এমসিসিএইচএসএলে দুর্নীতির অভিযোগ

আগের সংবাদ

শ্রমবাজারে দুষ্ট চক্রের থাবা

পরের সংবাদ

নৃ-তত্ত্ব, ভাষা জিজ্ঞাসা ও শিনোকান কবিতা

প্রকাশিত: মার্চ ২৯, ২০২৪ , ১২:০০ পূর্বাহ্ণ
আপডেট: মার্চ ২৯, ২০২৪ , ১২:০০ পূর্বাহ্ণ

(গত সংখ্যার পর)

শব্দ ও মৌখিক যোগাযোগের ছ’টি মৌলিক ব্যাপারের একটি ব্যাপার হলো ‘বার্তা’ এবং এই ‘বার্তা’ হলো তাই যার দিকে যোগাযোগের বাকি পাঁচটি ব্যাপার উন্মুখ। ‘বার্তা’ বলতে ইয়াকবসন বার্তার কেবলি প্রকাশগত দিক বোঝাতে চাননি, তিনি বলতে চেয়েছেন ‘উচ্চারিত শব্দগুলো ঠিক যা বলে ঠিক তাই হলো বার্তা’। অর্থাৎ ‘প্রকাশ’ ও ‘বিষয়ের’ সেমিওটিক সম্মিলনকে তিনি ‘বার্তা’ বলতে চাইছেন (আমাদের মনে পড়বে সোসুরে কথা যিনি ‘বৃক্ষ’ নামক ধ্বনিপ্রতীক গুচ্ছ এবং ‘বৃক্ষ’ নামক ধারণার সম্মিলনকে ভাষিক যোগাযোগের একক বা চিহ্ন হিসেবে নির্র্দেশ করেছেন, যাকে আমরা ‘শাব্দ’ নামে জানি)।
রোমান ইয়াকবসনের মতে ভাষিক যোগাযোগের কাব্যিক ক্রিয়ায় উচ্চারিত শব্দপুঞ্জ ও তাদের গ্রন্থন, তাদের অর্থ, তাদের বহিঃ ও অন্তঃস্থ রূপ তাদের নিজস্ব ওজন ও মূল্য অর্জন করে। এখানে একটি কথা বলা দরকার, কাব্যিক ক্রিয়ার কথা বলতে গিয়ে ইয়াকবসন কবিতার অর্থ-উদঘাটনের সূত্র দেখাতে চাইছেন না, ভাষাবিজ্ঞানী হিসেবে তিনি ভাষিক ব্যবস্থার ক্রিয়াকাণ্ডগুলোকে আমাদের বোধের আওতায় আনতে চান। এমন কোনো বৈজ্ঞানিক পথ তিনি বার করতে চাননি যা দিয়ে বিজ্ঞানসম্মতভাবে কবিতার মানে ধরে ফেলা যাবে। কবিতা কি বোঝায় তা নয়, বরং কীভাবে বোঝায় তা-ই। কীভাবে বোঝায় এবং কেনই বা পারে বোঝাতে যা বোঝাতে চায়, তার ওপর ভাষাতাত্ত্বিক আলোকপাত ইয়াকবসনের উদ্দেশ্য। ইয়াকবসন বলছেন, একটা ‘সমগ্র চিহ্ন’-এ একটা বিশেষ অভিব্যক্তি একটা বিশেষ বিষয়কে সাংকেতিত করে। ‘অভিব্যক্তি’ তাই ‘বিষয়ে’র কেবলি কোনো ‘বাহক’ নয়, সে বিষয় যতই আকর্ষণীয় হোক না কেন; আবার অন্যদিকে ‘অভিব্যক্তি’-ই একমাত্র ব্যাপার নয়। ইয়াকবসনের মতে, কোনো এক মানবীয় উচ্চারণের মুখোমুখি হয়ে ‘পাঠাক’ শুধুমাত্র ‘বিষয়’ কিংবা শুধুমাত্র তার ‘অভিব্যক্তি’-তে সীমাবদ্ধ থাকেনা, মগ্ন সেই পাঠক বরং বিষয় আর অভিব্যক্তির সম্পর্কে কৌতূহলী হয়ে ওঠে। মানবীয় উচ্চারণের এক অমোঘ ‘সমগ্র চিহ্নে’র মুখোমুখি হয়ে আমরা পাঠ করি :
কোথাও রয়েছে যেন অবিনশ্বর আলোড়ন :
কোনো এক অন্য পথে-কোন পথে নেই পরিচয়;
এ মাটির কোলে ছাড়া অন্য স্থানে নয়;
সেখানে মৃত্যুর আগে হয় না মরণ।
[জীবনানন্দ দাশ, ‘আলো পৃথিবী’]
‘আলো পৃথিবী’ কবিতার এই চারটি পঙ্ক্তি প্রতিষ্ঠা করে একটা ‘সমগ্র চিহ্ন’, যে চিহ্নের একটি মাত্রা এলো ‘বিষয়’, অন্য মাত্রা হলো তার ‘অভিব্যক্তি’- কোনো একটিতে তৃপ্ত না হয়ে এই উচ্চারণের কুহক ও ম্যাজিক আমাদের কাব্যিক ক্রিয়ার এক প্রগাঢ় সেমিওসিসে নিয়ে যায় : আমরা বুঝি ‘বিষয়’ শুধু নয়, অভিব্যক্তি নয়, অন্য কোনো এক বিস্ময় এর ভেতর খেলা করে। এই ‘বিস্ময়’কে ভাষাতাত্ত্বিকভাবে বুঝবার চেষ্টা করে ইয়াকবসন ‘কাব্যিক ক্রিয়া’-র প্রসঙ্গ উত্থাপন করেছেন, যার মূল কথা হলো ‘বিষয়’ ও ‘অভিব্যক্তি’-র স্বাতন্ত্র্য নয়, সম্পর্ক, কাব্যিক ক্রিয়ার সারাৎসার। কবিতার ব্যাখ্যা নয়, বরং কাব্যিক ক্রিয়া-সঞ্জাত এক সৃষ্টিমুখর সেমিওসিস ইয়াকবসনকে আলোড়িত করেছিল। যে পরাভাষার কথা বারবার টেনে আনেন ইয়াকবসন, জীবনানন্দের প্রায় সব কবিতা তার অমোঘ দৃষ্টান্ত : এ চারটি পঙ্ক্তিও তার ব্যতিক্রম নয়।
রোমান ইয়াকবসনের প্রবন্ধ সে সময়ের গ্রাজুয়েট ছাত্র ও পরবর্তীকালের বিখ্যাত নৃ-তাত্ত্বিক ভাষা বিজ্ঞানী ডেল হাইমসকে অনুপ্রাণিত করে। অনুপ্রেরণা মানে ভাষা-বিষয়ে ভাবনা ও ভাবুকতার সাহস। উত্তরকালে ডেল হাইমস যে ঊঃযহড়ঢ়ড়বঃরপং ও ঊঃযহড়মৎধঢ়যু ড়ভ চবৎভড়ৎসধহপব-এর তত্ত্ব প্রস্তাব করবেন তা খুব স্বাভাবিক। ‘ভাষার কাব্যিক ক্রিয়া কেবলি ‘কবিতা’য় সীমাবদ্ধ নয়, বরং মানবীয় উচ্চারণ ও যোগাযোগ উপস্থিত’- এটা ইয়াকবসনের কথা। সেজন্য ডেল হাইমস কাজ শুরু করেন নৃ-তাত্ত্বিক ভাষিক উপাদান ও উপকরণ নিয়ে। তাঁর বিষয় হয়ে দাঁড়াল নেটিভ আমেরিকানদের কবিতা। ‘কবিতা’ মানে কবিতার লিখিত ঐতিহ্য নয়, এর মৌখিক ঐতিহ্য। আদি-আমেরিকানদের (ইন্ডিয়ান) মিথ ও পুরাণকথাকে তিনি বিশ্লেষণের বিষয়বস্তু করেন।
ছাত্রজীবনেই ডেল হাইমস বিশিষ্ট ছিলেন, রোমান ইয়াকবসনের যে প্রবন্ধটির কথা উল্লেখ করেছি তাতেও নানাস্থানে ডেল হাইমসের উল্লেখ আছে। তবে হাইমসের নিজস্ব তত্ত্ব গড়ে ওঠে আরো পরে। হাইমস হার্ভাডে নিয়োগ পেলেও ওরকম ছকে-বাঁধা ‘আইভি লীগ বিশ্ববিদ্যালয়ে’ তিনি বেশিদিন অধ্যাপনা করেন নি। পেনসিলভেনিয়া বিশ্ববিদ্যালয়েই তিনি পেশা জীবনের বেশিরভাগ সময় কাটান। এখনো তিনি সমান উদ্যমী ও সক্রিয়, ভার্জিনিয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের ইংরেজি ও ভাষাতত্ত্বের অধ্যাপক। ডেল হাইমসের সকল কাজ ও গবেষণার মূলে কাজ করে ভাষা বিষয়ে সম্পূর্র্ণ স্বতন্ত্র একটা দর্শন ও বিশ্বাস। ভাষা বিষয়ে সোসুরের তত্ত্ব একমাত্র বৈজ্ঞানিক তত্ত্ব নয় বরং তার বাইরেও ভাষা-জিজ্ঞাসার সুযোগ থাকতে পারে এবং তা বৈজ্ঞানিক অর্থে গুরুত্বপূর্র্ণ হতে পারে। ডেল হাইমস মনে কেরন ‘ভাষা’র নির্বস্তুক রূপ নয়, বরং সামাজিক যোগাযোগে প্রতিফলিত ও ব্যবহৃত রূপকে গবেষণার বিষয় করতে হবে। এ পরিপ্রেক্ষিতে কাজ করতে গিয়ে এমন একটা ‘নৃতাত্ত্বিক ভাষাতত্ত্ব’ প্রস্তাব করেছেন যা নৃতত্ত্ব, ভাষাতত্ত্ব, কাব্যতত্ত্ব, সেমিওটিক্স ও সাহিত্যতত্ত্বে সমান গুরুত্বপূর্র্ণ। এমনকি ফোকলোর শাস্ত্রেও ডেল হাইমসের অবদান গুরুত্বপূর্ণ তাত্ত্বিক পরিপ্রেক্ষিত তৈরি করেছে। ‘নৃতাত্ত্বিক ভাষাতত্ত্বে’র প্রধান ধারণা হলো, মানবসমাজ যোগাযোগের প্রক্রিয়ায় নির্মিত যার প্রধান মাধ্যম হলো ভাষা ও ভাষার ব্যবহার। ফ্রানৎস বোয়াস নেটিভ আমেরিকানদের ভাষার ব্যাকরণ লিখেছেন, ডেল হাইমস আবিষ্কার করেন ভাষা-ব্যবহারের শৃঙ্খলা। হাইমসের কথা হলো, কেবল ভাষার যে ব্যাকরণ আছে তাই নয় (সোসুরের মতে, ‘ভাষা হলো একটা বিমূর্ত ব্যবস্থা’) ‘কথা’রও ব্যাকরণ আছে, শৃঙ্খলা আছে; কাজেই কথা বলার শৃঙ্খলাসূত্র উদঘাটন নৃতাত্ত্বিক ভাষা বিজ্ঞানীর কাজ। এ কাজ যে বৈজ্ঞানিকভাবে করা যায় ডেল হাইমসের কাজ তার দৃষ্টান্ত। এখানে উল্লেখ্য, সোসুরের কথা ছিল ভাষার ব্যবহৃত রূপের গবেষণা ভাষাবিজ্ঞানীর কাজ নয়, কারণ ভাষাবিজ্ঞানীর বিষয় ‘লগঁ’, ‘প্যারোল’ নয়। ডেল হাইমস প্রমাণ করেন, তা করা সম্ভব এবং করা উচিত।
এখানে কতগুলো কথা আমাদের বুঝতে হবে। ‘কবিতা’র একটা মার্গীয় ঘরানা আছে, ‘কবিতা’ বলে আমরা তাই বুঝি। এর পেছনে একটা ‘আধুনিক ধারণা’ কাজ করে, যে আধুনিক ধারণা তৈরি হয়েছে সাহিত্যিক প্রাতিষ্ঠানিকতা থেকে। শুধু তৃতীয় বিশ্বে নয়, সর্বত্রই সংস্কৃতির মৌখিক ও লৈখিক ভাগ আছে। আমরা যাকে কবিতার আধুনিক ধারণা হিসেবে দেখি, তা আমাদের সংস্কৃতি থেকে উদ্ভূত হয়নি, তার পেছনে আছে ঔপনিবেশিক জ্ঞানবৃত্তিক উদ্যম। আধুনিক কবিরা বাংলায় যা কিছু লিখেছেন এবং ‘আধুনিক’ বলে স্বীকার করেছেন, তার পেছনে পশ্চিমের আধুনিকতার নান্দনিক ও মতাদর্শিক প্রস্তাবনা নিগূঢ়ভাবে কার্যকর। বুদ্ধদেব বসু যখন আধুনিক কবিতার স্কুল খোলেন- তিনি একইসঙ্গে দুটো কাজ করেন : তাঁর সময়ে রচিত উল্লেখযোগ্য আধুনিক কবিদের লেখা প্রকাশ করা এবং সেই লেখাগুলোকে পশ্চিমী আধুনিকতার মানদণ্ডে বিচার করা। পাশাপাশি বিশ্ব কবিতায় যা ঘটছে, তা প্রভাবশালী গদ্যে প্রকাশ করা। বুদ্ধদেব বসু ও তাঁর সমসাময়িক কবিরা দেশজ উপকরণ ও বহমান মৌখিক সংস্কৃতি থেকে কোনো কিছু গ্রহণ করার প্রশ্নকে অবাঞ্ছিত মনে করেছেন। শার্ল বোদলেয়ারের উনিশ-শতকীয় ফরাসি দেশের সঙ্গে তিরিশ দশকের ঔপনিবেশিক নগরী কলকাতার মিল না থাকলেও, বোদলেয়ারকে বুদ্ধদেব বসু সমকালীন কবি হিসেবে উপস্থাপন করেন। আমি বলতে চাচ্ছি, বুদ্ধদেব বসুর শার্ল বোদলেয়ার নিয়ে যে মত্ততা ও মগ্নতা এবং তাঁর অনুবাদের সূত্রে বাঙালি কবিদের মধ্যে বোদলেয়ারের যে জনপ্রিয়তা তৈরি হয়, তাতে শার্ল বোদলেয়ারকে মনে হয় বাঙালি কবিদের সমকালীন। বুদ্ধদেব বসু বিদেশি সাহিত্যের অনুবাদ ও ভাষা রচনা করে এমন এক আধুনিকতার উত্থান ঘটান যা অরাজনৈতিক হয়েও এক ধরনের নন্দনতাত্ত্বিক আদর্শবাদের নেতৃত্ব দেয়। এরপর আধুনিক কবিতা বলে যা রচিত হয় তার বৌদ্ধিক প্রেরণা মূলত বুদ্ধদেব বসুর লেখা থেকে এসেছে। আধুনিক কবিতায় এই প্রভাব স্থায়ী হওয়ার পর আমরা যা লিখেছি তা চরিত্রগতভাবে আমাদের দেশ, কাল, সময় ও সংস্কৃতির সঙ্গে সম্পূর্ণ নিঃসম্পর্কিত। মৌখিক সংস্কৃতির দিকে ফিরে তাকানো বা প্রেরণা সংগ্রহ দূরে থাকুক, সে সম্পর্কে গগনচুম্বী অজ্ঞতাকে আধুনিকতার সাধারণ লক্ষণ মনে করা হয়। মৌখিক সংস্কৃতি হয়ে দাঁড়াল অসৃষ্টিশীল অধ্যাপকদের যথেচ্ছ বিচরণভূমি। একটা সমাজে ‘মতাদর্শের’ প্রভাব কত বড় হতে পারে বুদ্ধদেব বসু বাহিত সাহিত্যিক আধুনিকতাবাদের সর্বত্রব্যাপ্ত প্রভাবের অনন্তকালীন জয়যাত্রা তার প্রমাণ দেয়।
বাংলা কবিতার এই উচ্চমার্গীয় আধুনিকতাবাদ কেউ কেউ বর্জন করেছেন এবং তাদের মধ্যে কেউ কেউ যথেষ্ট প্রতিষ্ঠাও পেয়েছেন। মাঝে মাঝে বিকল্প কবিতা লেখারও চেষ্টা হয়েছে। কিন্তু আধুনিকতাবাদী প্রায়-সর্বজয়ী মতাদর্শের চাপে তাদের কণ্ঠস্বর ক্ষীণ থেকে ক্ষীণতর হয়ে গেছে। অন্যদিকে যাঁরা পশ্চিমী প্রভাবের সমস্যা ভালোভাবে অনুধাবন করেছেন তাঁরা কবিতায় এমন কণ্ঠস্বর অর্জন করতে পারেননি যা সমাজে সামগ্রিকভাবে একটা বিকল্প স্রোতের সংস্কৃতি তৈরি করতে পারত। এসব বিষয় এত স্পর্শকাতর ও নানা কারণে এত জটিল যে এর রূপরেখা দাঁড় করানো সংক্ষিপ্ত পরিসরে সম্ভব নয়।
ডেল হাইমস ঊঃযহড়ঢ়ড়বঃরপং বলতে দেশজ ধারার কাব্যতত্ত্ব বোঝাতে চান এবং রোমান ইয়াকবসনের মতো এই ‘কাব্যতত্ত্ব’-কে তিনি কেবল কবিতার মধ্যে সীমাবদ্ধ মনে করেননি। মানুষের কথা ও মানবীয় উচ্চারণের সকল পরিসরে লুকিয়ে থাকা ‘কবিতা’র অনুসন্ধান ও বিশ্লেষণ তাঁর লক্ষ্য। ঊঃযহড়ঢ়ড়বঃরপং তাই চড়বঃরপং হলেও, এর কারবার বৃহদর্থে সকল সৃষ্টিশীল ও অভিব্যক্তিময় ও শিল্পপূর্ণ মানবিক উচ্চারণ নিয়ে। সে কারণে যাকে আমরা প্রাতিষ্ঠানিকভাবে ‘সাহিত্য’ বলে জানি তা এর বিষয় নয়; বরং এর কেন্দ্র হলো ‘উচ্চারিত ভাষা’। সেই ‘সাহিত্য’ যা লেখা হয় না, কিন্তু যা উচ্চারিত, মৌখিক ও বাক্সময়। মানুষী উচ্চারণের বৈভব, সীমা ও প্যাটার্নের ওপর নির্ভর করে বেড়ে ওঠে দৈশিক কাব্যতত্ত্বের ধারণা।
উত্তর আমেরিকার বুকে জন্ম নেয়া ‘আদি সাহিত্য’ নিয়ে কাজ করেছেন ডেল হাইমস। এ সাহিত্য ‘রচিত’ নয়, ‘উচ্চারিত’; ‘লিখিত’ নয়, ‘মৌখিক’; এ হলো ঐতিহ্যের পরম্পরায় প্রবাহিত আদি আমেরিকানদের শব্দশিল্পের কথামালা। এ হলো মিথ, পুরাণ, কাহিনীর সুতো দিয়ে গাঁথা কাব্যমালা। যে বিখ্যাত বইটি তিনি লিখেছেন এ বিষয়ে, তা মূলত উত্তর প্রশান্ত মহাসাগরের উপকূলবর্তী আদি আমেরিকানদের গল্পকাব্য নিয়ে। ডেল হাইমস জানতেন, তিনি এমন কিছু করছেন যা ‘ভাষাতত্ত্বে’-র সনাতন ধারণায় গ্রহণযোগ্য্য হবে না, আবার অন্যদিকে সাহিত্যের লোকেরা তাকে অভ্যর্থনা জানানোর কোনো কারণ নেই। ‘ভাষাতত্ত্বে’র লোকেরা বলবে এতে ‘ভাষাতত্ত্ব’ আছে বটে, কিন্তু তা একরকম বিপদগামী- কারণ এ অনেকটা ‘ফলিত ভাষাতত্ত্ব’ যা ঠিক তাত্ত্বিক তাষাতত্ত্বের আওতায় পড়ে না। সাহিত্যের লোকেরা বলবে এ আবার সাহিত্য হয় কি করে, এসব ব্যাপার বড়জোর ‘ফোকলোর’। ফোকলোরের লোকেরা বলবে, ঠিক ফোকলোরও নয়- কারণ এর মধ্যে ভাষাতাত্ত্বিক খুঁটিনাটি খুব বেশি। নৃ-তত্ত্বের লোকেরা বলবে এ ধরনের কাজ নৃ-তত্ত্বের মধ্যে পড়ে না, এ হতে পারে সাহিত্যের ব্যাপার।
এসব তর্কগুলো অনুসরণ করলে আমরা বুঝতে পারব, ডেল হাইমস ঊঃযহড়ঢ়ড়বঃরপং-এর নামে যে-কাজ করেছেন তা আসলে সম্পূর্ণ নতুন একটা শাস্ত্রের উদ্বোধন ঘটিয়েছে। আধুনিক ভাষাতত্ত্বের ইতিহাস যদি আমরা পড়ি দেখবো, ‘ভাষা বিজ্ঞানী’-রা তাঁদের তাত্ত্বিক প্রস্তাবনায় ভাষার সামাজিক ও ব্যবহারগত দিককে একেবারে অপ্রাসঙ্গিক মনে করেছেন। বিংশ শতাব্দীর পঞ্চাশ দশকের পর ভাষাতত্ত্বে অবশ্যই পরিবর্তন আসে, নোয়াম চমস্কি এক্ষেত্রে উল্লেখযোগ্য। চমস্কিকে বলা হয় বাক্যের বিজ্ঞান আবিষ্কারক। কিন্তু এ ক্ষেত্রে চমস্কির তাত্ত্বিক উদ্ভাবনা অসাধারণ হলেও তিনি নিশ্চয়ই সামাজিক যোগাযোগের পটভূমিকায় উচ্চারিত মানুষের কথাকে তাঁর ভাষাতত্ত্বের বিষয় মনে করেননি। চমস্কির দুটো গুরুত্বপূর্র্ণ ধারণা হলো ‘কমপিটেন্স’ ও ‘পারফরমেন্স’- তাঁর এ দুটো কনসেপ্ট যতই বিপ্লবাত্মক হোক, এর মূলে সোসুরের ‘লগঁ’ ও ‘প্যারোল’ নামক বহু উচ্চারিত ধারণাদ্বয় কার্যকর। ‘কমপিটেন্স’ বলে চমস্কি বোঝাতে চেয়েছেন জটিল মনস্তাত্ত্বিক প্রক্রিয়ায় লব্ধ ভাষার কাঠামো সম্পর্কিত মানুষের জ্ঞান- এক কথায় তিনি ইঙ্গিত করছেন ‘লগঁ’ নামক সোসুরীয় ভাষা-কাঠামো, যা মানুষ শেখে। ভাষার নিয়মগুলো শেখা, যেমন একজন শিশু শেখে, এই হল ‘কমপিটেন্স’। ভাষার নিয়মগুলো শেখা মানে ‘লগঁ’ নামক ভাষার মৌলিক ও অপরিবর্তিত কাঠামো সম্পর্কে জ্ঞানলাভ। আর ‘পারফরম্যান্স’ হলো অর্জিত ভাষিক-কাঠামোর ব্যবহার। সোজা কথায় ভাষার মূল কাঠামো বা ‘লগঁ’ হলো সসীম, কিন্তু এই মৌলিক কাঠামোর ওপর ভিত্তি করে আমরা অসংখ্য ও অনন্ত বাক্য রচনা ও উচ্চারণ করে যেতে পারি আমাদের পারফরম্যান্সে। কাজেই মৌলিক কাঠামোর ওপর গড়ে ওঠা অসংখ্য ও অনন্ত বাক্য ভাষাবিজ্ঞানের বিষয় হতে পারে না, ভাষাবিজ্ঞানের বিষয় হবে ভাষার মূল কাঠামো। অর্থাৎ লগঁ, যা সসীম ও বিজ্ঞানসম্মতভাবে ব্যাখ্যাযোগ্য। মানবভাষার বাক্যরাশি অকল্পনীয়ভাবে বিপুল, তা গণনা ও পরিমাপ করা অসম্ভব; কিন্তু ওই অসংখ্য বাক্যরাশি যে ভাষিক কাঠামোর ওপর সৃষ্ট, তা সসীম ও নির্দেশযোগ্য।
ডেল হাইমস ভাষা জিজ্ঞাসায় একেবারে ভিন্ন পথ ধরে হাঁটতে চেয়েছেন। চমস্কি পড়ে আমরা বুঝি যে, তিনি বড় জোর ‘বাক্য’ পর্যন্ত হাত বাড়াতে রাজি, কিন্তু তাই বলে মানুষের উচ্চারণ ও কথাকে ‘ভাষাবিজ্ঞানে’র বিষয় হিসেবে দুঃস্বপ্নেও তিনি ভাবতে পারেন না। ডেল হাইমস ও নোয়াম চমস্কি বিষয়ে অনেক গল্প চালু আছে। চমস্কি হাইমসের লেখা অবশ্যই পড়েছেন, কারণ হাইমসের অন্যান্য- একান্তই ভাষাতত্ত্ব বা নৃতাত্ত্বিক বা সমাজতাত্ত্বিক ভাষাতত্ত্ব সম্পর্কিত- বইপত্রে চমস্কির উল্লেখ অনবরত এসেছে। কিন্তু চমস্কি কোথাও কখনো হাইমসের বক্তব্য নিয়ে কোনো কথা বলেন নি, কোনো মন্তব্য কখনো না। এটা অতীব আশ্চর্যজনক, কিন্তু আবার আশ্চর্যজনক নয়ও। ডেল হাইমসের লেখায় ভাষা বিষয়ক চিন্তার সপ্রতিভ দ্যুতি তাঁর অবশ্যই চোখে পড়েছে, কিন্তু তিনি একে শেষাবধি ভাষা বিজ্ঞান মনে করতে পারেননি। ডেল হাইমসের কথা ছিল এই যে, ‘ভাষাতত্ত্ব’ যদি কেবলি ‘ভাষার ব্যাকরণ’ না হয়ে বৃহদর্থে ভাষার অধ্যয়ন হয়, তাহলে আদি আমেরিকানদের মৌখিক উচ্চারণ ও শব্দ শিল্পের পাঠ ভাষাজিজ্ঞাসায় অনেক কিছু যোগ করার ক্ষমতা রাখে।
ডেল হাইমসের কাজের এলাকা শিনোকান কবিতা ও কথকতা। আরো সাধারণ করে বললে, ব্রিটিশ কলাম্বিয়ার আদি আমেরিকানদের গান, আখ্যান ও বচন নিয়ে তিনি লিখেছেন। যাদের টেকস্ট ব্যাখ্যা করে হাইমস তাঁর ‘দেশীয় কাব্যতত্ত্বে’র ধারণা নির্মাণ করেছেন, তাদের বলা হয়। কলাম্বিয়া নদীর তীরবর্তী অঞ্চলে এই আদি আমেরিকানদের বসবাস, যা এখন ‘ওরেগন’ ও ‘ওয়াশিংটনে’র অন্তর্ভুক্ত। দু’শ বছর আগে, সাদা ইউরোপীয়দের আগমনের পূর্বে, এ ছিল সবুজ বিস্তীর্ণ পাহাড়ি অঞ্চল। হরিণ, ভালুক, নানারকম প্রাণীর অপূর্ব সমাবেশে চঞ্চল। আর ছিল ‘স্যালমন’, আমেরিকার সবচেয়ে প্রিয় মাছ, যা দিয়ে সূচনা হতো আদি আমেরিকানদের বসন্ত। শীত আসার ও বরফ পড়ার আগে আগে যত বেশি সম্ভব স্যালমন ধরে ধরে জমিয়ে ফেলত শিনোকানরা, এবং তা দিয়ে স্বচ্ছন্দে পার করে দিত ঠাণ্ডা শীতের সব ক’টি মাস। আর সব আদি আমেরিকানদের তুলনায় শিনোকানরা ছিল স্বতন্ত্র, এবং তা মূলত তাদের ব্যবসা ও কারবারের জন্যে। এই শিনোকানদের ভাষা ও সংস্কৃতি নিয়ে কাজ করেন ফ্রানৎস বোয়াস ও তাঁর ছাত্র এডওয়ার্ড শাপির, এবং সংগ্রহ করে ছাপেন তাদের মিথ ও আখ্যানমালা ও ফোকলোর। কলাম্বিয়া নদীর দুই ধারে ছিল শিনোকানদের বসবাস এবং ডেল হাইমসের মতে, শিনোকান বলতে কেবল একটি নয়, প্রায় দুটি কি তিনটি বিশিষ্ট ভাষা বোঝায়। বৈশিষ্ট্যে ভিন্ন হলে এ ভাষার তিন ধরনের রূপই শিনোকানদের সমান বোধগম্য ছিল। শিনোকানদের খ্যাতি ছিল স্যামলন মাছের প্রাচুর্যের জন্যে এবং এই মৎস্য সম্পদের কারণেই তাদের স্থান ছিল অন্য আদি আমেরিকানদের ওপরে। নদী তীরে বাস করার সুবাদে শিনোকানরা প্রাচুর্যপূর্ণ ছিল। হাইমস আমাদের মনে করিয়ে দেন, ‘ইন্ডিয়ান’ ছিল বলে শিনোকানদের এমন মনে করার কোনো কারণ নেই যে ওরা ছিল ‘ন্যাংটো বুনো মানুষ- তা নয়। ভালো আবহাওয়ায় আপেক্ষিকভাবে শিনোকানরা ন্যাংটো কিছুবা ছিল বটে, কিন্তু তারা আরণ্যক বুনো মানুষ নয়। তাদের সভ্যতা ছিল, সাহিত্য ছিল, কবিতা ও কথকতা ছিল- শিনোকানরা ভ্রমণ খুব পছন্দ করত এবং তাদের ব্যবসা-বাণিজ্য ছিল। ছোট ছোট গ্রামে বাস করতো শিনোকানরা, প্রয়োজনীয় ফলমূল সংগ্রহের তাগিদ ছাড়া গ্রামের বাইরে ওরা খুব যেত না। নিজেদের বাড়ি আর গ্রামের বাইরে আরণ্যক জঙ্গলে বিপদ ঘটার ভয় তাদের কিছু কম ছিল, এমন মনে করার কারণ নেই।
শীতের সময় শিনোকানরা বার হত না, ছোট্ট ছোট্ট বাড়ির ভেতরেই কাটিয়ে দিত পুরো শীতকাল। সারা বছর ধরে জমানো খাবার দিয়ে স্ন্দুর চলে যেত তাদের কঠিন শীতের সময়। এই শীতেই শিনোকানদের ঘরে ঘরে জমে উঠতো মিথের আসর, মিথের গল্প আর কাহিনীর ভেতর ডুবে থাকতো ওরা। শীতকাল শিনোকানদের গল্প বলা আর গল্প শোনার সময়। বসন্ত আর গ্রীষ্ম যদি শিনোকানদের গদ্য (জীবন) হয়, শীত ছিল ওদের কবিতা। শিনোকানদের মিথ ‘কোনো এক সুদূর উত্তম সময়ে’র কথা বলে না, বরং তাদের মিথগুচ্ছে তারা কল্পনা করেছে এমন এক প্রাথমিক সময় যখন সবকিছু জড়াজড়ি মাখামাখি করে ছিল, যখন সবকিছু ভালো করে পরখ করা যায়নি, যখন সবকিছু ঠিক মতো প্রস্তুত হয়ে ওঠেনি। শিনোকানদের মিথের বিষয় কোনো ‘পতন’ নয়, কোনো এক অপেক্ষমাণ ‘উত্তরণ’ও নয়, বরং যেন এক

প্রস্তুতির মুহূর্ত এমন এক পৃথিবীর জন্যে যেখানে তারা এখন বাস করছে। শিনোকানদের জীবনে অভাব কিংবা ক্ষুধা ছিল না তা নয়, কিন্তু নিজেদের জীবনকে তারা দরিদ্র মনে করেছে এমন প্রমাণ তাদের গল্প-গাঁথায় নেই। বয়োজ্যেষ্ঠরা বলতো মিথের গল্প, শুনতো শিশু শিনোকানরা- মিথ ছিল যুগপৎ শিক্ষা ও আনন্দ। নৃ-তত্ত্বে যারা ক্রিয়াবাদী (ফাংশনালিস্ট) তারা প্রায়ই ‘মিথ’কে সংকুচিত করে ফেলেন; তাঁরা বলেন, ‘মিথ’-এর গুরুত্ব এর সামাজিক সম্পর্ক ও সংহতি রক্ষার ভূমিকায়। হাইমস তা অস্বীকার করেননি, তিনি শুধু যোগ করেছেন এই যে, ‘মিথে’র আর যত ভূমিকাই থাক না কেন, এই গল্পগুলো যে বার বার বলা হয়েছে তার কারণ একটাই- গল্প হিসেবে এগুলো অনবদ্য এবং কাহিনীর চারুতা ও অর্থময়তা ও অভিযাতের জন্যেই ওগুলো শিনোকানদের ঘরে ঘরে প্রজন্মের পর প্রজন্ম ধরে উচ্চারিত হয়েছে।
শীতের বরফ পড়ার আগে খাবার সংগ্রহ করে রাখা ছিল শিনোকানদের একটা বাস্তব দিক। কিন্তু তাই বলে তাদের আখ্যান, কথকতা ও কবিতায় একটা ‘দরিদ্র জীবনের ছবি’ ঘুরে ঘুরে এসেছে এমন মনে করার কোনো কারণ নেই। যে জীবন তারা যাপন করেছে সেই জীবনেই ছিল তারা তৃপ্ত, নিজেদের যাপন করা জীবনই ছিল তাদের অভিপ্রেত, সেই জীবনকে তারা ভালোবেসেছে। শিকার, সংগ্রহ আর মাছ ধরা- এই ছিল শিনোকানদের কর্মপৃথিবী, তারই পাশাপাশি কথা ও কল্পনার মানবিক বৈভব নিয়ে গড়ে উঠেছে তাদের অফুরাণ সৃষ্টিজগত।
শিনোকান তথা আমেরিইন্ডিয়ান কবিতার আলোচনা ডেল হাইমসের হাতে এক অসাধারণ জটিল, অনুপুঙ্খ, তীক্ষè প্রকল্পের রূপ নেয়। লক্ষ করতে হবে আমাদের যে, ডেল হাইমস যাকে ‘কবিতা’ বলছেন, পৃথিবীর যে কোনো দেশের শিক্ষিত সংস্কৃত মধ্যবিত্তের অভ্যস্ত চোখে তা একটু-বা অন্যরকম ঠেকতে পারে। তার কারণ, ‘কবিতা’ বলতে আমরা বিশেষ ধরনের গড়নসম্পন্ন মুদ্রিত টেক্স্ট বুঝি। শিনোকানদের সাহিত্যও নৃতাত্ত্বিকদের হস্তক্ষেপে মুদ্রিত সংকলনের রূপ নিয়েছে বটে, কিন্তু তার চরিত্র মূলত মৌখিক। সংস্কৃতির এমন উপকরণ যার অবলম্বন ‘মুদ্রণ’ নয়, যার স্বভাব ‘লৈখিক’ নয়, তাকে মুদ্রিত বিন্যাসে অবলোকন করার মধ্যে সমস্যা তো আছেই, কিন্তু সে সমস্যাকে এড়ানোর উপায় নেই। বরং মৌখিকতা থেকে লৈখিকতায় রূপ নেয়ার প্রক্রিয়াটা যেহেতু বিশেষজ্ঞদের হস্তক্ষেপ-নির্ভর, সে জন্যে এর মধ্যে একটা বুদ্ধিবৃত্তিক রাজনীতির প্রণোদনা অস্বীকার করার উপায় নেই। অর্থাৎ এমন বলার উপায় নেই যে, ‘বিশেষজ্ঞ’ যা উপস্থাপন করেছেন এবং ছাপার জন্যে পাণ্ডুলিপি প্রস্তুত করার ক্ষেত্রে যেসব স্তর, ভাবনা-পর্যালোচনা, বিন্যাস ও অনুবাদের খুঁটিনাটির মধ্যে দিয়ে গেছেন তার সর্বতোগ্রাহ্য বিশুদ্ধ নিরপেক্ষ কোনো পরিকল্প আছে। এ জটিলতার জন্যে নৃতত্ত্ব, ফোকলোর ও অন্যান্য শাস্ত্রে বিভিন্ন প্রাণবন্ত বিতর্কের জন্ম হয়েছে, তৈরি হয়েছে নানা তাত্ত্বিকতা। তবে যেসব উপাদান নিয়ে ডেল হাইমস কাজ করেছেন, তা মোটের ওপর আস্থা রাখার মতো। এটুকু বলা যায় যে, সংগ্রহকারীদের একটা নীতিমালা ছিল এবং ফ্রানৎস বোয়াস এ বিষয়ে যথেষ্ট সতর্ক ছিলেন। বাংলা রূপকথা সংগ্রহ ও সম্পাদনায় দক্ষিণারঞ্জন মিত্র মজুমদার যে সাহিত্যিক জাতীয়তাবাদী মতাদর্শের প্রণোদনায় বিভিন্নরকম পরিবর্তন ও পুনর্র্লেখনের দিকে ঝুঁকেছেন, ফ্রানৎস বোয়াস ও তাঁর ছাত্রেরা আমেরিইন্ডিয়ানদের আখ্যান সংকলন ও অনুবাদে সে পথে যাননি।
আগেই বলেছি, শিনোকানদের টেকস্ট ডেল হাইমসের অসাধারণ অন্তর্দৃষ্টি ও এক ধরনের বৈজ্ঞানিক উদঘাটনমূলক নান্দনিকতার দাক্ষিণ্যে সর্বপ্রথম ‘কবিতা’র মর্যাদার স্বীকৃতি লাভ করে। বহুকাল ধরে যেসব আখ্যানকে ‘গদ্য’ বা নেহাত কাহিনী মনে করে আসছিলেন বিশেষজ্ঞরা, হাইমস সেই সনাতন ধারণা পাল্টে দেন। তিনি শিনোকানদের টেক্স্টের ছত্র ছত্র ধরে প্রমাণ করেন তা কবিতা, গদ্য নয়; সাধারণ উচ্চারণ নয়। এ উদঘাটন বিপ্লবাত্মক, এর পেছনে কার্যকর তাঁর তীক্ষè নৃতাত্ত্বিক-ভাষাতাত্ত্বিক বিশ্লেষণশক্তি। ডেল হাইমস দেখান, শিনোকানদের কবিতায় ভাষাগত, প্যাটার্র্নগত, প্রতিমাগত, প্রকাশগত, অভিব্যক্তিগত কাব্যিক সকল বৈশিষ্ট্য বিদ্যমান। ডেল হাইমসের লক্ষ্য ছিল আমেরিইন্ডিয়ানদের ভাষা, কবিতা, অভিব্যক্তির বিরাট অজ্ঞাত অন্তর্লোক উন্মোচন করে মানব সংস্কৃতি ও শিল্প সম্পর্কে আমাদের ভাবনার পরিধি বিভিন্নভাবে বাড়িয়ে নিয়ে যাওয়া, এবং সেই প্রক্রিয়ায় আমাদের আবহমান সমস্ত চিন্তার সংস্কার ও বোধের অভ্যস্থতায় বিপ্লব তৈরি করা।
ডেল হাইমস লিখেছেন, ফ্রানৎস বোয়াস শিনোকানদের সাংস্কৃতিক টেকস্টগুলো সংগ্রহ, লিপিবদ্ধ করেন এবং প্রকাশ করেন, তাঁর লক্ষ্য ছিল ভিন্ন। বোয়াসের মূল উদ্দেশ্য ছিল ‘লুপ্ত হওয়ার পূর্বে আমেরিইন্ডিয়ানদের ভাষার নমুনা ধরে রাখা, তার ব্যাকরণ বর্ণনা করা, ধ্বনিরূপ বিশ্লেষণ করা এবং সর্বোপরি তাদের আখ্যানগুলোকে তাদের সংস্কৃতি অনুধাবনের বিশ্বস্ত দলিল হিশেবে রক্ষা করা। ‘সংস্কৃতি’ বোয়াসের দৃষ্টিতে ভাষা ও আখ্যানের মধ্য দিয়েই নির্ভরযোগ্যভাবে বোঝা সম্ভব।
কিন্তু যেহেতু ‘কবিতা’ বোয়াসের স্বক্ষেত্র ছিল না, সেজন্যে সম্ভবপর সতর্কতা ও যতেœর সঙ্গে সংগ্রহ ও লিপিবদ্ধ করার পরও শিনোকানদের টেকস্টের এই গুরুতর দিকটাতে তিনি দৃষ্টিপাত করেননি। তাঁর ছাত্র এবং পরবর্তীকালের পাঠকদেরও দৃষ্টি এদিকে পড়েনি। না পড়ার নানা কারণ ছিল। ‘কবিতা’ বলা যাবে কিনা এ ছিল একটা ‘সংশয়’, অন্যদিকে ‘কবিতা’ সম্পর্কে চালু প্রাতিষ্ঠানিক ধারণা এ পথের অন্তরায় ছিল। এমন নয় যে, ডেল হাইমস শুধুমাত্র বোয়াসের টেকস্ট নিয়েই কাজ করেছেন; হাইমস নিজে শিনোকানদের সঙ্গে দীর্ঘকাল ধরে লিপ্ত থেকে তাদের ভাষা, সংস্কৃতি ও জীবনযাপন ঘনিষ্ঠভাবে অবলোকন করেছেন। হাইমস তাদের অনেক আখ্যান রেকর্ড করেছেন এবং বিশ্লেষণ করেছেন। কিন্তু বোয়াসের সংগ্রহের দীর্ঘকাল পরেই শিনোকানদের সঙ্গে কাজ করেন হাইমস, ততদিনে অভিজ্ঞ বয়োবৃদ্ধেরা বিগত, কেউ কেউ জীবিত থাকলেও নিজেদের ভাষায় মিথ বর্ণনার উৎসাহ স্বভাবতই ছিল না। তবু হাইমস কিছু কিছু আখ্যান সংগ্রহ করেছেন, আমেরি ইন্ডিয়ানদের ভাষাগুলোর অভিধান রচনার জন্যে অনেক পরিশ্রম করেছেন। কিন্তু হাইমসের মূল অবদান হলো- শিনোকানদের উচ্চারণকে তার স্বরূপে উদঘাটন করা এবং তার ভিত্তিতে কবিতার একটা স্বতন্ত্র জগত আবিষ্কার করা। ডেল হাইমসের কাজ ও তত্ত্ব ও গবেষণা নৃতত্ত্ব, ভাষাতত্ত্ব, কাব্যতত্ত্ব ও সাহিত্যতত্ত্বে সম্পূর্ণ নতুন আয়তন যোগ করে। হাইমসের প্রভাবে যুক্তরাষ্টে ও বাইরে এসব শাস্ত্রে দু’যুগ ধরে উল্লেখযোগ্য কাজ হয়ে আসছে।
ডেল হাইমসের ঊঃযহড়ঢ়ড়বঃরপং থেকে আমাদের যা নেয়ার আছে, তা কেবল ফোকলোরে সীমাবদ্ধ থাকলে হবে না। সাহিত্য-সংস্কৃতি সম্পর্কে প্রচলিত বিশ্বাসগুলো ত্যাগ করা অপরিহার্য। প্রচলিত বিশ্বাসগুলোর কারণে আমাদের কবিতা ও সাহিত্যের বোধ নানাভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। আমাদের বোঝাবুঝির কোনো সমস্যা নেই। সমস্যা হচ্ছে বোঝাবুঝির সাংস্কৃতিক রাজনীতিতে। সমস্যা হচ্ছে সাহসের। অভয়ের। সমস্যা হচ্ছে যূথবদ্ধ সাহিত্যচর্চার নেশা। বিপরীত স্রোতে পথ করে নেয়ার নিশি- পাওয়া উন্মাদনা ছাড়া সাহিত্য হতে পারে না। সংস্কারমুক্ত হয়ে নিজের ভেতরের ডাক শুনবার প্রয়োজন আজ খুব বেশি।
সালাহউদ্দীন আইয়ুব

মন্তব্য করুন

খবরের বিষয়বস্তুর সঙ্গে মিল আছে এবং আপত্তিজনক নয়- এমন মন্তব্যই প্রদর্শিত হবে। মন্তব্যগুলো পাঠকের নিজস্ব মতামত, ভোরের কাগজ লাইভ এর দায়ভার নেবে না।

জনপ্রিয়