরে যায়। অর্থাৎ শিল্প থেমে যায়। একজন লেখক অন্বেষণের মাধ্যমেই নিজেকে নিজে ছড়িয়ে যাওয়ার প্রচেষ্টা বহমান রাখেন। ওরহান পামুকের কথায়, ‘লেখক হলো এমন একজন, যে বছরের পর বছর ধৈর্য ধরে তার নিজের ভেতরের দ্বিতীয় সত্তা আবিষ্কারের চেষ্টায় থাকে এবং সেই সত্তাই থাকে নিরূপণ করে সে আসলে কে?’ প্রকৃত লেখক এটাও ভালো করে জানেন, লেখালেখি এক ধরনের ভালোবাসা, নিমগ্নতা, গভীর আসক্তি। এ নিমগ্নতার কারণে ব্যক্তিজীবন, মনোজীবন, চারপার্শ্বের পৃথিবীর চলমান পরিবর্তন তার ওপর যেভাবে আছড়ে পড়ে, তিনি তার লেখায় সেভাবেই রিঅ্যাক্ট করেন। আসলে যারা লেখালেখি করেন, তাদের লেখার মধ্যে অনেক কিছুই এসে পড়ে। যে মানুষ প্রবন্ধ লিখছেন, গদ্য লিখছেন, কবিতা লিখছেন, গল্প বা উপন্যাস- সেই মানুষ একই সঙ্গে চার পার্শ্বে কী ঘটছে, কী লেখা হচ্ছে বা পূর্বে কী লেখা হয়েছে, সে সম্পর্কে সঙ্গতভাবেই অবহিত থাকেন। এসব তার ভেতরের অনুভবকে উস্কে দেয়। এসব কিছু আত্মস্থ করেই একজন লেখক সচেতনভাবে লেখায় আত্মনিয়োগ করেন। অবশ্য এক্ষেত্রে লেখককে ভাব-সৌকর্যের প্রয়োগে সংযত এবং জ্ঞানের চর্চা ও নিয়ন্ত্রণে যথেষ্ট সতর্ক থাকতে হয়। কারণ উৎকৃষ্ট লিখনশৈলী পাঠককে কেবল ভাবাপ্লæত, বিস্ময়াভিভূত ও তৃপ্তই করে না, এর অপ্রতিরোধ্য শক্তি ও দক্ষতা পাঠক- শ্রোতার চেতনায় উত্তেজনা তৈরি করে, পাঠককে মোহগ্রস্ত করে আরো গভীরে নিয়ে যায়, তা সৃজন-মনন যে সাহিত্যই হোক না কেন।
অনেক লেখক রচনার দুর্বলতা এড়ানোর জন্য রচনায় নির্বিচার অলঙ্করণ, ভাষায় অযথা বাগাড়ম্বর, ফাঁপা আবেগ বা শ্বাসরুদ্ধকর সংযমের আশ্রয় নেন। কিন্তু রচনার উৎকর্ষে এসব গুরুত্বপূর্ণ নয়। বরং মূল বিষয়ের সঙ্গে সম্পর্কিত পরিমিত আবেগ মথিত অলঙ্কার সহযোগে বাস্তব বর্ণনাই কাক্সিক্ষত। অলঙ্কারের অন্তর্নিহিত কিছু বৈশিষ্ট্য রচনার উৎকর্ষে শক্তি জোগায় নিঃসন্দেহে। তবে অলঙ্কারের লাগামহীন প্রযোগ রচনার বিশ্বাসযোগ্যতাকে প্রশ্নসাপেক্ষ করে এর মধ্যে কপটতা ও ভুল তর্কের খোরাক জোগায়। প্রসঙ্গত বলে রাখি, ‘রচনা’ কথাটা ঊংংধু বা সাহিত্যের গদ্যরীতি অর্থে উনিশ শতকের চতুর্থ পাদ থেকে এদেশে এবং রেনেসাঁস যুগ থেকে ইউরোপে সাধারণত ব্যবহৃত হলেও আমি এ লেখায় ‘রচনা’ অর্থে গদ্য- পদ্য নির্বিশেষে সামগ্রিক লিখন সাহিত্য কর্মকে বুঝিয়েছি, যা শৈলীপ্রধান, স্বতঃস্ফূর্ত ও আবেদনময়ী। যদিও সঙ্গত কারণে গদ্যরীতির প্রতি আমারও কিছুটা পক্ষপাত বিষয়ান্তে স্পষ্ট হয়ে উঠেছে।
উৎকর্ষ রচনার অন্তর্নিহিত তাৎপর্য এই যে, তা পাঠক চিত্ত স্পর্শ করে পাঠককে লেখকের চিন্তার সঙ্গে একাত্ম করে ফেলতে পারে। এটা ঐ সাহিত্যিক্যের পক্ষে সম্ভব যিনি উন্নত ভাবৈশ্বর্য সৃষ্টির সহজাত ক্ষমতা রাখেন এবং সৃজন-মননের মাধ্যমে তার চিন্তা ও বক্তব্য শিল্পসম্মতভাবে উপস্থাপন করতে পারেন। অবশ্য এমন ভাবাবেগ বা আবেগও আছে, যা উৎকর্ষের সঙ্গে যায় না- যেমন দুঃখ, ভীতি, করুণা। লেখায় এগুলোর প্রয়োগ সচেতনভাবে করতে হয়। জীব, জড় ও বস্তু জগতে দৃশ্যমান-অদৃশ্য বিষয়জাত উপলব্ধিকে মানসিক অভিজ্ঞতার আলোকে পরিকল্পিত ছকে আবদ্ধ করার মাঝেই সাহিত্য কৃতির সাফল্য, রচনার উৎকর্ষ নির্ভর করে। এ কাজ করতে গিয়ে লেখককে সময়ের সঙ্গে নিজেকে বদলে নিতে হয়।
একটা লেখা তরতর করে লিখে ফেললেই ‘রচনা’ হয়ে উঠে না। এজন্য প্রয়োজন পূর্ব প্রস্তুতি, চিন্তার আশ্রয় তথা মানসিক অভিজ্ঞতা। সর্বোপরি একটা সম্পূর্ণ ভাবনাবৃত্তে তা প্রতিস্থাপন। এই ‘ভাব’ বা ‘ভাবনা’কে সময়, পরিবেশ, সমাজের পটভূমিতে লেখায় এগিয়ে নিতে হয়। এর সঙ্গে থাকতে হয় জীবনযোগ। জীবন-জগতের অর্থ ও দৃষ্টিভঙ্গি অনুসন্ধানের মতো বিষয়বস্তুর প্রধান্য থাকলে লেখা অবশ্যই টেকসই হয়। উৎকৃষ্ট রচনায় চিত্রকরের ছবি আঁকা, কুমোরের মূর্তি গড়া, গায়কের গান করার মতো একটা সাধনার ব্যাপার ক্রিয়াশীল থাকে, যদিও সাদা চোখে তা অতটা দৃশ্যমান হয় না। যেমন ‘প্রতিদিনের ভাষা’র সঙ্গে ‘সাহিত্যের ভাষা’র ভিন্নতা একজন সাধারণ পাঠক সহজে অনুভব করতে না পারলেও একজন কবি বা সাহিত্যিক জানেন তার লিখিত ভাষা সাহিত্যেরই ভাষা। কারণ এর মাঝে আছে সৃষ্টির এক সচেতন ভিন্নতা, রুচির, দেখার এবং দেখাবার ভিন্নতা।
সাহিত্যের ভাষায় ‘শব্দ’ এবং ‘বাক্য’ বিশুদ্ধ অবস্থায় গৃহীত হয়। সাহিত্যের ভাষার অস্থিমজ্জায় শিল্পের ঐতিহ্য গ্রহণ-বর্জনের শাসনে নিয়ন্ত্রিত। এজন্য একজন কবি বা লেখক সাহিত্যের ভাষা নির্মাণের প্রয়োজনে সচেতনভাবে তার লেখায় কাটাকুটি-সংযোজন- বিয়োজন করেন। বার বার আলো ফেলে দেখেন তার লেখা শেষ পর্যন্ত ‘সাহিত্য’ হলো কিনা। সাহিত্যে নতুন নতুন থিম, চিন্তা ও ভাবধারা উপহার দিতে পেরেছেন কিনা। একজন প্রকৃত কবি, প্রাবন্ধিক, কথাসাহিত্যিক তার লেখা তৈরির সঙ্গে সঙ্গেই তা প্রকাশের জন্য ব্যতিব্যস্ত বা উদগ্রীব হয়ে উঠেন না। তিনি তা কিছু সময় বা কিছুদিন নিজের কাছে রেখে দেন। প্রসব বেদনার ঘোর কেটে গেলে নির্মোহ অবস্থায় শৈলচিকিৎসকের মতো লেখায় কাটাকুটি করেন, সার্জারি করেন। আসলে একজন লেখক নিজের লেখার সবচেয়ে ভালো, নির্মম ও নিরপেক্ষ সমালোচক হতে পারলেই কেবল তার কাছে উৎকৃষ্ট লিখনশৈলী আশা করা যায়। জীবনানন্দ দাশ তার কবিতা লেখার পর মূল কবিতা বারবার সংশোধন করতেন, যতক্ষণ পর্যন্ত না তার ভাব, বিষয় ও আঙ্গিকে শ্রæতিমধুর অলঙ্কার শোভিত না হতো, ঠিক তেমনি কবিতার নামকরণের ক্ষেত্রেও পছন্দ না হওয়া পর্যন্ত চলতো পরিবর্তন। কবি বিনয় মজুমদার তার কবিতা রচনার সময় নিরন্তর কাটাকুটি করতেন। তারপর সেগুলো আবার কপি করে রাখতেন অন্য কোনো ডায়েরিতে। সঙ্গে কবিতার নিচে তারিখ দিতে ভুলতেন না। সৈয়দ শামসুল হকতো নিজেই বলেছেন, কবিতার বেলায় দশ-পনেরো খসড়া হামেশাই তাকে করতে হয়। বেশ কিছুদিন রেখে তারপর একসময় চূড়ান্ত রূপ দেন। একইভাবে ঔপন্যাসিক সৈয়দ ওয়ালীউল্লাহ নিরন্তর সংশোধন, সংযোজন ও বিয়োজনের মাধ্যমে তার লেখনীতে ব্যক্তি বিশিষ্টতা নির্মাণ করতেন। ফরমায়েশি লেখার ক্ষেত্রে এ ধরনের কাটাকুটির সুযোগ কম। অবশ্য এক্ষেত্রে ব্যতিক্রমও যে সাহিত্যে নেই, তাও নয়। স্বল্প সময়ে মানোত্তীর্ণ লেখা তৈরির নজিরও আছে। সৈয়দ শামসুল হক তার ‘মার্জিনে মন্তব্য’ গ্রন্থে লিখেন, “সাগরময় ঘোষ কি তার বইয়ে লেখেননি যে, সুবোধ ঘোষ পত্রিকার আপিসে বসে, রাত জেগে পারব-না পারব-না বলেও, ঘুমহীন রক্তবর্ণ চোখ নিয়ে ‘জতুগৃহ’র মতো প্রথম শ্রেণির একটি গল্প লিখেছেন; দুতিনটি বাক্য লিখেছেন আর কম্পোজিটর এসে নিয়ে গেছে অক্ষর সাজাতে, এইভাবে রচিত হয়েছে এক বিস্ময়?” (মার্জিনে মন্তব্য- সৈয়দ শামসুল হক, অন্যপ্রকাশ, ঢাকা, ৪র্থ মুদ্রণ-ডিসেম্বর ২০২০, পৃষ্ঠা-২৬)। কবি নজরুল ইসলামের কালজয়ী রচনা ‘ও মন রমজানের ঐ রোজার শেষে’ গানটিও কিন্তু বিশেষ পরিস্থিতিতে গ্রামোফোন কোম্পানির চাপাচাপির জোরেই সৃজন সম্ভব হয়েছিল। সৃষ্টিশীল মানুষদের কাছ থেকে এভাবে হয়তো উৎকৃষ্ট রচনা আদায় করা যায়। কিন্তু আমার মনে হয়, একজন লেখক যখন সৃষ্টির উন্মাদনায় উষ্ণ হয়ে উঠেন, কল্পনা-ক্রিয়া তার মস্তিষ্কের ভেতর খেলা করে ‘সৃষ্টির বীজ’ সৃজন করে সেই মাহেন্দ্রক্ষণে লেখক কলম ধরলে তখন অভাবনীয় কালজয়ী নতুন কোন মানসম্পন্ন রচনা তার দ্বারা সম্ভব হতেও পারে। বিশেষত কবিতার ক্ষেত্রে। এসবে লেখালেখির ব্যাকরণ না মানলেও অনেক সময় তা ব্যকরণসিদ্ধ হয়। একটা শিল্পরূপ যখন প্রতিষ্ঠা পেয়ে যায়, তখন তার মধ্যে আপনা-আপনি বেশ কিছু বৈশিষ্ট্য-নিয়ম-কানুন তৈরি হয়ে যায়। এ বিষয়টি মাথায় রেখেই হয়তো আর্টেমাস ওয়ার্ড বলেছেন, ‘যতোক্ষণ ভালো আছি ব্যাকরণের দরকার কী?’ অবশ্য নিয়ম-কানুন না জেনে লেখালেখিতে কিছুটা ঝুঁকিও থাকে। এজন্য আর্টেমাস ওয়ার্ডই আবার বলেছেন, ‘যে লেখক ব্যাকরণের রীতিতে লিখতে পারে না, তার উচিত দোকান বন্ধ করে দেয়া’।
লেখালেখি অনেকটা গুরুমুখী বিদ্যা। এ গুরু প্রত্যক্ষ কেউ নাও হতে পারেন। অন্যের লেখা পড়ে, নিরন্তর লেখালেখির চর্চা করেও লেখক হওয়ার মনোজগৎ তৈরি করা যায়। এজন্য যে জিনিসটা সবচেয়ে বেশি প্রয়োজন তাহলো, লেখালেখির প্রতি আগ্রহ, অনুরাগ বা ঝোঁক। সযতœ পরিচর্যার মাধ্যমে এই ঝোঁকের যারা যথাযথ বিকাশ ঘটাতে পারেন, তারাই হয়ে ওঠেন প্রকৃত লেখক। মনে রাখতে হবে, লেখক হওয়ার জন্য ধরাবাঁধা কোনো নিয়মনীতি বা বিধিবদ্ধ শিক্ষা পদ্ধতি নেই। শুধুমাত্র লিখতে চাওয়ার আগ্রহের একাগ্রতার উপরই নির্ভর করে লিখতে পারা এবং লেখক হওয়া। তবে শুধুমাত্র আগ্রহেই রাতারাতি লেখক হওয়া যায় না। ‘পদ্মা নদীর মাঝি’র কালজয়ী লেখক মানিক বন্দ্যোপাধ্যায় বলেন, ‘রাতারাতি লেখকে পরিণত হওয়ার ম্যাজিকে আমি বিশ্বাস করি না। অনেক কাল আগে থেকেই প্রস্তুতি চলে। লেখক হবার জন্য প্রস্তুত হয়ে আসতে আসতেই কেবল একজনের পক্ষে হঠাৎ একদিন লেখক হিসেবে আত্মপ্রকাশ করা সম্ভব।’ (লেখকের কথা- মানিক বন্দ্যোপাধ্যায়, বাংলা গবেষণা প্রকাশনা, ঢাকা, ২০১৭, পৃষ্ঠা-৯)। অবশ্য মানিক বন্দ্যোপাধ্যায় কথিত এই অনেক কালের প্রস্তুতির পেছনে থাকে লেখকের প্রবল ইচ্ছাশক্তি, নিরন্তর পঠন-পাঠন ও একান্তে বসে অনুশীলনের কঠোর সাধনা। বেশির ভাগ লেখকেরই লেখালেখির স্বপ্ন জাগিয়ে তোলে ক্লাসের পাঠ্যবই। এই বই পড়তে পড়তে সে একসময় ঝুঁকে পড়ে বাইরের বইয়ের জগতে, যা তার লেখক মনকে উসকে দেয়। তখন তিনি বইয়ের লেখায় লেখকের প্রকাশ ভঙ্গি, ভাষার ব্যবহার, চরিত্র চিত্রন, জীবনবোধ, বিষয়ের বিস্তার- সব কিছুই গভীর অভিনিবেশ সহকারে পর্যবেক্ষণ করেন। মনের স্বাভাবিক সৃজন-ক্রিয়া অনুযায়ী বই নির্বাচন করে তা পড়েন। আত্মস্থ করতে চেষ্টা করেন লেখালেখির কলাকৌশল। অন্যের লেখার কাঠামো, পদ্ধতি ও শৈলীর সঙ্গে পরিচিত হওয়ার পরই একজন লেখকের নিজস্ব রচনা- শৈলীর অবয়ব গড়ে ওঠে। হয়ে উঠেন মৌলিক লেখক। যেমন- কবিগুরু রবীন্দ্রনাথের প্রথম জীবনের কাব্যপ্রেরণা ছিল পূর্বসূরি বিহারীলাল চক্রবর্তীর লেখা। আসলে লেখালেখি প্রকৃতপক্ষে এমন এক ঐক্যসূত্রে গাঁথা শব্দ-সমবায় যার ধারণা লেখকের সত্তার ভেতর অঙ্কুরিত হয় এবং চর্চার মাধ্যমে তা পরিপুষ্ট হয়। এমন অনেক লেখক আছেন যারা দৃষ্টিনন্দন ছবি কিংবা অন্য কোন শিল্পকর্ম দেখে প্রেরণা নেয়ার মতো অন্যের প্রেরণা ঔজ্জ্বল্যে উজ্জ্বলতর হন। এটা দোষের কিছু নয়। তবে অন্যের বা অন্যকিছুর হুবহু অনুকরণ, অনুসরণ বা নকল লেখালেখির ক্ষেত্রে মারাত্মক দোষণীয় প্রবণতা এবং তা অপরাধও বটে। কোন কোন ক্ষেত্রে অন্য লেখকের লেখা অনুপ্রেরণার উৎস হলেও তাকে অনুসরণ করা যাবে না। অনুসরণ কখনো মূলকে ছড়িয়ে যায় না। লেখকের থাকতে হয় ‘অসংকোচ প্রকাশের দূরন্ত সাহস’। এমন অনেক লেখকও দেখা যায়, যারা নিজের সমসাময়িকতা ও যুগ চেতনার বাইরে কিছু প্রকাশ করতে সংকোচ বোধ করেন। তাদের বেলায় বলতে হয়, তাদের অনুভূতি নিশ্চিতভাবে ভোঁতা, অস্বচ্ছ। তাদের দ্বারা অন্তত রচনার উৎকর্ষ সম্ভব নয়।
লেখালেখি বা সাহিত্য হচ্ছে একটা শিল্প, ভাবরস সঞ্চারের শিল্প। এই শিল্প সঞ্চারণ প্রক্রিয়ায় লেখক বেশ কিছু শিল্পবস্তু বা উপকরণ এবং কলাকৌশলের আশ্রয় নেন। ‘কলা কৌশলের মধ্যে সাহিত্যের সবখানি মূল্য নিহিত’। উপকরণকে আমরা যদি দেহ বলি, তাহলে কলাকৌশলকে বলতে হয় আত্মা। ভাষার মাধ্যমে গড়ে ওঠা লেখায় কাঠামো বা দেহ দৃশ্যমান। কিন্তু কলাকৌশল অশরীরী; দেখা যায় না, শুধু লেখার গতিময়তা, উৎকর্ষে তার প্রয়োগ টের পাওয়া যায়। এটাই শিল্প। এ পর্যায়ে লেখক শব্দ চয়ন, বাক্য গঠন ও বক্তব্য উপস্থাপনের মাধ্যমে বিষয়বস্তু বা ভাবনার সামগ্রিক আবেদন দ্বারা লেখায় একটা কাঠামো বা ভাষাগত অবয়ব দাঁড় করিয়ে পাঠককে আকৃষ্ট করতে সচেষ্ট হন। সতর্ক থাকেন বিরক্তিকর, অসার, অতিরঞ্জন অথবা অমর্যাদার কোনো কিছু এতে যাতে ঢুকে না পড়ে। কারণ এতে লেখা ঝুলে যায়। আসলে রচনার উৎকর্ষ ছাড়া কোনো লেখাই এককভাবে সামগ্রিক আবেদন সৃষ্টি করতে পারে না। উৎকর্ষের টেকসই ক্ষমতাই রচনায় সঞ্জীবনী সুধা সৃষ্টি করে। একটা লেখা তৈরি করার সময় লেখককে খেয়াল রাখতে হয়, লেখাটা কীভাবে এগোতে চাচ্ছে। অর্থাৎ লেখাটা কীভাবে এগোলে তা পাঠকের অনুভবকে নাড়া দেবে, কল্পনাকে উদ্দীপ্ত করবে। যেমন রং-তুলির আঁচড়ে অলংকৃত একটি চিত্রশিল্পে আমরা যদি আলো-ছায়া পাশাপাশি প্রক্ষেপণ করি, তাহলে আলোকিত অংশই সবার আগে আমাদের দৃষ্টিতে এসে আমাদের অনুভবকে নাড়া দেবে। পাশের অলঙ্কারিক সৌন্দর্য আবছা ছায়ায় দৃষ্টির আড়ালে হারিয়ে যাবে। সাহিত্যে আলো ফেলার বিষয়টি রচনার উৎকর্ষে খুবই গুরুত্বপূর্ণ। কালজয়ী লেখা রচনার উৎকর্ষের প্রকৃষ্ট উদাহারন।
লেখাকে ‘ফিকশন’ ও ‘নন-ফিকশন’- এই দুভাগে ভাগ করা যায়। ফিকশনে রয়েছে গল্প, উপন্যাস, নাটক, কবিতা, রোমাঞ্চ কাহিনি ইত্যাদি কল্পিত লেখা; আর নন-ফিকশনে থাকে তথ্যধর্মী লেখা প্রবন্ধ, নিবন্ধ, গদ্য ইত্যাদি, যা যাচাইযোগ্য। গল্প-উপন্যাসে কাহিনির অভিনবত্ব, ঘটনা-পরম্পরার অনিবার্যতা, চরিত্র চিত্রন, বর্ণনা থেকে সংলাপ পৃথকীকরণ, ক্রিয়াপদের কালরূপ নির্বাচন, স্বরচিহ্নিত ভাষার উপস্থাপন- এসবে কথাকারের পারঙ্গমতার উপর কথাসাহিত্যের উৎকর্ষ নির্ভর করে। কবিতায় বা পদ্যে শব্দ, ছন্দ ও সৌন্দর্যের মোহনীয় ব্যঞ্জনায় অনুভূতির অনুরণন, চেতনার অধিক্ষেপ সৃষ্টি করে বিস্ময় জাগানো উৎকৃষ্ট কালজয়ী সৃষ্টি সম্ভব। গদ্য-ভাষার চর্চার ক্ষেত্রে চমক জাগানোর সুযোগ একেবারেই কম। তবে গতানুগতিক বিষয় চর্চায় বিষয়ভেদে প্রতীক-রূপক, প্রাসঙ্গিক পরিহাসবোধ, শানিত বিদ্রুপ, মার্জিত কৌতুকরস রচনাকে যতটা বিশিষ্টতা দান করে, অন্য কিছুতে ততটা নয়। তবে এসবের অসাবধান ব্যবহার বাড়াবাড়ি ও ভাষাতাত্ত্বিক অস্থিরতা সৃষ্টি করে। একইভাবে রচনার অত্যধিক সংক্ষিপ্তকরণ রচনাকে পঙ্গু করে দেয়। একজন লেখককে অবশ্যই সবসময় মনে রাখতে হয়, লেখার সীমানা তিনি কোথায় টানবেন! এর ব্যত্যয় ঘটলে উন্নত রচনাশৈলী সৃষ্টির প্রচেষ্টা অনেক সময় ঝুঁকিপূর্ণ হয়। মানুষের এটা স্বভাবজাত প্রবণতা যে, ক্রুটিপূর্ণ ঐশ্বর্যময় রচনার দিকেই তাদের সমালোচনার তীরটা বেশি নিক্ষিপ্ত হয়।
রচনার উৎকর্ষে বিষয় উপযোগী শব্দ নির্বাচন একটি গুরুত্বপূর্ণ বিষয়। নিপুণভাবে ব্যবহৃত শব্দ আসলে চিন্তারই প্রতিফলিত আলো। বিষয়টা বুঝতেন বলেই প্রখ্যাত ফরাসি কথাসাহিত্যিক গুস্তাভ ফ্লবেয়ার নিজের পছন্দমতো একটি শব্দের বিন্যাসের জন্য বত্রিশ দিন পর্যন্ত সময় ব্যয় করেছিলেন। পৃথিবীর অন্যতম শ্রেষ্ঠ কথাশিল্পী মোপাসাঁ তার কাছেই গল্প লেখার প্রথম পাঠ নিয়েছিলেন। শব্দের শক্তি এমন যে, তা বাক্যে একাত্ম হয়ে ঘটন-অঘটন, মহান-তুচ্ছ, সত্যি-মিথ্যা, সম্ভব-অসম্ভব সব কিছুই করতে পারে। শব্দের সৌন্দর্য নির্ভর করে এর ব্যাকরণগত শুদ্ধতা ও বাক্যে যথাযথ উপস্থাপনায়। শব্দের অপপ্রয়োগ তথা গুরুগম্ভীর রচনায় হাল্কা শব্দ কিংবা হাল্কা চটুল রচনায় গুরুগম্ভীর শব্দ প্রয়োগ রচনাশৈলীকে বিপর্যস্থ করে তোলে। উন্নত বাক্য গঠন বা বাক্যের কাঠামো নির্মাণে যথাযথ ক্রমধারায় শব্দের বিন্যাস গুরুত্বপূর্ণ। আগোচালো শব্দ বা শব্দগুচ্ছ বর্জনীয়। কথাসাহিত্যে প্রাত্যহিক জীবন থেকে নেয়া ঘরোয়া শব্দ বেশ বিশ্বাসযোগ্য মনে হয়। যেমন সৈয়দ ওয়ালীউল্লাহর ‘লালাসালু’ উপন্যাসের একটি সংলাপ, ‘তাদের গীত ও হাসি ভালো লাগে না। ঝালরওয়ালা সালু কাপড়ে আবৃত মাজারটিকে তাদের হাসি আর গীত অবজ্ঞা করে যেন।’ (পৃষ্ঠা-২১)। কবিতায় শব্দই মূল নিয়ামক। কবিতায় দ্যুতিময় শব্দের ব্যবহারে বিষয়হীনতার নির্মাণ ও স্তব্ধতার অনুবাদও এক ধরনের কবিতা। আবার যোগসূত্রহীন অসংলগ্ন শব্দগুচ্ছে উচ্চারণকে সংযত করে অ্যাসাইনডেটন প্রয়োগ করে কবিতায় এক ধরনের আবেদন সৃষ্টি করা যায়। এতে আপাতদৃষ্টিতে শব্দকে অগোচালো মনে হলেও এর ভেতরে অভ্যন্তরীণ শৃঙ্খলা থাকে, যা সাধারণ পাঠকের উপলব্ধিতে আসে না। কিন্তু বিদগ্ধ পাঠক তা চিন্তার খোরাক হিসেবে ঠিকই খুঁজে নেয়। অক্ষর সাধক কবি শম্ভু রক্ষিতের কবিতা অনেকটা এরকমেরই।
লেখালেখি বিষয়টা স্বতঃস্ফূর্ত মানস প্রবণতার ব্যাপার। এটি সস্তা জনপ্রিয়তা অর্জনের সরাসরি বাহন নয়, যদিও কেউ কেউ লেখালেখি করে জনপ্রিয়তা অর্জন করে থাকেন। সমাজে প্রধানত দুই ধরনের লেখক দেখা যায়। চলতি জনপ্রিয় ধারার লেখক ও দায়বদ্ধ চিন্তাশীল ধারার লেখক। জনপ্রিয় ধারার লেখকেরা পাঠকের আনন্দ, আবেগ ও স্থূল জ্ঞানবুদ্ধিকে উসকে দিয়ে ‘বেস্ট সেলার’ বইও লিখে ফেলেন হয়তো। যেমন পর্নোগ্রাফি সাহিত্য-শিল্পের সঙ্গে যায় না। কিন্তু সাহিত্যকে পর্নোগ্রাফি পর্যায়ে উপনীত করার সুযোগ আছে। এ প্রসঙ্গে আবু সয়ীদ আইয়ুবের বক্তব্য, ‘উপন্যাস যত পানসেই হোক, তাকে চালু করবার সহজ অথচ অমোঘ উপায় হচ্ছে সেক্সের ঝাল-মসলাটা বেশ করে মাখিয়ে দেয়া।’ এ ধরনের বই সস্তা জনপ্রিয়তা সৃষ্টি করলেও শেষ পর্যন্ত তা চিরস্থায়ী হয় না বা চিরস্থায়ী প্রভাব বিস্তার করে না। অবশ্য জীবনকে পূর্ণরূপে ফুটিয়ে তোলার প্রয়োজনে দেহকেন্দ্রিক বিষয়বস্তুকে যদি অখণ্ড সৌন্দর্য রসে সুষমামণ্ডিত করা যায়, তাহলে তা স্থায়ী রূপ পায়। এক্ষেত্রে সোফোক্লিসের ‘ইডিপাস’, শেক্সপিয়ারের ‘হ্যামলেট’, মানিক বন্দ্যোপাধ্যায়ের ‘পুতুল নাচের ইতিকথা’ নান্দনিক চিন্তাশীল সাহিত্যের পর্যায়ে পড়ে। দায়বদ্ধ চিন্তাশীল ধারার এ ধরনের লেখকরা রচনায় গুরুত্ব দেন শিল্পমান ও জীবনবোধকে, যা হৃদয়ানুভূতির মিশ্রণে অপূর্ব রূপ-সুষমায় উদ্ভাসিত হয়। উৎকর্ষ বিচারে এ ধরনের রচনাই উত্তম। তবে এ ধারার লেখকের জনপ্রিয়তাও বেশ সময়সাপেক্ষ। আসলে লেখালেখি করে জীবনযাপন মানে একটি অলীক পথের ট্যানেল দিয়ে জীবন অতিক্রম করা। অনেকেই তা জানেন এবং জেনেও এ বন্ধুর পথে পা বাড়ান। আর নিজের ভেতরের অদম্য তাড়নায় ‘লেখক’ হিসেবে নিজেকে প্রতিষ্ঠার প্রণান্ত প্রচেষ্টা চালান।
লেখক হিসেবে প্রতিষ্ঠা পাওয়া সহজসাধ্য নয়। অনেক সময় দেখা যায়, দুনিয়া সেরা লেখক হয়েও সমসাময়িক যুগ তাদের স্বীকৃতি দেয় না, কিংবা স্বীকৃতি দিতে চায় না। এর পেছনে সামাজিক, রাজনৈতিক, ধর্মীয় ও রুচিগত কারণ থাকতে পারে। কিন্তু রুচিগত কুসংস্কারের অন্ধতা ও আক্রোশ বা রাজনৈতিক, সামাজিক, ধর্মীয় দমননীতি কোনো উৎকৃষ্ট রচনার ঔজ্জ্বল্য বা এর লেখককে বেশিদিন নিষ্প্রভ করে রাখতে পারে না। রচনার ঔজ্জ্বল্য নির্ভর করে বিষয়বস্তুর হৃদয় সংবেদ্য শিল্পরূপে। সাহিত্যে শিল্প সৃষ্টিতে এর সঙ্গে দরকার আঙ্গিকের নান্দনিক নির্মিতি ও দক্ষতা। দেহ ও আত্মার একীভূতকরণে যেমন প্রাণী, তেমনি বিষয়বস্তু ও আঙ্গিকের সম্মিলনে তৈরি হয় শিল্প। একটি রচনা যখন সত্যিকারের শিল্প হয়ে ওঠে, তখন তা সাহিত্যের সম্পদে পরিণত হয়। ভালো রচনা অনেকটা দ্য ভিঞ্চির মোনালিসা ছবির মতো, যা প্রতিনিয়ত জিজ্ঞাসার, বিস্ময়ের জন্ম দেয়। এ প্রসঙ্গে দার্শনিক রালফ ওয়ালডো এমাসনের একটা উক্তি আমার বেশ যুক্তিসঙ্গত মনে হয়। তিনি বলেছেন, ‘পথ যেদিকে নিয়ে যায় সেদিকেই যেও না। যেদিকে কোনো পথ নেই, সেদিকে হাঁটো এবং নিজের চিহ্ন রেখে যাও।’ একজন ভালো লেখক এভাবেই সাহিত্যে শিল্পের সংযোগ ঘটান।
প্রকৃতিগতভাবে মানুষের জীবন সীমাবদ্ধ। কিন্তু আমরা যে সীমার দ্বারা আবদ্ধ, আমাদের চিন্তা প্রায়ই তা ছাড়িয়ে যায়। দৈনন্দিন জীবনে আমরা যা কিছু প্রয়োজনীয় মনে করি তাকে আমরা সহজ ভাবি, আমাদের বিস্ময়কে লালন করি অসাধারণ কিছুর জন্য। দৈনন্দিন জীবনে আমরা যে আগুন ব্যবহার করি, তার একটু অসতর্ক ব্যবহার আমাদের জ্বেলে-পুরে অঙ্গার করে দিতে পারে। কিন্তু আমাদের ভয় অনাগত কালের বিস্ময় জাহান্নামের আগুনে। সাহিত্যের কাজ সৌন্দর্য উৎপাদন করা, বিস্ময় তৈরি করা। আবার সাহিত্য হচ্ছে জীবনের জন্য, মানুষের জন্য। অথচ আমরা সাহিত্যে এমন কিছু চাই, যা জীবনকে, মানুষকে অতিক্রম করে যায়। মানুষের এই অজেয় চাওয়ার বীজ উৎকৃষ্ট সাহিত্যে অবশ্যই থাকে বিস্ময়ের শৈলী হয়ে। এক্ষেত্রে একজন কবি-সাহিত্যিক তার সহজাত ভাবসারল্যে স্বতঃস্ফূর্ত লিখনরীতিতে সৃজন-মননে কতটা শিখরস্পর্শী ঢেউ তুলতে পারলেন, তার উপরই রচনার উৎকর্ষের মানদণ্ড নির্ভর করে।

মন্তব্য করুন

খবরের বিষয়বস্তুর সঙ্গে মিল আছে এবং আপত্তিজনক নয়- এমন মন্তব্যই প্রদর্শিত হবে। মন্তব্যগুলো পাঠকের নিজস্ব মতামত, ভোরের কাগজ লাইভ এর দায়ভার নেবে না।

জনপ্রিয়