এমসিসিএইচএসএলে দুর্নীতির অভিযোগ

আগের সংবাদ

শ্রমবাজারে দুষ্ট চক্রের থাবা

পরের সংবাদ

বিকল্প ভাবনায় লিটল ম্যাগাজিন

প্রকাশিত: মার্চ ২৯, ২০২৪ , ১২:০০ পূর্বাহ্ণ
আপডেট: মার্চ ২৯, ২০২৪ , ১২:০০ পূর্বাহ্ণ

লিটল ম্যাগাজিন বলতে আমরা যা বুঝি তা হচ্ছে- প্রচলিত প্রকাশনার বিকল্প এবং অবদমনহীন তারুণ্যের রাগী ও প্রতিবাদী উচ্চারণ, বরং বলা চলে, এটা একটা লড়াইয়ের হাতিয়ার। কার বিরুদ্ধে লড়াই? শোষণ-বঞ্চনার বিরুদ্ধে অধিকার আদায়ের লক্ষ্যে কিংবা আত্মমর্যাদা ও বাকস্বাধীনতা প্রতিষ্ঠার জন্য লড়াই। আরেকটি লক্ষ্য প্রায়ই অনুল্লেখ্য থেকে যায়, তা হলো নতুন চিন্তা চেতনা দর্শন বিজ্ঞানভাবনা এমনকি কাব্য বা সাহিত্যের বাঁক বদলের আন্দোলনেও প্রধান অবলম্বন হয়ে ওঠে লিটল ম্যাগাজিন।
লিটল ম্যাগাজিনের লেখক বলে একধরনের শ্লাঘাবোধ নিয়ে কাটিয়ে দিয়েছি সারাটা জীবন। ভেতরে ভেতরে অনুভব করেছি এক আত্মসৃষ্ট মানসিক শক্তি, যা আমাকে এবং আমার মতো অনেককে এই বোধ জাগিয়ে দিয়েছে যে, লিটল ম্যাগাজিনে প্রকাশিত লেখা টিকে যাবে ভাবীকালের পাঠকের জন্য। এক বিচিত্র আত্মতৃপ্তিবোধ আমাদের ভেতর এমন এক ধারণা তৈরি করে যে, যারা তথাকথিত খ্যাতিমান, দৈনিক পত্রিকার সাহিত্যপাতার লেখক, তাদের লেখা দিনান্তে চলে যাবে ঝালমুড়িওয়ালার কাছে। এই একটা টিকে থাকার লক্ষ্য নিয়ে অনেক তরুণ তাদের জীবন যৌবন পার করে দিয়েছেন লিটল ম্যাগাজিনের পেছনে। কিন্তু লিটল ম্যাগাজিনের সাথে টিকে থাকার কোনো সম্পর্ক নেই বা ছিল না।
মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে লিটল ম্যাগাজিনের যাত্রার সূচনা ঘটে সেখানকার বিপ্লবের প্যাম্ফলেট হিসেবে। তবে বিংশ শতকের শুরুতে এরা নিজেদের আসল চেহারায় আবির্ভূত হতে পেরেছে বলা যায়। ১৮৪০ সালে বোষ্টন শহরে প্রথম প্রকাশিত হয় লিটল ম্যাগাজিন। ১৮৪০-১৮৪৪ সাল পর্যন্ত এই কাগজ প্রকাশিত হয়েছিল। এই লিটল ম্যাগাজিনের সম্পাদক ছিলেন রালফ ওয়াল্ডো এমারসন এবং মার্গারেট ফুলার। পরবর্তীতে ১৮৯৬ সালে আর্থার সিমন্সের সম্পাদনায় লন্ডন থেকে প্রকাশিত হয় ‘দ্য স্যাভয়’। ভিক্টোরিয় পুঁজিবাদী ব্যবস্থার বিরুদ্ধে প্রতিবাদী লেখকদের প্রধান বাহন ছিল এটি। রাজনৈতিক দৃষ্টিভঙ্গির দিক থেকে এই কাগজের লেখকরা ছিলেন উদারপন্থী ও সাম্যবাদী।
আমরা লিটল ম্যাগাজিনের বেশ কিছু সুনির্দিষ্ট বিষয় লক্ষ করতে পারি, যা থেকে লিটল ম্যাগাজিনের স্বরূপ চিহ্নিত করা যায়। প্রচলিত ব্যবস্থার বিরুদ্ধে প্রতিবাদ, প্রচলিত রীতিনীতির পরিপন্থা, প্রতিষ্ঠান বিরোধিতা এবং সীমিত প্রচারসংখ্যা এই লক্ষণগুলোর মধ্যে উল্লেখযোগ্য। একটি নির্দিষ্ট মহৎ উদ্দেশ্য সামনে রেখে কোনো ব্যক্তি বা সমমনা লেখকদের গোষ্ঠী বা দল একটি নির্দিষ্ট চিন্তার প্রতিফলনের জন্য নিজ উদ্যোগ ও চেষ্টায় পত্রিকা প্রকাশ করে। নিজেদের কথা বলাই মূলত লিটল ম্যাগাজিনের কর্মব্যাপ্তি বলা চলে।
বিশ শতকের গোঁড়ার দিকে সাহিত্যের সবচেয়ে নামি লিটল ম্যাগাজিন ‘পোয়েট্রি’ প্রকাশিত হলে পাঠক ও লেখকমহলে দারুণ সাড়া পড়ে যায়। পোয়েট্রিকে ‘এ ম্যাগাজিন অব্ ভার্স’ বা ‘কবিতার পত্রিকা’ নামেও ডাকা হতো। হেরিয়েট মনরো ও এজরা পাউন্ডের সম্পাদনায় ১৯১২ সালে পোয়েট্রি যাত্রা শুরু করে। পোয়েট্রিতে কোনো কবির কবিতা ছাপা হলে তাকে আর কখনো পেছনে ফিরে তাকাতে হতো না; এমন ধরনের জনপ্রিয়তা ছিল এই কাগজের। ফরাসি সিম্বলিস্ট কবি ও সমালোচকগণও ১৮৮০ থেকে ১৯০০ সাল পর্যন্ত এ ধরনের ছোট কাগজের মধ্য দিয়ে আন্দোলন পরিচালনা করেছিলেন। ১৯২০-এর দশকে জার্মান সাহিত্যেও ছোটকাগজের অবদান লক্ষ করা যায়।
বিশের দশকের শুরুর দিকে তার বিভিন্ন স্মৃতিচারণে হেমিংওয়ে গভীর সন্তুষ্টির সাথে স্মরণ করেন যে তার গল্পগুলো যখন প্রতিষ্ঠিত কাগজগুলো ছাপতে অস্বীকার করে, তখন তিনি প্যারিসে ফিরে গিয়ে লিটল ম্যাগাজিনে গল্প ছাপাতে শুরু করেন, যা শীঘ্রই তাকে সাফল্যের দুয়ারে নিয়ে আসে। এক অচেনা লেখকের জন্য আভাঁ গার্দ ছিল সত্যিই সৌভাগ্যের ব্যাপার। হেমিংওয়ে যখন প্যারিসে ফিরে আসেন, এজরা পাউন্ড তাকে ফোর্ড ম্যাডক্সের সাথে পরিচয় করিয়ে দেন, যিনি তাকে ট্রান্সআটলান্টিকের সহকারী সম্পাদক হিসেবে কাজ করতে দেন। সে সময় প্যারিস ছিল অলাভজনক প্রকাশনা শিল্পের কেন্দ্রবিন্দু।
লিটল ম্যাগাজিন ছাড়াও রবার্ট ম্যাকঅ্যালমনের কন্টাক্ট পাবলিশিং কোম্পানি এবং উইলিয়াম বার্ডসের থ্রি মাউন্টেন প্রেস প্রতিষ্ঠিত হয় ১৯২২ সালে। হেমিংওয়ের প্রথম দুটি বই এই প্রকাশনীগুলো প্রকাশ করেছিল। তা না হলে এ বইগুলো সেকালে অত সহসা মুদ্রিত বা প্রকাশিত হতো না।
জয়েসের উদাহরণও এখানে উল্লেখ্য। জয়েস, হেমিংওয়ের প্রজন্মের বেশির ভাগ আমেরিকানদের কাছে সর্বশ্রেষ্ঠ জীবিত লেখক। জয়েসকে লেখা ছাপানোর জন্য সারাজীবন সংগ্রাম করতে হয়েছিল। তবে জয়েসের সৌভাগ্য ছিল একের পর এক নিবেদিতপ্রাণ মহিলাদের উদ্যোগ; যারা কেবলমাত্র যথেষ্ট অনুভূতিশীলই ছিলেন না, দৃঢ়প্রতিজ্ঞও ছিলেন যে জয়েস নির্বিঘেœ প্রকাশিত হবে। তাদের মধ্যে মার্গারেট অ্যান্ডারসন দ্য লিটল রিভিউতে ইউলিসিস সিরিয়াল চালিয়েছিলেন এবং ফলস্বরূপ তিন বছর ধরে সেন্সরদের সাথে তাকে লড়াই করতে হয়েছিল এবং সিলভিয়া বিচ বইটিকে দুনিয়ার সামনে উত্থাপন করার একমাত্র উদ্দেশ্যে প্রকাশক হয়েছিলেন। এভাবে ইউলিসিস প্যারিসে শেক্সপিয়র অ্যান্ড কোম্পানির অধীনে বই আকারে আবির্ভূত হয়েছিল, যে কোনো ইংরেজিভাষী দেশে এটি আইনসম্মতভাবে প্রকাশিত হওয়ার এক যুগ আগে।
সে হিসেবে ব্রিটিশ ভারতে বাংলার তরুণ লেখকরা কিন্তু তেমন পিছিয়ে ছিলেন না। ১৯২১ খ্রিস্টাব্দে গোকুলচন্দ্র নাগ, দীনেশরঞ্জন দাশ, সুনীতা দেবী এবং মনীন্দ্রলাল বসুসহ আরো কয়েকজন মিলে সাহিত্য, ললিত কলা, সংগীত ও নাটক সৃষ্টি ও চর্চার জন্য আড্ডার সূচনা করেন। প্রথমে ‘ঝড়ের দোলা’ নামে চারজনের একটি ছোটগল্পের সংকলন প্রকাশিত হয় ১৯২২ সালে। তারপর দীনেশরঞ্জন এবং গোকুলচন্দ্র মিলে ১৯২৩ সালে বের করেন ‘কল্লোল’ পত্রিকা। কল্লোল পত্রিকার প্রথম সম্পাদক ছিলেন দীনেশরঞ্জন দাশ।
কল্লোল সাহিত্যগোষ্ঠীই সম্ভবত বাংলা সাহিত্যের প্রথম আধুনিক নবজাগরণের সূচনা ঘটায়, যদিও রবিঠাকুরের নিছক মানবপ্রেমী সাহিত্যের বৃত্ত থেকে দূরে সরে গিয়ে আধুনিক সাহিত্যের এই ঝড়কে সাধারণ পাঠকরা খুব সহজে মেনে নেয়নি। সেই সময়ের আরেক বিখ্যাত সাময়িকপত্র ‘শনিবারের চিঠি’র সাথে ‘কল্লোল’ গোষ্ঠীর বেশ কিছু বছর ধরে বিখ্যাত সাহিত্যের লড়াই চলেছিল। স্বয়ং রবীন্দ্রনাথ এই বিতর্কে অংশগ্রহণ করেছিলেন এবং কল্লোলে বেশ কিছু রচনা লিখেছিলেন; যেখানে তিনি বলেছিলেন যে তিনি নব্য সাহিত্যের এই উদ্যোগের প্রশংসা করলেও বাস্তবমুখী সাহিত্যকে মানুষের আদিম ইচ্ছার বশবর্তী করে আনার সারশূন্যতাকেও অস্বীকার করেননি। এখানে উল্লেখ্য যে তিনি তার ‘শেষের কবিতা’র অমিত রায়ের বক্তব্যের মাধ্যমে নিজেকে অর্থাৎ মানবিক সাহিত্যস্রষ্টা রবীন্দ্রনাথের লেখার সমালোচনা করেছিলেন। অন্যদিকে কল্লোল গোষ্ঠীর লেখকরা ফ্রয়েড ও মার্কসের প্রভাবে প্রভাবিত ছিলেন বলে ধারণা করা হয়। কল্লোলের সাহিত্য আলোচনা যে সেকালের বহু বিখ্যাত প্রগতিশীল সাহিত্যিককে প্রভাবিত করেছিল- এ বিষয়ে কোনো সন্দেহ নেই। তারাশঙ্কর বন্দ্যোপাধ্যায়ও অনিয়মিতভাবে কল্লোলের আলোচনায় মাঝেমধ্যে যোগ দিয়েছিলেন। এই কল্লোল পত্রিকায় লেখার সময় কাজী নজরুল ইসলামের বয়স হয়েছিল পঁচিশ বছর, প্রেমেন্দ্র মিত্রের বয়স ছিল কুড়ির নিচে আর বুদ্ধদেব বসুর বয়স ছিল মাত্র পনের। কল্লোল পত্রিকার প্রভাব এবং আবহে অনুপ্রাণিত হয়ে বেশ দ্রুত জন্ম নেয় প্রগতি, উত্তরা, কালিকলম, পূর্বাশা ইত্যাদি পত্রিকাগুলো। বাংলা সাহিত্যের কল্লোল যুগে নতুন সাহিত্য সৃষ্টির উদ্দেশ্যে কালিকলম প্রকাশিত হয়, তবে বেশি দিন স্থায়ী হয়নি। ১৩৩৩ বঙ্গাব্দের বৈশাখ মাসে আত্মপ্রকাশ করে ১৩৩৬ বঙ্গাব্দের মাঘ মাসের সংখ্যার পর বন্ধ হয়ে যায়। কল্লোল পত্রিকার সঙ্গেই উচ্চারিত হয় কালিকলম-এর নাম। যৌবনের উদ্ধর্ত উদ্দামতায় বাঁধা বন্ধনের বিরুদ্ধে বিদ্রোহ এবং স্থবির পচে যাওয়া সমাজকে আলোড়িত করার জন্য প্রকাশিত কল্লোল পত্রিকার সঙ্গে ‘কালিকলম’-এর আদর্শেরও একটি গভীর ঐক্য ছিল। পত্রিকা দুটির লেখকরা ছিলেন সব তরুণ এবং নতুন লেখক।
যদিও পূর্ববঙ্গ ও পশ্চিমবঙ্গ মূলত একই সংস্কৃতির ধারক ও বাহক, তবু মেধা ও মননের বিকাশ বিচারে পূর্ব বাংলা বিশেষ গুরুত্ব রাখে। তখন ঢাকার বাবুবাজার থেকে কৃষ্ণচন্দ্র মজুমদারের সম্পাদনায় ‘বাঙ্গালা যন্ত্র’ প্রকাশিত হতো। তাছাড়া ঝালকাঠির ঈশ্বর চন্দ কর সম্পাদিত ‘বরিশাল বার্তাবহ’, আবুল হোসেন সম্পাদিত ‘শিখা’, বগুড়া থেকে এম মেছের আলী সম্পাদিত দ্বিমাসিক ‘তরুণ’, চট্টগ্রাম থেকে আব্দুল করিম সাহিত্য বিশারদ ও আবদুর রশিদ সিদ্দিকীর সম্পাদনায় মাসিক ‘সাধনা’, কুষ্টিয়ার লাহিনীপাড়া থেকে মীর মশাররফ হোসেনের প্রকাশনায়ও সম্পাদনায় পাক্ষিক ‘হিতকরী’ ও কুমারখালী গ্রাম থেকে ‘গ্রাম বার্তা প্রকাশিকা’,

যশোরের পালুয়া-মাগুড়া গ্রাম থেকে বসন্ত কুমার ঘোষ ও তার ভাই শিশির কুমার ঘোষ প্রকাশিত পাক্ষিক পত্রিকা ‘অমৃত প্রবাহিনী’, মানিকগঞ্জের বালিয়াটির জমিদার গিরিশচন্দ্র রায় চৌধুরীর ‘বিজ্ঞাপনী যন্ত্র’, রাজশাহীর বোয়ালিয়া ধর্মসভা থেকে প্রকাশিত ‘হিন্দুরঞ্জিকা’, বিক্রমপুরের লোনসিংহগ্রাম থেকে নারীবিষয়ক পাক্ষিক পত্রিকা ‘অবলা বান্ধব’, ঢাকার ব্রাহ্মসমাজের সংগঠন সঙ্গত সভার মুখপাত্র হিসেবে প্রকাশিত হয় পাক্ষিক ‘বঙ্গ-বন্ধু’ যার সম্পাদক ছিলেন বঙ্গচন্দ্র রায়। এসব পত্রিকার মধ্যে দুয়েকটি বাদে বাকি সব পত্রিকাই পূর্ব বঙ্গের বিভিন্ন জেলা, মহকুমা বা প্রত্যন্ত গ্রামাঞ্চল থেকে ছাপা হতো। এটা থেকে এই বিষয় সুস্পষ্ট যে এসব পত্রিকাই পরবর্তীতে আমাদের ছোট কাগজে মনোনিবেশে বিশেষ ইন্ধন জুগিয়েছে। পুঁজিবাদী সভ্যতার নির্মম নিষ্ঠুরতার বিপরীত মেরুতে দাঁড়িয়ে লিটল ম্যাগাজিন বা ছোট কাগজগুলো নিত্যযুদ্ধ চালিয়ে পিঠ সোজা রেখে, নৈতিকতা বিসর্জন না দিয়ে টিকে থাকার প্রাণান্তকর লড়াই সকল যুগেই বিদ্যমান থেকেছে। লিটল ম্যাগাজিনকে এই লড়াইয়ের মধ্যেই নতুন সৃষ্টি, নতুনতর লেখক তৈরিতে ভূমিকা রাখতে হয়। লিটল ম্যাগাজিনগুলো প্রায়শ ক্ষণস্থায়ী হলেও ভয়হীন সাহসে বিদ্রোহে অঙ্গীকারাবদ্ধ থাকে। এই চেতনাবীজ সুদূরপ্রসারী বটে। তাই ভারত থেকে ব্রিটিশরা বিদায় নিলে নতুন ধর্মভিত্তিক রাষ্ট্রে আমাদের জাতিসত্তার পরিচয় এবং বাংলা ভাষার আন্তর শক্তির বীজের উৎসের সন্ধান দিয়েছে লিটল ম্যাগ। ষাটের দশকে প্রকাশিত সপ্তক, কণ্ঠস্বর, স্বাক্ষর, সা¤প্রতিক, প্রতিধ্বনি, বক্তব্য, যুগপৎ, স্যাড, সমকাল এসব কাগজ আমাদের জাত্যাভিমান তৈরিতে অনেক গভীর ও বিস্তৃত ভূমিকা রেখেছে।
মুক্তিযুদ্ধভিত্তিক কয়েকটি ছোট কাগজ যারা মূলত কাজ করত মুক্তিযুদ্ধ ও এর পরবর্তী সময়কার কর্মসূচি ও পুনর্গঠনের বিষয়বস্তু নিয়ে তার মধ্যে অনিক ইসলাম সম্পাদিত প্রজন্ম, প্রবীর সিকদার সম্পাদিত মুক্তিযুদ্ধবিষয়ক ত্রৈমাসিক উত্তরাধিকার ’৭১সহ আরো বেশ কিছু ছোট কাগজ বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য। উত্তরাধিকার ’৭১ এ প্রথম সংখ্যায় বাংলাদেশের বিভিন্ন অঞ্চলের যুদ্ধের ভয়াবহতা ও তীব্রতা ভয়ংকরভাবে ফুটে উঠেছে। এই সংখ্যায় মুক্তিযোদ্ধা লিখেছেন তার নিজ অভিজ্ঞতা, কোনো বোন লিখেছেন তার ভাইকে হারানোর অনুভূতি, বীরাঙ্গনা বয়ানে তুলে ধরেছেন তাদের ওপর চলা অত্যাচার বিভীষিকার নির্মম স্মৃতি, ক্যাম্পে গণহত্যার বর্ণনা।
কিন্তু আমাদের ইতিহাসের বিষাদময় অধ্যায় ১৯৭৫-এর ১৫ আগস্ট কেড়ে নিল স্বাধীনতার স্বাদ। হাজারো বাধা-বিপত্তি উপেক্ষা করে প্রায় ধ্বংসস্তূপ থেকে উঠে দাঁড়াবার, ঘুরে দাঁড়াবার স্বপ্ন দেখছিল যখন সদ্য স্বাধীন দেশটি- তখনই এলো চরমতম আঘাত। সপরিবারে হত্যা করা হলো বাংলাদেশের রূপকার, স্বপ্নদ্রষ্টা শেখ মুজিবুর রহমানকে। এ আঘাত শুধু রাজনৈতিক পটপরিবর্তন করল এমন নয়- শিল্পসাহিত্য ও সংস্কৃতির ওপরও নেমে এলো ঘোর অমানিশা। এই অন্ধকার কাটিয়ে ওঠার প্রয়াস করতে বেশ অনেকটা সময় লাগলেও বাঙালি লেখক কবিরা তা শুরু করেন লিটল ম্যাগাজিনের মাধ্যমেই। বিশেষত আশির দশকে লিটল ম্যাগাজিনগুলো স্বৈরাচারী শাসনের বিপক্ষে তাদের চেতনাকে শানিত করে। এই সময়ে মিনার মনসুর সম্পাদিত এপিটাফ, রাশেদ মাহমুদ সম্পাদিত শামাসহ অনেক গুরুত্বপূর্ণ লিটল ম্যাগ প্রকাশিত হয়। পরবর্তীতে তপন বড়ুয়ার সম্পাদনায় গাণ্ডীব, খোন্দকার আশরাফ হোসেনের সম্পাদনায় একবিংশ, সরকার আশরাফ সম্পাদিত নিসর্গ এবং এজাজ ইউসুফী সম্পাদিত লিরিক স্বৈরাচার বিরোধিতার পাশাপাশি বাংলা কবিতা ও বাংলা সাহিত্যের ভাষা ও আঙ্গিক পরিবর্তন এবং বিভিন্ন আদর্শিক চেতনার বিকাশেও ভূমিকা রাখে। লেখক শিবিরের পত্রিকা তৃণমূল অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ কাজ করে সাম্যবাদী চেতনার প্রসার এবং মানবিক সংস্কৃতির বিকাশে। এরই ধারাবাহিকতায় নব্বই দশকেও প্রান্ত, নদী, পেঁচা, সমুজ্জ্বল সুবাতাসসহ সারাদেশ থেকে নানান চিন্তা ও বিশ্বাসের বৈচিত্র্যে অনেক অনেক উজ্জ্বল পত্রিকা প্রকাশ পায়, যা একসময় লেখক তৈরি এবং গণতান্ত্রিক চেতনার বিকাশে ভূমিকা রেখেছে। এখনো দেশের নানাপ্রান্তে তরুণরা নতুন কাগজ প্রকাশের মাধ্যমে নিজেদের সৃজনশীলতাকে পাঠকের সামনে নিয়ে আসছে।
তবে ইদানীং লক্ষ করলে দেখতে পাই লিটল ম্যাগাজিন ছাপা হয় বড় জোর দুই কী তিনশ কপি। কখনো কখনো পাঁচশ কপিও ছাপে, তবে তা মুষ্ঠিমেয় কয়েকটি পত্রিকা মাত্র। যে কাগজ মাত্র দুই-তিনশ লোকের গোচরে আসে তার একটা বড় অংশ ওই কাগজটির লেখক। এই লেখকদেরই কতজন এই ম্যাগাজিনের সবটুকু পাঠ করে তা-ও যথেষ্ট প্রশ্নের দাবি রাখে। প্রায় ১৬ কোটি, মতান্তরে ২০ কোটি; মানুষের এই জনপদে একটি কাগজ মাত্র ২০০-৫০০ কপি ছাপা হয়। পাঠক সংখ্যা আরো কম। তাই জনরুচি কিংবা জনমত তৈরিতে এই লিটল ম্যাগাজিন কতটুকু ভূমিকা রাখে তা নিয়ে সন্দেহের যথেষ্ট অবকাশ রয়েছে। এখন দেখা দরকার লিটল ম্যাগাজিন আদৌ কোনদিন বড় জনগোষ্ঠীকে পাঠক হিসেবে পেয়েছিল কিনা? তা মনে হয়, না। তবে কেন এই অহমিকা লিটল ম্যাগাজিনের লেখকের?
অহমিকার পেছনে লিটল ম্যাগাজিনের ইতিহাস ভীষণভাবে দায়ী। আমরা সকলেই জানি, লিটল ম্যাগাজিন কলেবরে লিটল হলেও, এর পাঠকসংখ্যা লিটল হলেও, এর ভেতরে রয়েছে বিপ্লবী চেতনার আগুন। লিটল ম্যাগাজিন সবসময় নতুন চিন্তা নতুন দর্শন এমনকি নতুন রাজনীতির সূচনা ঘটানোর প্রয়াস পেয়ে থাকে। সবসময় লিটল ম্যাগাজিন মানেই একটি বিপ্রতীপ ধারার চিন্তাচর্চার আধার। লিটল ম্যাগাজিনে সাধারণত লিখতে আসে রাগে ফুঁসতে থাকা তরুণ এবং প্রেমে টগবগ করা যুবক। তাদের সামনে প্রেম ও সাম্য ছাড়া আর কোনো লক্ষ্য থাকে না। তারা স্বার্থান্ধ হবার, কিংবা তখনও ধান্দায় লিপ্ত হবার প্রয়াস পায়নি। শৃঙ্খল ছাড়া হারানোর কিছুই থাকে না তাদের। তাই তরুণ নিঃস্বার্থ কবি-লেখকদের চিন্তার ভেতর মানব কল্যাণ এবং নিপীড়নবিরোধী চেতনার উন্মেষ ঘটে থাকে। শক্তি যদি লিটল ম্যাগাজিনের থেকে থাকে, তা এই দারিদ্র্যই বটে; যা লেখক-কবিদের অকপটে সত্য উচ্চারণ করার সাহস জোগায়। লিটল ম্যাগাজিনের সাথে সংশ্লিষ্ট থাকে অপ্রতিষ্ঠা এবং প্রতিষ্ঠাবিরোধ। কিন্তু সময় এমন এক উড়াল পক্ষী যে, কালক্রমে প্রতিষ্ঠাবিরোধীগণ দীর্ঘজীবন পার করতে করতে অর্জন করেন সুনাম বা খ্যাতি। তার সাথে যুক্ত হয় অর্থবিত্ত এবং সামাজিক মর্যাদা। তখন তাদের লেখায় ধীরে ধীরে ভুড়ির মেদের মতো জমতে থাকে আপস। আপসের ঘুণ এমন মারাত্মক হতে পারে যে, লেখক হয়ে পড়েন ছদ্মবিপ্লবী, প্রকৃতার্থে পাতিবুর্জোয়া। তাদের তখন জমে থাকা বিত্তের উত্তাপে বড় বড় (বৃহদাকার) কাগজ করার সক্ষমতা অর্জিত হয়, কাগজ প্রকাশও করে। কিন্তু সে কাগজ পরিসরে বৃহদাকৃতি হলেও দীপ্তিতে নিস্তেজ। সে কাগজ তখন আর আলোড়িত করতে পারে না নতুন প্রজন্মকে। এমনিতেই লিটল ম্যাগাজিন সংখ্যালঘু পাঠকের কাগজ; নতুন চিন্তার পক্ষে এবং প্রচলিত ব্যবস্থার বিপরীত অবস্থানে তার জায়গা নির্ধারণ করে, কিন্তু আপসকামী লেখকের হাতে তা ধীরে ধীরে নিষ্প্রাণ নিষ্প্রভ হয়ে বইদোকানে বা বাইন্ডারের ঘরে কাগজের অযথা স্তূপ হয়ে পড়ে থাকে। চেতনায় শানিত না হলে নতুন চিন্তাচর্চার স্ফুরণ না ঘটলে বিপ্রতীপ ধারার পাঠক কেন গ্রহণ করবে এসব কাগজ? এখন প্রশ্ন হচ্ছে আর্টিফিশিয়াল ইনটেলিজেন্সের যুগেও কি লিটল ম্যাগাজিন কেবলই প্রিন্ট ফর্ম নিয়ে বসে থাকবে? না, তা বোধহয় সম্ভব নয়। এখন সহজে অধিক পাঠকের কাছে পৌঁছাতে হলে অবশ্যই ওয়েবম্যাগে নিজেকে উন্নীত করতে হবে। ওয়েব লিটল ম্যাগ করতে হলে তেমন তেমন ওজস্বী লেখা, শানিত চেতনা এবং বৈপ্লবিক মনোবৃত্তি থাকা জরুরি। বর্তমান সময়ে পৃথিবী শাসন করছে পুঁজিবাদ এবং পুঁজিবাদকে মদদ দিচ্ছে ধর্মান্ধতা, মৌলবাদ এবং সা¤প্রদায়িকতা। সে আপনি ক্ষমতাসীন কিংবা ক্ষমতাহীন যে দলের দিকেই তাকান, দক্ষিণ এশিয়া থেকে মধ্যপ্রাচ্য এবং পূর্ব থেকে পশ্চিম- সর্বত্রই পুঁজিবাদ ও ধর্মান্ধ সা¤প্রদায়িকতার সম্মিলিত চেতনারই কেতন উড়ছে। তাই সাধারণ সাহিত্য পত্রিকা বা বাণিজ্যিক কাগজের সাহিত্য এই স্থিতাবস্থার ব্যাপারে ব্যাপক সন্তোষের সাথে সৃজন করছে আপস-রফার সাহিত্য। এইসব সাহিত্যে পাতিবুর্জোয়ার সাথে সাথে ছদ্মবিপ্লবীরও পদচারণা থাকে। কিন্তু ছিটকে পড়ে সত্যিকার নিরাপস চরিত্রের তরুণ অনভিজ্ঞ কিন্তু তেজোদ্দীপ্ত লেখকটি। এই লেখক তখন ফিরতে থাকে নানা সম্পাদকদের দুয়ারে দুয়ারে। কিন্তু তার কথাটি ছাপানোর যোগ্য কাগজ সে খুঁজে পায় না। কারণ, এসব বাণিজ্যিক কাগজে লেখা ছাপাতে হলে লেখাকে তাদের ছাঁচে ঢালাই করে লিখতে হবে। যারা চতুর লেখক তারা তথাকথিত স্বতঃস্ফূর্ততায় পত্রিকার নীতি বজায় রেখে ক্ষমতাকাঠামোর প্রতি চ্যালেঞ্জ না হয় এমনভাবে তার লেখাটি তৈরি করে নেন। নিয়মিত ছাপা ও প্রচার তখন তার জন্য ডাল-ভাত হয়ে পড়ে। কিন্তু ভেতরে ভেতরে গুমরে মরে তার শিকার লেখক সত্তা। আর যে যুবক প্রতিস্পর্ধী, সাহস যাকে এগিয়ে নিয়ে যায় সে যথাবাক্য উচ্চারণে স্থির থাকে। তখন তার জন্য সকল পত্রিকার গন্তব্যে একটি একটি করে তালা ঝুলতে থাকে। এই তরুণ-সাহসী-শানিত বিপরীত চিন্তার সংখ্যালঘু লেখকের চিন্তাচেতনা ও সাহিত্য প্রকাশের একমাত্র জায়গা কেবলই লিটল ম্যাগাজিন। আর এই লেখকই লিটল ম্যাগাজিনের শক্তি। মনে রাখা দরকার এই তারুণ্য বয়স দিয়ে নয়, চেতনা ও তেজ দিয়ে নির্ধারণ করতে হবে।
লিটল ম্যাগাজিনের আরেকটি বড় শক্তি বা বৈশিষ্ট্য বটে একধরনের গোষ্ঠীবদ্ধতা। যদিও সৃজনশীলতা একধরনের একা একা সৃষ্টির আনন্দে মেতে থাকার যজ্ঞ, তবুও কিছু বিষয় বা ধারণা বা স্বপ্নকে সামনে রেখে কবি লেখক শিল্পীরা ঐক্যবদ্ধ হয়ে কোনো ম্যানিফেস্টো নিয়ে বা ম্যানিফেস্টো ছাড়াই একটি নির্দিষ্ট লিটল ম্যাগাজিনের ব্যানারে এক ছাতার তলায় সংঘবদ্ধ হতে পারে। তবে ইতিহাস সাক্ষ্য দেয় যে, এই গোষ্ঠীবদ্ধতা চিরস্থায়ী তো দূরের কথা, দীর্ঘস্থায়ীও হয় না। এই গোষ্ঠীগুলোর মধ্যে যে বা যারা মেধাবী ও প্রতিভাবান থাকে, সে একসময় টের পায় মাঝারী মেধার সম্পাদকের কোচড়ের মধ্যে অবস্থান করতে করতে নিজ প্রজ্ঞা ও মেধার বিকাশ বাধাগ্রস্থ হচ্ছে। তখন সে গোষ্ঠীর গণ্ডি ছেড়ে একটি একাকী ঘুড়ির মতো উড়তে থাকে দিগন্তে। অধিকাংশই বোকাট্টা হয়ে হারিয়ে যায় বটে, তবে দুয়েকজন দীপ্তি ছড়িয়ে যেতেই থাকেন। সত্যিকার লিটল ম্যাগাজিন সম্পাদক এই লেখকদের বিকাশের পথ প্রশস্ত করা কর্তব্যের মধ্যে পড়ে। যারা তা করেন, কালের করাল গ্রাস থেকে নিজেকে এবং কাগজকে তারা হয়তো উদ্ধার করতে পারেন। যদিও অধিকাংশই কৃষ্ণবিবরে হারিয়ে যায়, তবু কোনো কোনো কাগজ কোনো কোনো লেখকের সৃষ্টি বিগব্যাং হয়ে নতুন গ্যালাক্সির সূচনা ঘটায়।
আমরা যারা লিটল ম্যাগাজিনের লেখক হিসেবে বেড়ে উঠেছিলাম, আমাদের কাছে এ কাগজ পরিসরে লিটল হলেও চিন্তার গভীরতা ও ব্যাপকতায় অনেক বিস্তৃত বা বড় বলে মনে করি। এই লিটল ম্যাগাজিনের শক্তি বিত্ত নয় চিত্তের উত্তাপ; তার সাথে সুনির্দিষ্ট লক্ষ্য উদ্দেশ্য বা ম্যানিফেস্টো নিয়ে গোষ্ঠী সমন্বয়ে একটি আন্দোলন পরিচালনা করাও লিটল ম্যাগাজিনের গুরুত্বপূর্ণ শক্তির নিয়ামক। আজ যদি লিটল ম্যাগাজিনগুলো প্রিন্ট ফর্ম থেকে নিজেদেরকে ডিজিটাল ফর্মে উন্নীত করে বিপ্লবাত্মক অনলাইন কাগজ করতে পারে, তবে অবশ্যই অনেক বেশি পাঠককে প্রভাবিত করতে পারবে। আপসহীন মানুষের সপক্ষে থাকা লেখকই মূলত লিটল ম্যাগাজিনের শক্তি। বেশি লোকের কাছে পৌঁছাতে পারুক বা না পারুক, অন্তত সত্য উচ্চারণে নিঃশঙ্ক এবং টলস্টয় কথিত সত্যভাবে বাঁচার জন্য লিটল ম্যাগাজিনই একমাত্র পথ।
জিললুর রহমান

মন্তব্য করুন

খবরের বিষয়বস্তুর সঙ্গে মিল আছে এবং আপত্তিজনক নয়- এমন মন্তব্যই প্রদর্শিত হবে। মন্তব্যগুলো পাঠকের নিজস্ব মতামত, ভোরের কাগজ লাইভ এর দায়ভার নেবে না।

জনপ্রিয়