সাবের হোসেন চৌধুরী : বনের জমি দখলে সরকারি প্রতিষ্ঠানকেও ছাড় নয়, বন কর্মকর্তার খুনিদের কঠোর শাস্তি নিশ্চিত করা হবে

আগের সংবাদ

সর্বাত্মক অভিযানে যৌথবাহিনী

পরের সংবাদ

প্রসঙ্গ চট্টগ্রামের কাউয়া আঞ্চলিক গান

প্রকাশিত: এপ্রিল ৫, ২০২৪ , ১২:০০ পূর্বাহ্ণ
আপডেট: এপ্রিল ৫, ২০২৪ , ১২:০০ পূর্বাহ্ণ

গত ২৫ ফেব্রুয়ারি দৈনিক ভোরের কাগজের সাহিত্য সাময়িকীতে লেখক, গবেষক শামসুল আরেফীনের ‘চট্টগ্রামের কাউয়া আঞ্চলিক গান’ শীর্ষক একটি প্রবন্ধ ছাপা হয়েছে। গত ২২ মার্চ চট্টগ্রামের দৈনিক আজাদীতে প্রকাশিত আরেফীনের ‘আস্কর আলী পণ্ডিতের চাটগাঁইয়া গান’ শীর্ষক প্রবন্ধেও কাছাকাছি বিষয়গুলো আলোচিত হয়েছে। প্রবন্ধে চাটগাঁইয়া গানের রূপকার প্রয়াত আস্কর আলী পণ্ডিত, কবিয়াল রমেশ শীল, মোহাম্মদ নাছির, আবদুল গফুর হালীসহ আরো কয়েকজন কিংবদন্তিতুল্য গীতিকারের গানকে কাউয়া আঞ্চলিক গান অভিধা দেয়া হয়েছে। দুই প্রবন্ধের কিছু বিষয়ে দ্বিমত জানাতে আমার এই নিবেদন।
বলার অপেক্ষা রাখে না শামসুল আরেফীন একজন মেধাবী ও পরিশ্রমী গবেষক। তার গবষেণা বহুমাত্রিক। চলতি বছর তিনি চট্টগ্রাম সিটি করপোরেশনের একুশে সম্মাননা স্মারকে ভূষিত হয়েছেন।
ভোরের কাগজে প্রকাশিত প্রবন্ধে আরেফীন লিখেছেন, ‘চট্টগ্রামে বিশুদ্ধ আঞ্চলিক গান কখন থেকে রচিত হচ্ছে, তা বলা মুশকিল। আস্কর আলী পণ্ডিতের ক্ষেত্রে এটা বলা যায় যে, তিনি কাউয়া আঞ্চলিক গান রচনা করলেও কোনো বিশুদ্ধ আঞ্চলিক গান বা চাটগাঁইয়া গান রচনা করেননি। তার জীবদ্দশায় ও মৃত্যুর পরে প্রকাশিত তার কোনো পুঁথি বা সংগীতগ্রন্থে চাটগাঁইয়া গান অলক্ষ। …আস্কর আলী পণ্ডিত ছাড়াও তার পরবর্তীকালে আরো অনেকে কাউয়া আঞ্চলিক গান লিখেছেন। যেমন, রমেশ শীল, মলয় ঘোষ দস্তিদার, অচিন্ত্যকুমার চক্রবর্তী, মোহনলাল দাশ, এম এন আকতার, গফুর হালী ও সঞ্জিত আচার্য প্রমুখ।’
শামসুল আরেফীনের প্রবন্ধ সূত্রে আমরা প্রথমে চাটগাঁইয়া গান ও কাউয়া আঞ্চলিক গান সম্পর্কে জানার চেষ্টা করব। তার আগে যাদের গানকে কাউয়া আঞ্চলিক গান বলা হচ্ছে তাদের সংক্ষিপ্ত পরিচিতি জেনে নিই।
কে আস্কর আলী, কে গফুর হালী : আসলে আস্কর আলী পণ্ডিত, রমেশ শীল, মলয় ঘোষ দস্তিদার, অচিন্ত্যকুমার চক্রবর্তী, মোহনলাল দাশ, এম এন আকতার, আবদুল গফুর হালী শুধু আঞ্চলিক গান নয়, চাটগাঁইয়া গানের মহত্তম রূপকার। সঞ্জিত আচার্য্য আঞ্চলিক গানের জীবন্ত কিংবদন্তি।
কালজয়ী বাংলা লোকসংগীত ‘ডালেতে লরিচরি বইও, কি জ্বালা দি গেলা মোরে’ এর স্রষ্টা আস্কর আলী পণ্ডিত। কবিয়াল রমেশ শীল শুধু বঙ্গের শ্রেষ্ঠ কবিয়ালই নন, তিনি চট্টগ্রামের আঞ্চলিক, মাইজভাণ্ডারী ও মরমী গানের দিকপাল। অন্যদিকে ১৯৩২ সালে এইচএমভি থেকে মোহাম্মদ নাছিরের আঞ্চলিক ও মাইজভাণ্ডারী গানের রেকর্ড বের হয়েছিল, তাও বিখ্যাত জগন্ময় মিত্রের তত্ত্বাবধানে।
মলয় ঘোষ দস্তিদার, চট্টগ্রামের আঞ্চলিক গানের অন্যতম প্রতিভূ। ‘চোড চোড ঢেউ তুলি’ কিংবা ‘ও ভাই আঁরা চাটগাঁইয়া নওজোয়ান’ গানগুলো তার অমর সৃষ্টি। আবদুল গফুর হালী ‘মনের বাগানে ফুটিল ফুল রে, পাঞ্জাবিওয়ালা, সোনাবন্ধু তুই আমারে করলি রে দিওয়ানা, ও শাম রেঙ্গুম ন যাইও’ গানের স্রষ্টা। ব্রিটিশ আমলের বিএ পাস অচিন্ত্যকুমার চক্রবর্তী মূলত গণসংগীত গাইতেন সলিল চৌধুরীর সঙ্গে। একসময় তিনি চট্টগ্রামের আঞ্চলিক ভাষায় গান লিখেন। সত্তরের দশকে তার লেখা ‘সূর্য উডের লে ভাই লাল মারি’ গানটি গেয়ে সারা দেশে আলোড়ন সৃষ্টি করেন আঞ্চলিক গানের সম্রাজ্ঞী শেফালী ঘোষ। আবার মোহন লাল দাশ ‘ওরে সাম্পানওয়ালা তুই আমারে করলি দিওয়ানা’ গানের রচিয়তা, স্বাধীনতার পর বাংলাদেশ টেলিভশনের সম্প্রচার উদ্বোধন অনুষ্ঠানে শেফালী ঘোষের কণ্ঠে এই গান শুনে মোহিত হয়েছিলেন খোদ জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান। এম এন আখতার কালজয়ী ‘কইলজার ভিতর গাঁথি রাইখ্যুম তোঁয়ারে’ গানের গীতিকার, সুরকার ও শিল্পী।
সঞ্জিত আচার্য্য আঞ্চলিক গানে চিরস্মরণীয় হয়ে থাকবেন তার ‘সাম্পানওয়ালা’ চলচ্চিত্র এবং সেই চলচ্চিত্রের গানগুলোর জন্য। সঞ্জিত আচার্য্যরে ‘বাঁশখালী-মইষখালী, পাল উড়াইয়া দিলে সাম্পান গুরগুরাই চলে’ গেয়ে নতুন প্রজন্মের শিল্পীরা তারকাখ্যাতি পাচ্ছেন।
চাটগাঁইয়া গান ও কাউয়া আঞ্চলিক গান
চাটগাঁইয়া গান ও কাউয়া আঞ্চলিক গানের সংজ্ঞা কী? আসলে চাটগাঁইয়া গান বা কাউয়া আঞ্চলিক গান নিয়ে খুব বেশি লেখালেখি হয়নি। এমনকি বাংলা একাডেমি থেকে প্রকাশিত কল্যাণী ঘোষ সম্পাদিত ‘চট্টগ্রামের আঞ্চলিক গান’ গ্রন্থে আঞ্চলিক গানকে ২০টি শ্রেণিভাগে ভাগ করা হলেও সেখানে এই দুই ধরনের গানের কোনো উল্লেখ নেই। চট্টগ্রাম একাডেমি প্রকাশিত ও আনোয়ারা আলম সম্পাদিত ‘শ্যামসুন্দর- শেফালী ঘোষ’ স্মারকগ্রন্থে সংগীতজ্ঞ সৈয়দ মহিউদ্দিনের জবানিতে ‘কাউয়া আঞ্চলিক গান’ প্রসঙ্গটি সংজ্ঞাসহ উল্লেখ আছে।
চাটগাঁইয়া গান হলো চট্টগ্রামেরই নিজস্ব সংগীত ধারা যেমন- আঞ্চলিক
গান, মাইজভাণ্ডারী গান, জাঁহাগীরি গীত, মোহছেন আউলিয়ার গান, হঁলা, হাইল্যা গান, গোরপ পোয়ার গান, উল্টা গান ইত্যাদি। ধামাইল যেমন সিলেটি সংগীতধারা, ভাওয়াইয়া যেমন বাংলাদেশের রংপুর এবং পশ্চিমবঙ্গের কোচবিহার ও আসামের গোয়ালপাড়ায় প্রচলিত এক প্রকার পল্লীগীতি, তেমনি আঞ্চলিক-মাইজভাণ্ডারী, হঁলাও একান্তই চট্টগ্রামেরই সংগীতধারা, এগুলোই চাটগাঁইয়া গান। সুতরাং শামসুল আরেফীন তার প্রবন্ধে যে বলেছেন, ‘আস্কর আলী পণ্ডিত চাটগাঁইয়া গান রচনা করেননি’ এই বক্তব্য ধোঁয়াশাপূর্ণ। কারণ স্বতন্ত্র চাটগাঁইয়া গান বলে আসলে কিছু নেই।
এবার আসা যাক কাউয়া আঞ্চলিক গান প্রসঙ্গে। তার আগে বলি, আঞ্চলিক গান কাকে বলে। আঞ্চলিক গান হলো বিশেষ কোনো অঞ্চলের মানুষের ভাষায় রচিত গান। চট্টগ্রামের মানুষের মায়ের ভাষায় রচিত গানকে চট্টগ্রামের আঞ্চলিক গান বলা হয়। আগেই বলেছি চট্টগ্রাম একাডেমি প্রকাশিত ও আনোয়ারা আলম সম্পাদিত ‘শ্যামসুন্দর-শেফালী ঘোষ’ স্মারকগ্রন্থে সৈয়দ মহিউদ্দিন ‘কাউয়া আঞ্চলিক গান’ এর একটা সংজ্ঞা দিয়েছেন, পড়ুন তার জবানিতে, ‘রেডিওতে দেখা হয়, শেফালী দি কিছু বলতে চান।…একটা সময়ে তিনি বললেন, ‘মহী খালি শ্যামকে দিলে হবে? আমাকে কিছু দেবেন না? আমি জানতাম, যে সমস্ত গীতিকার শেফালীদির জন্য আঞ্চলিক গান লেখেন, সেখানে ওনার স্বামী ননী বাবু হস্তক্ষেপ করেন। অর্থাৎ লোকে বোঝার জন্য চট্টগ্রামের আঞ্চলিক গানের সঙ্গে শুদ্ধ ভাষার (প্রমিত বাংলা) মিশ্রণ ঘটতে থাকে। আমি বলি ‘কাউয়া’ গান। …শর্ত দিলাম দিদিকে, আপনার জন্য গান লিখব, কিন্তু ননী বাবুর হাতে দিতে পারবেন না, উনি রাজি হলেন।’
অর্থাৎ ‘কাউয়া আঞ্চলিক’ হলো সেই গান সারা দেশের মানুষের কাছে বোধগম্য করার জন্য যে গানে প্রমিত বাংলা বা ভিন্ন অঞ্চলের শব্দ ঢুকিয়ে দেয়া হয়।
শ্যাম–-শেফালীর পর চট্টগ্রামের আঞ্চলিক গানের আরেকটি কালজয়ী জুটি হলো সঞ্জিত আচার্য্য ও কল্যাণী ঘোষ জুটি। আমাদের পরম সৌভাগ্য, চাটগাঁইয়া গানের এই দুই কিংবদন্তি এখনো আমাদের মাঝে বেঁচে আছেন। অতি সম্প্রতি আমি এই দুই শিল্পীর সঙ্গে কথা বলেছি। তারা দুজনই ‘কাউয়া আঞ্চলিক গান’ এর সংজ্ঞায়নে সৈয়দ মহিউদ্দিনকে সমর্থন করেন। এখানে বলা দরকার, আঞ্চলিক গানের কিংবদন্তি গীতিকাররাও সচেতনভাবে তাদের গানে কিছু প্রমিত বাংলা শব্দ ব্যবহার করেছেন, কিন্তু অবশ্যই তা মানানসই ভাবে, সুর ও ভাবের প্রয়োজনে এটা দরকার হয়, এটা দোষণীয় কিছু নয়। কিন্তু ‘কাউয়া আঞ্চলিক গান’ হলো সেই গান, যে গান শুনলে মনে হবে ‘বকের বাসায় কাকের ছা’।
কিন্তু লেখক শামসুল আরেফিন ‘কাউয়া আঞ্চলিক গান’ এর সংজ্ঞা দিয়েছেন তার উল্টোটা। তিনি লিখেছেন, ‘বাংলা সাহিত্যের মধ্যযুগে আঞ্চলিক ভাষার মিশ্রণে পুঁথি রচনার একটি রীতি লক্ষণীয়। উনিশ-বিশ শতকে আস্কর আলী পণ্ডিত রচিত পুঁথিতেও এই রীতি লক্ষ্যগোচর হয়। আঠারো শতকের কবি আলী রজা ওরফে কানুফকির এই রীতি অনুসরণ করে অর্থাৎ চট্টগ্রামের আঞ্চলিক ভাষার শব্দ প্রয়োগ করে গান লিখেছিলেন। আস্কর আলী পণ্ডিতের গানেও এই রীতিই অনুসরণ করা হয়েছে। এক সময় এ ধরনের গানকে চট্টগ্রামে কাউয়া আঞ্চলিক গান বলা হতো।’
আলী রজা ওরফে কানু শাহ’র সবচেয়ে আলোচিত কাব্যগ্রন্থ হলো ‘জ্ঞানসাগর’, যা পৃথিবীর অনেক দেশে অনেক ভাষায় অনূদিত হয়েছে। সাহিত্য ভুবনে মহাকবি আলাওলের মতোই চট্টগ্রামের আনোয়ারা মোকামের ওষখাইন গ্রামের কবি আলী রজারও আবিষ্কারক হলেন মনীষী আবদুল করিম সাহিত্যবিশারদ। আজ থেকে ১০৭ বছর আগে ১৯১৭ সালে (বাংলা ১৩২৪) আবদুল করিম সাহিত্যবিশারদের সম্পাদনায় ‘কলকতার বঙ্গীয় সাহিত্য পরিষৎ’ থেকে আলী রজার কাব্যগ্রন্থ ‘জ্ঞানসাগর’ প্রকাশিত হয়েছে। সাহিত্যবিশারদ কানু ফকিরের ছয়টি গ্রন্থের পাণ্ডুলিপি সংগ্রহ করেছিলেন। আবদুল করিম সাহিত্যবিশারদ ‘জ্ঞানসাগর’ গ্রন্থের ভূমিকায় লিখেছেন, ‘এই গ্রন্থের নাম ‘জ্ঞানসাগর’। …ইহা একখানি দরবেশী গ্রন্থ। ইহার প্রায় আদ্যোপান্ত নিগূঢ় আধ্যাত্মিক কথায় পূর্ণ। সে আধ্যাত্মিকতায় আবার হিন্দু-মুসলমানী ভাবের সংমিশ্রণ দেখা যায়।’
বস্তুত কানু শাহ কোনো আঞ্চলিক গান লিখেননি, তার কাব্যে আঞ্চলিক ভাষার প্রয়োগ থাকতে পারে। তেমনি আস্কর আলী পণ্ডিতও কোনো আঞ্চলিক গান লিখেননি। মূলত তিনি প্রাচীন বাংলার ধারায় লোকসংগীত লিখেছেন, যেখানে আঞ্চলিক ভাষার শব্দ প্রয়োগের মুন্সিয়ানা রয়েছে। আর আঞ্চলিক ভাষার মিশ্রণ থাকলেই তো তাকে কাউয়া আঞ্চলিক বলা যায় না। চর্যাপদ, আলাওলের ‘পদ্মাবতী’ এ মধ্যযুগের কবি আবদুল হাকিমের কাব্যেও আঞ্চলিক শব্দের মিশ্রণ আছে। যেমন কবি আবদুল হাকিম তার ‘বঙ্গবাণী’ কবিতায় লিখেছেন ‘যে সবে বঙ্গেতে জন্মি হিংসে বঙ্গবাণী সে সব কাহার জন্ম নির্ণয়ন জানি’। এখানে ‘ন জানি’ হলো চট্টগ্রামী ভাষার শব্দ। কবি ছিলেন স›দ্বীপের বাসিন্দা। এখন আঞ্চলিক শব্দের মিশ্রণ ঘটেছে বলে কি এই কবিতাকে ‘কাউয়া কবিতা’ বলা হবে?
গবেষকদের মতে বাংলা ভাষার আদি নিদর্শন চর্যাপদেও চট্টগ্রামী ভাষার শব্দ প্রয়োগ ঘটেছে। বরেণ্য গবেষক জামাল উদ্দিন তার ‘চট্টগ্রামের লোকসাহিত্য’ গ্রন্থে চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক ড. শফিউল আজম ডালিমের প্রবন্ধ-সূত্রে
তা উল্লেখ করেছেন এভাবে চর্যা নং-৩।
এ এক সে শুণ্ডিনি দুই ঘরে সান্ধই
চীঅণ বাকলে বারুনী বান্ধাই। (পৃ-১, বিরুবাপাদানাম)
আধুনিক বাংলায়- এক সে শুড়িনি দু ঘরে ঢোকে। চিকন বাকল দিয়ে সে বারুনী মদ চোলাই করে। শব্দের বুৎপত্তি-চীঅণ<চিক্কণ, চিকণ। চীঅণ শব্দ দিয়ে চট্টগ্রামের আঞ্চলিক বাক্য- দেখি খুব চীঅণ মনে অর। শুদ্ধ বাংলায় হবে- দেখে খুব চিকন মনে হচ্ছে। (এরকম আরো উদাহরণ আছে)। কাউয়া আঞ্চলিক গানের উদাহরণ আবদুল গফুর হালীর একটি আইকনিক গান হলো বানু রে জি জি জি ...। এই গানটি সত্তরের দশকে গ্রামোফোন রেকর্ডে শ্যাম-শেফালীর কণ্ঠে তুমুল জনপ্রিয় হয়। গানটির মূল ভার্সন এমন... ছেলে : বানু রে মেয়ে : জি ছেলে : অ বানু মেয়ে : জি জি জি রেঙ্গুম শঅরত যাইয়ুম আঁই তোয়াল্লাই আইন্নুম কি মেয়ে : শাড়ি-চুড়ির আশা গরি রেঙ্গুম যাইতাম দি যদি সোনার যৈবন কেনে রাইখ্যুম গামছা দি বাঁধি। ছেলে : অক্কল সমত তোঁয়ার কথা মনত থাকিব মেয়ে : চাইও তোঁয়ারে বার্মার মাইয়া ফাঁদত ফেলাইব ছেলে : বার্মার মাইয়া কি গরিব আঁই যদি ঠিক থাকি। এই গানটি সত্তরের দশকে ‘মনের মানুষ’ চলচ্চিত্রে গেয়েছেন শ্যাম-শেফালী। সেখানে কিন্তু গানের পরতে পরতে ঢুকে পড়েছে প্রমিত ও অন্য অঞ্চলের শব্দ। সেই গানটি এমন... ছেলে : বানু রে মেয়ে : জি ছেলে : অ বানু মেয়ে : জি জি জি ছেলে : ঢাকা শহর যামু আমি তোয়াল্লাই আনুম কি মেয়ে : শাড়ি-চুড়ির আশা করি রেঙ্গুম যাইবার দি যদি সোনার যৈবন কেমনে রাখুম গামছা দি বাঁধি ছেলে : সকল সময় তোঁয়ার কথা মনে থাকিব মেয়ে : চাইও তোঁয়ারে ঢাকার মাইয়াই ফাঁদে ফেলাইব ছেলে : ঢাকার মাইয়া কি করিব আমি যদি ঠিক থাকি। সহজেই অনুমেয় পরের ভার্সনে গানটি বিকৃত করা হয়েছে, ‘বকের বাসায় কাকের ছা’ ঢুকে গেছে। এটা মূলত সংগীত প্রযোজক ও একজন কিংবদন্তি শিল্পীর স্বামীর প্রভাবে হতো বলে প্রচার আছে। এ কারণে আবদুল গফুর হালী আঞ্চলিক গানের অবিসংবাদিত এই শিল্পীকে গান দেয়া বন্ধ করে দিয়েছিলেন। পরে গান বিকৃত করা হবে না- এই শর্তে তাদের মধ্যে আবার বনিবনা হয়। সত্তরের দশকে বিশেষত লং প্লে ও ডিস্কে গান রেকর্ড করার সময় আঞ্চলিক গানে প্রমিত বাংলা বা অন্য অঞ্চলের কথা ঢুকিয়ে দেওয়া হতো। এই কথার প্রমাণ মেলে চট্টগ্রাম একাডেমি প্রকাশিত ‘শ্যাম- শেফালী স্মারকগ্রন্থে’ দেয়া সৈয়দ মহিউদ্দিনের বক্তব্যেও। এম এন আখতার বলেছেন ‘অশ্লীল কাউয়া আঞ্চলিক’ গানের কথা আরেফীন সাহেব কাউয়া আঞ্চলিক গানের অস্তিত্ব প্রমাণ করার জন্য আরেকজন কালজয়ী শিল্পী এম এন আখতারের বক্তব্যকে সাক্ষী মেনেছেন। এখানেও আরেফীন সাহেব সচেতনভাবে অথবা অবচেতনে এম এন আখতারের আসল কথা বাদ দিয়েছেন। এম এন আখতার তার ‘মানবদরদী সুরসাধক’ গ্রন্থে ‘আমার কালুরঘাট বেতার’ শীর্ষক ভূমিকায় ‘অশ্লøীল কাউয়া আঞ্চলিক’ বিষয়ে নাতিদীর্ঘ বক্তব্য দিয়েছেন। তিনি বলেছেন, ‘একসময় আঞ্চলিক গানকে মানুষ ঘৃণা করত, আঞ্চলিক গানের শিল্পীদের নাজেহাল করত।’ কিন্তু সেটা কোনো আঞ্চলিক গান? এম এন আখতার তার লেখার শিরোনামই তো করেছেন ‘অশ্লীল কাউয়া আঞ্চলিক’ গান। এই ধরনের ‘অশ্লীল কাউয়া গান’ তো এখনো আছে, ইউটিউব খুললেই এই ধরনের গান দেখা যায়, যা শুনলে কানে আঙ্গুল দিতে হয়। কবিয়াল রমেশ শীল, মোহাম্মদ নাছির, আবদুল গফুর হালী, এম এন আখতার কথিত ‘অশ্লীল কাউয়া আঞ্চলিক গান’ কখন লিখেছেন? কোথায় আছে সে গান? শামসুল আরেফীন আসলে অশ্লীল আঞ্চলিক গান আর কাউয়া আঞ্চলিক গানকে গুলিয়ে ফেলেছেন। আস্কর আলীর লোকসংগীত; আদি রসাত্মক, অশ্লীলতাযুক্ত? শামসুল আরেফীন কাউয়া আঞ্চলিক গান সম্পর্কে আরো লিখেছেন, ‘শুদ্ধ বাংলার সঙ্গে আঞ্চলিক ভাষার মিশ্রণে রচিত গানকে কাউয়া আঞ্চলিক গান বলা হতো কেন, তার সঠিক কারণগুলো আমাদের জানা নেই। তবে ধারণা করতে পারি, প্রাগুক্ত আদিরসাত্মক এবং বিকৃতি রুচি ও অশ্লীলতাযুক্ত গানগুলোই ছিল মূল কারণ। ‘কাউয়া’ শব্দ থেকে বোঝা যায়, এ ধরনের গানকে এই শব্দ ব্যবহারের মাধ্যমে চরম উপেক্ষা, অবজ্ঞা ও অসম্মানিত করা হতো। তবে সাধারণ মানুষ বা লোকসমাজের কাছে এই গানগুলোর চাহিদা ও জনপ্রিয়তা ছিল। আস্কর আলী পণ্ডিতের সময়ে তার জনপ্রিয় হওয়া এ ধরনের কিছু গান : ‘কী জ্বালা দি গেলা মোরে’, ‘ডালেত লরি চরি বৈও চাতকি ময়না’, ‘কেউরে ন বুঝাইয়মরে আঁর পরাণবন্ধু কালা’, ‘বসি রইলি ও মন কার আশে/রঙ্গের বাজার।’ (চট্টগ্রামের কাউয়া আঞ্চলিক গান, দৈনিক ভোরের কাগজ, ১৫ ফেব্রুয়ারি, ২০২৪)। আরেফীন সাহেব ‘আস্কর আলী পণ্ডিত’ গবেষণায় গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রেখেছেন। তার ‘আস্কর আলী পণ্ডিত : একটি বিলুপ্ত অধ্যায়’ একটি মূল্যবান গবেষণাগ্রন্থ। কিন্তু সেই তিনি কীভাবে আস্কর আলী পণ্ডিতের লোকসংগীতকে আদি রসাত্মক, বিকৃত রুচির ও অশ্লীলতাযুক্ত’ হিসেবে বর্ণনা করলেন তা আমার বোধগম্য নয়। আস্কর আলীর ‘ডালেতে লরিচরি বইও’ গানটি একটি লোকধর্ম-ভিত্তিক সাধন-সংগীত। মধ্যযুগের কবি আলী রজা ওরফে কানু শাহ বলেছেন, ‘গীতন্ত্র মহামন্ত্র বৈরাগীর কাম/তালযন্ত্র মহামন্ত্র প্রভুর নিজ নাম’। আলী রজার ভাবের উত্তরসূরি আস্কর আলী পণ্ডিতও গেয়েছেন একই ভাবধারায়... ডালেত লরি চরি বৈও চাতকি ময়না, গাইলে বৈরাগির গিত গাইও\ ধুয়া\ অরে চাতকি ময়না রঙ্গ তোর কালা। তোমার মনে আমার মনে এক প্রেম জ¦ালা\ আচ্ছা এখানে আদরসাত্মক, অশ্লীল বা বিকৃত রূচির কী আছে? আস্কর আলী পণ্ডিতের আরো একটি গানকে ‘অশ্লীল কাউয়া আঞ্চলিক’ গানের কাতারে ফেলেছেন শামসুল আরেফীন, গানটি এমন... বসে রইলি মন কার আশে রঙের বাজার ভাঙ্গি যাইব একদিন চোখের নিমিষে। তেল থাকিতে বাত্তিরে নিভে কাল তুফানের বাতাসে। গুরু কেমন ধনরে ও ভাই, গুরু কেমন ধন সময় থাকতে না চিনিলি ওরে অবুঝ মন। ভবের খেলা বিষম জ্বালা দুধের সনে বিষ মিশে। বাণিজ্যে পাঠাইল তোরে বহু ধন দি লাভেমূলে সব হারালি সঙ্গে নিবি কী। তোরে গেরেফতারি গরি নিব লুকাই থাকবি কার পাশে। গুরু পদ ধরি হীন আস্কর আলী কয় সময়ে না করলে সাধন অসময় কি হয়। নাইয়রত্তুন নাস্তা আইনলে স্বামিয়ে ভালোবাসে। এই গানটির ভাব তো খুব সহজ...একদিন রঙের বাজার তথা এই পৃথিবী ধ্বংস হয়ে যাবে। যদি পরপারের পুঁজি না থাকে তাহলে তুমি স্রষ্টার সামনে কী নিয়ে দাঁড়াবে? যেদিন সমন আসবে, গ্রেপ্তার অনিবার্য সেদিন কার পাশে লুকিয়ে থাকবে? তাই লালনের সঙ্গে কণ্ঠ মিলিয়ে আস্কর আলী বলেছেন, ‘সময়ে না করলে সাধন অসময় কি হয়’। নাইয়র থেকে নাস্তা আনলে যেমন স্বামী খুশি হয় তেমনি ইহকাল থেকে পুণ্য নিয়ে গেলে পরকালে পরম স্বামী খুশি হবেন। আচ্ছা, বলুন এই গানকে কাউয়া আঞ্চলিক বলার যুক্তিটা কী? শামসুল আরেফীন কাউয়া আঞ্চলিক গানের যে সংজ্ঞা দিয়েছেন, ওই যে আঞ্চলিক শব্দের মিশ্রণ, আদি রস, অশ্লীলতা... এই গানের তার কোনটা আছে? সবশেষ বলি, চট্টগ্রামের আঞ্চলিক গানের লিজেন্ড আবদুল গফুর হালী, এম এন আখতার, সঞ্জিত আচার্য, কল্যাণী ঘোষ, সিরাজুল ইসলাম আজাদ কিংবা বুলবুল আকতার, তাদের পরম স্নেহ পেয়েছি আমি। প্রায় দুই যুগ ধরে তাদের সংগীতজীবন অনুধাবনে আমার বিশ্বাস হয়েছে, চট্টগ্রামে ‘কাউয়া আঞ্চলিক গান’ বা ‘হালদাফাডা গান’ শব্দগুলো ক্ষেত্রবিশেষে গালি। এসব শব্দবন্ধের অনুচিত ব্যবহার শিল্পী ও তাদের পরিজনদের কষ্ট দেয়।

মন্তব্য করুন

খবরের বিষয়বস্তুর সঙ্গে মিল আছে এবং আপত্তিজনক নয়- এমন মন্তব্যই প্রদর্শিত হবে। মন্তব্যগুলো পাঠকের নিজস্ব মতামত, ভোরের কাগজ লাইভ এর দায়ভার নেবে না।

জনপ্রিয়