গয়েশ্বর চন্দ্র রায় : ভারতের সবচেয়ে নিম্নমানের প্রোডাক্ট আওয়ামী লীগ

আগের সংবাদ

বহুমাত্রিক কৌশল আ.লীগের

পরের সংবাদ

অবশেষে বসন্ত এলো

প্রকাশিত: এপ্রিল ১, ২০২৪ , ১২:০০ পূর্বাহ্ণ
আপডেট: এপ্রিল ১, ২০২৪ , ১২:০০ পূর্বাহ্ণ

চা দিয়ে ভিজিয়ে একটা রুটি খেতে খুব ইচ্ছা করছে ভোলার। একসঙ্গে ১০ কাপ চা বানাচ্ছে আছমত। ১০ জন অর্ডার করেছে। বসার কোনো জায়গা নেই। এখানে এভাবেই দাঁড়িয়ে খায়। আর খাওয়ার পর সবাই বিল পরিশোধ করে চলে যায়। ভোলাও সেখানে দাঁড়িয়ে। ওর অবশ্য অর্ডার নেই। কিন্তু ক্ষুধার্ত চোখ দুটি লেগে আছে পলিব্যাগে ঝুলে থাকা রুটির দিকে। সঙ্গে কানে বাজছে চামুচের টুং টাং ফোক গানের সুর। শেষমেষ এক স্যুট পরা ভদ্রলোকের আচমকা ধমক খেয়ে সেখান থেকে সরে এলো ভোলা!
এভাবেই রোজ ফিরে আসে। সেখানে যেতে চায় না। একশ একবার পণ করে, আর পাগলা কুত্তা কামড়ালেও সেখানে যাবে না বলে। তারপরও ওই বোবা পেটটা বারবার ওখানে নিয়ে যায়। কখনো মা-বাপকে গাল খাওয়ায়, আর নিজেতো গাল মন্দের সঙ্গে মাঝেমাঝে চর থাপ্পড়ও খায়! তবে এই সমাজ হয়তো এটা বোঝে না, গালটা ভোলার হলেও লজ্জাটা কিন্তু সমাজের। এটাও বোঝে না যে, মানবতার স্খলনের রেটিং পয়েন্টও দিন দিন বাড়ছে। যেমন বাড়ছে উঁচু উঁচু ইমারত, চার চাকার গাড়ি আর ব্যাংক ভর্তি টাকা।
যাহোক মনটা খারাপ করে ফুটপাত ঘেঁষে বস্তির দিকে এগোতে থাকল ভোলা। মাঘের শীতে থর থর কাঁপছে আর হাঁটছে। গায়ে শীতের পোশাক না থাকলেও একটা ছেঁড়া জামা আছে। ছেঁড়া জামাটা দেখে মনে পড়ে জয়নুল আবেদীনের আঁকা দুর্ভিক্ষের ছবির কথা। আবার একাত্তরের একটা পরিসংখ্যান মনে ভাসে। কারণ একাত্তরে সবাই কাঁধে কাঁধ মিলিয়ে যুদ্ধ করলেও বর্তমানে কাঁধে পা দিয়ে সবাই হেঁটে চলে যেতে পছন্দ করে। এটাইতো একাত্তর এবং বর্তমান সময়ের মধ্যে পার্থক্য।
ভোলার বাবা মনু মিয়া বলেছে, আজ ফুটপাত থেকে একটা আধা পুরনো সোয়েটার কিনে এনে দেবে ছেলেকে। দেখা যাক কী হয়। ওর বাবাতো আবার রাতে রিকশা চালায়। দিনে কিছুটা ঘুমায়। অবশ্য আর কিছুক্ষণের মধ্যেই বাসায় ফিরবে সে।
ইতোমধ্যে ভোলার সঙ্গে ঘরের দরজায় দেখা হয়ে গেল মনু মিয়ার। বাবার মুখটা ঘামে ও ক্লান্তিতে বটগাছের পাতার মতো শুকিয়ে গেছে। আর ভোলার চোখে চোখ পড়তেই যেন গাছ থেকে পাতাটা মাটিতে ঝরে পড়ল। তাইতো ঘরে প্রবেশ করে মনু আমতা আমতা সুরে বলল, ‘বাজান রে গতকাইল রিকশাডার সামনের চাক্কাডা পামছার হইছিল। তাই ঠিক মতো ক্ষেপ মারবার পারি নাই। যাও মারছিলাম চাক্কার পিছনেই গেছে। তয় বাজান চিন্তা করিছ না। ওহনতো মাঘ মাস, আর কয়দিন পড়েইতো ফাল্গুন আইবো। তরে না হয় একবারে একখান সুন্দর দেইখা জামা কিনা দিমুনে?’
বাবার এমন অসহায় আত্মসমর্পণে বুকটায় বাবার জন্য ভালোবাসার সাইরেন বেজে উঠল ভোলার। যেন বটগাছটা আজ তার কাছে নুয়ে পড়ে ক্ষমা চাইছে। তাইতো লজ্জায় ‘ঠিক আছে বাবা, কোনো অসুবিধা নেই!’ বলে আরো যোগ করল, ‘সেটাই সব চাইতে ভালো হবে। এই ১০-১৫ দিনের জন্য কী দরকার একটা শীতের পোশাকের। এই কয়দিন পুরান জামাতেই চলবে। তবে নতুন জামাটা কিনে দিও বাবা। কারণ বুঝোতো স্কুল যেতে হয়। বাজান তুমি এখন ঘুমাও, তোমার বিশ্রামের দরকার। আমি স্কুলে যাই।’
মনু আর ভোলার এই রসায়নটা সমাজের কেউ বোঝে না, তাইতো চায়ের দোকানে ভদ্রলোকটা ভোলাকে ধমক দিল। আর মনুর মহাজন চাকার টাকাটা মনুর ভাড়া থেকে কেটে রাখল। এর মাঝেই ভোলার মা বলল, আয় বাজান কয়টা পানতা ভাত আছে। একটা মরিচ দিয়া ডইলা খায়া স্কুলে যা। সঙ্গে সঙ্গে ভোলা বলল, না মা! আমাকে একজন সাহেব একটা রুটি আর চা খাওয়াইছে। আজকে আর আমার খিদা নাই। ভাত কয়ডা তুমি আব্বারেই দিয়া দেও… বলে সে স্কুলের পথ ধরল।
ভোলা খেয়েছিল ঠিকই তবে চা-রুটি নয় বরং নির্দয় ধমক! কিন্তু মায়ের কাছে হয়ে গেল সেটা নাশতা। এভাবেই ভোলারা মায়েদের কাছে কথা লুকায়। কিন্তু মায়েরাও বোঝে। ভালো করেই জানে এ সমাজের সাহেবদের হালচাল। তবে জানে এটাই বাবার প্রতি ভোলাদের ভালোবাসার টান। তাইতো আঁচল চেপে শুধু কাঁদল।
এভাবেই একদিন মাঘ পেরিয়ে ফাল্গুন এলো। বাবাকে আবার জামার কথা মনে করিয়ে দিল ভোলা। বাবাও কথা দিল, কাল সকালে জামা নিয়ে আসবে। অপেক্ষার প্রহর গুনতে রইল ভোলা। বিছানায় এপাশ ওপাশ করতে রইল। কখন মনু মিয়া জামা নিয়ে আসবে। পরের দিন সকালে সেই জামা গায়ে স্কুলে যাবে।
কিন্তু সেদিন মায়ের চিৎকারে ভোলার ঘুম ভাঙল। দেখল ওর বাবাকে রিকশা থেকে ধরাধরি করে নামানো হচ্ছে। ভোলাও দৌড়ে গেল এবং দেখল ওর বাবার একটি পা নেই! সড়ক দুর্ঘটনায় পা হারিয়েছে।
আজ অনেক দিন পর ভোলাও মায়ের সঙ্গে একটানা কাঁদল! কেউ কাউকে সান্ত¡না দিল না। তবে সান্ত¡না একটাই, বটগাছটাতো এখনো বেঁচে আছে। বাকি কাজটা তাকেই করতে হবে। ভোলা আর সেদিন স্কুলে গেল না। বাবার রিকশাটা নিল আর রাস্তা দিয়ে ছুটতে শুরু করল। মা তাকিয়ে আঁচল চেপে কাঁদছে। বসন্তের কোকিল ডাকছে। গাছে গাছে নতুন পাতা বেরিয়েছে।
মো. আব্দুর রহমান : বালিয়াডাঙ্গা, কালীগঞ্জ, ঝিনাইদাহ

মন্তব্য করুন

খবরের বিষয়বস্তুর সঙ্গে মিল আছে এবং আপত্তিজনক নয়- এমন মন্তব্যই প্রদর্শিত হবে। মন্তব্যগুলো পাঠকের নিজস্ব মতামত, ভোরের কাগজ লাইভ এর দায়ভার নেবে না।

জনপ্রিয়