রাজধানীতে ছাদ থেকে নিচে পড়ে নারীর মৃত্যু

আগের সংবাদ

গরমে বিপর্যস্ত জনজীবন

পরের সংবাদ

বাউল আবদুর রহমান : আপন ঘরে প্রাণবন্ধুর রয় ঠিকানা

প্রকাশিত: এপ্রিল ১৯, ২০২৪ , ১২:০০ পূর্বাহ্ণ
আপডেট: এপ্রিল ১৯, ২০২৪ , ১২:০০ পূর্বাহ্ণ

হবিগঞ্জ জেলার আজমিরীগঞ্জ উপজেলাধীন জলসুখা গ্রাম। কুশিয়ারার কূল ঘেঁষে হাওর-বাঁওড় বেষ্টিত জলসুখা গ্রামে আবদুর রহমানের জন্ম ১৯৫৫ সালের ১০ মে বৃহস্পতিবার। পৈতৃক আদিনিবাস বানিয়াচুং থানার পাড়াগাঁও হলেও তার দাদা জানফর উল্লাহ লস্কর পরিবার নিয়ে বসতি গড়েন জলসুখা গ্রামে। বাবা একরাম হোসেন কৃষিজীবী এবং গানপাগল ধর্মপ্রাণ মানুষ ছিলেন। তার মা হাজেরা খাতুন। পুত্র আবদুর রহমানের জন্মের চার/পাঁচ বছরের মাথায় বৈধব্যের বসন ধারণ করেন। শিশুকালে পিতৃহারা আবদুর রহমান মায়ের স্নেহাচর্যে বড় হতে থাকেন। তাই মায়ের প্রতি তার পরমমমতা ও শ্রদ্ধাভক্তি।
আবদুর রহমানের শোণিতের ধারায় গানের সুর-লয়-তাল প্রবাহিত। তাই শিশুকাল থেকেই গানের আসর তাকে টানত। বাল্যকাল্যেই জীবনের প্রথম কোনো গানের মাহফিলে গ্রামের ফকির ছইদ্যা ফকিরের একতারা হাতে গেয়ে উঠেন:

‘মায়া প্রেমে রইয়াছ ভুলিয়া
সাধের মানবের
মায়া প্রেমে রইয়াছ ভুলিয়া \’

গ্রামের মানুষ তার গান শুনে মুগ্ধ হতবাক হলেন। জলসুখা গ্রামের আজিজুর রহমান খরান ছিলেন বাউল শাহ আবদুল করিমের মুরিদান। প্রসঙ্গত উল্লেখ্য, বাউল শাহ আবদুল করিমের সঙ্গে জলসুখা গ্রামের এক নিবিড় সম্পর্ক ছিল। জলসুখায় তার অনেক মুরিদান/ ভক্ত ছিল, তাদের টানে তিনি এখানে আসতেন। তাই একদিন, বালক আবদুর রহমানকে তিনি (খরান) বাউল শাহ আবদুল করিমের সঙ্গে পরিচয় করিয়ে দেন। করিম আবদুর রহমানের দরাজ কণ্ঠের গান শুনে বিস্মিত হন। ১৯৭৭ সালে ময়ের মায়াবন্ধন ছেড়ে আবদুর রহমান গুরু বাউল শাহ আবদুল করিমের সান্নিধ্য প্রাপ্তির জন্য দিরাই উপজেলার উজানধল গ্রামে ছুটে যান। অভাব-অনটনের কারণে আবদুর রহমান ম্যাট্রিক পরীক্ষা দিতে না-পারলেও ক্লাস টেন পর্যন্ত লেখাপড়া করেন। হস্তাক্ষর সুন্দর হওয়ার সুবাদে তিনি আবদুল করিমের গানের পাণ্ডুলিপি লেখার দায়িত্ব পান। বাউল শাহ আবদুল করিমের ডেরায় এসে গুরু/মুর্শিদের সান্নিধ্যে আবদুর রহমানের জীবনের মোড় ঘুরে যায়। বাউলের তত্ত্ব-তালাশে, স্রষ্টার সৃষ্টি রহস্যভেদে আকণ্ঠ নিমজ্জিত হন আবদুর রহমান। বাউলের সাধনমন্ত্রে তনু-মন ডুবে থাকে অনুক্ষণ। মাঝেমধ্যে জলসুখা এসে মাকে দেখে যান। ১৯৮২ সালে গুরুর নির্দেশে মায়ের একান্ত ইচ্ছায় বিবাহবন্ধনে জীবন জড়িয়ে নেন আবদুর রহমান। জীবনের ৩২ বছর কাটিয়েছেন গুরু/মুর্শিদ বাউল শাহ্ আবদুল করিমের একান্ত সান্নিধ্যে। করিমের সুযোগ্য শিষ্য হিসেবে নিজেকে প্রমাণ করতে সক্ষম হয়েছেন। চারশরও অধিক গান রচনা করেছেন, তথাপি আত্মপ্রচারবিমুখ বাউল আবদুর রহমান মঞ্চে/অনুষ্ঠানে গুরু করিমের গানই পরিবেশন করেন নিবিষ্ট চিত্তে। এ পর্যন্ত তার দুটি বই প্রকাশিত হয়েছে ভাটির সুর এবং ভাটির ঢেউ। অত্যন্ত মিতভাষী বাউল আবদুর রহমান বাউলের তত্ত্বকে ধারণ করেন, মনে-মননে লালন করেন।
বাউল শাহ আবদুল করিমের সংস্পর্শে এসে আবদুর রহমান বাউলতত্ত্বের ভাবসাগরে ভাসতে থাকেন। মরমের অন্তর্নিহিত নিগূঢ় তত্ত্বের অনুসন্ধানে নিমগ্ন হন। তিনি রচনা করেন মর্মস্পর্শী গান :

আপন ঘরে প্রাণবন্ধুর
রয় ঠিকানা
স্বভাবের দোষে আমি
বন্ধুর দেখিতে পাই না \

করিল আত্মসমর্পণ
প্রাণবন্ধু হইত আপন
দূরে যাইত ভব জ্বালাতন
দিতে পারলে ষোলোআনা \

লেখক পূরক দুটি পথে
আসা-যাওয়া করে তাতে
পারি না ধরতে ছুঁইতে
বাতাসে তার আনাগোনা \

আমার ঘরে আমি তারে
খুঁজিতে চাই বারে বারে
আসিয়া ছয়জন চোরে
দেয় আমারে কুমন্ত্রণা \

মন চলে না জ্ঞানের কথায়
তার ভাবে সে রয় সর্বদায়
আবদুর রহমান প্রেমপাঠশালায়
সময় যাইতে পারলাম না \

আবার কখনো স্রষ্টার দিদার লাভের জন্য বাউল আবদুর রহমানের মন কেঁদে ওঠে। গানের সুরে ভেসে বেড়ায় তাঁর মনের আকুতি :

ও ভাই জিকির পড়োরে
আল্লাহু আল্লাহু আল্লাহু \

ঐ নাম হইল পথে সাথী
ঐ নাম হইল মূল
ঐ নাম জপিলে পাইবায়
অকূলেতে কূল \

আটারো হাজার আলমে
যাহা হইল পয়দা
দিবানিশি করিতেছে
ঐ নামে সজিদা \

আবদুর রহমান ঐ নামে
হইয়া যারে ফানা
নামে জোরে পড়বে ঝরে
দেহের যত গোনাহ \

দুই.
আবদুর রহমান ও তার গুরু শাহ আবদুল করিম একে অন্যের গানে উদ্বুদ্ধ হয়ে অনেক গান লিখেছেন। শিষ্য আবদুর রহমান লিখলেন:

আমি প্রাণবন্ধুর কাঙ্গালিনী
বন্ধুরা আনিয়া দে গো সজনী \

কথা দিল থাকবে পাশে
লুকাইল কোন বিদেশে
আমি পথে বসে দিন গুনি \

কার বা কুঞ্জর মনচোরায়
মত্ত আছে পাশা খেলায়
আমার কেঁদে যায় দিন রজনী \

কেন আমায় ছেড়ে গেলো
তোরা কেউ জানালা বলো
আমায় করলো জনম দুঃখিনী \

আবদুর রহমান কয় কাঁদিয়া
কিরে বা জানাবো গিয়া
আমার দুঃখের কাহিনী \

শিষ্য আবদুর রহমানের এই গান রচনার পর গুরু
শাহ আবদুল করিম রচনা করলেন একটি বিচ্ছেদের গান। গুরু শিষ্যের দুটি গানের সুর ও তাল প্রায় অভিন্ন। শাহ্ আবদুল করিমের গানটি :

আমি কুলহারা কলঙ্কিনী
আমারে কেউ ছুঁইও না গো সজনী \

প্রেম করে প্রাণবন্ধুর সনে
যে দুঃখ পেয়েছি মনে
আমার কেঁদে যায় দিন রজনী \

প্রেম করা যে স্বর্গের খেলা
বিচ্ছেদ হয় নরকজ্বালা
আমার মন জানে, আমি জানি \

সখি গো, উপায় বলো না
এ জীবনে দূর হলো না
বাউল করিমের পেরেশানি \

তবে নিভৃতচারী আবদুর রহমান গুরু আবদুল করিমের প্রতি অতল শ্রদ্ধাবোধ থেকে করিমের রচিত গান পরিবেশনে স্বাচ্ছন্দ্যবোধ করতেন। একবার আবদুর রহমান গুরুকে বলেছিলেন, ‘বাবা, আমি গান আর গাইতাম না, গান গাওয়া ছাড়িয়া দিমু।’ একথা শুনে শাহ আবদুল করিম বললেন, ‘গান তুমি ছাড়তায় পারো, গানে তোমারে ছাড়বে না।’ গুরুর অমোঘ বাণী-ই চিরন্তন প্রমাণিত হলো। তাই, আবদুর রহমান আজো গানের সাগরে ডুবে আছেন। মরণ শয্যায় যখন শাহ আবদুল করিম কাতরাচ্ছেন তখনো শিষ্যের মাথায় হাত রেখে বললেন, ‘যাও, তোমারে মানুষে মায়া করবো নে!’ গুরুর সেই আশীর্বাদ মাথায় তুলে রাখলেন আবদুর রহমান। তাইতো, গুরুভক্তি থেকে বাউল আবদুর রহমান বলেন, ‘আমার গান আমি গাইলে মুর্শিদের গান কে গাইবে। আমি তাঁর গান গাই। আমার গান গাইবে শিষ্যরা।’ কী চমৎকার উপলব্ধি! গুরুমুখীশিক্ষা বাউল সাধনতত্ত্বের মূল সুরটা যেন আমাদের মর্মমূলে বেজে ওঠে। আর, বাউল আবদুর রহমান অনুক্ষণ আপন ঘরে প্রাণবন্ধুর ঠিকানা অনুসন্ধান করে বেড়ান।

মন্তব্য করুন

খবরের বিষয়বস্তুর সঙ্গে মিল আছে এবং আপত্তিজনক নয়- এমন মন্তব্যই প্রদর্শিত হবে। মন্তব্যগুলো পাঠকের নিজস্ব মতামত, ভোরের কাগজ লাইভ এর দায়ভার নেবে না।

জনপ্রিয়