এমসিসিএইচএসএলে দুর্নীতির অভিযোগ

আগের সংবাদ

শ্রমবাজারে দুষ্ট চক্রের থাবা

পরের সংবাদ

স্বাধীনতা-উত্তর সাহিত্য সৃষ্টির প্রবণতা ও ধারা

প্রকাশিত: মার্চ ২৯, ২০২৪ , ১২:০০ পূর্বাহ্ণ
আপডেট: মার্চ ২৯, ২০২৪ , ১২:০০ পূর্বাহ্ণ

সাহিত্য জীবনের দর্পণ, প্রতিচ্ছবি, মূর্ত বিমূর্ত দুই দিক নিয়ে। সে জীবন ব্যক্তি ও সমষ্টির, অধিকতর বিচারে পারিবারিক, সমাজ, রাজনীতি ও জাতিভিত্তিক। সংগ্রামে বা নিতরঙ্গ ধারায়ও সেই ছবির প্রকাশ। এবং তা আবেগে বা নিরাবেগে জাতীয় বিপ্লবে বা মুক্তি সংগ্রামেরও প্রতিফলন সাহিত্যে- তবে বিশেষভাবে কবিতায় গানে, সেই সঙ্গে কথা সাহিত্যে অর্থাৎ ছোটগল্পে, উপন্যাসে, নাটকে।
রাজনৈতিক আলোড়নে ভারত বিভাগ, বঙ্গ বিভাগ সম্পন্ন হয়ে পাকিস্তানি পূর্ববঙ্গে সাহিত্য সৃষ্টি অনাসৃষ্টির মধ্য দিয়ে একুশের প্রভাবে আধুনিকতাও প্রগতিশীলতার পথ ধরে। একুশের কবিতা, ভাষাভিত্তিক কবিতা, ষাটের দশকে জাতীয়তাবাদী চেতনার কবিতা ইত্যাদি মিলে সাহিত্যকর্মে কবিতারই বিপুল প্রাধান্য। এর সঙ্গে যুক্ত হয় মুক্তিযুদ্ধের কবিতা। সেই সঙ্গে ছোলগল্প ও উপন্যাস।
কবিতার বাগানে এভাবে নানা রং ফুলের সমারোহের মধ্যে স্বাধীনতা-উত্তরকালে কথাসাহিত্যের প্রসার- ছোটগল্পে ও উপন্যাসে সমাজ, জীবন ও রাজনীতির প্রকাশ ঘটিয়ে। পাকিস্তানি আমলে সংঘাতে সংগ্রামে ভাষা ও জাতীয়তাবাদী চেতনার স্মরণ ঘটিয়ে যে সাহিত্য সৃষ্টি, আগেই বলেছি তাতে কবিতার ব্যাপক প্রাধান্য। সেসব কবিতার বৈচিত্র্য কম নয়, যেমন বিষয়ে তেমনি প্রকরণে, তেমনি সংহত আবেগের প্রকাশ ঘটিয়ে।
ঊনসত্তরের উত্তপ্ত গণঅভ্যুত্থান, গুলিবিদ্ধ রক্তভেজা আসাদের শার্ট, কিশোর শহীদ মতিউরসহ পঁচিশে মার্চের মধ্য রাতে ঢাকায় গণহত্যার সূচনা গুলি বারুদের মাঝে ও রক্তের গন্ধ যে সব বিভীষিকা তৈরি করে তারই আলেখ্য রচিত হয় কবি ও কথাশিল্পীদের হাতে কবিতায় ও গল্পে, প্রবন্ধে, ক্বচিৎ উপন্যাসে। কবিতার তুলনায় উপন্যাসের এ দুর্বলতা আমাদের সাহিত্যকর্মের পূর্বাপর বৈশিষ্ট্য। যেমন স্বাধীনতা-পূর্ব তেমনি স্বাধীনতা-উত্তরকালে। তবে শেষোক্ত পর্বে আগেকার তুলনায় উপন্যাসের দৃষ্টি ও সৃষ্টি অধিকতর। উন্নতমান কিছু উপন্যাস রচিত হলেও দৃষ্টি ও সৃষ্টির সামঞ্জস্য বিধানে উৎকৃষ্ট মান উপন্যাসের সংখ্যা কম। বিশ্বমানের তুলনায় পরিস্থিতি কিছুটা হতাশাব্যঞ্জক। প্রাকরণিক অভিধায় সম্প্রতিক অর্থাৎ দুই-তিন দশকের উপন্যাস শিল্প মাঝেমধ্যে তির্যকপথে চমক সৃষ্টির চেষ্টা করেছে এবং করে চলেছে। তুলনায় ছোট গল্প প্রাকরণিক উৎকর্ষের বিচারে এগিয়ে। স্বাধীনতা-পরবর্তী গত সাড়ে চার দশকের নান্দনিক কাল্পনিক বর্ণনামচা এমন তথ্যই তুলে ধরে।
একটি কথা কারো কারো কাছে অপ্রিয় মনে হতে পারে। প্রশ্নও তুলতে পারে। সেটা হলো অ্যাকাডেমিক সাহিত্যচর্চার বাইরে পঞ্চাশ থেকে ষাট দশক হয়ে স্বাধীনতা-উত্তরকালে বাংলাদেশের সাহিত্যচর্চার একটি বৃহৎ সৃষ্টিকর্ম ভাষা সংগ্রাম ও মুক্তিযুদ্ধ আনুষঙ্গিক ঘটনাদি কেন্দ্র করে। সেখানে কবিতার প্রবলতা আবেগে ভাসমান। সেই সঙ্গে ছোটগল্প ও উপন্যাস, ক্বচিৎ নাটক।
এর কারণ স্পষ্ট। ১৯৪৭ আগস্টে পাকিস্তানের জন্মলগ্নের পর থেকে পূর্ববঙ্গ কেন্দ্রীয় সরকারের নানা রাজনৈতিক অপকর্মের শিকার। যেমন অন্যতম রাষ্ট্রভাষা বাংলা নিয়ে তেমনি অর্থনৈতিক সামাজিক বৈষম্য। ২৪ বছরের পাকিস্তানি শাসনামলের বাঙালির সারাটা সময় চলেছে বিক্ষোভে, প্রতিবাদে, আন্দোলন, এমনকি দীর্ঘ কারাবাসে বা মাঝেমধ্যে আত্মদানে। শুদ্ধ গণতান্ত্রিক শাসন ব্যবস্থা কখনো কায়েম হয়নি।
সে সময়ে, বিশেষ করে ষাটের দশকের সাহিত্য সৃষ্টির অঙ্গনে আরেকটি নতুন সৃষ্টি বৈশিষ্ট্য ছিল শ্রেণি সংগ্রামের পক্ষে সৃষ্ট গণসংগীতের ধারা। এ ধারার প্রকাশ প্রধানত চল্লিশের দশকের গণসংগীতের প্রভাবে- সলিল চৌধুরী, মেহাঙ্গ বিশ্বাস প্রমুখের প্রদর্শিত পথে। সাংগঠনিক দিক থেকে এ বিষয়ে উল্লেখযোগ্য ক্রান্তি ও উদীচীর আবেগময় তৎপরতা। ‘ছায়ানট’ নাম সংগঠনটির সাহিত্যিক জনপ্রিয় তৎপরতা ধরা ছিল রবীন্দ্রসংগীতে ও কখনো নজরুলের গানে এবং প্রায় একই সময়ে। শেষোক্ত ধারার ব্যাপক বিকাশ ঘটেছে স্বাধীনতা-উত্তরকালে বহুসংখ্যক রবীন্দ্র সংগীতের সাংগঠনিক তৎপরতায়। সে তুলনায় রবীন্দ্র সাহিত্যের চর্চায় গবেষণাকর্ম অপেক্ষাকৃত কম।
সত্তরের দশক মুক্তিযুদ্ধের কবিতার দশকরূপে বিবেচিত হলেও দ্রুতই তার চারিত্র বিভাজন দেখা যেতে থাকে। কারণ আর কিছু নয়। স্বাধীনতা-উত্তর সামাজিক-রাজনৈতিক নৈরাজ্য ও বিশৃঙ্খলা, অপ্রাপ্তির হতাশা, একদলীয় রাজনীতির প্রবলতা সমাজে ক্ষোভের সৃষ্টি করে। রাজনীতি ক্ষেত্রে বিভাজন ও বিরূপতা অবিশ্বাস্য মনে হলেও আত্মপ্রকাশ করে।
সমাজে অনৈতিকতা, অসততা, দুর্নীতি আর খুন, চাঁদাবাজি ও মায় গ্রাম পর্যায়ে ডাকাতির প্রকাশ অভাবিত সামাজিক পরিস্থিতি সৃষ্টি করে। মানুষ এসব দেখে বিস্মিত, ক্ষুব্ধ। এসবের প্রভাব পড়ে সাহিত্য কর্মীদের মধ্যে, সৃষ্টি করে নেতিবাচক প্রতিক্রিয়া। হারিয়ে যায় একুশের চেতনা, মুক্তিযুদ্ধের কবিতা ও কথাসাহিত্যের বড়সড় অংশের যাত্রা বিপরীত চরিত্রের পথ ধরে। একটি ছোট্ট উদাহরণ দুই পঙ্ক্তির কবিতায় :
‘রক্তের অক্ষরে লেখা একটি কবিতার জন্য
আবার বিদ্রোহী হও তুমি।’
কিন্তু রক্তের এত চড়ামূল্যে অর্জিত স্বাধীন স্বদেশে নতুন করে বিদ্রোহের কাজটি সহজ ছিল না। মানুষের চেতনায় স্বাধীনতার সুগন্ধ তখন কিছুটা হলে মৌতাত ছড়াচ্ছে। তৈরি হতে চলেছে একটি অর্থনৈতিক সুবিধাভোগী, বিত্তবান শ্রেণি। এদের রাজনৈতিক প্রভাব কম নয়। কিন্তু পাকিস্তানি শাসনের প্রতিচ্ছায়া যে আমাদের রাজনৈতিক ধারাকে ছেড়ে যায়নি, তার প্রমাণ পাওয়া গেল অল্প সময়ের মধ্যেই।
আবার রক্তের গন্ধ আকাশে বাতাসে, রক্তে ভেজে মাটি। পাকিস্তানি ঐতিহ্যের টানে দুই পাকিস্তানি চেতনার জেনারেলের হাত ধরে সামরিক-স্বৈরতান্ত্রিক শাসনের প্রকাশ। গণতন্ত্রের সুবচন নির্বাসনে। বাহাত্তরের সেকুলার সংবিধান খণ্ডিত, অগণতান্ত্রিক রঙে চিত্রিত। কিন্তু রক্তের আবহ দূর হয় না। একাত্তরের যোদ্ধা নেতাদের উচ্চাকাক্সক্ষা, রক্তাক্ত পরস্পর-বিরোধিতা সমাজে অভাবিত নৈরাজ্য সৃষ্টি করে।
সুস্থ রাজনৈতিক চেতনা পিছু হটে। কেবলই সংঘাত, বিদ্রোহ আর মৃত্যু ও রক্তপাত। মানুষ হতবাক এসব দেখে। তেমনি শিল্পী-সাহিত্যিকগণ। তাদের মধ্যেও বিভাজন। বিভাজন আদর্শগত চিন্তার, সেই সঙ্গে আদর্শগত মূল্যবোধের ক্ষয় ও দূষণ। প্রাপ্তির টানে কেউ ভাসে, কেউ ভাসে না।
কবিতাও সেভাবে প্রভাবিত, বিভাজিত। বিভাজিত চরিত্র বিচারে সাহিত্যকর্ম। স্বৈরশাসনের প্রায় এ যুগ ধরে সাহিত্য ভুবনে নৈরাজ্য। স্বল্পসংখ্যক শাসকপন্থি, অন্যরা নানা চেতনার টানে শৈল্পিক ধারায় বিভাজিত। কবিতা বা কথা সাহিত্যের নির্দিষ্ট আদর্শগত মূল স্রোত অন্তর্হিত। আশি ও নব্বইয়ের দশক এভাবে নান্দনিক দিক থেকে পরস্পর বিচ্ছিন্ন এক শিল্প সৃষ্টির ভুবনের জন্ম দেয়।
এসব ক্ষেত্রে নির্দিষ্ট মূল মতাদর্শের কোনো দিকদর্শন থাকে না। থাকেনি বাংলাদেশে সাহিত্য সৃষ্টির ভুবনে। যে যার মতো, নিজ নিজ শৈল্পিক ভাবনার পথ বেড়ে চলাই সঠিক মনে করে।
সাহিত্য সৃষ্টির ক্ষেত্রে হারিয়ে যায় একুশের চেতনা এবং মুক্তিযুদ্ধের চেতনা। হতাশা ও বিভ্রান্তি সাহিত্য অঙ্গনে প্রধান হয়ে ওঠে। এই দুইয়েরই প্রভাব নেতিবাচক।
জাতীয় জীবনের সবচেয়ে আদর্শগত বড় দুর্যোগ বিভাজিত জাতীয়তাবাদ-বাঙালি ও বাংলাদেশি। অন্যদিকে পাকিস্তানি প্রেতাত্মার প্রভাবে উর্দি শাসনের স্বৈরতন্ত্রী ধারা। তাতে আবার একশ্রেণির মানুষের সমর্থন। তবু শেষ পর্যন্ত স্বৈরতন্ত্র হঠে নূর হোসেন প্রমুখ তরুণের আত্মদানে। ঘোষণা : ‘স্বৈরতন্ত্র নিপাত যাক/গণতন্ত্র মুক্তি পাক’।
রক্তে ভেজা রাজপথে স্বৈরতন্ত্র নিপাত গেলেও রাজনৈতিক বিচারে গণতন্ত্রের মুক্তি ঘটে না। সুস্থ আদর্শবাদী রাজনীতির প্রকাশ ঘটে না, প্রভাব স্থায়ী হওয়া দূরে থাক। রাজনৈতিক স্বার্থপরতার স্রোত প্রবল ধারায় বহমান, সেইসঙ্গে সাম্প্রদায়িক চেতনার ভূতপ্রেত আসর জাঁকিয়ে বসে প্রেত নৃত্য করতে থাকে। কোথাও কোথাও পোড়ে সংখ্যালঘুর অবস্থান। নৈতিকতা লজ্জায় মুখ ঢাকে। নামে গণতন্ত্রের দ্বিতীয় শাসন, তৃতীয় দল সুযোগ বুঝে প্রথম বা দ্বিতীয় দলে শরিক।

দুই.
এ অবস্থায় সাহিত্যকর্ম নির্দিষ্ট আদর্শের প্রভাবে সবল, সুস্থ পথের নিশানা চিহ্নিত করতে পারে না। মূর্ত-বিমূর্ত, ভাববাদী-বস্তুবাদী বা নিছক ব্যক্তিত্ববাদী ধারায় বিভাজিত সাহিত্য ও সাহিত্যকর্মীর চেতনা। সেখানে আবারও বিচ্ছিন্নতারই প্রাধান্য, নিজ নিজ ছকে বা বৃত্তে। সৃষ্টি হয় কবিতার ভিন্ন এক স্বাতন্ত্র্যবাদী ধারা। তবে কথাসাহিত্য, মুক্তচিন্তা, সমাজচিন্তার পথ ধরেই চলতে থাকে। এ ধারায় উল্লেখ্য, কথাসাহিত্যিক সেলিনা হোসেন। অগ্রজদের মধ্যে সৈয়দ শামসুল হক এবং পরবর্তী কয়েক দশকের কয়েকজন তরুণ কথাসাহিত্যিক।
কবিতায় ওই বিছিন্ন ধারায় সাজ্জাদ আরেফিনের কিছু অসাধারণ স্তবক বা ছোট কবিতা বা প্রয়াত অরুণ সেনের কিছু প্রতীকসমৃদ্ধ পঙ্ক্তি বা মাহবুব সাদিকের কিছু উজ্জ্বল স্তবক বা অরুণ পিয়াস মজিদের ভিন্নধর্মী কবিতা মনে রাখার মতো। আদর্শগত ধারাটি যে একেবারে মরে যায়নি তার প্রমাণ রাখে মুনীর সিরাজের কবিতা। পাশাপাশি স্মরণযোগ্য বিমল গুহ বা গোলাম কিবরিয়া পিনুর উল্লেখযোগ্য কবিতা।
কিন্তু এরা মূল স্রোত সৃষ্টি করে না। না করলেই বা ক্ষতি কি? তবু সমস্যা থাকে। কারণ এদের সৃষ্টি সমাজ-রাজনীতির শুদ্ধিকরণে সহায়ক নয়। অবশ্য উল্লিখিত ব্যতিক্রমীদের

কথা বাদ দিয়ে আমার এ বক্তব্য। বরং আমি যাদের স্মরণ করি অকাল প্রয়াত মেধাবী কবি আবুল হাসানকে তার দ্বিমাত্রিক গুণসম্পন্ন কবিতার অনুপস্থিতির জন্য। কেউ স্মরণ করতে পারেন শহীদ কবি মেহেরুন্নিসাকে।
কারো হয়তো কারো দুঃখ খন্দকার আশরাফ হোসেনের অনুপস্থিতিতে। কারো মতে কাব্য চারিত্রে যার অগ্রজ ব্যতিক্রমী চরিত্রের কবি প্রয়াত শহীদ কাদরী। কয়েক দশক থেকে হতাশাগ্রস্ত পরিবেশের ধারাবাহিকতায় কবিতায় লোকায়তিক ধারার একটি প্রবণনতা লক্ষ্য করার মতো। এ ক্ষত্রে তরুণদের আনাগোনা অধিক। এদের অগ্রজ-নিশান বরদার আসাদ চৌধুরীর কলম এখনো স্তব্ধ হয়ে যায়নি।
তবে সাহিত্য সৃষ্টিতে যেটা অনভিপ্রেত (বিচ্ছিন্নতা সত্ত্বেও) তা হলো রাজপ্রাসাদের তকমার প্রতি আকাক্সক্ষা। ব্যক্তিগত প্রাপ্তি সেখানে নান্দনিক সমাপনের চেয়ে বড় হয়ে দাঁড়ায়। স্তোকবাক্যের ক্ষেত্রে রচনা কবিতার নামধেয় হয়ে ওঠে। শৈল্পিক দর্শনের স্থান দখল করে রাজনীতির সুবিধাবাদ।
একদা ইংরেজি সাহিত্যের সৃষ্টিশীল যুুগেও রূপকবির তকমার মোহ একাধিক শক্তিমান কবিকে আকৃষ্ট করেছে যে কারণে এর বিরুদ্ধে অন্যদের ক্ষোভ প্রকাশ পেয়েছে। জানি না বাংলাদেশের কবিতা ওই ইতিহাস সম্পর্কে অবহিত কিনা, না হলেও কারো কারো আচরণ তেমনই। সার্থক কবিতা রচনার ক্ষেত্রে প্রাপ্তিপ্রবণতা যে বাধা সৃষ্টি করে এ নগ্ন সত্য অস্বীকারের উপায় নেই। কিন্তু আমাদের কোনো কোনো কবি ব্যক্তিস্বার্থের টানে এই অপ্রিয় সত্য মনে রাখার প্রয়োজনবোধ করেননি। এদিক থেকে বিষয়টি দুঃখজনক বাংলাদেশি কবিতার জন্য।
কথাগুলো শুধু কোনো কোনো কবির জন্যই নয়, সত্য একাধিক সাহিত্যকর্মী, সংস্কৃতিকর্মীর জন্যও। দলীয় বাদান্যতা তাদের ভিন্নপথ ধরতে সাহায্য করেছে এবং করছে। এ ধারার সূচনা আশির দশকে স্বৈরশাসন আমল থেকে। সেটা তখন সমালোচিত ছিল। অনুগত কবি-সাহিত্যিকের সংখ্যাও ছিল কম। এখন সেই সংখ্যা অনেক বেড়েছে। আর সেক্ষেত্রে সমালোচনা নেই বললে চলে। প্রসঙ্গত, এ কথা সত্য যে সাহিত্যের প্রধান স্রোত এখন যেমন অনুগত রচনার পক্ষে, তেমনি উৎকৃষ্ট, স্বাতন্ত্র্যবাদী বিচ্ছিন্ন সৃষ্টির পক্ষেও।

\চার\
সাহিত্যের অন্যান্য শাখায় যতটা, কবিতায় তার চেয়ে অধিক প্রবণতার প্রকাশ বিভাজিত ত্রিধারায়। যেমন ‘অনুগত’ ধারার কাব্য ও গদ্য রচনার প্রবলতা, পাশাপাশি বিচ্ছিন্ন শৈল্পিক ধারার স্বাতন্ত্র্যবাদী কবিতা সৃষ্টির ধারা। অন্যদিকে সংখ্যায় অল্প হলেও আদর্শবাদী বিরল কণ্ঠস্বর : ‘আমরা পাথর সরাতে চাই’ কিংবা ‘কারাগারের কবিতা লিখতে চাই’। বিপরীত কণ্ঠের উচ্চারণ : ‘আমরা প্রথাবিরোধী নতুন ধারার নান্দনিকতা প্রধান কবিতা লিখতে চাই’। তৃতীয় আকাক্সক্ষার কথা না বললেও চলে। তারা অনুগত ধারায় প্রশান্তিবাচক কবিতা বা গদ্যসাহিত্য রচনায় আগ্রহী। বাংলাদেশের স্বাধীনতা-উত্তর সাহিত্য আপাতত এই ত্রিধারার আশ্রয় নিয়েছে। এতে কেউ চতুর্মাত্রিকতাও আবিষ্কার করতে পারেন।
বলা বাহুল্য এটা সমাজ ও রাজনীতির বিরাজমান পরিস্থিতির দান। প্রতিবাদী চেতনার ঐতিহ্য আপাতত সাহিত্যভুবন থেকে প্রায় নির্বাসিত। নিঃসন্দেহে এটা স্বেচ্ছানির্বাসন। এ প্রবণতা তরুণ থেকে মধ্য বয়সী পর্যন্ত বিরাজমান, অবশ্য বিভাজনের বৈচিত্র্যে ও বিচ্ছিন্নতায়। নতুন কোনো রাজনৈতিক ঘটনার পরিস্থিতি তাদের পথ বদলে সহায়ক নয়, উদ্বুদ্ধ করার বিষয়টি দূর অস্ত।
স্বাধীনতা-উত্তর বাংলাদেশের সাহিত্য ভুবনে কয়েক দশকের সময়পর্ব পেরিয়ে সা¤প্রতিককালে পৌঁছে সাহিত্য সৃষ্টির ক্ষেত্রে উল্লিখিত একাধিক ধারার প্রভাব ও উপস্থিতি এখনো যথেষ্ট মাত্রায়। চল্লিশের বা পঞ্চাশের কিংবা ষাটের দশকের সৃষ্টিশীলতা দূরাগত ধ্বনির চরিত্রে সমর্পিত। আমার বিশ্বাস, এ অবস্থার পরিবর্তন ঘটতে পারে সমাজ ও রাজনীতির সুস্থ পরিবর্তনের প্রভাবে। যে পরিবর্তন কবে আসবে তা কেউ জানে না।
অতি সংক্ষিপ্ত এ আলোচনার সূত্র ধরে তেমনি সংক্ষিপ্ত ভাষ্যে যা বলার অপেক্ষা, সাহিত্যের অন্য ধারা তাহলো নাটক ও গদ্য রচনার চিত্র চরিত্র। নাটক বিরাজমান পরিস্থিতিতে নিঃসন্দেহে অগ্রচারীর ভূমিকায়। দেশি বা বিদেশি আদর্শিক ধারায় নাটক সৃষ্টি ও তার মঞ্চায়ন বাস্তবিকই ইতিবাচক গুণগান বহন করছে। বলা বাহুল্য তাতে সমাজ-প্রগতির প্রকাশই প্রধান। বিশদ আলোচনায় তার প্রকৃষ্ট উদাহরণ মিলবে।
আর প্রবন্ধ সাহিত্যের তাৎক্ষণিক দিকটি প্রধানত ইতিবাচক। সেখানে কবিতার ব্যক্তি স্বাতন্ত্র্যবাদের প্রভাব নেই বললে চলে। ‘অনুগত’ রচনার তুলনায় বাস্তবতা চিত্রণের প্রাধান্য তর্কাতীত। সেখানে আবার প্রতিবাদী, যুক্তিনিষ্ঠ আলোচনাই প্রধান ধারা হয়ে দাঁড়িয়েছে।
সামাজিক সন্ত্রাস, গুম, খুন, অপহরণ, সমাজের সর্বস্তরে ব্যাপক দুর্নীতি, সর্বোপরি মানবিক ও গণতান্ত্রিক মূল্যবোধের অবক্ষয় যে শক্তিমান কালো অধ্যায় তৈরি করে চলেছে এর বিরুদ্ধে সুস্থ সামাজিক শক্তির বলিষ্ঠ ও সচেতন আত্মপ্রকাশ নেই। নেপথ্যে সম্ভবত ভয় ও আতঙ্ক। অনৈতিকতা ও অবৈধ তৎপরতার জয় সমাজের সর্বস্তরে। বিচার বিভাগ অসহায়, অংশত হলেও রাজনৈতিক প্রশাসনের শক্তির মুখে। উদাহরণ সাবেক প্রধান বিচারপতির লাঞ্ছনাজড়িত প্রস্থান।
এ অবস্থায় নিবন্ধে-প্রবন্ধে প্রতিবাদের উচ্চারণ ও লিখিত বয়ান বিরল সংখ্যকের। কিছু সংখ্যক দৈনিক পত্রিকা এ বিষয়ে ইতিবাচক ভূমিকা পালন করে চলেছে। প্রশ্ন উঠছে ‘এ কোন বাংলাদেশি সমাজ’? আর খ্যাত-অখ্যাত সাহিত্য পত্রিকা এবং মাসিক বা ত্রৈমাসিক লিটল ম্যাগাজিন সাহিত্য সৃষ্টি ও পর্যালোচনায় বিশেষ ভূমিকা রেখে চলেছে।
প্রথমোক্ত ধারায় ‘নতুন দিগন্ত’, ‘কালি ও কলম’, ‘শব্দ ঘর’, ‘সমধারা’ ইত্যাদি পুষ্টকলেবর সাহিত্য পত্রিকার পৃষ্ঠায় প্রকাশ পাচ্ছে মানসম্মত রচনা। এছাড়া বহুসংখ্যক লিটল ম্যাগ, যেমন ‘পাতাদের সংসার’-এর মতো প্রকাশনা সৃষ্টিকর্মের নানামাত্রিক প্রকাশ ঘটিয়ে চলছে। রয়েছে অনুগত ধারার বাইরে দু-চারটে বাস্তবধারার সাপ্তাহিক, যেমন শীর্ষ কাগজ। ইংরেজি ভাষার পত্রিকাগুলোতেও সা¤প্রতিক সমাজভাষ্য, সাপ্তাহিক সাহিত্য ভাষ্য নানামাত্রায় গুরুত্ব বহন করছে। যেমন ‘দ্য ডেইলি স্টার’, ‘দ্য এশিয়ান এজ’, ‘ঢাকা ট্রিবিউন’ এবং বিশেষ গুরুত্বে উল্লেখযোগ্য ‘আর্টস অ্যান্ড লেটার্স’। শোষাক্তটি ইতিবাচকতায় ব্যতিক্রমধর্মী এবং উপভোগ্য।
স্বাধীনতা-উত্তর বাংলাদেশের সাহিত্য প্রকাশ উল্লিখিত ভাষ্যে এসে দাঁড়িয়েছে- কারো কারো বিবেচনায় ইতি ও নেতির চরিত্র সামঞ্জস্য। সাহিত্য সৃষ্টির সামাজিক ও নান্দনিক দায়বদ্ধতার প্রকাশ এতে করে কতটা প্রগতি বা অগ্রগতির পক্ষে সে বিচার যতটা আলোচক-সমালোচকের, সম্ভবত তারচেয়ে বেশি বোদ্ধা পাঠকের। এক্ষেত্রে সাহিত্যকর্মীদের সচেতনতা অবশ্যই আকাক্সিক্ষত।
আহমদ রফিক

মন্তব্য করুন

খবরের বিষয়বস্তুর সঙ্গে মিল আছে এবং আপত্তিজনক নয়- এমন মন্তব্যই প্রদর্শিত হবে। মন্তব্যগুলো পাঠকের নিজস্ব মতামত, ভোরের কাগজ লাইভ এর দায়ভার নেবে না।

জনপ্রিয়